সুখপাখি পর্ব ৮

সুখপাখি

৮.
আবিরকে সকালে নাস্তা করিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো শিমু। হালকা কুসুম পানি দিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছে। আবির বেহায়ার মতো শিমুর দিকে তাকিয়ে আছে। কাবার্ড থেকে ছাই রঙের একটা টিশার্ট এনে পরিয়ে দিলো। আবির বললো,
— “এতোকিছুর পরেও তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে না যে?”

শিমু উঠে গিয়ে চিরুনি আনলো।আবিরের সামনে বসে বৃদ্ধা আঙুলি এবং শাহাদাত আঙুলি দিয়ে আবিরের গালটা হালকা চেপে ধরে মাথা নিচু করে চুল আচড়ে দিয়ে বললো,
— “আমিতো আপনাকে আমার গার্জিয়ান মানতাম। সম্পূর্ণ স্বামী হিসেবেই মেনে নিয়েছি। আপনি আমাকে মানতে পারেননি। তাই এতো মারধর করেছেন। আপনি হয়ত আমাকে চরিত্রহীন ভাবেন তাই…।”

পুরো কথা বলার আগেই আবির শিমুর মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
— “প্লিজ এসব আর বলো না।”

শিমু একটু সরে বসলো। আবির বললো,
— “এখন গার্জিয়ান মানো না আমায়? এখন স্বামী মানো না?”

শিমু কিছু বললো না। চুপ করেই ছিলো। আবির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
— “শিমু তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছো?”

শিমু দাঁড়িয়ে গেলো। বললো,
— “হ্যাঁ। আমি আসার সময় কিছুই আনি নি। তাই নিয়ে যাওয়ার কিছু নেই আমার। আমি এভাবেই চলে যাচ্ছি। আপনি এখন আগের তুলনাই অনেকটা সুস্থ আছেন। নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবেন।”

শিমু দরজার দিকে হাটা ধরলো। আবির দিশেহারা হয়ে পরলো। বেডে পা ঝুলিয়ে বসেই শিমুর হাত ধরে এক টান দিলো। শিমু হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগেই আবির জড়িয়ে ধরলো শিমুর পেট। আবির বিচলিত কণ্ঠে বললো,
— “প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি আর তোমাকে কষ্ট দিবো না প্রমিজ। আমাকে যত শাস্তি দেয়ার দাও তাও আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ শিমু। আমি মাফ চাইছি তোমার কাছে। প্লিজ ছেড়ে যেও না।”

শিমুর বুকে মুখ গুজে রইলো। শিমু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু আবির আগের থেকে আরো শক্ত করলো তার হাতের বন্ধন। শিমু বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
— “কি হচ্ছে এসব? ছাড়ুন আমাকে। আপনি আমাকে কিনে নিয়েছেন বলে যাই ইচ্ছা তাই করতে পারেন না আমার সাথে। আমি থাকবো না এখানে।”

— “না ছাড়বো না। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। আমার সামনে। তুমি না চাইলেও থাকতেও হবে। হবে মানে হবে। প্লিজ ছেড়ে যেও না।”

— “ওকে যাবো না। তবে একটা শর্ত আছে।”

— “আমি তোমার সব শর্তে রাজি। তাও ছেড়ে যেও না।”

— “শর্ত না শুনেই রাজি হয়ে যাচ্ছেন। পরে যখন শর্ত বলবো তখন বলবেন এটা রাখতে পারবো না।”

— “আচ্ছা বলো।”

— “আপনি মাহিন ভাইয়ার সাথে আর কোনোদিন কথা বলবেন না। তার সাথে কোথাও যাবেন না। দেখা হলেই এড়িয়ে যাবেন। এটাই শর্ত।”

— “এটা তো অনেক সামান্য। তুমি বললে আমি সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবো। কারো দিকে তাকাবো না। শুধু তোমার সাথেই কথা বলবো। আমি তোমার সব শর্তে রাজি। তাও প্লিজ ছেড়ে যেও না।”

— “সবার সাথে কথা বলা বব্ধ করতে হবে না। শুধু মাহিন ভাইয়ার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে দিবেন। এরপর আপনি নিজেই বুঝবেন কার সাথে কথা বললে ভালো হবে কার সাথে বললে বিপদে পড়বেন।”

— “আমি রাজি।”

— “ঠিকাছে আমি যাবো না।”

— “সত্যি?”

— “হুম।”

আবির শিমুর বুকে চুমু দিয়ে মাথা রাখলো। শিমু আবিরের চুল ঘাটছে। শিমুর প্রতিটা হৃদস্পন্দন আবির শুনতে পারছে। যা আবিরের মনে এক ভালোলাগা প্রকাশ করছে। শিমু আবার বললো,
— “আপনি সারাদিনে কয় পেগ মদ গিলেন?”

— “সারাদিন খাই না তো।”

— “তো?”

— “মাঝে মাঝে রাতের বেলা বারে বসে ড্রিংক করি।”

— “মদ খাওয়ার পরিণতি কি জানেন?”

আবির শিমুর দিকে তাকালো। শিমুর হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললো,
— “সত্যি বলতে জানি না।”

— “যে ব্যাক্তি মদ্যপান করে তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হয়না। আর সে যদি তখন মারা যায় তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তবে সে যদি তওবা করে তাহলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। কিন্তু সে যদি পুনরায় মদ্যপান করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে “রাগাদাতুল খাবালত্বীনাতুল খাবাল” পান করানো হবে? আর “রাগাদাতুল খাবালত্বীনাতুল খাবাল হচ্ছে জাহান্নামীদের থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত নিকৃষ্ট রস।”

আবির আতংকিত হয়ে শিমুর হাত ধরে বললো,
— “শিমু আমি আর কোনোদিন ড্রিংক করবো না প্রমিস।”

— “এভাবে হবে না। আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।”

— “ঠিকাছে।”

— “ছাড়ুন এখন। আমি নাস্তা করিনি।”

— “নাস্তার প্লেট এখানে নিয়ে আসো।”

শিমু আবিরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
— “আপনি আবার নাস্তা করবেন?”

— “খেতে চাইলে কি দিবে না?”

— “না।”

— “কিহ?”

শিমু হেসে দৌড় দিলো। শিমুর মুখের হাসি দেখে আবির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো একটা।

——————————
— “আচ্ছা আপনার পরিবারে কেউ নেই? এখানে এসেছি পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না।”

শিমুর মুখে আবির পরোটা পুরে দিলো। কথাটা শুনে আবির থমকে গেলো। শিমু আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির গম্ভীর হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
— “আমি অনাথ। কেউ নেই।”

— “ওহ। মায়ের নাম মনে নেই? বাবার নাম?”

আবির বিরক্ত হয়ে বললো,
— “ওই মহিলার কথা তুলবে না আমার সামনে। ওই মহিলাকে আমি মনে করতেও চাই না।”

— “কি কারণে?”

— “বলতে ইচ্ছে করছে না।”

— “না বললে আমি আরো জ্বালাবো। জ্বালিয়ে কান ঝালাপালা করে দেবো। হুহ।”

শিমুর জেদ দেখে আবির হতাশ হলো। তারপর বললো,
— “ঠিকাছে বলছি।”

শিমু আবিরের দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
— “বলুন।”

— “আমার আম্মার নাম হলো ফিরোজা বেগম। আর আব্বার নাম ছিলো আমির হোসেন। আমার যখন এক বছর বয়স তখন আব্বা হজ্বে গেছিলেন। সেখানে যেই পাথরে চুমু দেয়া হয় সেই পাথরে আব্বা চুমু দিয়ে সরে আসার সময় কারো পায়ের সাথে উষ্ঠা খেয়ে নিচে পরে যায়। আর তখন মানুষের ভিড়ের মধ্যে পায়ের নিচে চাপা পরে আব্বা মারা যায়। এগুলো আমি দাদির থেকে শুনেছিলাম।”

— “তারপর আপনার আম্মা?”

— “আমার যখন সাত বছর বয়স ছিলো তখন আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে ওই মহিলা আরেকজনকে বিয়ে করে সেখানে চলে যায়। আমার দিকটা একবারো ভাবেনি। আমি যে কষ্ট পাবো সেটা একবারো চিন্তা করেনি। নিজে ভালো থাকার জন্য চলে গেছে। আর আমাকে অন্ধকার জগতে ফেলে চলে গেছে। শিমু আমি উনাকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম। কেনো চলে গেলো আমাকে ফেলে? একবারো কি আমার কথা মনে পড়ে না? আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেসব কি মনে হয়না?”

আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে ফেললো। শিমু চুপ করে রইলো। এখন শান্তনা না দেয়াই ঠিক মনে হচ্ছে তার। আবির কিছুক্ষণ পর বললো,
— “আমি নেশার দুনিয়ায় পা রাখি যখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়তাম। উনার যাওয়াটা মানতে পারিনি। সবসময় কেঁদেছি। অনেক খুজেছি কোথাও পাইনি। এরপর আর সহ্য করতে না পেরে প্রথমে ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকতাম। এভাবে চার বছর চলে গেলো। একদিন মাহিনের সাথে দেখা হয়, কথাবার্তা হয়। সেদিন মাহিন আমাকে আবারো নতুন করে নেশার দুনিয়ায় প্রবেশ করায়। প্রথমে নেশা করলে আমি হুশে থাকতাম না। মাতাল হয়ে যেতাম। এরপর এটা সয়ে গেছে আমার। এখন ড্রিংক করলে বা ড্রাগ নিলে আমার নেশা হয়না। আমি স্বাভাবিকই থাকি।”

মাহিনের নাম শুনে শিমুর মাথাটা গরম হয়ে গেলো। মনে মনে বললো,
— “কোথায় ভালো ভাবে বাঁচতে শিখাবে তা না করে আরো মরার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ফালতু একটা লোক।”

শিমু গলা খাকারি দিলো। তারপর বললো,
— “সব বুঝলাম। আচ্ছা এবার বলুন যখন উনি আপনাকে ছেড়ে চলে যায় তখন উনার বয়স কত ছিলো?”

— “দাদি বলেছে ওই মহিলার যখন বিয়ে হয় তখন উনার বয়স ছিলো চৌদ্দ বছর। ষোলো বছরে মা হয় আর আঠারো বছরেই বিধবা হয়ে যায়।”

শিমুর বুকটা কেপে উঠে। সেদিনের স্বপ্ন যদি সত্যি হয়ে যেতো তাহলে সেও আজ আবিরের মায়ের মতো আঠারো বছরের আগেই বিধবা হয়ে যেতো। পুরো শরীরে এক হিমশীতল বাতাস বয়ে গেলো। শিমু কিছুক্ষণের জন্য একেবারে চুপ হয়ে গেলো। শিমু গলা ধরে এলো। কেনো যেনো কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে আবিরের সামনে কাঁদতে চায়না। তাই নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
— “শুনুন। উনাকে ক্ষমা করে দিন।”

— “এটা কি সম্ভব? উনার কারণে আমি এতো কষ্ট পেয়েছি। আজ আমার এই অবস্থা।”

— “উনার কারণে নয়। আপনার নিজের কারণে আপনি কষ্ট পেয়েছে। আর ওই মহিলা এটা কেমন কথা? উনি আপনার মা। উনাকে আম্মা বলে সম্মোধন করুন। মা যেমনই হোক তিনি মাই হয়। ইসলামে মায়েদের মর্যাদা অনেক। তাইতো মায়ের পায়ের নিচেই সন্তাতের বেহেশত দিয়েছে। আর আপনি বলছেন উনার কারণে আজ আপনার এই অবস্থা। মোটেও না। আপনি নিজের মধ্যে ক্ষোভ পুষে রেখেছেন বলেই আজ এ অবস্থা। যদি মাফ করে দিতেন আজ আপনার জীবন অন্য দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হতো।”

আবির চুপ করে রইলো। শিমু আবিরের হাত ধরে বললো,
— “একটা ঘটনা শুনুন। এক মজলিসে সাহাবিদের সামনে রাসূল বললেন, এখন যে লোকটা এখানে এসে বসবে সে জান্নাতি। সবাই অবাক হলো। এভাবে তিনদিন সেই একই ব্যাক্তিকে রাসূল জান্নাতি ঘোষণা দিলেন সবার সামনে। সেখানে এক সাহাবী (নাম মনে নেই) ভাবতে লাগলো সে এমন কি ইবাদত করে যার কারণে রাসূল নিজেই বলছে জান্নাতি। সে ওই ব্যাক্তির বাড়িতে গেলো। গিয়ে বললো, আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আপনি কি তিনদিনের জন্য আমাকে আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিবেন? সে বললো ঠিকাছে আপনি থাকতে পারেন। তিনদিন সেই সাহাবী, ব্যাক্তিটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু তাকে এমন কোনো বিশেষ ইবাদত করতে দেখা গেলো না। চতুর্থ দিন সে নিজেই জিজ্ঞেস করলো, আপনি এমন কি ইবাদত করেন যার কারণে রাসূল আপনাকে জান্নাতি ঘোষণা দিলেন? সেই ব্যাক্তি বললো, এমন বিশেষ কোনো ইবাদত তো আমি করি না। তবে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আমি সেই মানুষদের মাফ করে দি যারা আমাকে গাল- মন্দ করেছে, বকা দিয়েছে, ধমক দিয়েছে। সেটার জন্য হয়ত রাসূল এই ঘোষণা দিতেন পারেন।”

আবির মুগ্ধ হয়ে শুনলো শিমুর কথা। শিমু হেসে দিলো আবিরের এমন বাচ্চা বাচ্চা চাহনি দেখে। আবির সোজা হয়ে বসে বললো,
— “ঠিকাছে আমিও মাফ করে দিলাম আমার আম্মাকে।”

— “আমার কথায়?”

— “না। মাফ করে দেয়া একটা বিশেষ ইবাদত সেই আশায়।”

শিমু মুচকি হাসলো। তারপর বললো,
— “আপনার মা যেটা করেছে সেটা ভুল করেন নি। হ্যাঁ, এটা অন্যায় ছিলো আপনাকে রেখে তিনি চলে গেছেন। তবে একবার ভাবুন আঠারো বছর বয়সের একজন কিশোরী সে কি চায়না সে সুখী থাকুক? তার একজন প্রিয় মানুষ থাকুক? তার প্রিয় মানুষ তাকে দেখে রাখুক? সেই বয়সে তিনি কতটুকুই বা ম্যাচুয়ারড ছিলেন? আর বিধবার তকমা লাগিয়ে তিনি কিভাবে বাঁচতেন যেখানে তাঁর মাথার ছায়াটাই নেই। এভাবে থাকলে তিনি কত লাঞ্চনা, অপমানের শিকার হতো আপনি ভাবতে পারছেন?”

আবির শিমুর কোমড় ধরে টেনে কাছে এনে কোলে বসিয়ে বললো,
— “সত্যি বলতে আমি এভাবে কোনোদিন ভেবে দেখিনি। শুধু নিজের দিকটাই ভেবেছি। ধন্যবাদ বউ তোমাকে। আমাকে এতো সুন্দর করে সব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।”

— “হয়েছে এখন আর ঘি ঢালতে হবে না। হুহ!”

— “এভাবে বলতে পারলে?”

— “হিহি।”

—————————————-
এখন আবির একেবারেই সুস্থ। অফিসে যাওয়া আসা শুরু করেছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলো শিমু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাধছে। আবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শিমু সালাম দেয় আবিরকে। আবির সালাম নিয়ে বললো,
— “হঠাৎ সালাম।”

— “স্বামীকে সালাম দেয়া সুন্নাহ।”

— “আচ্ছা। শুনো তোমার সাথে কিছু গল্প করবো।”

— “কি গল্প?”

— “তোমার সম্পর্কে জানতে চাই।”

— “ঠিকাছে ফ্রেস হয়ে আসুন। আমি নাস্তা দিচ্ছি। খেতে খেতে গল্প করবো।”

আবির ফ্রেস হয়ে আসে। শিমু নাস্তা নিয়ে রুমেই চলে আসে। দুজনে সোফায় বসে খাওয়া শুরু করে। আবির খেতে খেতে বললো,
— “তোমার পরিবার সম্পর্কে বলো।”

— “আমার আব্বা আমার জন্মের আগেই মারা যায়। দাদি বলেছে আব্বার অনেক আগে থেকেই ফুসফুসে সমস্যা ছিলো। এসব জেনেও আম্মু রাজি হয় বিয়েতে। আব্বু মারা যাওয়ার পর যখন আমি পৃথিবীতে আসি তার এক বছরের মাথায় আম্মু আমাকে নিয়ে দুপুরে ঘুমাতে যায়। সেই ঘুমে আম্মু আর উঠেনি। তারপর চাচি এবং দাদি দুজনে আমাকে বড় করেছে। চাচি কখনো আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।”

— “মাহিনও তাহলে অনেক ভালো।”

— “ভালো না ছাই। আমাকে আপনার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।”

— “হেই ওয়েট। বিক্রি করে দিয়েছে মানে? এসব কি বলছো?”

— “হ্যাঁ মাহিন ভাইয়াই বলেছে আমাকে আপনার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।”

— “হোয়াট দা হ্যাল ম্যান? ও বলেছে আর তুমি বিলিভ করে নিয়েছো? শিমু তুমি বুঝতে পারছো কথাটা কতটা ভিত্তিহীন?”

— “আপনিও তো বলতেন আপনি আমাকে কিনে নিয়েছেন।”

— “আরে কথাটা তো তুমিই আমাকে প্রথম দিন বললে। আমি তোমার মোহে এতোই ডুবে ছিলাম যে হুম বলে দিয়েছি। তুমি বিলিভ করে নিয়েছো। পরে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। এরপর মেবি আরেকদিন রেগে বলেছিলাম। সেটা বলেছি তুমি ছেড়ে যাবে বলায় ভয় দেখাতে বলেছি।”

— “তাহলে মাহিন ভাইয়া যে বললো?”

— “দেখো এভাবে মানুষ মানুষকে কিভাবে কিনে নেয়? আমার জানামতে তো এমন করা যায়না। আর তুমি কি আমাকে বিলিওনিয়ার ভাবো যে, আমার বাড়ি ভর্তি টাকা আছে তোমাকে কিনে নিবো?”

— “মাহিন ভাইয়াই তো বললো আপনি ওকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন সাথে একটা ফ্ল্যাট আর…”

— “ফ্ল্যাট? আমার কাছে ফ্ল্যাট কই থেকে আসবে? আমার শুধু এই মেনসন আর ছোটখাটো আমার অফিস ছাড়া আর কিছুই নেই। তাও এই ম্যানসন আমি বাপ দাদার সূত্রে পেয়েছি। তাও অনেক ঝড় ঝামেলার পর। মেনসনের প্রতিটা জিনিস অনেক পুরানো। এই ম্যানসন আমার দাদার বাবার আমলের। সব জিনিস দামি এবং নতুন লাগে কারণ আমি সব কালো রঙ করে দিয়েছি তাই। আর টাকা তো সে আমার থেকে এক লক্ষ নিয়েছে কিসের ব্যবসার কাজে।”

— “আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি ওকে প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে দিবেন বলেননি?”

আবির আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে শিমুর দিকে তাকিয়ে ছিলো। নাস্তার প্লেট দিয়ে নিজের কপালে বাড়ি মেরে বিড়বিড় করে বললো,
— “নিব্বি বিয়ে করলে এই এক ঝামেলা। যেটা বুঝার সেটা তো বুঝেই না। আরো উল্টাটা বেশি করে মাথায় ঢুকিয়ে জট বাজিয়ে রাখে।”

শিমু মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে।আবির বললো,
— “তোমার কি আমাকে নারী পাচারকারী মনে হয়? নাকি মনে হয় যে, আমার কাছে মেয়েদের গোডাউন আছে সেখান থেকে প্রতিদিন একটা একটা করে বের করি? আজব তোহ! তোমাকে এইসব ফাউল কথা কে বলেছে, হ্যাঁ? আরে আমিতো তোমাকে বিয়ে করতে গেছিলাম। বাসায় আসলে একা একা লাগতো তাই আমার বাড়ির মেইড বলেছে বিয়ে করে নিতে। সেদিন মাহিনকে বললাম মেয়ে দেখতে সে আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছে। তারপর আমি বিয়ে করতে গেছি। এইসব উদ্ভট কথা পেয়েছো কোথায়?”

শিমু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তার সবকিছু মাথার উপর দিয়ে আচ্ছে। আবির খাওয়া শেষে বললো,
— “শিমু তুমি কি বিয়েতে রাজি ছিলে না?”

শিমু ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ না। আবির একটা ধাক্কার মতো খেলো। শূন্য দৃষ্টিতে শিমুর দিকে তাকিয়ে আছে। আহত স্বরে বললো,
— “মাহিন বললো তুমি রাজি তাই আমিও রাজি হয়েছি। আমি কাউকে জোর করে বিয়ে করতে চাইনি। আর প্রথম রাতে যেটা আমি জোর করে করেছি সেটা আমার ড্রাগের ইফেক্ট। এরপর আবার যখন করেছি সেটাও আমার ড্রাগের ইফেক্ট। আমি কাউকে জোর করতে চাইনি কখনো।”

আবির আর কিছু বললো না। নাস্তার প্লেট আর গ্লাস নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। শিমু বেশ বুঝতে পারছে শুরু থেকেই মাহিন গুটিবাজি করেছে। কতবড় কালপ্রিট সে। তার সংসারে শুরু থেকে আগুন লাগিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আপাতত আবিরের মন ভালো করতে হবে শিমুর। শিমু রান্নাঘরে এসে আবিরের পাশে দাঁড়ালো। বেসিনে হাত ধুতে ব্যস্ত সে। আবির মুখটা মলিন করে রেখেছে। শিমু বললো,
— “আপনি কি রাগ করেছেন?”

— “শিমু আমি টপ বিজনেসম্যান নই। আমার কাছে যে গাড়িটা আছে সেটা একটা কোম্পানি থেকে গিফট পেয়েছি। আমি এতো বড়লোক মানুষ না। সাধারণ একজন মানুষ। আর তোমার দ্বীনের প্রতি জ্ঞান আছে অনেক। অনেক বিষয় বুঝো। কিন্তু তুমি বাহ্যিক দুনিয়ার সাথে সম্পর্কিত নও। তুমি খুবই বোকা। তোমাকে যে কেউ খুব তাড়াতাড়ি বোকা বানিয়ে দিতে পারবে।”

আবির রুমে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। মনটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। শিমু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনটাও খারাপ।

চলবে,,,
® নাহার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here