সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -২৩+২৪ ও শেষ

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব

৬৬.
নেশায় টলমল পায়ে ছাদের এক কর্ণার থেকে অন্য কর্ণারে বেখেয়ালি ভাবে হেঁটে যাচ্ছে প্রাচী। বেশ কয়েকবার সমুদ্র তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তেমন কোনো লাভ হয় নি।
– “প্রাচী, লিসেন টু মি! এখানে একটু চুপ করে বসো। আমি তোমার জন্য নিচ থেকে লেবুর শরবত নিয়ে আসছি। লেবুর শরবত খেলে ভালো লাগবে। নেশাটাও কেটে যাবে!”
প্রাচীকে জোর করে চেয়ারের উপর বসাতে বসাতে প্রলাপ বকে সমুদ্র। প্রাচী গোল গোল চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বাচ্চাদের মত বলে ওঠে,
– “না, না আমি লেবুর শরবত খাব না। আমি অ্যাপেল জুস খাব। ঐ যে, ঐ বোতল টাতে যেই জুস ছিল আমি ওটা খাব।
আর নেশা আবার আলাদা করে করতে হয় নাকি সুইটহার্ট? আমার নেশা তো শুধুমাত্র তুমি।”
বলেই নিজের ঠোঁট দুটো সংকুচিত করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই সমুদ্র হুড়মুড় করে প্রাচীর কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে সরে আসে। প্রাচীর এহেন কান্ডে চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম তার।
– “এই মেয়ের মাথা আসলেই গিয়েছে। কোথায় প্ল্যান করেছিলাম কতকিছু সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু এই ওয়াইনের জন্য আমাকেই সারপ্রাইজড্‌ হতে হচ্ছে। কেন যে রাখতে গিয়েছিলাম। মন তো চাচ্ছে ওটা দিয়ে নিজের মাথা এখন নিজেই ফাটাই‌।”
মেঝেতে পড়ে থাকা বোতলটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সমুদ্র। শেষমেষ আর কোনো উপায় না পেয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রাচীকে কোলে তুলে নেয় সমুদ্র। এখানে আর একটা মুহূর্ত ও থাকা সম্ভব না। নেশার ঘোরে প্রাচী কি থেকে কি করে বসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ছাদ থেকে নেমে প্রাচীকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। প্রাচীকে খাটের উপর শুইয়ে দিয়ে সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “এখানে চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি দুই মিনিটের মধ্যে যাব আর আসব, প্রমিজ।”
প্রাচীকে ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই প্রাচী তড়িৎ গতিতে সমুদ্রের হাত ধরে ফেলে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরমুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সে।
– “কি হচ্ছে কি প্রাচী? আমি তো বললাম আমি এখনই এসে পড়ব।”
সমুদ্রের কথায় বিন্দু পরিমাণ ও ভ্রূক্ষেপ না করে প্রাচী পুনরায় হ্যাঁচকা টান দিতেই টাল সামলাতে না পেরে খাটের উপর বসে পড়ে সমুদ্র। সমুদ্রের উত্তপ্ত ঘন নিঃশ্বাস মুখশ্রীতে আছড়ে পড়তেই আবেশে চোখ বুজে নেয় প্রাচী।
– “সমুদ্র?”
প্রাচীর ডাকে সমুদ্র সাড়া দিতে যাবে তার পূর্বেই প্রাচী সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধের উপর নিজের মাথা হেলিয়ে দেয়।

– “আপনি জানেন সমুদ্র, আপনার প্রেয়সিনী আপনাকে কতখানি ভালোবাসে? জানেন ছোট্ট একটা মেয়ে যে কি না ভালোবাসা কি জিনিস, এই আবেগ, অনুভূতি কি কখনোই এসব সম্পর্কে ধারণাটুকু‌ পোষণ করে নি। তবে সে শুধু এটা জানত সে একজনের প্রতি খুব গভীর ভাবে আসক্ত। সে জানত তার ঐ মানুষটাকে ছাড়া একটুও চলবে না। আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, তার প্রিয় প্রতিটি জিনিসকে নিজের প্রিয় করে তুলেছিল। কিন্তু যাকে ভালোবাসত‌ সে তার দিকে ভুল করে কোনোদিন চোখ তুলেও তাকাতো না, সবসময় এড়িয়ে এড়িয়ে চলত। অথচ সেই বিপরীত মানুষটাও কিন্তু সেই মেয়েটার প্রতি খুব বাজেভাবে আসক্ত ছিল। তাইতো এসব এড়াতে নিজের প্রেয়সিনীকে‌ ছেড়ে চলে গিয়েছিল অনেকদূর!
জানেন, সেই মেয়েটার নাম কি? মেয়েটার নাম হচ্ছে প্রাচী আর গোমড়ামুখো ছেলেটির নাম ছিল সমুদ্র। দ্যা গ্রেট জুনায়েদ আরহাম‌ সমুদ্র। আপনি এমন কেন সমুদ্র? এত কষ্ট না দিলেও পারতেন আমায়!”
সমুদ্রের কাঁধে মাথা রেখেই বিড়বিড় করে বলে ওঠে প্রাচী। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের অশ্রু সমুদ্রের কাঁধ স্পর্শ করতেই নড়েচড়ে উঠে সমুদ্র। প্রাচী কি তবে কান্না করছে?

৬৭.
এতক্ষণ যাবৎ খুব মনোযোগ সহকারেই সমুদ্র প্রাচীর বলা প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছিল‌। কিন্তু পরক্ষণেই প্রাচী বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই ভড়কে যায় সে। তড়িঘড়ি করে প্রাচীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার চিবুকে হাত স্পর্শ করে ব্যাতি‌ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠে,
– “প্রাচী, এই প্রাচী কি হয়েছে? কান্না করছো কেন? আ’ম সরি‌! আমি জানি আমি তোমার সাথে খুব খারাপ বিহেভ‌ করেছি; তার জন্য সরি। এই সমুদ্র তার প্রেয়সিনীকে‌ সত্যিই খুব ভালোবাসে। প্লিজ এভাবে কান্না করো না, আই প্রমিজ আজকের পর থেকে আর কোনো কষ্ট দিব না তোমাকে।”
সমুদ্রের কথা শুনে মুহুর্তেই কান্না থামিয়ে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে সমুদ্রের দিকে তাকায় প্রাচী। তারপর হঠাৎ ই সমুদ্রের দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
– “ঠিক আছে; কিন্তু একটা শর্তে। আজকে তো আমার বার্থডে তাই না? আমি যা চাইব তাই দিবেন? আর না দিলে কিন্তু আমি কিছুই খাব না, আপনার সাথে কথাও বলব না।”
প্রাচীর আবদার শুনে ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। কি এমন শর্ত যে তাকে মানতেই হবে। তবুও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই প্রাচী প্রশস্ত হেসে বলে ওঠে,

– “আই ওয়ান্ট‌ এ বেবি! আমার একটা বেবি চাই সমুদ্র; দেখতে ঠিক আপনার মতো! যে আমাকে মাম্মা বলে ডাকবে!”
প্রাচীর কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সমুদ্র। প্রাচী যে হুট করে এত বড় কথা বলে বসবে তার কল্পনাও করে নি সে।
– “কি হলো আপনি চুপ করে আছেন কেন সমুদ্র?”
– “প্রাচী, লিসেন‌। এগুলো সব তুমি নেশার ঘোরে বলছো‌। আচ্ছা তুমি ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে না হয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।”
প্রাচীকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে নিলেই প্রাচী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে,
– “না আমার বেবি চাই‌। এখনই চাই। প্লিজ সমুদ্র! আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না! বলব না আমি আপনার সাথে কথা। চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। আপনাকে ছেড়ে চলে যাব।”
সমুদ্রকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কর্ণপাত হতেই চট করে মেজাজ বিগড়ে যায় সমুদ্রের। এই সামান্য কথা টুকুর জন্য তাকে ছেড়ে যেতে হবে? রাগে ক্ষোভে খপ করে প্রাচীর বাহু খামচে ধরে চাপা স্বরে বিড়বিড় করে,
– “আমাকে ছেড়ে যাবে? আমি তোমাকে ভালবাসি না? সেটা আমি কখনোই হতে দিব না মিসেস মেহরিশ আয়াত প্রাচী!”
প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলার অবকাশ পায় না প্রাচী। কেননা তার পূর্বেই সমুদ্র প্রাচীর ঠোঁট যুগল নিজ দখলে নিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও নেশার ঘোরে আর সমুদ্রের শক্তির কাছে হার মেনে নিতে হয় প্রাচীর।
পূর্ণ চন্দ্রিমা তিথি‌। রাতের আকাশে চাঁদ পূর্ণ থালার মত বিরাজমান। পূর্ণ চাঁদের আলোয় চারপাশ বেশ আলোকিত। রাতের আঁধার যতই গভীর হতে থাকে ততই আঁধারে ডুবে যেতে থাকে ভালোবাসার রঙিন দুটো প্রজাপতি।

৬৮.
সকালের স্নিগ্ধ সূর্যরশ্মির ছিটেফোঁটা মুখশ্রী ছুঁয়ে যেতেই নড়েচড়ে উঠে প্রাচী। নিজেকে কারো বাহুতে আবদ্ধ অনুভূত হতেই ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। সমুদ্রের উন্মুক্ত বুকের উপর মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে; যার ফলস্বরূপ সমুদ্রের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল বারংবার।
মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে‌। কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল তা মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় সে। সবকিছু স্পষ্ট মনে না পড়লেও আবছা আবছা মনে পড়ে তার‌। কিন্তু পরক্ষণেই সমুদ্রের দিকে চোখ যেতেই সবকিছু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতেই একপ্রকার আঁতকে উঠে সে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পড়তেই সমুদ্র ও নড়েচড়ে উঠে পড়ে। প্রাচীর দিকে একপলক তাকিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রাচী সমুদ্রকে এড়িয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে‌ চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে রুমে প্রবেশ করতেই খেয়াল করে প্রাচী রুমে নেই। তার মানে প্রাচী কি তার উপর রাগ করেছে? ভাবতে ভাবতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট পরিধান করতে করতে রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সমুদ্র। রুমের দরজার সামনে যেতেই পিহুকে নিয়ে উপস্থিত হয় প্রাচী‌। হাতে সকালের নাস্তার ট্রে‌। মাথা নিচু করে রুমে এসে টেবিলের ওপর ট্রে রেখে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
– “এখানে নাস্তা রাখা আছে, খেয়ে নিবেন। আমি পিহুকে খাইয়ে রেডি করে দিচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই পুনরায় পিহুকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে যাবে প্রাচী তখন পেছন থেকে সমুদ্র অনুতপ্তের‌ সুরে বলে,
– “প্রাচী, আ’ম সরি! আসলে কাল রাতে যা হয়েছে,,”
– “ইটস্ এ নরমাল ম্যাটার সমুদ্র। আপনাকে সরি বলতে হবে না। আর আমি জানি আপনি ইচ্ছে করে,, থাক এখন এসব কথা বাদ দিন‌। লেট হয়ে যাচ্ছে আমাদের।”
বলেই হনহনিয়ে রুম ত্যাগ করে প্রাচী। লজ্জায় চোখ তুলে তাকানো যাচ্ছে না সমুদ্রের দিকে। কি করে থাকবে সে? আর প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমুদ্র।
সকাল এগারোটার দিকেই সবাই ফার্ম হাউজ থেকে বেরিয়ে পড়ে। অফিসের জরুরি মিটিং এটেন্ড‌ করার জন্য সাদাত চৌধুরী উপস্থিত থাকতে পারেন নি ফার্ম হাউজে। মূলত প্রাচীর জন্মদিন সেলিব্রেট করতেই ফার্ম হাউসে সবকিছুর ব্যবস্থা করে সমুদ্র।

তিন মাস পর,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেডি হতে ব্যস্ত প্রাচী। হসপিটালে যেতে হবে। আনোয়ার সাহেব, জেবা বেগম, ইশরাক সবাই এখন হসপিটালেই আছেন। আজ সকালেই লেবার পেইন ওঠায় ফিহাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। সকাল ন’টা নাগাদ জেবা বেগমের ফোন আসতেই হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাচী।
হলরুম থেকে সমুদ্রের কন্ঠস্বর পেতেই বাইরে বের হওয়ার জন্য অগ্রসর হবে তখনই মাথা একপ্রকার ঝিমঝিম করে ঘুরে ওঠে প্রাচীর। সেকেন্ড কয়েক পর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে ইশরাক‌। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না কোনোভাবেই। ফিহাকে বেশ খানিকক্ষণ আগেই নেয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। এখনো কোনো ডক্টর বের হচ্ছে না কেন? সমুদ্র আর প্রাচীও উপস্থিত হয়েছে ইতিমধ্যে। টানা আড়াই ঘণ্টা পর ভেতর থেকে সদ্য জন্মানো বাচ্চার চিৎকার ভেসে আসতেই নড়েচড়ে দাঁড়ায় ইশরাক‌। অবশেষে তার আর ফিহার‌ ভালোবাসার চিহ্ন, তাদের সন্তান পৃথিবীতে আগমন করেছে। সাদা তোয়ালে জড়ানো একটি বাচ্চাকে একজন নার্স এসে ইশরাকের‌ কোলে তুলে দিয়ে বলে উঠে,
– “কংগ্রেচুলেশন‌, স্যার। আপনি একজন মেয়ের বাবা হয়েছেন।”
– “নার্স, আমার ওয়াইফ? ফিহা কেমন আছে?”
– “শি ইজ ফাইন‌। একটু পরেই তাকে কেবিনে শিফট করা হবে। এক্সকিউজ মি।”

ফিহাকে কেবিনে শিফট করা হলে বিভিন্ন ফর্মালিটিস পূরণ করার জন্য ইশরাক রিসিপশনে গিয়েছে। এদিকে প্রাচী বাইরে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ায়। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ মাথা একটু বেশিই ঘোরাচ্ছে‌। প্রেশার ফল করলো নাকি? কফি খাওয়া দরকার। সমুদ্র ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল‌। করিডোরের সামনে আসতেই ধীরে ধীরে চোখের সামনে সব ঝাপসা হতে শুরু করে প্রাচীর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিস্তেজ শরীর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে তার।
এদিকে কথা বলা শেষে পেছনে ঘুরে প্রাচীকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠে সমুদ্র। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রাচীকে আগলে নিয়ে নার্স দের ডাক দিতেই ভেতর থেকে নার্স সহ জেবা বেগম বেরিয়ে আসেন। পাশের কেবিনে দ্রুত প্রাচীকে শিফট করতেই পাশের ওয়ার্ড থেকে একজন সিনিয়র গাইনোকলজিস্ট এসে চেকআপ করে কিছু টেস্ট দেন প্রাচীর।
হুট করে এমন হওয়াতে বেশ ভয় পেয়ে যায় সমুদ্র। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ডক্টর বলে উঠেন,
– “ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার আরহাম‌। ইটস্ নট এ সিরিয়াস ম্যাটার। ইউর ওয়াইফ, মিসেস প্রাচী ইজ প্রেগন্যান্ট!”
ডক্টরের বলা কথা শুনতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় সমুদ্রের।…………..
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-১)

৬৯.
ডক্টরের‌ বলা কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সমুদ্র। তার ভাবমূর্তি একদম স্থির হয়ে গিয়েছে। মিসেস জেবা বেগমের চোখে মুখে বেশ উৎফুল্লতার‌ ছাপ‌। অতি পরিমাণ বিস্ময়‌তা কাটিয়ে উঠতে পুনরায় থমথমে গলায় সামনে বসে থাকা গাইনোকলজিস্টকে‌ জিজ্ঞেস করে ওঠে সমুদ্র,
– “রিয়েলি? আপনি কি সত্যি বলছেন ডক্টর? প্রাচী কি আসলেই,,?”
– “ইয়েস মিস্টার আরহাম‌, আপনার ওয়াইফ মিসেস প্রাচী মা হতে চলেছে এন্ড শি ইজ প্রেগন্যান্ট ফর টু মান্থস্।”
নিজের কানকে‌ বিশ্বাস করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে সমুদ্রের পক্ষে। তবুও তার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। ডক্টরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে; উদ্দেশ্য প্রাচীর কেবিন। কেবিনের‌ সামনে যেতেই প্রাচীর ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার‌। নিষ্পলক চাহনি তার; যেন খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে। অতি সন্তর্পণে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সমুদ্র। বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে প্রাচীর বাম হাত ধীরে ধীরে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিতেই হালকা নড়েচড়ে ওঠে প্রাচী।
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে একটা বদ্ধ কেবিনের উপর আবিষ্কার করে প্রাচী। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই সমুদ্রের চিন্তিত মুখশ্রী চোখ এড়ায় না তার।
– “সমুদ্র, আপনি? আমি এখানে কি করছি?”
ভয়ার্ত কন্ঠে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে ওঠে প্রাচী।
– “কবে থেকে চলছে এসব? এত বড় কথা আমাকে একবারও জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করো নি তুমি?”
সমুদ্রের এমন থমথমে গলায় বলা কথা শুনে চুপসে যায় প্রাচী। কি লুকিয়েছে সে সমুদ্রের কাছ থেকে? তার কি কিছু হয়েছে?
– “ক,ক্,কিসের‌ কথা বলছেন আপনি সমুদ্র? কি জানাইনি আমি আপনাকে? আর কি হয়েছে আমার?”
– “যা লুকিয়েছ‌ তা অনেক বড় অপরাধ; আর এর জন্য শাস্তি ও পেতে হবে তোমাকে‌।
তোমার ভেতর ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে; আমাদের অনাগত সন্তান, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন!”
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই পলক ফেলতে ভুলে যায় প্রাচী। চোখ দুটো তার কোটর‌ থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেট স্পর্শ করে সে। আসলেই কি সমুদ্র যা বলছে তা সত্যি? তার মাঝে কি আসলেই ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে? কেউ তাকে মা বলে ডাকবে ভাবতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে প্রাচীর।
সমুদ্র প্রাচীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
– “মেহু পাখি?”
সমুদ্রের ডাক শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী‌।
– “থ্যাঙ্ক ইউ‌ সো মাচ, মেহু পাখি! আমাকে আমার জীবনের এত বড় একটা সারপ্রাইজ দিতে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কত কত খুশি হয়েছি। থ্যাঙ্ক ইউ সো‌ মাচ‌।”
প্রাচী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রুমে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে ইশরাক, জেবা বেগম। তখন রিসিপশনে যাওয়ায় প্রাচীর খবর পায় নি সে।
– “প্রাচী? তুই ঠিক আছিস? মা যে বললো বাইরে করিডোরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি?”

– “ভাইয়ু, তুই শান্ত হ! আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু একটু মাথা ঘুরে এসেছিল আর এখন আমি একদম ঠিক আছি তো!”
বেডে শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে উঠে প্রাচী। ইশরাক এগিয়ে আসতেই সমুদ্র উঠে গিয়ে ইশরকাকে‌ জড়িয়ে ধরে।
– “চিন্তা করিস না ইশরাক‌। তোর বোনের কিছু হতে দিব না আমি। আর তোর বোনের কিছুই হয়নি; বরং তুই মামা হতে চলেছিস!”
সমুদ্রের কথা মুহূর্তের মধ্যেই পুরো কেবিন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এক খুশির খবর আসতে না আসতেই দ্বিতীয় খুশির খবর চলে আসায় উপস্থিত সবাই যেন খুশিতে উৎফুল্ল।
দুপুরের দিকে ফিহার‌ জ্ঞান আসতেই সবাই ধীরে ধীরে ফিহার‌ কেবিনে প্রবেশ করে। চোখ খুলেই প্রথমে ইশরাককে‌ নজরে পড়ে ফিহার‌।
পাশেই দোলনায় তোয়ালে জড়ানো ছোট একটা ফুটফুটে বাচ্চা। একজন নার্স এসে বাচ্চাটাকে ফিহার‌ কাছে এগিয়ে দিতে ফিহাও সযত্নে বাচ্চাটাকে আগলে নেয়‌। মুখশ্রী দেখতে অনেকটাই ইশরাকের‌ মতোন‌, নরম তুলতুলে হাত, পা।

৭০.
বিকেলের পর পরই বাসায় এসে পড়ে প্রাচী, সমুদ্র। বাসায় ফিরতেই কোহিনুর চৌধুরী ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রাচীকে নিয়ে। দুপুরের দিকে সমুদ্রের সাথে ফোনে কথা হয় তার‌। বাসায় পৌঁছাতেই প্রাচীর বেশ খাতির যত্ন শুরু করে দেন তিনি। এর জন্য অবশ্য বেশ কয়েকদফা সমুদ্রকে কথাও শুনিয়ে দিয়েছে প্রাচী। সমুদ্র চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে।

– “এখন থেকে তোমার সব কাজ বন্ধ, প্রাচী। তুমি শুধু এখন থেকে বেড রেস্ট নিবে‌ আর শুধু হেলদি খাবার খাবে। আর সমুদ্র তুই প্রাচীর সবসময় খেয়াল রাখবি। যখন যা লাগবে তখন ই তা এগিয়ে দিবি।”
সমুদ্র ও ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
– “কিন্তু মা এখনি এত কিছু করার কি প্রয়োজন? সবে তো দু মাস হয়েছে। এখনো তো ছয় সাত মাস বাকি‌। আর সারাদিন বসে থাকতে বোরিং লাগবে‌।”
অসহায় দৃষ্টিতে কোহিনুর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে প্রাচী‌।
– “নো মোর এক্সকিউজ‌! ইটস মাই অর্ডার।”
প্রাচীকে বুঝিয়ে দিয়ে কোহিনুর চৌধুরী এক প্লেট ভর্তি ফল প্রাচীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। এদিকে কোহিনুর চৌধুরী রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের দিকে তেড়ে গিয়ে ঝাঁজালো কন্ঠে বলে উঠে,

– “এই, এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো! মাকে এত তাড়াতাড়ি বলার কি দরকার ছিল? আর বলেছেন ভালো কথা, এখন আপনার জন্য সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতে হবে; কোনো কাজ ছাড়াই‌। ভালো লাগে না, ধ্যাত!”
রাগে আপনমনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “তো কি ভুল বলেছে মা? এখন থেকে নো কাজ। আর একদিক দিয়ে আমার ভালোই হয়েছে। সারাদিন নিজের ওয়াইফির‌ সাথে রোম্যান্স করতে পারব, সময় কাটাতে পারব। অ্যাম আই রাইট, ওয়াইফি‌!”
– “আপনিইইই!”
– “মা?”
পিহুর‌ কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই থেমে যায় প্রাচী। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই পিহু দৌড়ে এসে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয়। পিহুও খুশিমনে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু দিয়ে বসে।

কেটে যায় দুই মাস। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পিহুর ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। গত কয়েক দিন বেশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে তার। আকাশ আর হৃদিতার‌ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে গতকাল। আর বিয়ে জড়িত সকল অনুষ্ঠানে এটেনডেন্ট করায় শরীর বেশ দুর্বল হয়ে এসেছে তার‌।
– “তুমি গিয়ে নিচে গাড়িতে গিয়ে বসো। প্রাচীকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমরা ডক্টরের‌ কাছে যাব‌।”
হঠাৎ সমুদ্রের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী।
– “ডক্টর? কিন্তু কেন সমুদ্র?”
– “আজকে ডক্টরের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট আছে। তোমার চেকআপের‌ জন্য‌।”
প্রাচীও আর কোনো কথা বাড়ায় না। চুপচাপ ব্যাগ আর পিহুকে‌ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। তবে ভেতরে কোনো এক অজানা কারণে বেশ নার্ভাস ফিল হচ্ছে। যেন কোনোকিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
পিহুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে হসপিটালের দিকে যায় সমুদ্র। মিনিট চল্লিশেক পর গাড়ি এসে হসপিটালের সামনে থামে। গাড়ির সিটবেল্ট খুলতে খুলতে প্রাচীর দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। উদাসী চেহারায় অন্যমনস্ক হয়ে যেন কিছু একটা ভেবে চলেছে প্রাচী।
– “প্রাচী?”
পরপর কয়েকবার ডাক দিতেই ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর।
– “কি হয়েছে? এনিথিং প্রবলেম? অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবছিলে?”
– “ক,কি,কিছুনা তো।”
– “আচ্ছা ঠিক আছে। চলো হসপিটালে এসে পড়েছি।”
সমুদ্রের কথা শুনে প্রাচীও ধীর পায়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।

৭১.
ডক্টরের‌ কেবিনে,,
ডক্টর আয়েশা বেশ সরু দৃষ্টিতে সামনে থাকা রিপোর্ট গুলো পরখ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি টেস্ট করা রিপোর্টের পাতা উল্টাতেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে গভীর ভাবে। চশমার আড়ালে রিপোর্ট গুলো পরখ করে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। একটু আগেই প্রাচীর প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করিয়েছেন তিনি।
ডক্টরকে‌ এমন চিন্তিত হতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল সমুদ্র। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? ডক্টরের মুখে এত চিন্তার ছাপ কিসের?

– “ডক্টর? ইজ এভরিথিং ওকে? প্রাচীর সব রিপোর্ট কি ঠিক আছে?”
সমুদ্রের কথায় ডক্টর আয়েশা সহ প্রাচীও মাথা তুলে তাকায়‌। অতিরিক্ত টেনশনে গলা শুকিয়ে আসছে প্রাচীর।
– “দেখুন মিস্টার জুনায়েদ, মিসেস প্রাচী আপনার ওয়াইফ‌। আর অনাগত সন্তান ও আপনাদের দুজনের। তাই বেবির এবং মায়ের হেলথ সম্পর্কে জানার অধিকার ও আপনাদের দুজনের আছে‌।
আমি কিছু লুকাব না আপনাদের কাছ থেকে। এসব টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী যা দেখছি তাতে বেবিদের অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না।”
ডক্টর আয়েশার বলা কথা শুনে হতভম্ব হয় সমুদ্র। কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “বেবিদের মানে?”
– “ইয়েস, মিস্টার জুনায়েদ! আপনার ওয়াইফের গর্ভে একটা না বরং দু দুটো ভ্রূণ বেড়ে উঠছে। আর দুটো বেবি কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো বেবিদের হেল্থ নিয়ে‌। রিপোর্ট অনুযায়ী, মিসেস প্রাচীর প্রেগন্যান্সি তে বেশকিছু কম্প্লিকেশন‌ রয়েছে; তার উপর তিনি দু দুটো বাচ্চা ক্যারি করছে‌ন‌। এমতাবস্থায় উনার ডেলিভারিতে বেশ কিছু কম্প্লিকেশন আসতে পারে। আর যার জন্য এমনও হতে পারে আমরা মা ও বাচ্চাদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে বাঁচাতে পারব‌।”

ডক্টর আয়েশার কথা শুনতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রাচীর। সমুদ্র ও নিশ্চুপ। অতি পরিমাণ আশংকা আর আশ্চর্যতা তাকে একসাথে ঘিরে ধরেছে যেন।………….
শেষ পর্বের শেষ খণ্ড রাতে দেব….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here