সম্পর্ক,পর্ব-২০+২১

#সম্পর্ক
#২০

(১৮+ এলার্ট)
চারদিন হলো, রতিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আহ্নি বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে,ফোন বন্ধ বলছে। এরপর আবিরদের বাসায় গিয়েছিল, কিন্তু তারাও এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারল না। উনারাও চিন্তিত রতি কে নিয়ে। রতির অফিসের কারো নাম্বারও তাদের কাছে নেই।
আহ্নির খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। পড়াশোনা হচ্ছে না। প্রান্তের সাথে রোমান্টিক আলাপ হচ্ছে না। দুপুরের সাথে নিয়ম করে প্রতিদিন ঝগড়া করা হচ্ছে না। মোট কথা, আহ্নি স্টাক হয়ে গেছে। তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান রতিতেই আঁটকে গেছে। কোথায় আছে মেয়েটা, কী অবস্থায় আছে? ভালো আছে তো?
আহ্নির মন গুমরে গুমরে কাঁদে।

আহ্নির এই হঠাৎ পরিবর্তন প্রথমে চোখে পড়ল দুপুরের। গতকাল আহ্নির একটা স্কার্ফ নিয়েছিল দুপুর। অন্যবেলায় এটা নিয়ে আহ্নি তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিলেও, গতকাল থেকে এই পর্যন্ত একটা সাউন্ডও করেনি মুখ দিয়ে। ফিরেও তাকায়নি। ব্যাপারটা দুপুরকে অবাক করেছে, তবে সে বেশি একটা পাত্তা দিল না। কিন্তু যখন দেখল সকাল, দুপুর পার হয়ে যায়, আহ্নি ঘর ছেড়ে বের হয় না, খায় না, ডাকলে সাড়া দেয় না, সারাক্ষণ কপালে ভাঁজ পড়ে থাকে, কী যেন ভাবে একা একা…তখন দুপুরের কৌতূহল জাগলো।

বিকেলের সময় একটু নরম ভাব নিয়ে আহ্নির ঘরের ভেতর ঢুকলো দুপুর। আহ্নি তখন জানালার ধারে বসা, তার চোখ দুটো টকটকে লাল, কিছুক্ষণ আগেই একদফা কেঁদেকেটে এখন স্থির হয়েছে।
দুপুর অনেকটা ক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কেন যেন ডাক দেওয়ার মতো সাহসটা পেল না। এই প্রথম দুপুরের মনে হলো, তারা দুটিতে একই মায়ের পেট থেকে জন্মানো সত্ত্বেও দু’জন দু’পথের মানুষ। তাদের মধ্যকার দূরত্ব আকাশ-পাতাল। অথচ বোন-বোনের সম্পর্ক নাকি স্বর্গীয় সম্পর্ক হয়! দুপুর ধীর শব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট্ট করে। তারপর জড়তা সমেত বিছানায় বসল। আহ্নি এইবার কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দুপুরের দিকে তাকায়। অপ্রস্তুত দুপুর একটা শুকনো হাসি ছুঁড়ে দিল, আহ্নি প্রত্যুত্তরে মুখোভঙ্গিও বদলালো না। পুনরায় জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল।

দুপুর রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোর কী হইছে?’
আহ্নি জবাব দিল না। দুপুর মৃদু শ্বাস ফেলে। তার কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। ভাই-বোনদের সম্পর্ক কত মধুর হয়, অথচ ওদের এমন কেন! চার ভাই-বোন সব আলাদা আলাদা… কারো সাথে কারো বন্ধুত্ব নেই। কেউ কেউ অন্যজন কে প্রতিপক্ষ ভাবে!

দুপুর ফের মিনমিনিয়ে বলল, ‘আহ্নি, বল না কী হইছে। তুই হঠাৎ এত চুপচাপ হয়ে গেলি কেন? তুই হলি ঝড়ের মতো। তোকে ছটফটেই ভালো লাগে। এমন চুপচাপ তোর স্বভাব, মানায় না.. কী রে আহ্নি, জবাব দিবি না?’
আহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে দুপুরের দিকে তাকাতেই দুপুর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যাই। তুই থাক।’ বলে এক পা ফেলতেই আহ্নি বিষন্ন গলায় বলল, ‘রতি ভাবিকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
দুপুর থেমে গেল। দুপুরের দুই ভ্রু কুঁচকে এলো, ‘বলিস কী! পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কই গেছে?’
‘জানি না। অফিসিয়াল কাজে চাঁদপুর গেছিল। কিন্তু এরপর থেকে ফোন বন্ধ। কোনোভাবেই কন্টেক্ট করতে পারছি না। আমার খুব টেনশন হচ্ছে।’
‘হতে পারে ওখানে নেটওয়ার্ক নেই, বা কারেন্ট নেই তাই ফোন অফ।’
‘এমনটা হলেও যেকোনো উপায়ে আমাকে বা আবির ভাইয়ার বাসায় ইনফর্ম করতো ভাবি। ভাবি এতটা সেন্স ছাড়া পাবলিক না। আমার মনটা বড্ড কু গাইছে। অস্থির লাগছে ভীষণ। শোনো আপা, ভাবির যদি কিছু হয় আমি কাউকে ছাড়ব না বলে দিলাম।’

শেষ বাক্যটা কেন বললো, আহ্নি নিজেও জানে না। তার মুখ দিয়ে অটোমেটিক বেরিয়ে গেছে। দুপুরের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয়। সে সরু চোখে তাকাল, ‘তুই কী বলতে চাস? ভাবিকে গায়েব করার পেছনে আমার হাত আছে?’
‘আমি সেটা বলিনি। আমি নিজেও জানি না আমি কী বলতেছি। প্লীজ যাও। একা থাকতে দাও একটু। আমার টেনশনে আর ভালো লাগতেছে না। মাথার ভেতর সব উলোটপালোট হয়ে গেছে। কী থেকে কী বলতেছি নিজেও জানি না।’

দুপুর উঠে দাঁড়াল। তার মায়া লাগছে আহ্নিকে দেখে। আহ্নি যে কী পরিমাণে রতিকে ভালোবাসে, সেটা এই বাড়ির সবাই জানে। সেও জানে। পুরো পৃথিবীতে কেয়ামত হয়ে গেলেও আহ্নি কোনোদিন রতিকে ভালোবাসা থামাবে না, এটা খুব ভালো করেই জানে দুপুর। দুপুর আশ্বাস দিল, ‘চিন্তা করিস না। খুব দ্রুত খোঁজ পেয়ে যাবি। আমি শিউর ওখানে কোনো গ্যাঞ্জাম হইছে। গ্যাঞ্জাম মিটলেই তোর ভাবি ফোন করবে।’

আহ্নি নিরুত্তর। দুপুর রুম ছাড়লো।
নিশ্চুপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আহ্নি একসময় অজান্তেই কেঁদে উঠল। দুই চোখে জলের বর্ষণ…
আকাশের বুকে রতির মৃদু হাসি মুখটা ভেসে উঠেছে। আহ্নির বুকটা খচখচ করতে লাগলো।

________
সারাদিন রতি একা একা কাটিয়েছে। তার হাত-পা এখনো বাঁধা। তাকে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে বিছানায়। সে শুধু শুয়ে শুয়ে সময় কাটায়। টয়লেট পেলে বিছানায় করে। দুপুরে একজন আসে, রতিকে পরিষ্কার করে দেয়, চাদর পাল্টে দেয়। তারপর রতিকে খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। রতি তার নাম জানে না, তাকে চিনেও না। তাকে কোনো প্রশ্ন করলেও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। অসহ্য হয়ে উঠেছে রতি। এই জীবন তার কাম্য ছিল না, কোনো কালেই কাম্য ছিল না। সারাদিন মফিজুলের দেখা না পাওয়া গেলেও সন্ধ্যার পর তার গলা শুনতে পায় রতি। একটু পরেই একটি মেয়ে আসে। রতিকে পুনরায় পরিষ্কার করে দেয়। তারপর রতির শরীর থেকে সমস্ত পোশাক খুলে একটা পাতলা চাদরে ওকে ঢেকে দিয়ে চলে গেল। রতি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইল। দুই চোখের ক্লান্তি নেই। তারা তাদের মতো করে জল ঝড়াচ্ছে।

মফিজুল আলম উদম গায়ে, লুঙ্গি পড়ে ঘরে ঢুকলেন। রতি না চাইতেও তার দিকে একবার তাকাল, তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। তাই দেখে মফিজুল আলম হা হা শব্দে হেসে উঠলেন।

‘আমাকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলে হবে? এই আমার বাহুতেই তো সারারাত কাটাতে হবে তোমাকে সুন্দরী।’

তিনি এগিয়ে গিয়ে রতির শরীরের একপাশ থেকে চাদর উঠিয়ে দেখলেন, রতি নিজেকে খিঁচে ধরে রেখেছে সে সময়। মনে মনে বার বার নিজের মৃত্যু চাচ্ছে আল্লাহর কাছে। এই বিষ মুহূর্ত গুলো সহ্য করার মতো সহ্যশক্তি তার নেই…
মফিজুল ঠোঁটের বিষাক্ত হাসি চওড়া করল। তারপর খুব আস্তে আস্তে রতির পেটের উপর চুমু এঁকে দিল, রতি মুচড়ে উঠে। ভাঙা, তেজহীন গলায় অনুরোধ করল, ‘আমাকে বিয়ে করুন। তাও অপবিত্র করবেন না। প্লীজ..’
‘তাই? এত অপবিত্র হবার ভয় যখন তাহলে চড় মারলি কেন?’
‘আ-আম-আর ভুল হয়ে গেছে। আর ক-কখ-নো হবে না। প্লী-ই-জ..’
‘তোকে বিয়ে করতে চাইছিলাম ভোগ করার জন্য। সেটা তো এখন এমনিই করতে পারছি তাহলে আর বিয়ের নাটক কেন?’
রতি জবাব দিতে পারল না। অসহায় চোখ জুড়ে মেঘের বর্ষণ। মফিজুল আলম চাদর দিয়ে রতিকে ঢেকে দিতে দিতে বললেন, ‘আগে খেয়ে নে। তারপর যা করার করব। দুর্বল শরীরে মজা নেই।’

উঁচু গলায় কাউকে ডাকতেই সেই মেয়েটি ঘরে ঢুকলো। মফিজুল আলম হিন্দিতে তাকে খাওয়ানোর আদেশ দিয়ে বের হয়ে সিগারেট টানতে গেলেন। মেয়েটি চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করতে লাগল।
একটা অন্নও রতির গলা দিয়ে নামতে চায় না। তবুও জোর করে গিলছে রতি। ক্ষুধার জ্বালা যে সবচেয়ে বড় জ্বালা। সব জ্বালা এড়িয়ে যাওয়া যায়, ক্ষুধাকে এড়ানো যায় না। কাঁদতে কাঁদতে কোনো রকমে খাচ্ছে রতি।

খাওয়া শেষ হলে মেয়েটি চলে যায়। মফিজুল আলম ঘরে আসেন। তারপর রতির দুই হাত বাধন মুক্ত করে দিলেন। পা বাধা অবস্থায় রইল। রতিকে ধরে ধরে উঠে বসালেন। গায়ের উপর থেকে চাদর সরিয়ে গাঢ় চোখে তাকালেন, যেন চোখ দ্বারাই গিলে খাবেন রতি কে। রতি হাত ছাড়া পেতেই মফিজুল আলমের পায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। পা দুটো ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কোনো কথাই স্পষ্ট তার মুখ দিয়ে বের হলো না। সে শুধু কাঁদছেই…

মফিজুল আলম প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। তিনি ঝাঁকি দিয়ে রতিকে সোজা করে বসালেন। ধমকে বললেন, ‘একদম চুপ.. একটা সাউন্ড হবে না। রোমান্টিকতার মাঝে এসব নাটক করবি না। আমার মেজাজ নষ্ট হয়।’
ধমকের চোটে রতির কান্না থামলেও ফোঁপানি রয়ে যায়। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোনোরকমে বলল, ‘আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। তাও আমাকে ছেড়ে দিন, প্লীজ।’
‘যা বলব তাই করবি?’
রতি মাথা কাত করল।
‘ঠিক আছে। দাঁড়া..’ বলে এক টানে লুঙ্গিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মফিজুল। রতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মফিজুল হইহই করে উঠলেন, ‘আরে, তাকা, এদিকে তাকা। কী আজব! তুই না বললি আমি যা বলব তাই করবি? এখন তাকা এদিকে। তুই কামার্ত চোখে তাকাবি। তোর কামার্ত চোখ দেখে আমার চোখও জ্বলে উঠবে। তারপর… বাকিটা মুখে বলব না। তাহলে মজা থাকবে না।’

রতির কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। একটা মানুষ এতটা নোংরা হতে পারে? এই জন্যেই বুঝি, একটা মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর, হয় সুইসাইড করে আর নয়তো একদম থমকে যায়। মানসিক ভাবে আনস্টেবেল হয়ে পড়ে। এই কারণেই হয়, এবার বুঝতে পারছে রতি। খবরের কাগজে, টিভিতে, ফেসবুকে, কত জায়গায় কত মেয়ের রেপ হওয়ার ঘটনা শুনেছে। কখনোবা শুনেও এড়িয়ে গেছে, কখনোবা একটু একটু ব্যথিত হয়েছে। কিন্তু কোনোদিন কল্পনাও করেনি, ওই ধর্ষিত মেয়েটার উপর দিয়ে কী পরিমাণ শারীরিক, মানসিক অত্যাচার ঝড়ের মতো গেছে!

মফিজুল আলম আচমকা রতির এক গালে ঠাস করে চড় মারলেন। পুরুষ মানুষের চড়, সে তো মোটেও নরম নয়! রতি ছিঁটকে দূরে সরে গেল। নিজেকে সামলাতে না সামলাতেই আরো কয়েকটা চড় মেরে বসলেন মফিজুল আলম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুইও এভাবেই মারছিলি না? কীরে এভাবেই মারছোস না? কেমন লাগে এখন? মজা লাগে?’

রতি মাথানিচু করে আছে। তার মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। উঁচু করার মতো শক্তিটুকু নেই। হঠাৎ, পিঠের মধ্যে ঘ্যাঁচ করে কিছু একটা গেল, রতি কেঁপে উঠল। পুরো শরীরে কিছু একটা ছুটে গেল। ভয়ার্ত চোখে পিছন ফিরতেই দেখলো, মফিজুল আলম ছুরি হাতে বসে আছেন, একদম স্বাভাবিক, নির্বিকার ভঙ্গিতে। রতির পিঠে আচড় মারা উনার জন্যে একদম স্বাভাবিক কান্ড যেন! পিঠের অনেকখানি চামড়া ছিঁড়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। ব্যথায় রতি শুয়ে পড়ল। অস্থির কণ্ঠে গোঙাতে লাগল।

মফিজুল আলম নির্বিকার চোখে কতক্ষণ দেখলেন, তারপর রতির শরীরের উপর নিজের শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলেন। রতির দম বন্ধ হয়ে এলো। রতির কানে কাছে নিজের মুখ নিয়ে, তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘জোরাজুরি পছন্দ না। নিজে থেকে সায় দে। নইলে এখন পিঠ কাটছি, এরপর আর কী কী কাটব, চিন্তাও করতে পারবি না।’
রতি স্তব্ধ হয়ে গেল এরপর পুরোপুরি। আর একটুও নড়লো না, একটুও না…

________
‘চারদিন হয়ে গেছে, আর আমাকে কেউ জানালো পর্যন্ত না!!’ চিৎকার করে উঠল আবির। আহ্নি ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে আবির স্বান্তনা দিল, ‘কেঁদো না। আমার পরিচিত একজন আছে ওই অফিসে। আমি তার মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছি। একদম চিন্তা করো না তুমি আহ্নি।’
‘আমাকে জানাবেন ভাইয়া, প্লীজ দ্রুত জানাবেন। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।’
‘শান্ত হও। সামলাও নিজেকে আর দোয়া করো। কিচ্ছু হবে না, ডোন্ট ওরি।’

আবির ফোন রেখে তৎক্ষনাৎ তার বন্ধু শামিমকে ফোন করল। শামিম সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। বলল, ‘বলিস কী! অথচ আমাদের উনি ম্যাসেজ দিয়েছে যে ঢাকায় ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে গেছে। অনেক ইমার্জেন্সি, ফ্যামিলি ম্যাটার। তাই উনি এই আউটডোরে থাকতে পারবেন না। উনাকে যেন ক্ষমা করা হয়। বস এই নিয়ে চিল্লাচিল্লিও করেছে কিন্তু বেশিকিছু বলেনি। আউটডোর শেষে উনাকে অফিসে ডেকে কিছু বলতে চেয়েছিল বস।’

‘তোর কাছে ম্যাসেজের স্ক্রিনশট আছে?’
‘আমার কাছে নাই। বসের কাছে চাইলে পাব। আমি দিচ্ছি ওয়েট..’

আট মিনিটের মাথায় ইমোতে স্ক্রিনশট পাঠালো শামিম। আবির বেশ কিছুক্ষণ সেই স্ক্রিনশটের দিকে চেয়ে রইল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু দেখল, এবং পরমুহূর্তেই চিন্তায় ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আহ্নিকে ফোন করে বলল, ‘রতি ভাবি ভয়ংকর বিপদে আছে আহ্নি, ভয়ংকর বিপদে।’

আরাফ রাতে খাওয়ার টেবিলে আহ্নির কথা জিজ্ঞেস করলে, দুপুর বলল, ‘আহ্নি আজ সারাদিন কিছু খায়নি। ও অনেক চিন্তায় আছে ভাইয়া। কান্নাকাটিও করছে কয়েক দফা।’
‘চিন্তা? কীসের চিন্তা? কী হইছে?’ আরাফের ভ্রু কুঁচকে গেল।
‘ইয়ে, মানে.. আমি অত ভালো করে জানি না। শুধু এইটুকু জানি, রতি ভাবি নাকি অফিসিয়াল কাজে বাহিরে গেছে। ঢাকার বাহিরে। কিন্তু এখন চারদিন যাবত উনার ফোন বন্ধ। কেউ উনাকে ট্রেস করতে পারছে না। এসব নিয়েই আহ্নি চিন্তায় মগ্ন।’

আরাফ তাচ্ছিল্যভরা হাসি ফুঁটালো ঠোঁটে। ডালের বাটি থেকে ডাল নিতে নিতে বলল, ‘ওকে বল টেনশন না করে চুপচাপ খেতে। এখান থেকে এক নাগর ধরে গেছে, ওখান থেকে আবার কোন নাগর ধরছে কে জানে।ঠিকই দুইদিন পর আসল ঘটনা বের হবে।’

দুপুর সন্তুষ্ট হলো না আরাফের কথায়। এই প্রথম রতির জন্য তার নিজেরও খুব টেনশন হচ্ছে।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি

#সম্পর্ক
#২১

আরও তিনদিন কেটে গেছে। রতির কোনো হদিস পায়নি আহ্নি, আবির। এমনকি রতির অফিসের বসও বিচলিত এই বিষয়টা নিয়ে। রতিকে সে নিজের মেয়ের মতোন দেখেছে। খুবই শান্ত, ভদ্র, নরম মেয়ে রতি। প্রথম দেখাতেই যে কেউ তাকে পছন্দ করবে, এমনই একটি মেয়ে রতি। আবিরের কথামতো মিসিং ডায়েরি করানো হয়েছে। রতির নাম্বার ট্রেস করে দেখা যায়, লাস্ট নাম্বারটা খোলা ছিল চাঁদপুরের একটি গ্রামে। সেখানে গিয়েও তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ, কিন্তু সন্দেহজনক কোনোকিছুই চোখে পড়েনি।

আহ্নির অবস্থা করুণ। সে দিনরাত সমানে কেঁদে যাচ্ছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে সাথে নফল নামাযও পড়ছে খুব। তার একটাই চাওয়া, রতি ভাবি জলদি ফিরে আসুক। রতি যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক!
এমন যখন এলোমেলো অবস্থা সবার, তখন একদিন আরাফের সাথে খুব বেশি ঝগড়া লাগলো আহ্নির। সেদিন আহ্নি দুপুরের পর পরই, যোহরের নামায পড়ে কোরআন শরিফ পড়ে, আবার নফল নামাযের জন্য দাঁড়িয়েছে। তখন আরাফ এসে আহ্নির রুমে হানা দিল। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আহ্নির নামায দেখতে লাগল। আহ্নি দুই রাকাত নামায শেষে মোনাজাত ধরল এবং কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার। কোনোরকমে মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শুনতে পেল, আরাফ বলছে, ‘এই জন্যে সেদিন আমার সাথে আসে নাই। আর তুই তো উল্টা তোর পেয়ারের ভাবির সাপোর্ট টেনে আমাকে কত্তকিছু শুনাইছিস! এখন দেখ। চোখ মেইল্লা দেখ। ভাগছে তোর ভাবি, আরেক নাগর ধইরা। আর তুই বেকুবের মতো বেহুদাই কান্নাকাটি করতেছোস!’

আহ্নি দাঁত দিয়ে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধটুকু আঁটকালো। তার অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, রতির ব্যাপারে একটা বাজে শব্দও যদি কেউ ব্যবহার করে, তবে তার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলার জন্য হাত ক্রমাগত নিশপিশ করতে থাকে। আর সেখানে আরাফ এই ধরনের কথা বলছে! আরাফ যদি তার চেয়ে বয়সে ছোট হতো, তবে এক্ষুনি জবাই দিয়ে ফেলতো।
আহ্নির মানসিক অবস্থাও খুব করুণ।

সে শক্ত কিন্তু ভঙ্গুর গলায় বলল, ‘ভাইয়া তোমার এসব ফালতু কথা শোনার মতো মুড নাই আমার।যাও।’
আরাফ তৎক্ষনাৎ এসে আহ্নির গালে চড় বসিয়ে দিল। কিড়মিড় করে বলল, ‘এখনো ত্যাড়ামি? ওই রতি তোর আপন? আমরা কেউ না? তো যা না… রতির কাছে গিয়ে থাক। এই বাসায় কেন আছিস?’
আহ্নির মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। নিজেকে শক্ত হাতে সামলাতে সামলাতে বলল, ‘ভাবির একবার খোঁজ পেলেই আমি চলে যাব। বলতে হবে না। আর তোমার হাত সামলে রাখো। আমি এখন ছোটো না যে যখন মন চায় মারবা। আমার শরীরও সরকারি না!! প্লীজ, যাও। মেজাজ খারাপ কইরো না।’
‘মগজ ছেঁছে ভর্তা বানিয়ে দিব। বেয়াদব!! সাহস কত এই মেয়ের। বড় ভাইয়ের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, সেটাও ভুলে গেছিস?’
‘সম্মান পেতে হলে সম্মান দিতে হয়। আমি ছোটো তাতে কী? আমারও সম্মান আছে! এই জিনিসটা আগে নিজের মাথায় ঢুকাও তারপর আইসো আমার মগজ ভর্তা করতে।’

জায়নামাজ রেখে ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, আরাফ আহ্নির দুই গাল টিপ দিয়ে ধরল। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল আহ্নি।

‘এই জানোয়ার, এতদিন তোর সব ত্যাড়ামি সহ্য করছি। এর মানে কী সবসময় পার পেয়ে যাবি? রতি আমাদের কে? কে আমাদের ও? আমাকে ফেলে চলে গেছে, আমি বেহায়ার মতো ফিরিয়ে আনতে গেছিলাম, আসে নাই। কারণ তার তো এক ভাতার দিয়ে হয় না, চৌদ্দ টা লাগে। আর তুই কীনা ওরকম একটা মা**র জন্য আমার সাথে গলা বাড়াস?’

আহ্নির মাথায় এইবার জিদ চেপে গেল। রাগলে মানুষের সেন্স ঠিক থাকে না। আর শরীরেও অসুরের শক্তি চলে আসে যেন। আহ্নি তীব্র ধাক্কায় আরাফকে নিজের থেকে সরিয়ে নিল। তার চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। কী লাল! নাকের পাঠা ফুলে গেছে। গাল দুটোও ফোলা। সে কাঁপছে, ফোঁসফোঁস শব্দে শ্বাস ফেলছে। দেখলে মনে হবে, এটা আহ্নি না, কোনো নাগিনী বোধহয়! তার শিকারকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আরাফ ভড়কে গেল। সে বিস্ময় নিয়ে আহ্নির দিকে তাকিয়ে আছে।

আহ্নি ফোঁসফোঁস করে বলল, ‘আর একটা বাজে কথা বললে, আমি যে কী করব,আমি নিজেও জানি না। তুমি আমার ভাই? মাই ফুট!! আই হেইট ইউ… তোমার মতো খারাপের কাছে আমার রতি ভাবি কেন, পৃথিবীর কোনো মেয়ে এসে থাকবে না। তোমাকে কোনোদিন কেউ ভালোবাসবে না, কেউ না। তুমি লাকি ছিলে যে আমার ভাবির মতো কেউ এসেছিল তোমার জীবনে। বাট আনফরচুনেটলি, ইউ লুজ হার.. নাও জাস্ট গেট আউট এন্ড নেভার কাম ইন মাই রুম। তুমি আমার ভাই না। তুমি আমার কেউ না। আই জাস্ট হেইট ইউ… গো, আই সেইড গো…’

আহ্নি সশব্দে কেঁদে উঠল। আরাফ পুরোপুরি ভড়কে গেছে। আহ্নির এই রূপে সে চেনে না, ঘাবড়ে দিয়েছে তাকে। আরাফ পরিস্থিতি সামলাতে চুপচাপ রাগ নিয়ে ঘর ছাড়ে। যাওয়ার সময় দরজায় লাথি মেরে চলে গেল। আহ্নি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে। দুই হাত দিয়ে শক্ত মেঝে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেও পারল না। সে কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে রতির উদ্দেশ্যে স্বগতোক্তি করল, ‘কই তুমি ভাবি, কই তুমি… তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য ভাবি। তুমি ছাড়া আমার সব পুড়ে যাচ্ছে ভাবি। আই মিস ইউ। আই নিড ইউর আর্ম টু স্টে কাম.. প্লীজ দ্রুত আমার কাছে এসো ভাবি। আমি, আমি অপেক্ষা করছি।’

আহ্নির কান্নার দৃশ্য বড় করুণ। একটি মেয়ে, তার পিতা-মাতার জন্য না, তার ভালোবাসার জন্যেও না, তার ভাই-বোনের জন্যেও না, কোথাকার কোন আরেকটি মেয়ে রতি, তার জন্য হাউমাউ করে কাঁদছে। তাহলে বুঝুন, আহ্নির ঠিক কোন জায়গায় রতির বসবাস?

দুপুর হন্যপায়ে রুমে এসে ঢুকল এবং চমকে গেল। আহ্নির কাছে গিয়ে ঝুঁকে বসল। বলতে লাগল, ‘এই আহ্নি, প্লীজ কান্না থামা বোন। ভাবি চলে আসবে। ঠিক খোঁজ পাবি। কান্না থামা… শশশশ! চুপ চুপ, আহ্নি ভালো মেয়ে,আর ভালো মেয়েরা কান্না করে না।’

‘আহ্নি ভালো মেয়ে আর ভালো মেয়েরা কান্না করে না’ বাক্যটি ছোটো বেলায় আহ্নির জন্য বলতো দুপুর, যখন আহ্নি হাপুস নয়নে কাঁদতো। মা বকলে, বাবা চকলেট কিনে না দিলে, বড় ভাই চুল টানলে, ছোটো ভাই চিপসের প্যাকেট কেড়ে নিলে, ছোট্ট আহ্নি এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদতো। তখন দুপুর এগিয়ে আসতো। আহ্নিকে কোলে তুলে নিতো। কার্টুন দেখিয়ে, মুরগী দেখিয়ে, গাড়ি দেখিয়ে, অথবা চলন্ত উড়োজাহাজ দেখিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করতো, আর বার বার বলতো, ‘আহ্নি ভালো মেয়ে আর ভালো মেয়েরা কান্না করে না’ ব্যস, তখন আহ্নির কান্না থেমে যেত। ওই টুকুন ছোট্ট মেয়েটা তখন থেকেই নিজের নামের পাশে ‘ভালো মেয়ে’ উপাধি পেতে চাইতো।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালি বিকেল গুলো! কমলা দুপুরে কত না দু’জনে একসাথে গোসল করতে গিয়ে লাফালাফি করে কত বালতি ভেঙে ফেলেছিল! বৃষ্টি আসলে দুই বাঁদরে দৌড়ে চলে যেত ভিজতে। তারপর দু’জনেই ভাগাভাগি করে মায়ের বকুনি শুনতো। আহা! একটুখানিতে সুখ কুড়িয়ে নেওয়া দিনগুলো আজ কোথায়! কোথায়?
চোখের পাতায় ভেসে উঠে প্রতিটি দৃশ্য।
চোখ ভিজে যায় দুপুরের। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় পেছনে ফেলে আসা এক সুন্দর অতীতে। যখন বাস্তবে ফিরলো, বুঝতে পারল আহ্নি দৃঢ় হাতে দুপুরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। দুপুরের চোখের কোল ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়া, এবার আর কেউ ঠেকাতে পারল না। সে হু হু করে মৃদু শব্দে কেঁদে ফেলল।

কাঁদুক দুই বোন, কেঁদেকেটে শান্ত হোক। এই চোখের পানি দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব মুছে দিক, দূর করে দিক সমস্ত সমস্যা…
দু’জনকে আবার এক সুতোয় বেঁধে ফেলুক!

একসময় দু’জনের কান্না কমে আসে। আহ্নি দুপুরের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রেখে বলল, ‘আমার এই বাসায় থাকতে আর ভালো লাগে না আপা।’
‘কই যাবি?’ চোখ জোড়া মুছতে মুছতে প্রশ্ন করে দুপুর।
‘একটা জায়গা আছে। চাইলে যাওয়া যায়, কিন্তু আমি লজ্জায় বলতে পারছি না তাকে। সে এমনিতেই কত কী করেছে! এখনো করছে। তার উপর আবার আমার কথা কেমনে বলি?’
‘তুই কার কথা বলছিস বল তো।’
‘আবির ভাইয়া।’

দুপুর দুই সেকেন্ড থমকালো। কতদিন কথা হয় না আবিরের সাথে! আবিরকে ইদানীং খুব মনে পড়ে দুপুরের। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা যেদিন দুপুর বঁধু বেশে লাজুক লাজুক চেহারায়, ঘোমটার তল থেকে তৃষ্ণিত নয়নে তিনবার উচ্চারণ করেছিল একটি শব্দ, ‘কবুল’। এরপর আবিরের কী খুশি! বাসর রাত যেদিন, সেদিন সারারাত আবিরের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছিল দুপুর। আবির তো একবার নেচে নেচেই বলছিল, ‘তুমি আমার বউ! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না দুপুর। উফ আল্লাহ, এই অভাগাকে দ্রুত দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। এত সুন্দর বউ রেখে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকতে কার ইচ্ছে করে?’
সেদিন মন মিটিয়ে হাসিতে মেতেছিল দুপুর। এখন সেই দিনগুলি শুধুই স্বপ্নে এসে হানা দেয়। বাস্তবতা পাল্টে গেছে!

দুপুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলল, ‘তুই তার বাসায় গিয়ে থাকবি?’
‘আর কোনো জায়গা আছে আপাতত? আর এই বাসায় থেকে ভাইয়ার খোঁচা মার্কা কথা শুনতে পারব না। মা-ও তো কম যায় না। ভাইয়ার কথা তাল দেয়।’
‘ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারলেও মা’কে বলতে পারব না। জানিসই তো, এখন আমার সহ্য কর‍তে পারে না সে। তার মতে, আমার কারণে সে অনেক টাকা লস করল!’
‘ভাইয়াকে বললেও সে শুনবে বলে তোমার মনে হয় আপা?’
দুপুর এক সেকেন্ডে জবাব দেয়, ‘না।’
‘তো? আমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই আপা। আমি নিজেই ভাবিকে খুঁজতে চাই। এসব পুলিশের আশায় বসে থাকলে কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু না। আর এই বাসায় থেকে এগুলো সম্ভব না।’
‘হুম, তাহলে তুই বল আবিরকে। সে নিশ্চয়ই তোকে মানা করবে না।’
‘জানি কিন্তু লজ্জা লাগছে। বলতে পারছি না। জড়তা কাজ করে।’

দুপুর একটু সময় কী যেন ভাবল। তারপর আহ্নিকে চমকে দিয়ে বলল, ‘আমি বলি? বুঝিয়ে বলব।’
আহ্নি চোখ গোল গোল করে বলল, ‘তুমি বলবে?’
দুপুর অপ্রস্তুত, ‘হুঁ, তুই চাইলে।’
আহ্নির ঠোঁটে হাসি উঁকি দিল, ‘আচ্ছা বলো। আমার আপত্তি নেই তো। দাঁড়াও, আমার ফোন দিয়ে কল দিয়ে দিই।’

আহ্নি আবিরকে ইমোতে অডিও কল দেয়। কয়েকবার রিং হলে আবির ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, আহ্নি, বলো।’
দুপুর অস্বস্তিতে কাটাকাটা হয়ে উঠল। শরীর শিরশির করছে কেমন যেন! মনে হচ্ছে কেউ চিপা দিয়ে ধরছে গলা, আওয়াজ বের হচ্ছে না।
অনেক কষ্টে কয়টা শব্দ উচ্চারণ করতে পারল দুপুর, ‘আ-আমি, আমি দু-পু-র।’

__________
একসময়ের রূপ লাবণ্যে ভরা রতির শরীর, আজ প্রায় মৃত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাদিন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে সে। না ভাগ্যের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই, না আছে বিধাতার উপর। তার মনে হয়, জীবনে এমন কোনো পাপ করেছিল, যেটার বিনিময়ে এই শাস্তিটুকু তার পাওনা ছিল, তাই পাচ্ছে। পাওয়া শেষ হলে মরে যাবে। নিশ্চয়ই কবরটা হবে তার জন্য সুখের এবং শান্তির।
রতিকে এখন যে বিছানায় রাখা হয়েছে, সেটির বাম সাইড জুড়ে বড় জানালা। রতির ইচ্ছে করে একবার জানালার পাশে গিয়ে বসতে। একটু চেঁচাতে, যদি কেউ বাঁচাতে আসে! কিন্তু শরীরের জোর বা মনের সাহস কোনোটাই নেই। যে মেয়েটির তত্ত্বাবধানে রতিকে রেখেছে মফিজুল, সেই মেয়েটিও প্রচুর শয়তান। একটু উনিশ বিশ হলেই রতিকে চড় দেয়। মফিজুল রতির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিয়েছে। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত। জ্বলে খুব। রতি নীরবে সবটা সহ্য করে যায়।
ঠোঁট নাড়িয়ে ‘উহ’ শব্দ করার মতো শক্তিটাও তার নেই।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফর্সা আকাশটাকে দেখে রতি, মন ভরে দেখে। কবে মারা যায় কে জানে! এরপর তো এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হবে না। পৃথিবী সুন্দর, শুধু সুন্দর না এই পৃথিবীর মানুষ গুলো।কিছু কিছু মানুষের জন্যেই পৃথিবী নোংরা উপাধি পায়। আকাশের বুকে ভেসে উঠে তিনটি মুখ, একটি আরাফের — সে কী কখনো জানবে রতি ঠিক কতটা কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে?
একটি আবিরের — যে তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ যন্ত্রণার জীবনে পরিণত হয়েছে।
আর একটি আহ্নির — এই মেয়েটি তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল প্রতি মুহূর্তে। এই মেয়েটির প্রতি তার অনেক কৃতজ্ঞতা। এই মেয়েটিকে সে কোনোদিন ভুলবে না।

রতির চোখের কোণ দিয়ে ঠান্ডা জল গড়িয়ে যায়। রতি অপলক চেয়ে থাকে আকাশে ভাসা আহ্নির মুখটির দিকে। ঠোঁট দুটো খুব অল্প নড়ে উঠে, বেরিয়ে আসে নামটি, ‘আহ্নি… আহ্নি।’
রতি প্রশ্ন করে মনে মনে, ‘কেমন আছো আহ্নি? তোমার সাথে তোমার ভালোবাসার মিল কী হয়েছে? আমি একটুও ভালো নেই আহ্নি। আফসোস থেকে যাবে, মৃত্যুর আগে একবার কেন তোমার মুখটা দেখে যেতে পারবো না!’
রতি কাঁদে, নিঃশব্দে, লুকিয়ে, খুব গোপনে কাঁদে। তার কান্না দেখে উজ্জ্বল আকাশ মুখ লুকিয়ে নেয় মেঘের আড়ালে। মেঘরা গর্জন করে জানান দেয়, এই রতি, তোর কষ্ট আমাদের সহ্য হচ্ছে না রে। রতির চোখের পানি বাড়ে, ঠিক তখন মেঘ চিঁড়ে নেমে আসে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি মন খারাপের বৃষ্টি, এই বৃষ্টি রতির কান্না…
কেউ কী বুঝবে?
রতির কষ্ট দেখে ঘরের দেয়ালগুলোও গুমরে উঠে যেন!
ভাগ্যিস, ওদের জীবন নেই!

________
মিলা বলল, ‘স্যার, এমনে কতদিন?’
মফিজুল আলম জুতার ফিতা বাধতে বাধতে জবাব দেয়, ‘মরলে শেষ।’
‘উনার হাত-পা খুইলা দেওন যায় না? ঘর নষ্ট করে। আমার পরিষ্কার করতে ঘিন করে।’
‘তোরে টাকা দেই কী জন্যে? হ? যেইটা কাম সেইটা কর আর চুপ থাক।’
মিলা ঠোঁট বাঁকালো, ‘পারুম না। বেশি তেজ দেহাইবেন না। বাইরাইয়া যামু।’
মফিজুল দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ চাপে। এই মেয়ে দুনিয়ার ত্যাঁদড়। এই টারে ভাড়া করা একদম ঠিক হয় নাই। কথায় কথায় ব্ল্যাক মেইল!!
মফিজুল আলম কিড়মিড় করে বললেন, ‘পয়সা বাড়ায় দিমুনি। হইছে?’
হৃষ্টচিত্তে টুলে গিয়ে বসল মিলা।
মফিজুল বেরিয়ে পড়লেন। সে নিজেও একটু চিন্তায় আছেন। যেই ফ্ল্যাটে রতিকে নিয়ে থাকছেন, এটি বনানীতে অবস্থিত। ফ্ল্যাটের অন্যরা মিলাকে তার স্ত্রী হিসেবে জানেন। আর রতি যে আছে, সেটি কেউ জানেন না। খুব সাবধানে থাকে মফিজুল তবুও ভয় হয় সবসময়। রতিকে ভারত নিয়ে এসেছে, এটি বলেছে যাতে রতি আরও ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যায়, চুপচাপ থাকে। কোনো ধরনের ঝামেলা করার চেষ্টা না করে। কিন্তু কতদিন বাঁচতে পারবে এভাবে?
রতির দেহে অবশিষ্ট কিছু নেই… মফিজুল আলম চাইলেই রতিকে মেরে গায়েব করে দিতে পারে।এর আগেও তো কতজন কে এভাবেই সরিয়েছে। কেউ বোঝেনি!
আগের দুই স্ত্রী যদি সময় সুযোগ থাকতে তাকে না ছেড়ে চলে যেতো, তাহলে ওদের অবস্থাও এই রকমই হতো বোধহয়।
আসলে মানুষ কে অত্যাচার করতে মফিজুল আলমের খুব ভালো লাগে। একটা পর্ণ ওয়েবসাইটে এরকম কিছু ভিডিও দেখেছিল সে বাহিরের দেশের। তারপর নিজেরও ইচ্ছে জাগলো। এখন আস্তে আস্তে এটা নেশায় পরিণত হয়েছে।

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই অফিসে ঢুকলেন মফিজুল। তিনি প্রতিদিন অফিস করছেন যাতে কেউ তার প্রতি কোনো প্রকার সন্দেহ না করতে পারে।
মফিজুল আহ্নির পাশ কাটিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। আহ্নি তখন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। লিজা নামের যে মেয়েটা রতির ক্লোজ কলিগ, সে বলেছে মফিজুল আলম নাকি রতি কে অনেকদিন যাবত ডিস্টার্ব করতো। মফিজুল আলমেরও আউটডোরে যাবার কথা ছিল কিন্তু কোনো কারণ বশত উনি যায়নি। অসুস্থতার কথা বলে ঢাকায় রয়ে গেছে।

গতকাল আবিরের সাথে কথা বলে দুপুর। আহ্নিকে আবিরদের বাসায় কয়টা দিন থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আবির দুপুরের সাথে তেমন ভালোমতো কথা বলেনি। কোনোরকমে হু, হা, করে শেষ করেছে। এরপর সন্ধ্যা বেলায় কিছু জামাকাপড় সহ আবিরদের বাসায় হাজির হয় দুপুর। শিমির সাথে রুম শেয়ার করে। আজকে সকাল হলেই প্রান্তকে নিয়ে রতির অফিসে চলে আসে সে। আসার পর লিজার সাথে দেখা হলো, আর কথাটি জানতে পারল। কেন যেন আহ্নির মন বলছে, এই মফিজুল আলম “সামথিং ফিশি” টাইপ মানুষ।
আহ্নির মাথায় চট করে একটা প্রশ্ন জাগলো, ‘এই লোক রতির গায়েব হওয়ার পেছনে নেই তো?’
আহ্নির চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। মফিজুল আলম মোটেও আহ্নিকে খেয়াল করল না। সে কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছে। সে আহ্নিকে চেনেও না।

আহ্নি প্রান্ত আর লিজাকে নিয়ে অফিস রুমের বাইরে রিসিপশনে এসে দাঁড়াল। আহ্নি বলল, ‘মফিজুল আলমের ব্যাপারে আমাকে কিছু বলো না লিজাপু।’
‘তেমন কিছু আমিও জানি না আহ্নি। রতিকে ইনিয়েবিনিয়ে বেশ কয়েকবার প্রেমের কথা বলেছিল। এমনকি বিয়ে করতে প্রস্তুত এমন কথাও বলে। কিন্তু রতি কোনো ইন্টারেস্ট দেখায়নি। কেনই বা দেখাবে? এই লোকের বয়স দেখছো? তার উপর আগে আরও দুইটা বিয়ে করছিল।’
‘দুইটা বিয়ে? সেও বউরা কী এখনো আছে?’
‘উঁহু, নাই। শুনেছি দুটোই ডিভোর্স।’
‘তার বউদের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় আছে আপু? তুমি না পারলেও তার ওয়াইফরা নিশ্চয়ই জানবে এই দামড়া ব্যাটা কেমন লোক।’
‘প্রথম বউয়ের ব্যাপারে, আমি কিছুই জানি না। তবে সেকেন্ড ওয়াইফের ফোন নম্বরটা দিতে পারি। আমাদের এখানে জব করার জন্য তার সিভি জমা দিয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু মফিজুল আলম করতে দেননি। সেই সিভি খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।’
আহ্নি অনুনয় করে বলল, ‘প্লীজ আপু, একটু খুঁজে দাও।’
‘এভাবে বোলো না আহ্নি। রতিকে খোঁজার জন্য আমিও হেল্প করতে চাই তোমার। ও আমার খুব ভালো বান্ধবী ছিল।’
আহ্নি হাসিমুখে বলল, ‘থ্যাংকিউ।’

বিকেলের দিকে লিজাপু আহ্নির নাম্বারে ম্যাসেজ করল, মফিজুলের সেকেন্ড ওয়াইফের নম্বরটা। মেয়েটার নাম নুসরাত। লিজাপু বললেন, ‘সিভিটা অনেক আগের। নাম্বারটা এখনো অন কীনা জানি না।প্রে করছি, যেন অন থাকে।’
আহ্নি ডায়াল করলো নাম্বারটায়। মনে মনে প্রার্থনা করল, যেন খোলা থাকে। আল্লাহ ওর প্রার্থনা শুনলেন, দুই বার রিং হতেই একটি মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি
*আজকের পর্বটি লিখে আমি খুব স্যাটিসফাইড😊।
রিচেক করা হয়নি। বানান ভুল থাকতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here