#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৫
#সুমাইয়া_আফরিন
অনু লারাকে জানালো ফিরে এসে সবটা খুলে বলবে সে। অনু লারার স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অনুর চোখ দুটো মেসেজগুলো দেখার জন্য কাতরাচ্ছে। প্রায় এক ঘন্টা স্কুটি চালিয়ে পৌছে গেল সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে। স্কুটি থামিয়ে অনু দৌড়ে চলে গেল সিড়ির কাছে। অনুর মামার বাড়ি তিনতালায়। অনু বড় বড় পা ফেলে তার মামার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কলিং বেল বাজাতেই অনুর মামি এসে দরজা খুলে দিল।
অনুর মামি জাহানারা আক্তার অনুকে দেখে খুশিতে উত্তেজিত হয়ে গেলেন। অনুকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন তিনি। চোখের কার্ণিশ বেয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ল তার। খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেছেন তিনি। অনুও তার মামিকে দেখে ভীষন খুশি হয়েছে। এক অজানা প্রশান্তি খুজে পাচ্ছে তার মামির সাথে দেখা করে।
অনুর কন্ঠস্বর পেয়ে অনুর মামাতো ভাই বোন হাসান আর হৃদি দৌড়ে আসে অনুর কাছে। হৃদি শক্ত করে অনুকে জড়িয়ে ধরে। হাসানও প্রচন্ড খুশি হয় অনুকে দেখে। ছোট বেলা থেকেই এই বোনই তো তাদের সব খেয়াল রেখেছে। অনুর মামি এক অদ্ভুত চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার কারনে তার ছেলে মেয়েদের বেশি খেয়াল রাখতে পারেননি তিনি।
হৃদির যখন চার বছর বয়স তখনই তার মা তার কাছে থেকে দূরে চলে গেছেন। অনুর মামা নিজের ব্যবসায়িক কাজে অনেক ব্যস্ত থাকতেন যার কারনে ঠিক মতো খেয়াল রাখতে পারতেন না নিজের ছেলে মেয়েদের। তখন অনুই সব দায়িত্ব নিয়েছিল হাসান ও হৃদির। হৃদি ও হাসানের খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে রাখতো অনু। হাসান তখন চতুর্থ শ্রেনিতে পড়তো তাই অনুকে হাসানের পড়া শোনার দিকটাও দেখতে হয়েছিল।
জাহানারা আক্তার শিক্ষিত হওয়ায় হাসানের কোনো প্রাইভেট টিউটোর দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু জাহানারা আক্তারের অসুস্থতার জন্য হাসানের পড়াশোনার ক্ষতি হতে থাকে। যার কারনে অনুকেই হাসানের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হয়। একজন মা তার সন্তানের প্রথম টিউটর হয় আর দ্বিতীয় টিউটর হয় শিক্ষক। কিন্তু হাসানের দ্বিতীয় শিক্ষক অনু যা সবসময় হাসান মেনে এসেছে।
অনুর মামি বর্তমানে অনেকটা সুস্থ। অনুকে টেনে এনে ঘরে বসিয়ে তার পাশে বসে পড়েন তিনি। হাসান আর হৃদিও অনুর সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। জাহানারা অনুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে রেখেছে। অনুর ঠোটের কোণে মিষ্টি হাসি বিরাজ করছে। অনু মামি হৃদিকে ফ্রিজ থেকে একটু পায়েস আনতে বললেন অনুর জন্য। অনু মাথা ডান আর বাম দিকে নাড়িয়ে বলল,
‘না না আমি পায়েস খাবো না। আমি না খেয়ে চলে এসেছি। আমাকে এখন খেতে দাও।’
অনুর মামির মাথায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
‘তাহলে তুই আমাকে একটু জানিয়ে আসবি না! সবসময় দুইটা রুটি আমি বেশি বানাই কিন্তু আজকে তোর মামা দুইটা রুটি বেশি খেয়ে চলে গেছেন। তাই তরকারি আছে কিন্তু রুটি নেই।’
অনুর মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল। রাতে না খাওয়ার কারনে অনুর পেটের ভেতর ইদুর গুলো বক্সিং খেলা শুরু করে দিয়েছে । অনু কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘মামি আমার খুব খিদে পেয়েছে কিছু একটা করো না প্লিজ।’
অনুর এমন বেগতিক অবস্থা দেখে হাসান নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল,
‘আপু তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমার জন্য পাশের হোটেল থেকে পরোটা আর ডাল নিয়ে আসছি। জাস্ট গিভ মি টু মিনিটস।’
হাসান দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হাসানের কথায় জাহানারা বেগম যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মুখে ফিছেল হাসি দিয়ে বললেন,
‘এই পাগলি তুই না খেয়ে চলে এসেছিস কেন রে?’
অনু এত কিছুর আকস্মিকতায় ভুলেই গেছিলো যে সে এখানে কেন এসেছিল। অনু হন্তদন্ত হয়ে তার মামিকে জিজ্ঞাসা করল,
‘আচ্ছা মামি,ওই সিমটা কোথায়?’
অনুর মামি অনুর এমন প্রশ্নে অনেকটা অবাক হলেন। অনু ঠিক কোন সিমের কথা বলছে তা বুঝতে পারছে না সে। তাই জিজ্ঞাসু চক্ষুতে অনুকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কোন সিম?’
অনু জাহানারা আক্তারের প্রশ্নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ব্যকুল কন্ঠে বলে উঠল,
‘ওই সিমটা যেটা মামা আমাকে প্রথমে কিনে দিয়েছিল। ভালো করে মনে করে দেখো মামি,মামা প্রথমে আমাকে একটা বাটন ফোন কিনে দেয়। আর সেই সাথে একটা গ্রামিন ফোন সিমও কিনে দিয়েছিল। মনে পড়েছে তোমার।’
অনের মামি কিছুক্ষন চুপ থেকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হঠাৎ চোখ মুখ বড় বড় করে তিনি বললেন,
‘যেই নাম্বারে তুই রাফাতকে ফোন করেছিলি ওই নাম্বারটার কথা বলছিস।’
অনুর চোখ মুখ উজ্জলিত হয়ে ওঠে। মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে অনু সম্মতি জানায়। অনুর মামি হতাশ হয়ে বললেন,
‘ওই সিম তো হৃদি ভেঙে ফেলেছে। ওকে বলেছিলাম সিম টা পড়ে আছে বেকার বেকার তাই আমার ফোনে ঢুকিয়ে দিতে। ও ঢুকাতে গিয়ে ফট করে ভেঙে ফেলেছে।’
অনু তার মামির কথায় আৎকে ওঠে। এক রাশ বিষন্নতা গ্রাস করে ফেলে তাকে। হৃদি অনুর কোল ঘেষে বলে ওঠে,
‘সরি আপি।’
অনু মুখে জোড় পূর্বক হাসি এনে হৃদিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ইট’স ওকে আমার পুচকি সিস্টার।’
অনু হৃদির হালকা করে নাক টিপে দেয়। অনু দিষ্টুমি হাসিতে মেতে ওঠে। কিন্তু অনুর মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। এখন কি করে দেখবে সেই মেসেজগুলো?
আচমকা হাসান লাফাতে লাফাতে এসে অনুর সামনে পরোটা আর ডাল রেখে দিল। অনু আয়েস করে খেয়ে তৃপ্তির হাসি দিল। খাবার খেয়েই যেন অনুর মাথায় যেন বুদ্ধি খেলে গেল।মাথায় টোকা মেরে নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এই বুদ্ধিটা তোর মাথায় আগে কেন আসেনি অনু।’
অনু উল্লাসে মেতে উঠল। যেন পৃথিবী জয় করে ফেলেছে সে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল তার কাঙ্ক্ষিত কাজের জন্য। বেরিয়ে পড়ার সময় অনু তার মামার কাছে ফোন দিয়ে জেনে নিল সিম কম্পানিটা কোথায়। অনুর মামা যে ঠিকানা দেয় অনুকে সেই ঠিকানা অনুযায়ী পৌছে যায় সেখানে। অনুর কম্পানিতে গিয়ে সিমটি রিভিউ করে নেয়। সিম হাতে পেতেই অনু কম্পানি থেকে বেরিয়ে পড়ে। স্কুটি যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত চালিয়ে আবার নিজের মামার বাড়ি চলে যায় সে।
মামার বাড়িতে ঢুকেই অনু হাপাতে শুরু করে।বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কম্পানিতে সিমটা রিভিউ করতে অনেক সময় লেগে গেছে তার। এখন প্রায় ১২ টার মতো বাজে। অনুর কপালে ও নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অনুর মামি দৌড়ে এসে অনুকে ফ্যানের তলে বসালেন। অনু রিল্যাক্স হয়ে কিছুক্ষন বসে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল।অনুর মাথায় তীব্র যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে।
অনু নিজেকে ধাতস্থ করে হৃদিকে বলল একটা পিন নিয়ে আসতে। হৃদি এক দৌড়ে গেল আর এক দৌড়ে চলে আসলো। অনু পিন নিয়ে নিজের ফোনের সিম পকেট বের করে তার মধ্যে নতুন সিমটা ভরে দিল। সিমে ব্লক করা রাফাতের নাম্বারে খুজে বের করল সে। নাম্বারে ক্লিক করতেই থমকে গেল সে।
অনুর হৃদয় অদ্ভুতভাবে কম্পিত হচ্ছে। যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অনুর নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুক্ষন সময় লেগে গেল। জাহানারা আক্তার অস্ফুট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। অনুর এমন অবস্থা দেখে একটু ভড়কে গেলেন তিনি। অনুর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কি হয়েছে মা?তোকে এমন লাগছে কেন?’
অনু ছলছল চোখে দৃষ্টিপাত করল তার মামির দিকে। শুকনো ঢক গিলে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘এক গ্লাস পানি হবে মামি?’
জাহানারা আক্তার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অনুর দিকে। অনু এভাবে কেন বলছে তা জাহানারা আক্তারর নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে কিছুতেই ঢুকছে না। জাহানারা আক্তার কোনো কথা না বলে অনুর জন্য পানি আনতে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালেন। অনু আবার রাফাতের মেসেজগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করল। চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার। রাফাতের মেসেজগুলোতে হৃদয় ফেটে যাচ্ছে তার।
রাফাতের প্রথম মেসেজ,
‘অনু আই এ্যাম সরি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমাকে।’
‘অনু আমি জানতাম না যে বাবা তোমার সাথে এত জঘন্য একটা অপরাধ করেছে। প্লিজ অনু রিপ্লাই মি,, প্লিজ প্লিজ।’
‘অনু আমি না বুঝে তোমাকে কথাগুলো বলে ফেলেছি,,, আর কখনো তোমার সাথে এমন বিহেভ করবো না,,, প্লিজ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।’
‘অনু আমার বাবা তোমার সাথে যা করেছে তুমি সবটা কি করে মেনে নিলে?তোমার উচিত ছিল আমার বাবাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। অনু তুমি যদি এমন কোনো স্টেপ নাও তাহলে সবসময় পাশে পাবে আমাকে। এটা আমি তোমাকে প্রমিস দিলাম।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। রাগ করো আমার উপর বাট কথা তো বলো প্লিজ। তুমি এভাবে কেন রাগ করে আছো? অনু তুমি তো আমার লিগেল ওয়াইফ সো তোমার তো এখানে আসা উচিত। আমার বাবাকে যদি শাস্তি দিতে না চাও তাহলে চুক্তি অনুসারে সংসার তো করবে তাই না। অনু ফোন ধরছো না কেন তুমি? ফোনটা ধরো প্লিজ।’
‘অনু ট্রাই টু আন্ডারস্যান্ড। তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাই। গড সেক ফনটা ধরো প্লিজ।’
আর কোনো মেসেজ অনু পড়তে পারলো না। প্রায় দুইশোটার মতো মেসেজ দিয়েছে রাফাত। অসংখ্য ফোন কলস আর মেসেজে ভরে আছে রাফাতের নাম্বারটা। অনুর নিজের উপর রাগ হতে লাগলো রাফাতের সাথে করা খারাপ ব্যাবহারগুলোর জন্য। সে তো সাহায্য করতে চেয়েছিল অনুকে কিন্তু অনুই তো সুযোগ দেয়নি তাকে। সে তো সংসার করতে চেয়েছিল তার সাথে কিন্তু অনুই তো করেনি। দ্বিতীয় সুযোগ চেয়েছিল তার কাছে কিন্তু সেই তো দেয়নি সুযোগ।
হতাশা আর নিজের প্রতি এক রাশ অভিমান গ্রাস করে নিতে থাকল অনুকে। অনুর নিশ্বাস ধীরে ধীরে ঘন হতে থাকল। আচমকা জাহানারা আক্তার পানির গ্লাস সামনে ধরতেই ঘোর কাটে তার। পানি গ্লাস হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে শেষ করে ফেলল সে। হাতে ব্যাগ নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল সে। জাহানারা আক্তার অনুকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করল কিন্তু অনু কারো অনুরোধ কর্নগোচর করল না।
হনহন করে বেরিয়ে গেল তার মামার বাড়ি থেকে। অনুর মামি নির্বিঘ্ন চক্ষুতে তাকিয়ে রইলেন অনুর যাওয়ার দিকে। অনু স্কুটি দ্রুত চালিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মাথার মধ্যে এখন একটাই চিন্তা তার, কি করে রাফাতের সাথে যোগাযোগ করবে সে। কারন রাফাতের নাম্বার বা বাড়ির ঠিকানা কোনোটাই অনুর কাছে নেই। এতক্ষনে হয়তো রাফাত তার বোনকে অন্য হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। হাসপাতালের কথা মাথায় আসতেই অনুর মনে পড়ল ফ্রমে রাফাত বা রাফাতের ফ্যামিলির কারো নাম্বার আছে। অনু স্কুটি ঘুরিয়ে হাসপতালের দিকে অগ্রসর হলো।
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৬
#সুমাইয়া_আফরিন
স্কুটি নিয়ে হসপিটালে পৌছে গেল অনু। যেখানে ফ্রম জমা দিতে হয় সেখানে গিয়ে স্নেহার ফ্রমটি চাইলো সে। প্রায় পাঁচমিনিট পর অনু হাতে পেল সেই ফ্রমটি। ফ্রমটি দেখেই অনু উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠল। অনুর চিৎকার যেন আশে পাশের মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তারা অনুর দিকে। অনু সবার তাকানোর ভঙ্গিকে উক্ষেপ করে আবার ফ্রমটিতে নজর দিল। সৌভাগ্যবশত রাফতই ফ্রমটা পুরন করেছিল। আর যেহেতু ফ্রমটি রাফাত পুরন করেছে সেহেতু ফ্রমটিতে রাফাতের নাম্বারই দেওয়া আছে।
অনু রাফাতের নাম্বারটা সেভ করার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। ফোন অন করতেই চমকে গেল সে। মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার উপর। ৫৫ টা ফোন দিয়েছে ইরা, লারা আর মিমি।অনু তাড়াতাড়ি করে নাম্বারটি সেভ করে নিল নিজের ফোনে। ফ্রমটি আবার যথাস্থানে রেখে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো সে। এক মুহূর্তও দেরি না করে নাম্বারটায় ফোন দিল সে। কিছুক্ষন রিং হয়ে কেটে গেল ফোনটা। অনু আবার চেষ্টা করল কিন্তু আবারও ব্যর্থ হলো সে। অনুর মনে এখন সন্দেহ জাগতে লাগল এটা সত্যি কি রাফাতের নাম্বার নাকি অন্য কারো?
মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে স্কুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল অনু। বাড়িতে ঢুকতেই সবাই অনুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে।ইরা ব্যকুল কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘অনু এতক্ষন কোথায় ছিলি তুই?’
অনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিমি বলল,
‘কাউকে কিছু না বলে কেন গেলি তুই?আর কোথায় গেছিলি?’
লারাও কিছু বলতে যাবে তার আগে অনু বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আরে বাবা তোরা তো দেখছি প্রশ্ন দিয়ে আমাকে গিলে খাবি।’
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে একট দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনু। অনুর উপর দিয়ে এত ধকল যাওয়ার কারনে হাপিয়ে গেছে সে। মাথার অসম্ভব যন্ত্রনা ভোগ করছে সে। অনু ইরা, লারা আর মিমির দিকে খেয়াল করে দেখল সবাই নির্বিঘ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনু নিজের ভ্রু উচু করে বলল,
‘কি হয়েছে?তোরা এত টেন্সড হয়ে আছিস কেন?’
ইরা অনুর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। ইরা কন্ঠস্বর উচু করে ব্যাঙ্গত্নক ভঙ্গিতে বলল,
‘এটা তুই বলছিস অনু? রাতে এক ঘন্টা দেরি করে এলি। তারপর সকালে না খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলি। আর এখন দুপুর একটা বাজে। দেখ, চারিপাশে আযান দিচ্ছে। নিজের ফোনটা একবার চেক কর তোকে আমরা তিনজন কতোবার কল করেছি। কোথায় ছিলি তুই এতক্ষন?’
অনু ইরার কথায় মুচকি একটা হাসি দিল। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার যে আর কেউ তার পাশে থাকুক আর নাই থাকুক তার এই বন্ধু সবসময় তার পাশে থাকবে।অনু জিহবা দিয়ে ঠোটযুগল ভিজিয়ে নিল। মুহূর্তেই ঠোট লাল বর্ণ ধারন করল তার। অনু মুখে ফিছেল হাসি নিয়ে বলল,
‘ওকেয় মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস,,, প্লিজ পার্ডান মি। আই’ম রিয়েলি ভেরি সরি। তোদের সাথে কন্ট্র্যাক্ট করা উচিত ছিল আমার।’
লারা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে অনুর দিকে। লারা অভিমানি কন্ঠে বলে উঠল,
‘এটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল অনু। আমরা যে কতো পরিমান টেনশনে ছিলাম তা তুই বুঝতে পারবি না।’
অনু কিছুক্ষন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বাস্তবে আসলেই সে আজকে অনেক টেনশনে ফেলে দিয়েছে তাদের। অনুর নির্লিপ্ত চোখে ক্ষমা পাওয়ার উৎকৃষ্ট ইচ্ছা ভাসমান। মিমি অনুর অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোটের কোণায় এক ফালি হাসি নিয়ে বলল,
‘আরে এখন এসব বাদ দে তো। বলছিলাম যে, কোথায় গেছিলি তুই?’
অনু বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল সব কাহিনি। আজকে অনুর এত যাত্রা শুনে সবাই হা করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। কিন্তু অনু খেয়াল করল সবার ঠোটের কোণায় এক অদৃশ্য হাসি বিরাজ করছে। অনুর বুঝতে বাকি রইল না সবাই কালকের রাতে রাফাত আর তার সাথে ঘটে যাওয়া অফুরন্ত দৃষ্টগোচর মুহূর্তগুলো নিয়ে হাসছে।
অনুর কান দিয়ে গরম বাতাস বের হওয়া শুরু করল। বারবার নাকটা ফুলে যাচ্ছে তার। অনুর চারপাশে থাকা মানুষগুলোর মুখে মিটিমিটি হাসি বিরাজ করছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে অনুর। অনু কখনো এমন পরিবেশে পড়েনি। এক অসস্তিকর পরিবেশে ভুগছে সে। অনু সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে ধপ করে চেয়ার থেকে উঠে দড়ালো।
অনুর এভাবে উঠে যাওয়াতে সবার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।
অনু বজ্রদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দাঁত কটমট করতে করতে কর্কশ সুরে বলে উঠল,
‘তোদের মতো শয়তান ফ্রেন্ড যেন আর কারো না হয়। তোদের সবকিছু বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
ইরা,লারা আর মিমি নিজেদের পেটে অদক্ষেপ হাসি দমিয়ে রাখতে না পেরে অট্টহাসিতে মেতে উঠল। অনুর কানে তাদের হা হা হাসি ঢোলের মতো বাজতে লাগল। অনু রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। অনুর এভাবে চলে যাওয়া দেখে ইরা লারা আর মিমি তাৎক্ষনিকভাবে থেমে গেল। অনু রুমে ঢুকতেই লারা আবার ফিক করে হেসে দিল। লারার হাসি দেখে ইরা আর মিমিও হেসে দিল।
অনুকে তাদের হাসি আরো লজ্জায় ফেলে দিল। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আলনা থেকে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। ওয়াশরুমে ঢুকে ঝরনাদ নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঝরনার পানির প্রত্যেকটা বিন্দু অনুর শরীরের এক অন্যরকম শিহরন বইয়ে দিল। অনু বুঝতে পারল না সেই অজানা অনুভুতির রহস্য। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল সে।
অনু ওয়াশরুমে থাকা অবস্থায় তার ফোনে রিংটন বেজে ওঠে। অনু লারাকে ডাক দিয়ে বলল যেন সে তার ফোনটি ধরতে। লারা কল রিসিভ করে কানে ধরে বলল,
‘আসসালামুআলাইকুম।’
ফোনের অপরপাশ থেকে এক পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো লারার কর্ণকুহরে। অপরপাশ থেকে চিকন কন্ঠের অধিকারী মানুষটি বলে উঠল,
‘ওয়ালাইকুমুসসালাম। কে বলছেন?’
লারা অজানা মানুষটির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। নিজে ফোন দিয়ে বলছে ”কে বলছেন”।লারা রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘আপনি ফোন দিয়েছেন তো আগে আপনি বলুন আপনি কে?’
ওপাশ থেকে আবারও সেই মধুর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো লারার কানে। কিন্তু এবার কন্ঠস্বরের সাথে একটু রাগ মিশ্রিত আছে তা লারা বেশ বুঝতে পারল। রাগান্বিত মনোভাব নিয়ে লোকটি বলে উঠল,
‘ডিস্টার্ব করার জায়গা পাননি নাকি? আমি আগে ফোন করিনি আপনি আগে ফোন করেছিলেন। প্রায় এক ঘন্টা আগে।’
এবার লারা কান থেকে ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে দিল। ফোনটি নিচে নামিয়ে ভাবতে লাগল সে যে এটা কে হতে পারে? ফোনের দিকে নজর দিতেই তার মনে পড়ল এটা অনুর ফোন। আর অনু তো তার কাজের সাথে সম্পর্কিত কাউকে ফোন দিতে পারে। জিহবায় কামড় দিয়ে কানে ফোন ধরল লারা।আমতা আমতা করে বলল,
‘সরি,,আসলে এটা আমার ফ্রেন্ড্রের ফোন। ও ওয়াশরুমে গেছে। আমার মনে হয় ও আপনাকে ফোন দিয়েছিল।’
অপরপাশের মানুষটি গম্ভির গলায় বলে উঠল,
‘আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে?’
লারা অনেকটা অবাক হয়ে গেল লোকটির কথা শুনে। তার মাথায় সমস্যা থাকতে যাবে কেন?লারা উচু স্বরে বলে উঠল,
‘দেখুন আপনার যা কথা আপনি অনুর সাথে বলুন। অনুই আপনাকে ফোন দিয়েছে। আর আমি মোটেও পাগল নই।’
ইতিমধ্যে অনু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। লারা অনুর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতেই অনু ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল এটা রাফাতের নাম্বার। অনুর হৃদয় অস্মভব কম্পিত হচ্ছে। দষ্টিহীন ভয় আস্তে আস্তে অনুকে গ্রাস করতে লাগল। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল। এমন অনুভুতির কারন অনুর অজানা।
অনু কানে ধরেই সালাম দিল ফোনের অপরাপাশে অবস্থানরত মানুষটিকে। লোকটি সালাম নিয়ে বলল,
‘কি সমস্যা আপনাদের?কেন ফোন দিয়েছেন?’
অনু শুকনো ঢক গিলে বলল,
‘রাফাত আমি অনু।’
রাফাত অনুর নাম শুনেই হতভম্ব হয়ে গেল। ঠোটের কোনায় অফুরন্ত হাসি ফুটে উঠল তার। অজানা খুশিতে এক তৃপ্তি অনুভব করছে সে। অনেক জড়তা আর আবেগ নিয়ে বলে উঠল,
‘অনু তুতুমি ফোন দিয়েছো আমায়?’
অনু রাফাতের কথায় ভ্রু কুচকে ফেলল। সামান্য ফোন দেওয়ায় রাফাত এমন করছে কেন?ফোন তো দিতেই পারে সে? অনু ভ্রু উচু করে বলল,
‘হুমম কেন? দিতে পারি না?’
ফোনের অপরপাশ থেকে এক কৃক্রিম হাসির শব্দ ভেসে আসলো অনুর কর্ণকুহরে। অনু নিশব্দে হাসিটা কর্ণগোচর করল। রাফাত হাসি মাখানো কন্ঠস্বরে বলে উঠল,
‘না না, তা হতে যাবে কেন?বলো,, কেন ফোন দিয়েছো?’
অনু অনেকটা ইতস্তত বোধ করতে লাগল রাফাতকে কথাটা বলতে। অনেকক্ষন চুপ করে থেকে অনু বলে উঠল,
‘আপনি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?’
রাফাত অনুর কথা শুনে অবাকের চুড়ান্ত সীমায় পৌছে গেল। যেই মেয়েটা তাকে সহ্য করতে পারে না সে আজকে তার সাথে দেখা করতে চাইছে?ভুল শুনছে না তো সে?নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুক্ষন সময় লেগে গেল তার। রাফাত শিয়র হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞাসা করল,
‘কি বললে শুনতে পাইনি?’
‘দেখা করতে পারবেন আজকে?’
অনুর বাক্যটি শেষ করতে সময় লাগতে পারে কিন্তু রাফাতের সম্মতি জানাতে দেরি হলো না। অনু রাফাতের এমন উৎসাহ দেখে একটু অবাক হলেও বুঝতে দিল না তাকে। অনু রাফাতকে বিকাল চারটার দিকে বসুন্ধরা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলল। রাফাত অনুর প্রত্যেকটা কথায় রাজি। আজ যেন রাফাত যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
ফোন কেটে রাফাত আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ইয়েস ইয়েস বলতে বলতে টেবিলে গ্লাসে থাকা পানি হাতের সাহায্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সে। বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পড়ে থাকা পানির দিকে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল সে।
অনু লারার দিকে তাকিয়ে দেখল লারা চোখ মুখ কুচকে তকিয়ে আছে তার দিকে। অনু লারার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে পরখ নিল। লারা নিচু স্বরে বলে উঠল,
চলবে,
(