সাহেব বিবি গোলাম পর্ব ৭

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:৭

,
,
ঘুম থেকে উঠতেই মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করলাম।
নিজেকে খুব নরম কিছুর উপর শোয়ারত অবস্থায় মনে হলো।
ফট করে চোখ খুললাম।
চারপাশের অবস্থা দেখে আবার চোখ বুজলাম আমি।
কেন যেনো মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি।নয়তো নিজেকে নিজের রুমে দেখবো কেনো?তাছাড়া আমি তো ছিলাম শুভর সাথে।একটা দোকানের ছাউনির নিচে।
খুব বৃষ্টি হচ্ছিল তখন।
আমি আবার পিটপিট করে চোখ খুললাম।
নাহ,সপ্ন তো না।এটা তো সত্যিই আমার রুম।এইযে আমার খাট,পড়ার টেবিল,বুক সেলফ।
সবই তো আছে।সপ্ন কি এতোটা নিখুত ভাবে দেখা যায়?
তাহলে?কোনটা সপ্ন? শুভর সাথে দেখা হওয়া,পালিয়ে বাসে চড়া,এইসব সপ্ন ছিলো?
তারমানে আমি পালিয়ে যেতে পারিনি?আজ কি তবে আমার বিয়ে?মামার ঠিক করা পাত্রের সাথে?আর মা?সে কোথায়?
আমি খাট ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।আমার শরীরে শুভর জ্যাকেট জরানো।তারমানে ওসব সপ্ন ছিলোনা?কিন্তু আমি এখানে কিভাবে এলাম?কে আনলো এখানে?মামা?মামা কি ধরে ফেলেছিলো আমায়?আর শুভ কোথায়?মামা তার সাথে কিছু করেনি তো?আমার জন্য নির্দোষ একটা ছেলের কোন ক্ষতি হয়ে যায়নি তো?
এতো এতো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।
গলা শুকিয়ে এলো।গা ঘেমে চুপচুপ হয়ে গেলো।মাথা চেপে ধরে আমি বসে পরলাম।
সব কিছু গোলমেলে লাগছে আমার কাছে।সবকিছু।
এমুহূর্তে মাকে আমার দরকার। তার কাছ থেকেই সব জানতে হবে আমার।
পা টিপেটিপে দরজার কাছে দাড়ালাম আমি।এবং তক্ষুনি মামি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন।সাথে আরও কিছু মেয়েও ঢুকলো। মামি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

—তাড়াতাড়ি কর তোরা,খুব তাড়াতাড়ি। ছেলে খুব তাড়া দিচ্ছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সে বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে।

তার কথা শুনে আমার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো।তারমানে আমি যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই হচ্ছে। আজ আমার বিয়ে।মামা ই নিশ্চয়ই আমায় নিয়ে এসেছে এখানে।
আমি বললাম,

—আমি কোন বিয়ে-টিয়ে করবো না মামি।

মামি চোখ গরম করে তাকালেন।
আশেপাশে মেয়েরা আছে বলে হয়তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারলেন না।নয়তো ঠিক তুলতেন।
তবে দাতে দাঁত চেপে বললেন,

—চুপচাপ বিয়েটা কর।খারাপ হতে বাধ্য করিস না আমায়।

আমি তাচ্ছিল্য ভরা হাসি হাসলাম।এমনিদিন কখনোই আমি মামা মামির মুখের ওপর কথা বলিনা।তবে আজ অদৃশ্য এক শক্তি আমায় ঘিরে ধরলো।একটা অজানা জোর পেয়ে বসলাম।হয়তো পিছু হটতে হটতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সেইজন্যেই।
বললাম,

—আর কি খারাপ হবে মামি?আর কতোটা নিচে নামবে তোমরা?যা নামার তা তো নেমেই গেছো।
আমায় যেতে দাও তোমরা।

মামি হেসে উঠলেন।এমন হাসি শুনলে কেনো যেনো গায়ে কাটা দেয় আমার।
তিনি বললেন,

—তো যা না,তোকে বেধে রেখেছে কে?চলে যা।এইতো দরজাটা খোলাই আছে।

আমি অবাক হলাম খুব।মামি আমায় যেতে বলছে?এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছে আমায়?বললাম,

—কিন্তু মা কোথায়?

—মাকে কি দরকার?তুই একা যা?

আমি অবাক নয়নে তাকালাম।মামি কি বলতে চাচ্ছে? মামি এবার আর পাশের মেয়েদের তোয়াক্কা করলেন না।এগিয়ে এসে আমার চুলের মুঠি টেনে ধরলেন।বললেন,

—শেষবারের মতো বলছি,ভালোয় ভালোয় বিয়েটা করে নে,নয়তো মাকে জীবিত আর দেখতে পাবি না কখনো?

আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
চোখ বেয়ে জলের ধারা নামলো।বললাম,

—আমার মা কোথায়?

মামি আমায় ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালেন।বললেন,

—আছে,কোথাও।বিয়েটা হয়ে যাক তারপর দেখতে পাবি।

আমি ঘৃণা ভরে তাকালাম।এটা কি সত্যি আমার মামি?আমার বাবা থাকাকালীন যার মুখ থেকে মধু ঝরতো,এই কি সে?সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য এরা আমায় এক বড়লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছে? নাহ বিয়ে তো না।এরা তো আমায় বেঁচে দিচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম,

—তোমরা কি মানুষ?

মামি আমার মুখ চেপে ধরলেন।বললেন,

—হুশশশ্।আস্তে কথা বল।বাইরে পাত্র বসে আছে।একটু আওয়াজ ও যেনো বাইরে না যায়।

পাশের মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—তোরা বসে আছিস কেনো?তাড়াতাড়ি সাজা?

মেয়েগুলো তাদের কাজে লেগে পরলো।আমাকে খাটে বসিয়ে ইচ্ছে মতো সাজাতে লাগলো।আমি আর টু শব্দ করলাম না।কিকরে করবো?আমার মায়ের জিবন যে সঙ্কটাপন্ন।তাছাড়া পালাবোই বা কোথায়?মামা ঠিক আবার ধরে ফেলবে।
আমার চোখ বেয়ে অশ্রুকনা নামা শুরু করলো।
বারবার দুটো মানুষের কথা আমার মনে হতে লাগলো।
একজন মা,অন্যজন প্রিতম।
তাকে আর বুঝি পাওয়া হবেনা আমার।তার সাথে কি আর কখনো যোগাযোগ করতে পারবো?সে কি আমায় ভুলে যাবে?অন্যকাউকে বিয়ে করে সংসার করবে?আমাকে খুজবেনা?পাগলের মতো আমায় ভালবাসে যে সে।

,
একটু বাদেই কাজি ঘরে এসে বিয়ে পরানো শুরু করলো।
আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনলাম।কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে একাকার হয়েছে আমার।এতক্ষণ কাঁদার ফলে এখন আর কাঁদতে পারছিনা।মাথার যন্ত্রনা বেড়েছে।
চোখ ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। তারপরও আমি প্রানপনে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করলাম।
একটা কাগজ বাড়িয়ে দেওয়া হলো আমার দিকে।
মামা চোখ দিয়ে ইশারা করলেন,সই করে দেওয়ার জন্য।আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সই করলাম।
হুজুর গোছের লোকটা বলে উঠলো,

—বলো মা কবুল?

আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম।
গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না আমার।কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বুকটা।আশেপাশে তাকিয়ে মায়ের খোজ করলাম।কিন্তু নাহ,মা কোথাও নেই।
আমার দেরি হচ্ছে দেখে লোকটা আবার বললো,

—কি হলো মা?বলো?

আমি ঝাপসা চোকে তাকালাম।মামির কর্কশ স্বরে হুমকি ভেসে এলো।সে বললো,

—ঢং না কে কবুল বল।নাকি মাকে দেখার ইচ্ছে নেই?

আমি চোখ বন্ধ করে বলে উঠলাম,

—কবুল।

মামা মামির মুখের হাসির রেখা প্রসস্ত হলো।তাদের চোখদুটোও জ্বল জ্বল করে উঠলো।হয়তো বেশকিছু টাকা পাওয়ার খুশিতে।
ছেলে যে আমাকে বিয়ে করার বিনিময়ে মামাকে টাকার অফার করেছিলো।
একটু পরেই মা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।
আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জরিয়ে নিলো আমায়।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।বললো,

—তোকে বাঁচাতে পারলাম না আমি পিহু,পারলাম না আমি।

আমি তার চোখের পানি মুছে শান্ত স্বরে বললাম,

—কোথায় ছিলে মা তুমি?

—জানিনা,একটা অন্ধকার ঘরে কারা যেনো আটকে রেখেছিলো আমায়।এইমাত্র কেউ ঘরের দরজাটা খুলে দিলো।সাথে সাথেই একটা সিএনজি নিয়ে আমি বাড়ি এলাম।
এসে দেখি এই অবস্থা।
তুই বিয়েটা কেনো করলি পিহু?কেনো করলি।

আমি চুপচাপ রইলাম।আর কাঁদতে ইচ্ছে করছেনা আমার।মাথাটা ঘুরছে খুব।বললাম,

—ভাগ্যে ছিলো মা।

মা আবার কেঁদে উঠলেন।এমন সময় মামি ঘরে ঢুকলেন।বললেন,

—মা,মেয়ের ঢং এখনো শেষ হয়নি? ওদিকে জামাই বাবাজি যে তাড়া দিচ্ছে, বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে সে।

আমি উঠে দাড়ালাম সাথে সাথে।
ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে আমায়।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরোতেই আমার চোখ কপালে উঠলো।
পরে যেতে গেলেই পাশের দেয়াল আকড়ে ধরলাম।
মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হলো,

—শুভ,আপনি?
,

,

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here