সবিনয়ে_নিবেদন পর্ব ৮

#সবিনয়ে নিবেদন
#পার্ট:০৮
#বিনতে মাহনূর

“সেদিন আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে তোমার সাথে ওমন করে ছিলাম।তুমিতো জানো আমার পরিবার সম্পর্কে।মধ্যবিত্ত পরিারের ছেলে ছিলাম।বাবা সামান্য স্কুল টিচার।বাবা মার বড় ছেলে হওয়ার দরুন অনেক দায়িত্ব ছিল আমার।আমার পরে ছোট ছোট দুজন ভাই বোন আছে তাদের দায়িত্বও আমার ছিল। পড়ালেখায় বরাবরই ভালো ছিলাম বলে ভালো ভার্সিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে ছিলাম।অনেক সপ্ন ছিল বাবা মা ভাই বোন কে নিয়ে ভালোভাবে বেচেঁ থাকার অদম্য ইচ্ছা ছিল।সবই ঠিক চলছিল,তারপর তুমি এলে আমার জীবনে।প্রথম যেদিন তুমি এসে ডাকলে তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার কথা শুনে তোমার মাঝে হারিয়ে গেছিলাম।সব ঠিক ছিল তোমার সাথে কথা বলা তোমার সাথে সময় কাটানো সব।একটু একটু করে যে তোমার প্রতি গভীর ভাবে দুর্বল হচ্ছিলাম তাও বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু প্রতিবাদ করিনি।আমার সবটা জুড়ে তোমার বসবাস ছিল।লেখাপড়ায় তেমন মন বসতো না।সব সময় তোমার কথা মনে পরতো।জানি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চেয়ে বসেছিল মন তাও ভালো লাগছিল।ভালোবেসে ফেলে ছিলাম তোমাকে।খুব থেকেও বেশি যদি কিছু থেকে থাকে তেমন ভালোবেসে ছিলাম।কিন্তু একটা ঝড় আর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।”

এতো টুকু বলে তিনি চুপ করলেন।হয়তো অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে ছিল যা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার।কিন্তু আমার জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো।কি এমন হয়ে ছিল যার জন্য আমাদের ভালোবাসার পরিণতি ওমন হয়ে ছিল।যদিও একে অপরকে কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি তাও ভালোবাসতো ভালোবাসাই।তার কাছ থেকে পরের ঘটনা শোনার জন্য চুপটি করে তার বুকের সাথে মিশে আছি।

“এক দিন হঠাৎ করে বাড়ি থেকে ফোন আসলো বাবার হার্ট এ্যাটাক হয়েছে।তোমার মনে আছে বেশ কিছু দিন আমি ভার্সিটিতে আসিনি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম মনে আছে।সে বার তিনি কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেছিলো।চিন্তায় জান যাওয়ার অবস্থা।ফোনের ওপর ফোন দিয়েও তাকে পাইনি।কারো কাছ থেকে কোনো খবরও পাচ্ছিলাম না কারন তিনি খুব ক্লোজ ভাবে কারো সাথে মিশতো না তাই তার ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না।তিনি ফিরে ছিল দিন ১৫ পর।আর তারপর থেকে কেমন হয়ে গেছিলো।

“সেবার আমি বাড়ি গিয়ে ছিলাম। ফোনে বাবার খবরটা পেয়ে কাউকে আর জানানোর মত অবস্থাতে ছিলাম না।যতো দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যাই।গিয়ে জানতে পারি বাবার অবস্থা বেশি ভালো না।তিন তিনটা দিন হসপিটালে যে কেমন কেটেছে তোমাকে বুঝাতে পারবো না।বাবাকে হারানোর ভয়,চিন্তা ঝেঁকে ধরে ছিল।মা কেঁদে কেটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো বারং বার।ভাই বোন দুটো মা বাবার এই অবস্থা দেখে খুব ভয় পেয়ে ছিল।একা হতে সব সামলাতে হয়ে ছিল তখন।পাশে দাঁড়ানোর মতো একটা মানুষও ছিল না।চার দিনের দিন ডাক্তার বললো বাবা এখন আগের থেকে ভালো আছে।কিছু দিন পর বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসি।তখন জানতে পারি আমাকে পড়ানোর জন্য বাবা তার জমি বন্ধক রেখে ছিল যার মেয়াদ গত মাস পর্যন্ত ছিল।আর টাকা শোধ করতে পারেনি বলে আমাদের জমি তারা দখলে নিয়ে নিয়েছে।আর সেই চিন্তায় বাবা অসুস্থ হয়ে পরেন।এসব শুনে নিজেকে বড্ডো অপরাধী মনে হয়েছিলো।আমি আর ফিরে যেতে চাইনি।বাবাকে বলে ছিলাম আর পড়বো না যতটা পড়েছি এই অনেক এখন যা পারি তাই করবো।কিন্তু বাবা মানেনি।তিনি জোর করে পাঠিয়ে দিয়ে ছিল।আমিও ভেবে ছিলাম আর মাত্র তিন মাস তারপর পরীক্ষা।তাই আর অমত করিনি।কিন্তু ভার্সিটিতে যে আরো একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল তা জানা ছিল না।সে দিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়ে ছিল।হোস্টেলে আমার রুমমেট জানায় তোমাকে আর আমাকে নিয়ে পুরো ভার্সিটিতে বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে কিছু লোক।আমি তখন ওর কাছে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এসব জানো কি না? ও বললো তুমি জানো কিন্তু তোমার তাতে কিছু আসে যায় কি না ওরা জানে না।একে বাড়ির ওই অবস্থা তার ওপর এখানের এই অবস্থা।তোমার ওপর খুব রাগ হচ্ছিলো।কেন কিছু বলিনি ওদের?।সারা রাত ভাবলাম কি করবো?আমার ওপর অনেক দায়িত্ব বাবাকে নিরাশ করতে পারবো না।তাই তোমাকে ইগনোর করা শুরু করলাম।ভেবে ছিলাম কিছু মাস দূরত্বে যদি তোমাকে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিতে পারি তাহলে ক্ষতি কি।কিন্তু তোমার আমার আসে পাশে থাকা,কথা বলতে চাওয়া আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে দিচ্ছিল না।আর তোমার ওপর রাগও ছিল,সবাই এতো কিছু বললো অথচ তুমি কোনো প্রতিবাদ করনি।রাগ, কষ্ট সব এসে সেদিন তোমার ওপর পরে ছিল।বিশ্বাস করো এতটা রুঢ় হতে চাইনি।কি করতাম আমি?আমার স্থানে তুমি থাকলে কি করতে?সেদিনের পর তোমার দেখা আর পাইনি।অনেক খুঁজেও তোমাকে পাইনি।আমি ভেবে ছিলাম তুমি রাগ করবে অভিমান করে কথা বলবে না কিন্তু এমন কিছু করলে যা কল্পনাও করিনি।তোমাকে না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়ে ছিলাম। কোথায় কোথায় না খুঁজেছি?পাইনি।চলে গিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে। সত্য জানার চেষ্টা পর্যন্ত করনি।কতদিন যে ঘর বন্ধি হয়ে ছিলাম জানি না। মরে যেতে ইচ্ছা করতো কিন্তু পারিনি পরিবারের জন্য বাঁচতে হয়েছে।মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পরীক্ষা দিই।রেজাল্ট ভালো হওয়ার সুবাদে খুব দ্রুত একটা চাকরিও পাই।বাবা মা ভাই বোন সবাইকে ভালোভাবে রাখার স্বপ্নও পূরণ হয় কিন্তু তোমাকে নিয়ে দেখা সপ্ন পূরণ করা হয়ে ওঠে না।এতো কিছুর মধ্যেও আমি একা ছিলাম। নিঃসঙ্গ জীবন কেটেছে এই দু বছর।তোমাকে খুঁজতে তোমার বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু ওখানে কেউ তোমার বর্তমান ঠিকানা জানতো না।লোক সম্মুখে নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে রাখলেও রাতের আধারে তা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতো।”

এতটুকু বলে উনি থামলেন।উনি কাদছেন,তার চোখের পানি আমার কপালে এসে পরছে।আমিও কাদছি।প্রতিটি ঘটনার এপিঠ ওপিঠ দু পিঠ থাকে।কিন্তু আমরা যা চোখে দেখতে পাই তাই বিশ্বাস করি।আতো কষ্ট তিনি নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে ছিল আর আমি ওনাকে ভুল বুঝেছি।নিজের কাছে নিজেকে ঘিন্না লাগছে।এ কেমন ভালোবেসেছি আমি তাকে?তার মনের কথা যদি বুঝতেই না পারি তাহলে কেমন ভালোবাসলাম।তিনি নিঃশব্দে কেঁদে চলছেন।আমি তার কাছ থেকে একটু দূরে সরে সযত্নে তার চোখের পানি মুছে দিলাম।তিনি আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন।এতো কষ্টের মধ্যেও কি করে কেউ হাসতে পরে?তিনি বলেই হয়তো পারছেন।
“তারপর।”

তিনি আবার হাসলেন।উফ,এতো হাসির কি আছে?আমি মেকি রাগ দেখি বললাম,
“আপনি এখনো সবটা বলেননি।”

তিনি ঠোঁট কামড়ে হাসি দিয়ে বললো,
“তাই?”

আমি রেগে বললাম,
“আপনি বলবেন কিনা?”

“আচ্ছা আচ্ছা,এতে রাগ করার কি আছে।বলছি তো বাবা।”

“হুম বলুন।”

“তার আগে বুকে মাথা রাখো।”

আমি হেসে দিয়ে তার বুকে মাথা রাখলাম।

“আমার অফিস কলিগ আলিফ।খুব ভালো বন্ধুও বলতে পারো।এই একজনই আছে যে আমার ব্যাপারে সব জানে, ইভেন তোমার কথাও।রায়া আলিফের হবু বউ।”

“কিহ্!আপনার বন্ধুর হবু বউ?আর তাকেই আপনি নিজের বউ বলে চালিয়ে দিলেন?আপনার মত খারাপ আর একটাও নেই।”

আমার কথা শুনে তিনি শব্দ করে হেসে দিল।এমনিতেই রেগে ছিলাম তারওপর ওনার হাসি যেন সারা গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল।রেগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসিয়ে দিলাম তার বুকের ডান পাশে একটা কামড়।
“আহ্,কি করছো? রাক্ষসীদের মতো কামড়াচ্ছো কেন?”

বলেই হেসে উঠলো।আমি মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকালাম।তিনি আমাকে পরম যত্নে দুহাতে আগলে নিলেন।

“প্ল্যানটা মূলত রায়াই দিয়েছিল।রায়া,আলিফ আর আমি প্রায় সাথে থাকতাম।দেখা গেলো আলিফ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে তাই রায়াও চলে আসলো।ওর সাথে আমার বন্ডিং খুব ভালো। সেভাবেই একদিন ওর বাড়ির সকলের ছবি আমদের দেখাচ্ছিল,তার মধ্যে একটা ছবিতে তুমি ছিলে।রায়কে জিজ্ঞেস করলে ও বললো তুমি তোয়ানার বেস্ট ফ্রেন্ড।পরে ওকে সব বললাম।আলিফ তোমার কথা জানলেও কখনো দেখানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি।সব শুনে আলিফ বললো তোয়ানার বিয়েতে আমার যাওয়া উচিত।যেহেতু তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তাই অবশ্যই আসবে।সেই সুযোগে তোমাকে বুঝিয়ে বলাটাও সহজ হবে।আমিও তাই ঠিক মনে করলাম।কিন্তু বাঁধ সাধলো রায়া। ও বললো তুমি যে এখনো আমাকে ভালোবাসি তার কোনো প্রমাণ নেই।তাই ও আগে জানতে চায় তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো কি না। তুমি একবার কষ্ট পেয়েছো দ্বিতীয়বার ওর জন্য কষ্ট পাও তা ও চায় না।আরো বললো ও আমাকে ওর হবু বর বলে তোমার কাছে পরিচয় করিয়ে দিবে।ভালোবাসলে জেলাস হয়ে নিশ্চয়ই কিছু করবে।কি আর করার ছিল আমার?তোমাকে এতো দিন পর দেখার লোভ সামলাতে পারিনি।আর সত্যি বলতে আমিও জানতে চেয়েছিলাম তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো কি না।”

“আপনি যদি রায়ার হবু বর না হয়ে থাকেন তাহলে তোয়ানা চিনতে পারলো না কেন?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here