সাহেব বিবি গোলাম পর্ব ৬

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:৬

,
,
এলোমেলো চুলে, অগোছালো শার্টে,ঘামে ভেজা শুভকে দেখতে খারাপ লাগছেনা মোটেও।বরংচ আগের চেয়েও বেশি ভালো লাগছে।
তবে তার চোখগুলো ভীষন লাল হয়ে আছে।তাকালেই কেমন ভয় ভয় লাগছে।ছেলেটার গায়ে শক্তি আছে বলতে হয়!নয়তো ওতোগুলো শক্ত সামর্থ লোকগুলোকে একা একা মেরে শুইয়ে দিতে পারে?নিশ্চয়ই ছেলেটা কোন হিরো অথবা গুন্ডা।
যদিও দেখতে হিরোদের মতোই কিন্তু স্বভাব চরিত্র তো এক্কেবারে গুন্ডাদের মতো।তাহলে বেটা গুন্ডাই হবে।
আমাকে ভাবতে দেখে শুভ হাটতে হাটতে আড়চোকে বারকয়েক তাকালো।
সামনে তাকিয়েই বললো,

—ঝগরুটে চুপ কেনো?ভয় পেয়েছো?

আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।ভয় আবার?বিরাট আকারের ভয় পেয়েছি।এতো ভয় আমি জিবনে আর কখনো পেয়েছি কিনা সন্দেহ।
কিন্তু এমন বিপদ থেকে তো শুভই আমাকে উদ্ধার করলো।যতোই ঝগড়া করি একটা থ্যাংস্ তো সে ডেফেনেন্টলি প্রাপ্য।

আমি মিনমিন করে বললাম,

—থ্যাংস্ ভাইয়া।

শুভ হুট করে দাড়িয়ে পরলো।আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ বড় করে বললো,

—হোয়াট?

আমি আবার বললাম,

—থ্যাংক বলেছি তো!

—তার পরে কি বললে?

—কি বলবো?

একটু ভেবে বললাম,

—ওহ,ভাইয়া বললাম।
আসলে আপনি আমার থেকে নিশ্চয় বয়সে অনেক বড় হবেন।তাই আরকি?

আমার কথার মাঝেই শুভ চাপা চিৎকার করে বলে উঠলো,

—সিরিয়াসলি?আমি ভাইয়া?আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে তোমার ভাইয়া মনে হচ্ছে?

আমি অবাক হলাম খুব।সামান্য ভাইয়া বলাতে এতো রিয়াক্ট করার কি আছে?বলেছি তো বলেছি,তো কি এমন হয়েছে?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে শুভ ধমকে উঠলো।বললো,

—স্পিক আপ!

আমি সামান্য কেঁপে উঠলাম।হঠাৎ করে এতোটা রেগে যাওয়ার কারন কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকলোনা।
মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললাম,

—সামান্য ভাইয়াই তো বলেছি তাতে কি এমন হয়েছে?

শুভ এগিয়ে এসে বললো,

—তোমার মা তোমার বাবাকে ভাইয়া ডাকলে কেমন লাগবে?তোমার মামি তোমার মামাকে ভাইয়া ডাকলে তার কেমন লাগবে? ঠিক তেমনটাই আমার লাগছে।

আমি আহম্মক হয়ে দাড়িয়ে পরলাম।
শুভর বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়ালাম।কিন্তু কোন কূল কিনারা পেলাম না।শুভর কথার মানে কি?আমার বাবা,মামার সাথে ওর কি সম্পর্ক?কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে দাড় করালো?

আমাকে চিন্তামগ্ন দেখে শুভ দুষ্টু হেসে বললো,

—মাথায় ওতো চাপ নিও না মায়াবতী,গোবর ভরা মাথা তোমার।ওতো চাপ সইতে পারবেনা।

আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম তার দিকে।
দাত কিড়মিড় করে বললাম,

—আমার মাথায় গোবর? আমার মাথায়?

পরক্ষনেই আরেকটা কথা মাথায় ঢুকলো। লোকটা আমায় আবার মায়াবতী বলেছে।
বললাম,

—আমাকে আর কখনো মায়াবতী বলে ডাকবেননা।

—কোনো কেনো?

—এমনি।

—এমনি তো না,কোন কারন নিশ্চয় আছে?

আমি আঁড়চোখে তার দিকে তাকালাম।শুভ হেসে ফেললো।বললো,

—কোন প্রিয় মানুষের দেওয়া ডাকনাম বুঝি?

আমি উত্তর দিলাম না।কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়না,দিতে ইচ্ছেও করেনা।
তাছাড়া প্রিতমের কথা আমি কারো সাথে শেয়ার করিনা।শুধু মা জানে।তাছাড়া আর কেউ না।
যদিও আমার আর আছেই বা কে?

আমাকে চুপ থাকতে দেখে শুভও চুপ করে রইলো।
দুজনে অন্ধকার রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাৎ মেঘ ডেকে উঠলো।
বৃষ্টির ফোটাও পরতে শুরু করলো।
আমি চমকে শুভর দিকে তাকালাম।
শুভ তাকানোর মানে বুঝলো।
চটজলদি আমার হাত ধরে রাস্তার পাশের দোকানের ছাউনির নিচে দাড়ালো।
আমি তাকাতেই ফট করে হাত ছেড়ে দিলো।
আমিও আর ঘাটলাম না।
কি দরকার শুধু শুধু?দুজনেই তো বিপদে পরেছি।
চরম বিপদে।
এই রাস্তায় সকালের আগে বাস পাওয়া যাবেনা।যাও একটু হোটেলের খোজে যাচ্ছিলাম তাও হলোনা।
এখন কি এখানে দাড়িয়েই রাত পার করতে হবে নাকি কে জানে?
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ হলো খুব জোরে।
শুভ আমাকে আড়চোখে দেখলো।
আমি সোজাসুজি দাড়িয়ে বললাম,

—ওমন করে কি দেখেন?

শুভ আনমনে বললো,

—তোমাকে?

—মানে?

শুভ থতমত খেয়ে আমতাআমতা করলো।বললো,

—না মানে তোমাকে ভালো করে দেখছি বুঝলে?দেখলাম তুমি সত্যিই মানুষ নাকি এলিয়েন?

হঠাৎ আমার রাগ মাথায় উঠে গেলো।তেড়ে গিয়ে বললাম,

—আমি এলিয়েন মানে?

শুভ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
—তা নয়তো কি?সারাজীবন দেখে এসেছি মেয়েরা বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ শুনলে ভয় পায়।লাফিয়ে ওঠে।
পাশে কোন সুদর্শন ছেলে থাকলে তাকে জাপটে ধরে।
আর তুমি?ভয় পাওয়া তো দুরের কথা,একটু নড়লেও না?

—কারন আমি বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে ভয় পাইনা।

শুভ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো,

—সিরিয়াসলি? কি আনরোমান্টিক গো তুমি?

একটু হতাশার স্বুরে বললো,

—বেচারা তোমার বর,কি ফাটা কপাল তার!এতো আনরোমান্টিক বউ পাবে সে।

আমি শুভর কথায় রাগার পরিবর্তে চমকে উঠলাম।ঠিক এমন কথাই প্রিতম বলতো।
সে সবসময় বলতো,

—কি আনরোমান্টিক তুমি মায়াবতী, আমার কপালে শেষে কিনা এমন বউ জুটবে?

আমিও তখন কপট রাগ দেখাতাম।
লিখতাম,

—যাও,তাহলে রোমান্টিক মেয়ে দেখে বিয়ে করো।

প্রিতম রিপ্লাই দিতো,

—আরে আরে রাগ করছো কেনো?আমার তো আনরোমান্টিক মেয়েই পছন্দ।
বিয়ের পরে নাহয় রোমান্টিকতা নিজের হাতে ধরে শেখাবো।

আমি তখন লজ্জায় লাল হতাম।

শুভর কথার কোন উত্তর না দেওয়ায় শুভ নিজেও চুপ রইলো।
বাইরে বৃষ্টির পরিমান বেড়েছে।
সাথে মৃদু হাওয়াও দিচ্ছে।
আমার বেশ শীত করতে লাগলো।
গায়ের শাড়ির আচলটা টানাটানি করে গায়ে পেঁচালাম।
শুভর গায়ে পাতলা একটা শার্ট,হাতে তার জ্যাকেট খুলে রাখা।
বেটার কি শীতও লাগেনা নাকি?যদিও নাও লাগে তবে জ্যাকেটটা আমায় দিতেও তো পারে।
আমার মনের কথা কিভাবে যেনো শুভ বুঝে গেলো।
সে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

—নিজেকে কি নায়িকা মনে হয় তোমার?

আমি অবাক হয়ে বললাম,

—মানে?

—মানে আমি নায়ক না আর তুমিও নায়িকা না।সো এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও।নায়কদের মতো নিজের জামা নায়িকাকে পরিয়ে দেবার মতো ইচ্ছে আমার অন্তত নেই।

আমি মুখ ফুলালাম।বললাম,

–আপনি নায়ক হবেন কি করে?আপনি তো গুন্ডা। ভিলেন,ভিলেন।

শুভ হেসে উঠলো।বললো,

—আমি গুন্ডা হলে তুমিও গুন্ডি।

—মোটেও না।

—তবে কি নায়িকা?নায়ক হবে কে অন্যকেউ?উহু,মোটেও না।
আমি থাকতে তো কক্ষনো না।

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
মানেটা কি?কোন কথার থেকে কোথায় চলে যায় ছেলেটা?ভাবনা চিন্তা ফেলে পাশের কাঠের বেন্ঞ্চটায় উঠে বসলাম।
চোখ লেগে আসছে আমার।
একটু ঘুম দিলে মন্দ হয়না।
যদিও শুভ অচেনা ছেলে।তাকে পাশে রেখে এভাবে ঘুমিয়ে পরাটা উচিৎ না।
তবুও কেন যেনো তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো খুব।
আপনাআপনি ভরসা এসে গেলো।
কেন এমন হলো কে জানে?

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here