সন্ধ্যে নামার পরে পর্ব -১০+১১

#সন্ধ্যে_নামার_পরে
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-১০

ফাহাদ ঘরের এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তার মা এসে ঘরের দরজায় বেশ কয়েকবার আঘাত করে ফাহাদকে বের হয়ে আসতে বললেন। কিন্তু ফাহাদ কোনো সাড়া দিলো না। ফাহাদের মা রাশিদা বেগম জানতেন না ছেলের কুকর্মের কথা। পিয়াস, রাদিন আর মাহিমের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তিনি একটুও আফসোস করলেন না। তখন তিনি জানতেন না যে নিজের ছেলেও এর সাথে যুক্ত আছে। এই তিনজনের একেরপর এক মৃত্যু সংবাদে ফাহাদের নিজেকে গুটিয়ে নেয়া চোখে পড়ে রাশিদা বেগমের। যখন ওই তিনজনের ক্যারেকটার সম্পর্কে জানতে পারেন তখন ফাহাদের ব্যাপারেও জানার চেষ্টা করেন এবং জেনেও যান। ফাহাদ ওদের সাথে যুক্ত ছিল এই খোঁজ আগে না নেয়ার জন্য নিজের প্রতি নিজে রেগে আছেন রাশিদা।

সন্তানকে স্বাধীনতা দেয়া মানে এই না যে, সে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে। এই অপব্যবহারের খবরটা যদি তিনি আগে নিতেন তাহলে হয়তো ফাহাদ ওদের সাথে জড়াতে পারতো না। রাশিদা বেগম তার এলাকায় মহিলা আসনের ভাইস চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকায় নিজের ঘরে ভালো করে নজর ফেলা হয়নি। এই ভুলের মাশুল এখন তিনি নিজ হাতেই গুনবেন। প্রতিটা বাবা-মায়ের উচিৎ নিজেদের সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে এসব খোঁজ রাখা। নয়তো পিয়াস, রাদিন, মাহিম আর ফাহাদের মতো জঘন্য থেকে জঘন্যতম কাজও ওরা করে ফেলতে পারে।

রাশিদা বেগম একটা লোহার দন্ড হাতে নিয়ে ফাহাদের ঘরের দরজার সামনে বসে আছেন। নিজের ছেলের কুকর্মের বিচার উনি নিজ হাতেই করতে চান। অপেক্ষায় আছেন কখন ফাহাদ ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো, তবুও ফাহাদ বের হচ্ছে না। রাশিদা একই জায়গায় বসে আছেন। রাশিদার মেয়ে জিনিয়া বেশ কয়েকবার এসেছিল রাশিদাকে খাবার খাওয়ার কথা বলতে। বিকেলে যখন এসেছিল তখন রাশিদা জিনিয়ার গালে ঠাটিয়ে এক চড় মেরে বসলো। জিনিয়া ঘুরে গিয়ে দেয়ালের সাথে বারি খেলো। রাশিদা চেঁচিয়ে বলল জিনিয়াকে,

“আমার রাগ পড়ার আগ পর্যন্ত যদি আরেকবার আমার কাছে আছিস তো তোর হাল কি করবো সেইটা ধারনার বাইরে। চোখের সামনে আসবি না আমার। ভাইয়ের কুকীর্তি জানার পরেও আমাকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নাই। আগে কুপুত্রের বিচার নিজ হাতে শেষ করবো, তারপর তোকে। প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।”

জিনিয়াকে বাসার কাজের মেয়ে তুলে ধরে রাশিদার সামনে থেকে নিয়ে যায়। বাহিরের যা হচ্ছে ফাহাদ তা ঘরে বসে স্পষ্টই সব শুনছিলো। ফাহাদের বাবা জাফর এগিয়ে এসে নিজের স্ত্রীকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রাশিদার গরম চোখ দেখে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। রাশিদা বেগম চোখ গরম করে জাফরকে বলেছিল,

“ছেলের হয়ে একটা কথা বলতে আসবে তো তোমাকে থানায় দিয়ে আসবো। ছেলের বিষয়ে এতদিন তো একটা কথাও আমার কানে পৌঁছে দাওনি। এখন কেন বলতে এসেছো ? চলে যাও এখান থেকে।”

জাফর রাশিদার সামনে থেকে চলে গেলো। রাশিদা এখন যেন এক বাঘিনী। তার সামনে এখন টিকে থাকা মুশকিল। বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে আছে এই বাঘিনীর ভয়ে। কি ঘটবে ফাহাদ যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসবে ?

__________

সন্ধ্যার পর আলাল সাহেব বাসায় ফিরলেন। আফরা বরাবরের মতো এবারো কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথে গিয়ে দরজা খুলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু রায়হান আফরাকে বাঁধা দিলো। কারণ রায়হান চাচ্ছে বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে। আফরা চুপচাপ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা খুলে দিলে আলাল হাসি মুখে সামনে তাকাতেই দেখলেন রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল,

“সারপ্রা…ইজ আব্বু”।

আলাল সাহেব ভেতরে ঢুকে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। এই ফাঁকে আফরা আলালের হাত থেকে অফিস ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আফরা রোজই এই কাজটা করে। এটা করতে তার ভালো লাগে। বাবা-ছেলে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলে আফরা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে আলালকে দেয়। রায়হান ভ্রু কুচকে আফরার পানি দেয়া দেখলো। রায়হানের কাছে আফরাকে হাই প্রোফাইলের কাজের লোক মনে হচ্ছে। যে কিনা বাড়িতে কেউ আসলে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে এগিয়ে নিয়ে আসবে। যে কিনা সেবাযত্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ইত্যাদি। পানি খাওয়া শেষ করে বাবা-ছেলে গল্প গুজবে মেতে উঠে। রেসমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলেন বাবা-ছেলের চমৎকার মুহুর্ত। কত বছর পর একসাথে বসে এমন হাসির জোয়ার বইছে ছেলের সাথে। রেসমি সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো আফরা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রেসমি আফরাকে ডেকে বললেন,

“আফরা, এই সময় রান্নাঘরে যাচ্ছো কেন ?”

আফরা এক দৌড়ে রেসমির দিকে এগিয়ে এলো। এসে বলল,

“আম্মু তুমি বের হয়ে এলে কেন ? তোমার কি কিছু লাগবে ? বলো আমাকে, আমি করে দিচ্ছি।”

রেসমি বলল,

“আগে বলো এখন তোমার পড়তে বসার কথা, এখন রান্নাঘরে কেন যাচ্ছিলে ? তোমাকে না বলেছি, রান্নাঘরে সময় না দিয়ে পড়াশোনায় সময় দেবে। কিছু খেতে ইচ্ছে হলে সুইটিকে বলবে। তখন সুইটি ছিলো না বলে তোমাকে বলেছি তোমার বাবাকে খাবার দিতে। তা বলে এই না যে তুমি এখন রান্নাঘরেই আনাগোনা করবে।”

আফরা বলল,

“আম্মু, চিন্তা করো না। আমি একটু হালকা নাস্তা বানাতে চাচ্ছিলাম। আব্বু তার ছেলের সাথে আড্ডা দিতে বসে গেছেন ফ্রেস না হয়েই।”

রেসমি বলল,

“কথা ঘুরিয়ে ফেলতে চাচ্ছো। যাইহোক, ওদিকে যেন না দেখি তোমাকে। গিয়ে পড়তে বসো যাও। একটু পর ডাক দিলে দৌড়ে খেতে চলে আসবে।”

আফরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“ঠিক আছে যাচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলো কিন্তু।”

আফরা নিজের ঘরে চলে গেলো। আফরা রেসমির খেয়াল রাখে সবসময়। কেননা রেসমি অসুস্থ। হাটতে সমস্যা হয়। এক দূর্ঘটনায় রেসমির পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সব কিছু ঠিক হয়ে গেলেও দূর্ঘটনার স্মৃতিস্বরূপ এক পায়ে সমস্যা থেকে যায়। রেসমিকে এক পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। রেসমি, রায়হান এবং আলাল তিনজন একসাথে বসে বেশ আড্ডা দিচ্ছে। এক সময় রায়হান আফরার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। রেসমি আলালকে বলল যাতে সে আফরা সম্পর্কে বলে। আলাল বলা শুরু করলো,

“ওর নাম ফাইজা। আমার ছোট কালের বন্ধু ফিরোজের মেয়ে। ফিরোজ বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেনি পারিবারিক সমস্যার কারণে। আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই এগিয়েছি সব দিক দিয়ে।”

রায়হান বলল,

“তাহলে তোমার বন্ধুর মেয়েকে এখানে এনে রেখেছো কেন ?”

আলাল কিছুটা রাগ মিশ্রিত স্বরে বলল,

“কথার মাঝে কথা বলা কবে থেকে শিখলে ? আমি কি বলেছি আমার কথা শেষ হয়েছে ? আগে কথা শুনবে, তারপর মন্তব্য করবে।”

রায়হান মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বসে রইলো। আলাল আবার বলা শুরু করলেন,

“তোমার মা এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটাতো শুনেছিলে। তাতে যেই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম সেখানে ফাইজাকেও ভর্তি করানো হয়েছিল। ডাক্তার নার্সদের টুকিটাক কথায় আন্দাজ করেছিলাম যে কোনো এক ক্রিটিকাল পেসেন্ট এডমিড করা হয়েছে। এরজন্য পুলিশ কেইস করা জরুরি। আগ্রহস্বরূপ পেসেন্ট এর ফ্যামিলি মেম্বারকে দেখতে গিয়ে ফিরোজের সাথে আমার দেখা হয়। তারপর শুনলাম ফাইজার অবস্থার কথা। ব্যাপারটা শুনতে জঘন্য হলেও ফাইজার অবস্থা ছিল গুরুতর। খুব খারাপ লাগলো এই অবস্থা দেখে। ফিরোজের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম ফাইজার দায়িত্ব আমি নেবো। সেই অনুযায়ী ফাইজার পুরো চিকিৎসা খরচ আমিই দিয়েছি। পাশাপাশি তোমার মায়ের চিকিৎসাও সেখানে হয়েছে। তোমার মা যে একটা মেয়ে সন্তান চাইতো সেটাতো তুমি জানো। ফাইজার অবস্থা শুনে তার ইচ্ছা হয় যে ফাইজাকে সে নিজের কাছে রাখবে, যত্নে রাখবে। সেই অনুযায়ী ফিরোজকে বুঝিয়ে ফাইজাকে এখানে নিয়ে আসি। নিজের মেয়ে হলে যা যা করতাম সেগুলো ফাইজাকে দিচ্ছি। ফাইজা নাম শুনলে নাকি তোমার মায়ের কাছে ফাইজার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ে। তাই নাম পালটে আমরা আফরা ডাকি। আফরা যতটুকু সুস্থ হয়েছিল তাতে এইচএসসি এক্সামটা দিতে পেরেছিল। মাঝে অনেকদিন সময় পেয়েছে রেস্ট করার। ওর যাথে পুরনো ক্ষতের কথা মনে না জাগে তাই তাকে ব্যাস্ত রাখতে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। সাথে সাথে ক্যারাটে কোচে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। যাতে পরিস্থিতি সাপেক্ষে এখন সে নিজেকে নিজে সেফ করতে পারে। মনে রেখো, তুমি কখনো ওর সাথে এমন কোনো ব্যবহার করবে না যেটাতে সে কষ্ট পায়।”

রায়হান সমস্ত কথা শোনার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ালো। রায়হানকে সমস্ত কথা বললেও ফাইজার সাথে কি ঘটনা ঘটেছিল সেটা ক্লিয়ার করে বলেনি আলাল। রায়হান এই প্রশ্নটা করতে চেয়েও করলো না।

________

পুলিশ অফিসার ফাহাদদের বাড়ির পাকা উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। রাশিদা বেগম তাকে ভেতরে আসতে দিলেন না। পুলিশ চাইলো ফাহাদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু রাশিদা বেগমের গর্জনে মাঝ উঠানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি হবে ফাহাদের ? তাকে কি পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে ? নাকি রাশিদা বেগম তার শায়েস্তা করবেন ? নাকি সেই আগন্তুকের হাতেই বিনাশ ঘটবে ফাহাদের ?
#সন্ধ্যে_নামার_পরে 🔞
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-১১

রাত প্রায় দশটা বাজে। পুলিশ আরো অনেক আগেই চলে গিয়েছে। রাশিদা বেগমকে অনেকবার বলেছে তাদের সাথে কোঅপারেট করার জন্য। কিন্তু রাশিদা বেগম তার কথায় অনড়। পুলিশ বুঝতে পেরেছে যে এখানে এক ঘন্টা কেন এক মাস যাবত দাঁড়িয়ে থাকলেও ফাহাদের সাথে তাদের দেখা করতে দেয়া হবে না।

রাশিদাদের কাজের মেয়ে লিপি রাশিদা বেগমের কাছে ছুটে এসে বলল,

“খালা, জিনিয়া আফায় সেই যে বাসা থিকা বাইর অইছে এখনো আসে নাই।”

রাশিদা চোখ গরম করে লিপির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ভর সন্ধ্যায় কেন বের হয়েছে ? না বলেই বা কেন গিয়েছে ?”

লিপি কাচুমাচু হয়ে বলল,

“আমি অত কিছু জানিনা খালা। জানার মইধ্যে এইটাই জানি যে, আফনার মাইর খাওয়ার পর অনেক কান্দাকাটি করছে। পরে মোবাইলে কি জানি লেখালেখি করছে। হেরপর বাসা থিকা বাইর অইয়া গেলো। কওয়ার মইধ্যে এইটুক কইলো যে, আফায় নাকি হের বান্ধুবী সুমাইয়ার কাছে যাইবো। আমি আর কিছু জানিনা।”

রাশিদা জোরে ধমক দিলেন লিপিকে,

“গাধার বাচ্চা, তুই জানোসটা কি ? তোরে না বলছি তুই সবসময় জিনিয়ার খবর তৎক্ষনাৎ আমাকে দিবি হুম। তাহলে এত সময় পর বললি কেন ? এমন একটা পরিস্থিতি চলতেছে এখন যে কার কখন কি হয় ঠিক নাই, এর মধ্যে সে বের হয়ে গেলো আর তুই এখন আমাকে বলতেছিস। সুমাইয়ার বাসায় এক্ষুনি যাবি। আমি দশ মিনিটের মধ্যে জিনিয়াকে আমার সামনে দেখতে চাই।”

লিপি এক ছুটে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। সুমাইয়াদের বাসা জিনিয়াদের বাসা থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। লিপিকে সময় দেয়া হয়েছেও দশ মিনিট। মনে একরাশ ভয় নিয়ে লিপি ছুটলো সুমাইয়াদের বাসার দিকে। লিপি মনে মনে আল্লাহকে যত পারছে ডেকে চলছে। কেননা এই চাকরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ লিপির কাছে। এই বাড়ির কাজ থেকে যা টাকা পায় তা দিয়ে তার পাঁচ সদস্যের সংসার খরচ চালাতে হয়। যদি এই চাকরিটা হারায় তাহলে লিপি পরিবারের কারো মুখে আহার তুলে দিতে পারবে না। এক দৌঁড়ে সুমাইয়াদের বাসার সামনে গিয়ে থামলো। সুমাইয়াদের বাড়ি থেকে জানতে পারলো যে, জিনিয়া নাকি এ বাসায় আসেইনি। এ কথা শোনার পর লিপির যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এমন একটা খবর রাশিদা বেগমকে কিভাবে দেবে ? রাশিদা বেগম যেভাবে রেগে আছেন, এই মুহুর্তে এমন সংবাদ দিলে হয়তো লিপিকেই খু-ন করে ফেলবে।

লিপির মন বলছে আশেপাশে খুঁজেও জিনিয়াকে পাওয়া যাবেনা। তবুও মনকে শান্তনা দিতে জিনিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে বাসায় ফিরলো। বাসায় ঢুকে যেন লিপির হাত-পা বেশি কাঁপতে শুরু করলো রাশিদা বেগমের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভেবে। বাসার ভেতরে এসে প্রচুর জোরে দরজার আঘাত করার শব্দ লিপির কানে এসে ধাক্কা দিলো। লিপি ছুটে গেলো সেই শব্দের দিকে। লিপি মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো রাশিদা বেগম ফাহাদের দরজায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করছেন। মজবুত ডিজাইনের কাঠের দরজায় কুড়াল চালাতে রাশিদা একটু ক্লান্তই বটে। সারাদিন রাগের বসে কিছুই খাননি। অভুক্ত থাকার কারণে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক ব্যাপার। রাশিদা দরজায় কুড়াল দিয়ে কোপ দিচ্ছেন আর বলছেন,

“কু-ত্তা-র বাচ্চা দরজা খোল। নয়তো দরজার মতো তোরেও আজকে কো-পা-মু। তোর জন্য আজকে আমার মেয়ে অপহরণ হইছে। তোর উপর প্রতিশোধ নিতে আমার মেয়েটারে তুলে নিছে। জানো….রের বাচ্চা, তুই যদি আজ এই কুকাম না করে বেড়াইতে তাহলে আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয় এমন সাহস কার আছে আমি দেইখা নিতাম। সব অশান্তির মূল তুই, শো…রের বাচ্চা। জিনিয়ার জান বদলে তোরে চাইছে। বের হ তুই ঘর থেকে। খোপের মধ্যে বইসা থাকলে ভাবছোস তোরে কেউ নাগাল পাইবো না। তোর মতো নর্দমার কীট আমার ছেলে হইতে পারে না। তুই ঘর থাইকা বের হ। যদি আমি দরজা ভাইঙ্গা আসি তাইলে তোরে এইখানেই শেষ করে ফেলবো। নিজ ইচ্ছায় বের হ বলতাছি। জিনিয়ারে অক্ষত অবস্থায় ফিরাইয়া নিয়া আসবি। নয়তো তোরে আজকে কো-র-বা-ন করে ফেলবো।”

লিপি গুটিগুটি পায়ে পিছিয়ে বের হয়ে গেলো সেই ঘর থেকে। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস যা ছিল তা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। গত মাসের বেতনটা দুদিন আগেই দিয়ে দিছিলো। এসব পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন পরিবারে থাকবে না আর সে। এমন মানুষের মধ্যে থেকে কাজ করার চেয়ে না খেয়ে মারা যাওয়া ভালো। সম্মানটুকু তো লোকচক্ষুর আড়ালে ফাহাদ ছিনিয়ে নিয়েই গিয়েছে। গর্ভে জন্ম নেয়া ছোট প্রাণটা না হয় এই শকুন চোখের আড়ালেই থাকুক। পরিবার সহ না হয় দূরে কোথাও চলে যাবে। হাত-পায়ে যেহেতু শক্তি সামর্থ্য আছে সেহেতু যেকোনো জায়গায় খেটে খেতে পারবে। এখানে আর এক মুহুর্তও না। দেখা যাবে যে জিনিয়ার অপহরণের দায় শেষমেশ না তার ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়।

_________

ফাইজা সকলের সাথে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। রায়হান ফাইজার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে সেটা ফাইজা ঠিক বুঝতে পারছে। ফাইজা দেখছে কিন্তু তাকাচ্ছে না। ফাইজা চাচ্ছে না এখন চোখাচোখি হয়ে উভয়ের কেউই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ুক। খাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে গেলো। ফাইজার ফোনে একটা কল এলো। নেটওয়ার্ক সমস্যা হওয়ায় ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটার কথা ঠিক বুঝতে পারছিল না। সেইজন্য বাগানের দিকের জানালাটা খুলে দিলো। ফাইজার চোখে পড়লো রায়হান সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। ফাইজা সেদিকে আর বেশি নজর দিলো না। ছেলে মানুষ সিগারেট খাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজের ক্ষতি এরা নিজেরাই করে, এতে অন্যের কিই বা আসে যায়। ফাইজা কথা বলা শেষ করে জানালা লাগাতে গিয়ে রায়হানের দিকে চোখ পড়াতে দেখলো লোকটা আরো একটা সিগারেট জ্বালানোর জন্য গ্যাস ম্যাচে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। বাহিরের বাতাস আগুন জ্বালাতে বারবার বাঁধা দিচ্ছে। বাতাস যেন বাঁধা দিয়ে বলছে,

“এসব ছাইপাঁশ না খেলে কি হয় বাপু ? মুখে দুর্গন্ধ আর কলিজা পুড়ে ছাই করা ছাড়া এই সিগারেট আর কি দেয় ? কোনো দুশ্চিন্তার শান্তনা ? হাহাহা… ওটা মনের ধোকা আর মস্তিষ্কের মিথ্যা মায়াজাল ছাড়া আর কিছুই না।”

ফাইজা জানালা বন্ধ করে দিলো। এখন তার অনেক কাজ। টেবিলের উপর এলোমেলো বইগুলো ঝটপট গুছিয়ে নিলো ফাইজা।

________

ফাহাদ কিডন্যাপারদের বলা যায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদকে এখান থেকে ওরা এসে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাত এখন শেষ হতে চলল, কিন্তু কারো কোনো খোঁজ নেই। এদিকে ফাহাদকে জিনিয়ার চিৎকার শুনিয়েছে ফোন কলে। জিনিয়া কেঁদে কেঁদে বলছিল,

“ভাইয়া, ওরা আমাকে বেঁধে রেখেছে ভাইয়া। আমার উপর অত্যাচার করছে। আমাকে বাঁচিয়ে নাও ভাইয়া।”

ভাই যতই খারাপ হোক না কেন, নিজের বেলায় সে ষোলো আনাই বুঝে। জিনিয়ার শেষ চিৎকারে শুনেছিল, কেউ একজন জিনিয়ার উড়না খুলে নিয়েছে। ফাহাদের তখন রাগের পাশাপাশি আদরের ছোট বোনের সম্মানের কথা ভেবে দুনিয়া সব উলটপালট করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু সে এই মুহুর্তে কিছুই করতে পারছে না। ভোর হয়ে এলেও ফাহাদকে কেউ নিতে আসেনি। লাস্ট কলে ফাহাদকে বলা হয়,

“তোমার আড়ালে পুলিশ তোমাকে ফলো করছে। প্লাস আমাদের লোকেশন ট্র‍্যাক করার ফন্দি আটছে। যখন এসব পুলিশি ঝামেলা মুক্ত হয়ে আসতে পারবে সেদিন কল দিও। দেরি করলে তোমার উপর থাকা সমস্ত ঝড়তুফান তোমার বোনের উপর চলে আসবে।”

আদরের বোন জিম্মি থাকায় ফাহাদ এখন বাড়তি কোনো কথা বলছে না। মরতে তাকে হবেই, আজ না হয় কাল। দলের তিনজন যেহেতু পরপারে পাড়ি জমিয়েছে, সেহেতু তার যাওয়াটাও নিশ্চিত। যতই লুকিয়ে থাকুক না কেন, বের হতেই হবে। শেষ গন্তব্য যেখানে, সেখানে যেতেই হবে। ফাহাদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। গেলো না বাড়ি ফিরে। সেখানে ফিরলেও লাভ হবে না। রাশিদা বেগম মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে আছেন বলতে গেলে। জিনিয়াকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে তাকে এক পা ও বাড়িতে রাখতে দেয়া হবে না। তাকে যে ত্যাজ্য পুত্র করে বের করে দেয়া হয়েছে।

চলবে…

ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন যাতে আগামীতে শুধরে নিতে পারি। গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ রইলো, ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here