সাদাফুল পর্ব -০৫

পর্ব-৫
#সাদা_ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর

গত কয়েকদিন স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে তীব্রের সাথে দেখা হয় শুভ্রতার। তীব্রও প্রতিদিন ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে দোকানের পাশে অথবা রাস্তার পাশে বাইকে হেলান দিয়ে শুভ্রতার জন‍্য দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্রতা প্রতিদিন ক‍্যামেলিয়াকে আদর করে আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথাও আদান প্রদান হয় যার সবকিছুই ক‍্যামেলিয়াকে ঘিরে। এই যেমন সে কি কি খায় সারাদিন কি করে ইত্যাদি। বেশ ভালোভাবেই তীব্রের ফেব্রুয়ারি মাসের সবগুলো দিন কেটে যায়।মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ফাইনাল সেমিস্টার। যার কারনে আজ বিকেলেই তাকে ঢাকা ফিরতে হবে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে। আপাতত পরীক্ষার জন্য ঢাকায়ও নিজের সাথে রাখতে পারবে না আর বাড়িতেও ক‍্যামেলিয়া তীব্র ছাড়া কারো কাছেই ঘেঁষে না। লতাকে দেখলে তো দৌড়ে গিয়ে লতার পায়ে খামচি দেয়। তাই নিরুপায় হয়ে কাধে ব‍্যাগ নিয়ে স্কুল ছুটি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এখন শুভ্রতাই ক‍্যামেলিয়াকে রাখতে পারে কারন ক‍্যামেলিয়া তীব্রের পরে শুভ্রতাকেই বেশ পছন্দ করে। ক‍্যামেলিয়াকে দেওয়া ছাড়াও তীব্র আরও একটি কারণে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়েছে। তা হলো প্রিয় মানুষকে দেখার ইচ্ছা। প্রায় এক মাস পরীক্ষা চলবে আর এই এক মাস কিভাবে কাটাবে তা নিয়েই বেশ চিন্তিত তীব্র ।
শুভ আর লায়লা না আসায় শুভ্রতা আজ একাই বাড়ি ফিরছে। শুভ্রতাকে দেখে ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে শুভ্রতার পাশে এসে হাটতে থাকে। শুভ্রতার হাতে ক‍্যামেলিয়াকে দিয়ে বলে,

“শুভ্রতা! একটা অনুরোধ রাখবে?”

শুভ্রতা একটু সামনে এগিয়ে হাটতে হাটতে পাকা রাস্তা পার করে গ্রামের কাঁচা রাস্তার পাশে বড় বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। চারপাশে নিচু জমিতে ফসলি মাঠ। মাঠের মাঝখান দিয়ে মূলত সামান্য চওড়া মাটির রাস্তাটা। তীব্রও শুভ্রতার পিছু পিছু এসে অনেকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। আসলে শুভ্রতার স্কুল তাদের গ্রামের বাজারে হওয়ায় অনেক মানুষজনের কোলাহল থাকে। আর গ্রামের মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজনকে কথা বলতে মোটেও ভালো চোখে দেখবে না। শুভ্রতা তীব্রের দিকে না তাকিয়েই বলে,

“কি অনুরোধ বলুন”!

“ক‍্যামেলিয়াকে তোমার কাছে কয়েকদিনের জন‍্য রাখবে”? আমার ফাইনাল সেমিস্টার ঢাকা ফিরতে হবে। বাড়িতেও রাখা সম্ভব না।”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নত করেই বলে,

“ও কি আমার কাছে থাকবে?”

“আমার পরে তোমার কাছে সবথেকে শান্ত থাকে”।

শুভ্রতাও কিছু সময় পর সম্মতি দেয়। তীব্র একটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে ক‍্যামেলিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর খুব দ্রুত আবারও দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্রতা বিনিময়ে একটু হাসি দিয়ে ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়। তীব্র নিষ্লক শুভ্রতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে বুকে অসহনীয় চিনচিন ব‍্যাথা করছে। শুভ্রতা কয়েক কদম এগিয়ে থামে। পেছনে তাকিয়ে একটু জোরে বলে,

“কবে ফিরবেন তীব্র সাহেব”?

প্রথমবার শুভ্রতার মুখে নিজের নাম উচ্চারিত শুনে মূহুর্তেই তীব্রের মুখে এক আময়িক হাসি ফুটে উঠে। হাসি মুখেই উত্তর দেয়,

“খুব তাড়াতাড়ি ইনশাআল্লাহ”।

শুভ্রতাও প্রতিত্তরে আর কিছু না বলে আবারও বাড়ির পথে হাটতে থাকে। যতক্ষণ শুভ্রতাকে দেখা গিয়েছিল ঠিক ততক্ষণ তীব্র দাঁড়িয়েছিল তারপর নিজেও রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্য।


শুভ্রতার হাতে বিড়াল দেখে বেশ রেগে যান শুহানা বেগম। শুভ্রতা মাত্র উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। বারান্দায় বসে শাক কুটছিলেন তিনি। মায়ের ধমকে শুভ্রতা উঠানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঘরে যাওয়ার সাহস পায় না। শুহানা বেগমের চিল্লাচিল্লি শুনে রহমান মিয়া ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। শুভ্রতার হাতে ধবধবে সাদা বিড়ালটি দেখে রহমান মিয়া উঠানে এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়ায়। মাথায় হাত রেখে বলে,

“আম্মাজান এত সুন্দর বিলাইডা তুমি কইত্তে পাইছো?”

রহমান মিয়ার কথা শুনে শুহানা বেগম আরও রাগে জ্বলে উঠে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলেন,

” এই বিলাইরে এখুনি বাইরে ফালাই দিয়া আসবি। নইলে বিলাই এর লগে তুইও বাইরে থাক”।

মায়ের ধমকে শুভ্রতার চোখে পানি চলে আসে। দৃষ্টি মাটির নিচে রেখে ক‍্যামেলিয়াকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“আম্মা বিড়ালটারে রাখি না, আর কোনো আবদার করবো না”

রহমান মিয়া চুপ করে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি তার একদম শান্তও নয় আবার খুব দুষ্টও নয়। কিছু চাওয়ায় পর একবার মানা করলে দ্বিতীয়বার আর তা নিয়ে কথা বলে না।একদম আহামরি সুন্দরও নয় তবুও মুখজুড়ে
অন‍্যরকম মায়া খেলা করে। যার কারনে মেয়ের সব চাওয়া উনি পূরণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ক‍্যামেলিয়ার একবার তাকিয়ে দেখেন বিড়ালটি অত‍্যাধিক সুন্দর আর মায়াভরা।মুচকি হাসি দয়ে ক‍্যামেলিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে আদর করতে করতে বলেন,

“আম্মা রোদ থেইক্কা আইছো। ঘরে যাও হাতমুখ ধুইয়া খাইয়া লয় আর বিলাইডারেও দুধ দিয়া ভাত দেও।”

বাবার কথা শুনে মুখ তুলে বাবার দিকে তাকায় শুভ্রতা। শুহানা বেগম কিছু বলার আগেই রহমান মিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“হুনো শুহানা, বিলাই পবিত্র প্রানী। আমাগো নবীও বিলাই পছন্দ করতো। হাদীসেও বিলাই পালতে বলা হয়ছে। হুদা বিলাই ক‍্যা আমাগো আশেপাশে সব প্রানীর লগেই ভালা আচরণ করা উচিত। আমার আম্মা যহন বিলাই আনছে পালবার. ইচ্ছা কইছে তো পালুক। তুমি আর কিছু কইয়ো না। বিলাইডা সত‍্যই অনেক সুন্দর আর তুলতুলে, তাকাইয়া দেহো।”

৬.
সেমিস্টারের প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে তীব্রের। ঢাকা ফিরার পর প্রতিটা দিন কাটিয়েছে শুভ্রতার কথা মনে করে। বুকের বা পাশ’টা যেনো শূন্য হয়ে আছে। কখন সেমিস্টার শেষ হবে কখন গ্রামে গিয়ে সেই প্রিয় মুখখানা দেখবে তার প্রতিক্ষায় রয়েছে তীব্র। শুভ্রতা কি বুঝবে তীব্রের অনুভূতি? তাকে না দেখার কারনে এক প্রেমিকের হৃদয়ের দহন!

রহমান মিয়া ক‍্যামেলিয়াকে বেশ আদর করেন। তবে ক‍্যামেলিয়া যেনো শুহানা বেগমকেই অধিক পছন্দ করে। হয় পিছু পিছু ঘুরছে না হয় তার কোলে গিয়ে বসছে। শুহানা বেগম প্রথম প্রথম রাগ হলেও উনিও এখন খুব আদর করেন ক‍্যামেলিয়াকে।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মুক্তপাখির ন‍্যায় গ্রামের দিকে রওনা দেয় তীব্র। ফিরতে ফিরতে মধ‍্যরাত। তিথি রহমান তখনও ছেলের জন‍্য জেগে ছিলেন। মায়েরা বোধহয় এমনি হয় দুনিয়া ঘুমিয়ে গেলেও তারা সর্বদা জাগ্রত থাকে সন্তানের জন‍্য। রাত করে ফিরার কারনে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি তীব্র। ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে নাস্তার জন‍্য টেবিলে বসে। তিথি রহমান ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“মেয়েটা কে বাবা?”

মায়ের অকপটে কথা শুনে তীব্রের কাশি উঠে যায়। দ্রুত পানি পান করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কোন মেয়ে আম্মা?”

“যে মেয়ের জন‍্য আমার ছেলে চাতক পাখির ন‍্যায় ঢাকা থেকে ছুটে আসে”!

তীব্র বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর তিথি রহমানকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে হাত ধরে বলে,

” বাজারের রহমান চাচার মেয়ে শুভ্রতা”।

“কোন রহমান? বাজারের কসাই রহমান মিয়া?”

“হ‍্যা!”

তিথি রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভিতরের থেকে তিনি সামান্য ক্ষুন্ন হয়েছেন। কসাইয়ের মেয়ে! জিনিসটা শুনতেই কেমন লাগে। তীব্র মায়ের ভাবটা বুঝতে পেরে বলে,

“আম্মা আপনিই তো শিখিয়েছিলেন কোনো কাজই ছোট নয় যদি তা হালাল হয়। তাহলে ভেতর থেকে কেনো ক্ষুন্ন হচ্ছেন?”

তিথি রহমান মুচকি হাসি দিয়ে বলেন,

“অবশ‍্যই কোনো কাজই কখনো ছোট নয় বা লজ্জার নয়। আমার ছেলে যেখানে খুশি আমিও সেখানেই খুশি”।

চলবে..

[গল্পটা কেমন লাগছে? গতকাল গল্প না দেওয়ার জন‍্য দুঃখিত। হ‍্যাপি রিডিং ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here