সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -২২+২৩

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২২

বীভৎস চেহারা নিয়ে বাড়িতে ফিরেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো বর্ণ। ছেলের এমন দূর্দশা দেখে পারভীনের মনে হলো বুকের ভেতরে কেউ যেন খামচে ধরেছে। তিনি দৌড়ে ছেলের দরজার নিকটবর্ত্তী দাঁড়ালো। নরম সুরে ডেকে উঠলো বাবা বলে। কিন্তু কোন স্বারা পাওয়া গেলো না ভেতর থেকে। অনেক ডাকাডাকি করেও ব্যর্থ হয়ে দরজা থেকে সরে এলেন পারভীন। অন্য দিকে ঘরের ফ্লোরে মরণান্তিক যন্ত্রণা নিয়ে নীরবে পরিদর্শন করতে রইলো হাসোজ্জল প্রণয়ীর ছবি। যে ছবিতে নদীর রূপসজ্জার কোন কমতি নেই। ভেতর থেকে না পাওয়া তীব্র কষ্ট বক্ষঃস্পন্দনকে কাঁপিয়ে দিলো বারংবার। প্রেমে এতো কেন কষ্ট! তাঁকে না পাওয়ার সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা কেন? “আমাকে তুমি পাবে না ,আমি অন্য কারো”। অগোছালো শব্দে বিরবির করে বলতে রইলো অভিধানের সকল প্রেম শব্দ। তাতে যদি প্রণয়ীর মন গলে। কিন্তু সামনে থেকে যখন প্রণয়ীর মন গলেনি,এবারও গলবে না। পল্লব জোড়া নীরবে বন্ধ করে ভাবতে রইলো সেদিনের কথা! যেদিন নদী ভুলেই মনের গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলো। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় নদী তখন চোখ খুলতে পারছিলো না! বর্ণ নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরতেই নদী চোখ খুলে তাকায় নদী। হঠাৎ নদীর কি হয় কে জানে? নদী সেচ্ছায় বর্ণের হাত মুঠোবন্দী করে সামনে এগিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা প্রায় অনেকটা দূরে চলে আসে। এতোটা নিকটে বর্ণকে পেয়ে নদী ঠিক ভুল বিচার করতে ভুলে যায়। বর্ণ একটু আড়াল হতেই নদী আপন মনে বিরবির করতে থাকে অনেক কথা। যে কথাগুলো স্পষ্ট জানান দিয়েছে, নদী তাঁকে কতোটা চাইতো হৃদয় থেকে। কথাগুলো এমন ছিলো।

_ আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি,তখন আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম মনে আছে আপনার বর্ণ ভাইয়া। সেদিন আপনি আপনার ক্লোজ একজন বন্ধুকে বলছিলেন,আমাকে আপনি কতোটা ভালোবাসেন। বিবরণ দিচ্ছিলেন,আমাকে পেলে আপনি কতটা সুখি হবেন। সবটাই আমি আড়াল থেকে শুনে ফেলি। আপনার ওই কথাগুলো শুনে আমার শরীর পুরো শীতল হয়ে গিয়েছিলো। আমার দু’টো আঙুল না থাকায় কেউ তেমন একটা আমার সাথে বন্ধুত্ব করেনি,আর প্রেম সে তো বহুদূরের কথা। তাই হয়তো কিশোরী মনে আপনার ওই কথাগুলো গিয়ে কড়া নেরেছিলো। কিন্তু কোথাও ভয়ে আপনার কাছে ধরা দিতে ইচ্ছে করেনি! গত একমাস আপনাকে এতোটা কাছে পেয়ে আজ খুব লোভ হচ্ছে আপনাকে পাওয়ার! জানি সম্ভব না,তবুও ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে বলে দিতে আমি আপনায় ভালোবাসি।

নদীর প্রতিটা কথা বক্ষঃপঞ্জরে গিয়ে ধাক্কা খেলো বর্ণের। সে সন্তপর্ণে এগিয়ে গেলো নদীর নিকট। সামনে দাঁড়াতেই কল্পনা ভেবে নদী ঘোরের মাঝেই জড়িয়ে ধরে বর্ণকে। বাকিটা নদীর মুখে আর বলতে হয় না,বর্ণ বুঝে যায়। কিন্তু বিপত্তি আকছার ঘটায় আশংঙ্কার মতো প্রবলবেগে ছুটে আসা বাতাসের তীব্র গতি। বাতাসের ঝাপটা মুখে বারি খেতেই নদী খেয়াল করে কল্পনায় ভাবা মানুষটা তাঁর কল্পনা নয় সত্যি। ছিটকে দূর সরে আসে বর্ণের থেকে। কিন্তু তাতে লাভের সম্ভাবনা কিছুই ছিলো না। কারণ ততোক্ষণে সবটাই দিনের রশ্মির মতো পরিষ্কার বর্ণের কাছে। নদীর স্বীকারোক্তি, ভালোবাসার ছোট্ট শব্দ আর হুট করেই জড়িয়ে ধরা তখনো বর্ণকে ভাবাচ্ছিল। তাই আকম্মাৎ কিছু খুঁজে পায়নি বলার মতো। সে শুধু চেয়ে দেখছিলো নদীর প্রাণপণে ছুটে যাওয়ার পথে। সত্যি থেকে নদী কীভাবে পালিয়ে যেতে পারে বর্ণ সেটা নিজ চোখে দেখে অনুভব করছিলো।

হঠাৎ দরজার কড়াঘাতে ভাবনায় ছেদ ঘটলো বর্ণের। ভাবনা ছুটে গেলেও তাঁর কোন স্বারা পাওয়া গেলো না। সে তেমন ভাবেই পড়ে রইলো যেমনটা আগেও ছিলো।

_ বর্ণ,আমি বাবা। কি হয়েছে দরজা খোল। ভাইয়া ফোন করে জানালো তুমি কিছু না বলেই তাঁদের ওখান থেকে চলে এসেছো। কি হয়েছে? আগে দরজা খোলো।

বাবা-র কন্ঠ বিচলিত লাগছিলো বর্ণের কাছে। তবুও নিজেকে বাবা-র সামনে এভাবে উপস্থাপন করতে নারাজ সে। সে জানে তাঁর বাবা তাঁকে এভাবে দেখলে ঠিক হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন করবে তাঁকে। কিন্তু কী উত্তর দেবে সে? কোন প্রশ্নের উত্তর যে তাঁর কাছে নেই। কিন্তু এখন দরজা না খুললে তাঁর বাবা ভয়ে থাকবেন তাঁকে নিয়ে। যে মা’কে সে এতো ভালোবাসতো! তাঁর যে রূপের সাথে বর্ণ পরিচিত আসলে সে রূপ শুধুমাত্র তাঁদের সাথেই ব্যবহার করেন তিনি। অথচ তাঁর বাবাকে সব সময় সে ভয় পেতো। আর আজ সেই বাবাই সবটা জেনে তাঁকে সাপোর্ট করেছে। কথাটা ভাবতেই কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে আঁটকে গেলো কথার ভাঁজে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মিছেমিছি নিজেকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলো। অবশেষে কিছুটা শান্ত হতেই উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে দিতেই হুরমুর করে ঘরে প্রবেশ করলেন শাহজাহান সাথে পারভীন। পারভীনকে দেখে ভেতরের চাপিয়ে রাখা কষ্ট যেন বেড়ে যেতে রইলো। উল্টো দিকে মুখ রেখে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্য বর্ণ বললো।

_ হুট করেই একটা কাজ পড়ে গেছে বাবা! তাই চলে এসেছি। আর ওখানে যে কাজে গিয়েছি সেটা কমপ্লিট হয়ে গেছে।

ছেলের এমন বিকৃত স্বর মোটেও ভালো লাগলো না শাহজাহানের কাছে। তিনি নিজের কৌতুহল দূরে রেখে বললেন।

_ তোমার চাচা দুশ্চিন্তা করছে,উনাকে ফোন করে জানাও তুমি ঠিক আছো।

_ তুমি জানিয়ে দাও আব্বু আমার ইচ্ছে করছে না।

_ তোমার–

শাহজাহান সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না,তাঁর আগেই তাঁর মুখের কথা কেঁড়ে নিলেন পারভীন।

_ নিশ্চয়ই তোমার ভাইয়ের ছেলে বা বউ কিছু বলেছে আমার ছেলেকে! না হলে কেন আমার ছেলে হুট করে ওই বাড়ি থেকে চলে আসবে? এই জন্যই আমার অনুপস্থিতিতে ওই বাড়িতে আমার সন্তানেরা যাক আমি চাই না। তোমায় তখন বারবার করে বারন করার সর্তেও তুমি আমার কথা শুনলে না। আমার ছেলেকে যদি উল্টো পাল্টা কিছু বলে থাকে ওই পরিবারের কেউ, আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না বলে রাখলাম।

মায়ের এমন রূপ বর্ণের কাছে স্বাভাবিক লাগতো,যদি না সে সত্যিটা জানতো। তাই মায়ের এমন রূপ আর সহ্য হলো না বর্ণের। চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে মায়ের নিকট হাত জোর করে বললো–

_ দয়া করে কোন কথা বলার দরকার নেই তোমার। ওই বাড়ির কেউ আমাকে কিছু বলেনি। তাই ভুলেও ওদের দোষ দিও না তুমি। আর আমি তো নদী নই,যে যা বলে গেলো আর চুপচাপ শুনে দায়িত্বশীল হয়ে সব হুকুম আদেশের সাথে পালন করে গেলো। আমার শরীরটা ভালো না! তাই আমাকে একা থাকতে দাও। আমি আর নিতে পারছি না এই মিথ্যা ভালোবাসা গুলো।

হঠাৎ শান্ত ছেলের এমন কড়া সুরে বলা কথাগুলো মোটেও ভালো ঠেকলো না পারভীন আর শাহজাহানের কাছে। তাঁদের এই কথার মাঝে নদী কোথা থেকে এলো তা যেন বুঝলো না শাহজাহান সাহেব কিন্তু পারভীনের মুখটা একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। সে কিছু একটা ভেবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পারভীন বের হয়ে যেতেই শাহজাহান ঘরের দরজা আঁটকে দিলেন। সিটকিনি আঁটকে যাওয়ার শব্দে পিছন ঘুরে তাকালো বর্ণ। যখন সে দেখলো তাঁর বাবা দরজা লাগিয়ে তাঁর নিকটতমে এগিয়ে আসছে,তখন বর্ণ নিজের ভাষা’র ঝুপড়ি থেকে বলার মতো কোন শব্দ খুঁজে পেলো না। মুখোমুখি শাহজাহান সাহেব দাঁড়াতেই বর্ণ বাবাকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। যে কান্না কেঁদেছিল নদী তাঁকে জড়িয়ে! সেই একি কান্না এখন সে-ও কাঁদছে।

_ বাবা আমি হেরে গেছি ভালোবাসা নামক যুদ্ধে। তোমার ছেলে হেরে গেছে বাবা। সে আমার হবে না বাবা! সে যে তাঁর বাবা-র সম্মানরক্ষা করতে আমাকে অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। ওই কঠিন মেয়ে যে আমার ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পরহিতব্রত করার পণ করেছে সেই মেয়ে। অন্য কারো কথার ইন্দ্রজালে সে অনেক আগেই ফেঁসে রয়েছে। আজ আমি হাজার সত্যি তাঁর মুখোমুখি দাঁড় করালেও সে বিশ্বাস করতে নারাজ আব্বু। আব্বু ও আমায় খুব ভালোবাসে জানো? কেমন করে যেন সব অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছে বাক্সবন্দী করে। আচ্ছা আব্বু ওকে বলবে আমাকে শিখিয়ে দিতে কীভাবে অনুভূতির কবর দিতে হয়। আমার এই শরীর যে নিঃসাড় হয়ে পড়ছে ওকে পাবোনা চিন্তা করতেই। নিজেকে প্রায় ম্রিয়মাণের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার প্রাণ পাখি উড়াল দিয়েছে। তাঁর হৃৎস্পন্দনটা বড্ড কঠিন। সেখানে আমার তুলোর মতো নরম সুপ্ত অনুভূতি গুলো প্রবেশ করতে পারছে না। আমার এই হৃদয় যদি ওর সান্নিধ্যে না পায় আব্বু আমি পাগল হয়ে যাবো। কিছু করো আব্বু, কিছু করো। ওই কঠিন মেয়ে তোমার ছেলেকে মেরে ফেলছে আব্বু,ওর নামে তোমরা মামলা করো। যে ওকে তাঁর কথার ইন্দ্রজালে ফাঁসিয়েছে,তাঁকে শাস্তি দাও,কঠিন শাস্তি। ওকে যে আমার চা—

কথাগুলো বলতে বলতেই হেলে বাবা-র বুকে ঢলে পড়েছে বর্ণ। ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে যেন শাহজাহান সাহেব ভেঙে পড়লেন। অতিরিক্ত কষ্ট যে তাঁর সন্তানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে, তা ভালোই বুঝলেন তিনি! তাহলে কি পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলেছে তাঁদের পরিবারে আবারও সেই অতীত। বর্ণ কি নতুন করে প্রেম বিরহে ভেঙে প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগ খুঁজে নিতে চাইছে,যেমনটা নিয়েছিলো তাঁর—–।

———

_ অস্বাভাবিকভাবে তোর চোখমুখ ফোলা কেন নদী? তুই কি কেঁদেছিস?

আচমকাই ভাইয়ের কন্ঠে খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলে চাইলো নদী। তৎকালীন কি বলবে,সেটা খুঁজে পেলো না সে। কোন রকমে বললো–

_ এমনই শরীরটা ভালো না, সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তাই হয়তো চোখমুখ ফুলে গেছে।

নদীর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে আবারও খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সাগর। কিন্তু সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিনা বেগম। তাঁর কেন জানি নদীকে ঠিক লাগলো না। তাই স্বামীর প্লেটে আরো একটু তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন–

_ আজ রাতে আমি তোমার সাথে ঘুমাব,দরজা দেওয়ার দরকার নেই। তুমি শুয়ে পড়ো আমি হাতের কাজ শেষ করে ঘরে যাবো।

_ কেন? আমি ঠিক আছি মা। মাইগ্রেনের ব্যথা বেড়েছে,চিন্তা করো না আমি টাফলিন খেয়েছি।

_ আমি ঘুমাচ্ছি এটাই ফাইনাল।

মায়ের মুখের উপর বলার মতো আর কিছু বলতে পারলো না নদী। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো! অথচ চেষ্টাই চালিয়ে গেলো খাবার খাওয়ায়, গলা দিয়ে তো একটি দানাও নামতে নারাজ। অবশেষে অর্ধেক খাবারেই পানি ঢেলে উঠে গেলো সে । নদী উঠে যেতেই মান্নান সাহেব প্রশ্ন করলেন।

_ মেয়ের শরীরটা কি বেশিই খারাপ মিনা?

স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে মিনা বেগম বললেন–

_ বুঝতে পারছি না,রাতে ওর সাথে থেকে দেখি কি হয়। যদি সত্যি অনেক অসুস্থ দেখি কাল না-হয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।

_ হুম, ভালো মন্দ আমায় জানিও

_ আচ্ছা

অন্ধকারে নিজের বাম হাতে একবার হাত বোলালো নদী। এই হাতটা ধরে কতো কথাই না বলেছে বর্ণ। তাঁর কতো কতো অভিযোগ পেশ করেছে নদীর কাছে। আর নদী? সে তো প্রতিবারের মতো এবারও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিলো। ভেঙে যেতে যেমন তাঁর সময়ের দরকার হয়নি,তেমনি নিজেকে সামলে নিতেও দরকার হয়নি সময়ের। সন্তপর্ণে বর্ণকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সে এতোটাই সন্তপর্ণে সরে দাঁড়িয়েছে,তা ঘরের ইটগুলোও টের পায়নি। সেখানে অন্য কারো টের পাওয়ার তো কোন কথাই নেই। তবুও কাউকে যে গভীর ভাবে সে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই নদীর,তাঁকে যে সকল দিকের খেয়াল একাই রাখতে হবে। তাঁর কি কষ্ট হচ্ছে না,অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু সব কষ্টে কষ্ট পেতে নেই। সব ভালোবাসায় পূর্ণতা খুঁজতে নেই,কিছু ভালোবাসা অপূরণীয় থেকেই আজীবন বক্ষঃস্থলে বাসা বেঁধে থাকুক।

ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যথায়, ব্যথা পেলো দু’জনেই। কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশিত করে দুঃখের পাল্লা হাল্কা করেছে! আর কেউ কাউকে বলতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করে নিজের ভেতরেই হাজার বার যুদ্ধকে পরাজিত ঘোষণা করতে চেয়েছে,কিন্তু যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তুমি হেরে গেছো নদী! তুমি ভালোবাসার যুদ্ধে হেরে গেছো।

ইনশাআল্লাহ চলবে#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২৩

শুভ্র নির্মল প্রহরের দেখা পাওয়া বড়ই মুশকিল হয়ে পড়েছে আজকাল। গগনবিহারী পাখিগুলো উড়াল দিয়েছে ডানা ঝাপটে। মৃদু হাওয়ায় দুলছে কৃষ্ণচূড়া ডালের ছোট্ট ছোট্ট পাতা। সবুজ পাতার বুকে ক্ষণে ক্ষণে খেলা করছে শীতল পরশের বাতাসের ঝাপটা। দিকবিদিকশুন্য হয়ে দুলছে চিকন সরুর ডালগুলো। সেখানে একদল চড়ুই পাখির ঝাঁক উড়ে এসে বসে কিচিরমিচির শব্দ করে গান তুলেছে কিংবদন্তী গল্প তৈরি করার লক্ষে। সূর্য মামার দেখা পাওয়া যেন আজ বড্ড বিষ্ময়কর। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের দলেরা একদি ওদিকে ছোটাছুটি করছে। জানা অজানা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই গগনপানে চোখ তুলে একবার তাকালো নদী। সেখানে যেন সে শূন্যতা অনুভব করলো। দ্রুত চোখের মণি সরিয়ে আনলো জমিনে। চারিদিকে ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেছে। গায়ের নিল রঙের চাদরটা খানিক টেনে নিলো শরীরে। সামনের দিকে চালিত করলো নিজের পদদ্বয়। কয়েক কদম এগিয়ে যেতে যেতেই থেমে যায় পদদ্বয়। কেন তাঁর কোন তুরঙ্গিত কারণ খুঁজে পায় না সে। বাংলা মাসের কার্তিক অগ্রহায়ণ শেষ হয়ে পৌষের চিরকলের চাকায় থেমেছে মাস। কেটে গেছে প্রায় দুই মাস। কিন্তু থেমে নেই কোথাও কারো জীবন! সে দিব্যি এগিয়ে চলেছে তাঁর আপন গতিতে। সময় ধরে রেখেছে তাঁর বৈষম্য বিমোচক। হঠাৎ হাঁটার গতি থামিয়ে পিছুপা হয়ে তাকালো নদী! কেন জানি মনে হলো কেউ তাঁকে ডাকছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। আবারও পায়ের গতি সামনে এগিয়ে নিলো সে। সামনে হাঁটতে নিলেই কারো শক্তবাহুর সাথে ধাক্কা খেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে । নিভন্ত নয়ন জোড়া তুলে সামনে তাকাতেই অতি পরিচিত মুখের অধলখানা ভেসে উঠলো চোখে। শুকনো ঠোঁটের কোণায় জলন্ত সিগারেট,যেখানে কমলা রঙের আগুন বিদ্যমান। সরু ঠোঁট দিয়ে বন্দি করে রাখা ধোঁয়া বেরুচ্ছে নাক,মুখ থেকে। বিষাক্ত গ্লাসে সে সুখ টান দিচ্ছে তা কি জানে? জানে না হয়তো! জানলে নিশ্চয়ই এমন বিষপান করা থেকে সে বিরতি থাকতো। অন্য দিকে
পল্লব জোড়া যেন তাঁর গভীরতা তৈরি করেছে মুখের অধলের সাথে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো রূপ নিয়েছে বড় আকারে। উসকোখুসকো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের মাঝে এসে তাঁদের জায়গা দখল করেছে। বড্ড অবহেলায় নিজেকে বেঁধে রেখেছিলো সে! তা নদী বুঝে নিলো কয়েক সেকেন্ডে মাঝেই। ভালোবাসা যে ভালো নেই,তা গভীর ভাবেই টের পেলো সে। জলন্ত সিগারেটের শেষ টানটা সে অতিবাহিত করলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। হাত থেকে সিগারেটের ফিল্টার ফেলে দিয়ে ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটালো জোরপূর্বক। হাত নাড়িয়ে নদীর আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করলো। নদী তখনো ভাবান্তর হয়ে তাকিয়ে আছে বর্ণের মুখোপানে।

_ এভাবে কি দেখছিস আমার চেহারায়? নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাবি না সেখানে। যদিও বা কিছু ছিলো! তা ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরে হারিয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে ভেতর বাহিরের সব সৌন্দর্য। এখন আছি বলতে শুধু আমি-ই। হয়তো কারো দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে বেঁচে আছি। বর্ণ নামের এক হাসোজ্জল মানুষটা নদীরঙিন শৈবালের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে ছিলো কিশোর বসয় থেকে। যেখানে সেই নদীই নেই,সেখানে তাঁর বেঁচে থাকাটা বৃথা। তাই তাঁকে খুঁজে লাভ নেই।

বর্ণের কথায় নদী নিজের বিমূঢ়তা ছড়িয়ে মিশে যেতে রইলো বক্ষঃস্পন্দনের মাঝে। খুঁজে পেলো না শব্দচয়ণ থেকে বলার মতো কোন ভাষা। নিষ্পলক হয়ে তখনো সে তাকিয়ে রইলো বর্ণের চোখে। চোখে চোখ রেখে খুঁজে চললো কতোটা কষ্টে ব্যথিত হয়ে পড়েছে বর্ণ । বর্ণও তখন নদীর চোখে চোখ রেখে খুঁজে চলেছে নিজের প্রাপ্ত জায়গা। পেতে চাইছে তাঁর চোখে নিজের জন্য ব্যকুলতা! পেয়েছে কি সে? কি জানি? সকল সহিংসতা প্রতিরোধ করে নদী মাথা নিচু করে প্রশ্ন করলো–

_ হঠাৎ আপনি এখানে?

ঠোঁটদ্বয়ের মাঝে মিছেমিছিই হাসি বজায় রাখলো বর্ণ নদীর প্রশ্ন শুনে। সামনের দিকে হাত ইশারা করে বললো–

_ মন্থর হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে চল হেঁটে কথা বলি।

_ হু,কি?

_ বললাম সামনে চল

_ হুম

সন্তপর্ণে দু’জনেই এগিয়ে চললো পিচঢালা রাস্তার পাশ বেয়ে। কারো ঠোঁটের কোণায় হাসি নেই! আছে বিষাদের ছাপ। মিনিট পাঁচেক নিভৃতেই প্রভাবিত হলো তাঁদের চলার পথ। সকল নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বর্ণ মুখ খুললো–

_ জীবন থেকে সাতারোটি বছর প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার জন্য তোকে সাবধান করবো পরবর্তী জীবনের জন্য ,নাকি আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার পরই তোর বিয়ের ফুল ফুটবে এটা মনে করে তোকে শুভেচ্ছা জানোবো বুঝতে পারছি না৷ শুধু বলবো,হাজার চেষ্টা করেও আজকের দিনকে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। বারংবার মনকে বুঝিয়েছি,শাসন করেছি! কিন্তু ওই মন পাগলটা শুনতে নারাজ। কেন? কি কারণ জানা নেই? শুধু জানি আজকে তোকে এক পলক না দেখলে,তোকে না দেখার তৃষ্ণায় মরে যেতাম আমি। ভুল না ঠিক সেটা আজকাল ভাবতে বসি না। ভাবতে বসলেই বক্ষঃপঞ্জরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করি। সে কি অসহ্য ব্যথা তোকে বলে বোঝাতে পারবো না।

বর্ণের প্রতিটা কথা কর্ণকুহরে সাময়িক ভাবে ধাক্কা খেলো। হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা হঠাৎ করেই যেন কয়েক গুন বেড়ে গেছে। আজ তাঁর জন্মদিন। কই তাঁর তো মনে নেই? নিজের জন্মদিনর কথা সে নিজেই কীনা সেটা ভুলে বসে আছে। কিন্তু মানুষটা ঠিক মনে রেখেছে। শুধু মনে রেখেছে বলছে কেন? মনে রেখে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতেও চলে এসেছে।
অবশ্য কখন দিন ফুরিয়ে সপ্তাহ,মাস শেষ হয়েছে সেটা নিজেও জানে না নদী। আঁখি ছলছল করে একবার বর্ণের চলার পথে তাকালো। কিন্তু বর্ণ হেঁটে চলেছে তাঁর আপনমনে। তাঁর অন্য কোথাও মন নেই। নদী তৎক্ষনাৎ বলার মতো কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তাই সে-ও আপন মনে পা মিলিয়ে বর্ণের সাথে হাঁটতে রইলো। নদীকে চুপ থাকতে দেখে বর্ণ নিজেই আবার কথা বললো

_ সিগারেট খাবি নদী? আমার নেশা উঠেছে একটা সিগারেটের। এখন না খেতে পারলে ঠিক শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। তোর মতো। তোর যে-মন শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ইনহেলার স্প্রে করতে হয়! তেমনি আজকাল আমার সিগারেট দরকার হয়। দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি দোকান থেকে। প্যাকেটে যা ছিলো সব শেষ! তোকে দেখার তাড়া থাকায় কিনতে ভুলে গেছি। তুই এখানে অপেক্ষা কর আমি এখনি আসছি।

বর্ণ দৌড়ে হাতের ডান সাইটের দোকানে চলে গেলো। আর সেদিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো নদী। এতোটা অধঃপতন ঘটছে মানুষটার মাঝে। যে মানুষটা কিনা সিগারেটের গন্ধে সহ্য করতে পারতো না,আজ সেই ছেলে কিনা সিগারেট খাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন। বর্ণ যেমন এক ছুটে গিয়েছিলো,তেমনি এক ছুটেই ফিরে এসেছে। কিন্তু পার্থক্য হলো খালি হাতে সে গিয়েছিল এখন তাঁর হাতে জলন্ত সিগারেট। সিগারেটে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নদীর উদ্দেশ্যে বললো।

_ কষ্ট ভুলতে এটা খুব কার্যকর ভূমিকা রাখছে আমার জীবনে । বুঝলি নদী বাবা-র ভালো ছেলে হওয়ার তরুণে অন্য কোন নেশা ছুঁতে পারছি না। কিন্তু প্রেমিকার প্রত্যাখ্যানে সামান্য সিগারেট তো খাওয়াই যায়। কি বলিস তুই? খাবি নদী? কষ্ট দূর করার ঔষধ। খেয়ে দেখ কেমন সুখ সুখ অনুভব হয়।

_ এসব কেন করছেন বর্ণ ভাইয়া? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এতো আয়োজনের কি দরকার? কোথাও কি আমার কষ্টে কম পড়েছে?

_ বালাইষাট কম পড়বে কেন? আমার জানা মতে বেশিই আছে। আমি তো তোকে কষ্ট দিচ্ছি না,নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি, সাথে আমার জন্মদাত্রী জননীর কাছে নিজের কষ্টটা প্রকাশিত করছি। কিন্তু জননীটা না ভীষণ শক্ত পাথরে গড়া। একটুও গলছে না। সে যাইহোক তোকে শুভেচ্ছা জানাতে এতদূর ছুটে এলাম! কিছু দিবি না।

_ কি দিবো?

_ যেটা চাইছি সেটা

নদী বিচলিত কন্ঠে বললো–

_ কি চাইছেন?

নদীর বিকৃত স্বরে বর্ণ হাসলো শুধু। মুখ ফুটে বললো।

_ কিছু না। তা বিয়ে কবে তোর?

_ জানি না

_ নিজের বিয়ে,অথচ নিজেই জানিস না! হাউ ফানি নদী।

_ বললাম তো জানি না।

_ আরে কি হলো তোর চেচাচ্ছিস কেন? ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম তুই জানিস না,এবার ঠিক আছে।

_ না,কিচ্ছু ঠিক নেই। আপনি কেন এসেছেন এখানে? বারবার কেন আমায় কষ্ট দিতে ফিরে আসছেন। আমি যখনই নিজেকে সামলে নিচ্ছি ঠিক তখনই আপনি উত্তাল ঢেউয়ের মতো আমার বুকে আছড়ে পড়ছেন? কি বোঝাতে চাইছেন আপনি? আমাকে না পাবার তীব্র যন্ত্রণায় আপনি মরে যাচ্ছেন। আরে আমাকে না দেখিয়ে নিজের মা’কে দেখান! তাহলে যদি কাজ হয়। আমি তো আমার বাবা-র সম্মান রক্ষা করতে পিছুপা হয়ে দাঁড়িয়েছি,আর আপনি তো আপনার মায়ের ভয়ে পিছুপা হয়ে আছেন। সাহস আছে,নিজের মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার। জানি নেই! যতো হুমকি ধামকি আমার কাছেই। মায়ের ছেলে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ান, প্রশ্ন করুন কেন সে আমায় এতো অপছন্দ করে? শুধুই আমি প্রতিবন্ধী বলে! নাকি অন্য কোন কারণ? যদি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান,তাহলে আমার সামনে আসবেন তাঁর আগে নয়। উত্তরটা যদি যুক্তিপূর্ণ হয় নিজেই সরে দাঁড়াবেন আমার জীবন থেকে,আর যদি তা নাহয়, তবুও আমার কিছু করার নেই!কারণ আমি আপনার প্রেমিকা নই,কিন্তু আমি আমার বাবা-র মেয়ে। তাঁর আদেশ আমাকে পালন করতেই হবে। আর দয়া করে আমাকে আমার নিতি থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন না। ফলাফল ভালো হবে না। কথাগুলো মাথায় রাখবেন।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here