#সুখের_পাখি
৪৫
ইহানের একটা অতীত আছে। বেদনাদায়ক সেই অতীতটা ইহান ভুলে যেতে চায়। ওসব কথা এখন আর মনে করতে চায় না ইহান। তবুও মনে পড়ে যায়। কিছু কথা কি চাইলেও ভুলে যাওয়া যায়? ভুলে যাওয়া কি এত সহজ! কক্ষনো না। না চাইতেও কিছু স্মৃতি মনের পর্দায় রয়ে যায়। চেষ্টা করেও কখনও তা মুছে ফেলা সম্ভব না। ইহান একবার ভাবে তনুকে তার অতীতের কথা জানিয়ে দিবে। পরমুহূর্তে আবার ভাবে থাক দরকার কী? তনু তো কিছুই জানে না। জানতে চায়ও না। ওকে জানিয়ে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না।
–‘কিন্তু ওকে না জানালে ওর সাথে বেইমানি হয়ে যাবে। ওকে ধোঁকা দেওয়া হবে। তনুর কষ্ট হলেও ওর জানা দরকার। এখন ওসব শুধুই আমার অতীত। কিন্তু সেই অতীতটাকে তো আমি এখনও মনে রেখেছি। পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। হয়তো এখন পারব। তনুর জন্যই পারব। ও আমার জীবনে এসেছে আমার সব কষ্ট খুশিতে পরিণত করতে। তনু আমার সুখের পাখি।’
অনেক ভেবেচিন্তে ইহান ঠিক করেছে তনুকে সে শান্তির কথা জানিয়ে দিবে। তনুকে জানাবে তার আগেও ইহানের জীবনে অন্য একজন এসেছিল। তনুর আগেও ইহান অন্য একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল। তার জীবনে আসা প্রথম মেয়ে ও প্রথম ভালোবাসা ‘শান্তি’। শান্তিকে ও ধরে রাখতে পারেনি। ওকে হারিয়েছে। জীবনের প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে। শান্তিকে সে আজও ভুলতে পারেনি। ভবিষ্যতেও হয়তো পারবে না। ওকে ভুলা সম্ভব না। তবে ইহান এখন একজনকেই ভালোবাসে। সে হচ্ছে তনু। শান্তি তার মনের এককোণে স্মৃতি হয়ে থাকবে। তনু তার মন প্রাণ সবটা জুড়ে ভালোবাসা হয়ে মিশে রইবে।
তনু হুড়মুড়িয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দরজার কপাটে কপালে বাড়ি খেল। ইহান ওদিকে তাকিয়েই রেগে গেল। ইশ! কতটা ব্যথা পেয়েছে।
–‘তোমার সারাক্ষণ দৌড়ের উপরই থাকতে হয়! শান্ত ভাবে হাঁটতে চলতে পারো না তুমি?’
–‘আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছিলাম। খুশির খবর যত তাড়াতাড়ি দেওয়া। তাই তো দৌড়াচ্ছিলাম।’
তনু কথা শেষ করার আগেই ইহান ওর সামনে এসে গেল। চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
–‘কোথায় লেগেছে দেখি।’
–‘কপালে। এইযে এখানটায়।’
–‘ইশ! ফোলে সুপারি হয়ে গেছে। নিজের খেয়াল কবে রাখতে শিখবে তুমি তনু!’
ইহান তনুকে বকতে বকতে কপালে ফোলে ওঠা জায়গায় ডলে দিচ্ছে। তনু নিজের প্রতি ইহানের কেয়ার দেখে খুশিতে মরে যাচ্ছে। শান্ত মেয়ের মত দাঁড়িয়ে আছে সে। ইহান বলল,
–‘কী খবর দিতে ছুটে এসে কপাল ফাটালে শুনি বলো।’
–‘কাল আপনার বাবা আসবে। ফুপু আম্মা বলেছে।’
ইহানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তনুর সামনে থেকে সরে এলো ও। বাবার সাথে তার সম্পর্ক কীরকম তা তনু জানে না। ওকে সবই বলতে হবে।
–‘ইহান ভাই, আপনি খুশি হোননি?’
–‘এই খবরে খুশি হয়ে নাচার কী আছে? আর খুশি না হওয়ারই বা কী আছে? যার বাড়ি সে বাড়িতে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।’
তনু ফুলি আপার থেকে একটু একটু শুনেছে ফুপার সাথে ইহান ভাইয়ের সম্পর্ক তেমন ভালো না। বাকি সব বাবা ছেলের মত তো না-ই। তাই তনু আর এই বিষয়ে কোন কথা বলল না। ইহান ভাই এখনও তার উপর রেগে যেতে পারবে। ভালোবাসে বলে তো আর রাগ বাদ দিয়ে দেয়নি। রাগটা এখনও তেমনই আছে।
তনুকে চুপ থাকতে দেখে ইহান ডাকল,
–‘এদিকে এসো।’
দুই লাফে ইহানের কাছে চলে গেল তনু। ইহান বিছানায় বসে গিটার নিয়ে কিছু করছে।
–‘বলুন।’
–‘শ্বশুর আসবে এই খবর দেওয়ার জন্যই কি আমার কাছে এসেছিলে?’
–‘হুম।’
–‘শুধু এইজন্যই আসা হয়েছিল? আর কোন কারণ নেই?’
–‘না তো।’
–‘ভালো। মনে হচ্ছে শ্বশুর বাড়ি আসায় তুমি অনেক খুশি।’
–‘আমি তো ফুপাকে কখনও দেখিনি। কাল এলে দেখতে পাব। তাই একটু বেশি এক্সাইটেড।’
–‘হুম।’
ইহান ঝুকে পড়ে গিটারে লেগে আছে। তনু ওকে দেখে হাসল। মনে মনে বলল,
–‘আমি তো আপনার কাছে আসার কোন অজুহাত পেলেই খুশি। কারণ ছাড়া কি বারবার আসতে পারি? আমার তো ইচ্ছে করে সারাক্ষণ আপনাকে আমার সামনে বসিয়ে রাখার। চোখের আড়াল হলেই আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।’
–‘তনু, একটা কথা বলো তো। আমিই কি তোমার জীবনে প্রথম প্রেম?’
উত্তর দিতে এক মিনিটও সময় নিল না তনু। সাথে সাথেই বলে ফেলল,
–‘হ্যাঁ। প্রথম এবং শেষ।’
ইহানের এবার নিজেকে আরও ছোট লাগছে। আগেই কেন সব কথা তনুকে জানায়নি সে। হয়তো সব জানা থাকলে তনু তাকে ভালোবাসতো না।
–‘আমার আগে এমন কেউ আসেনি তোমার জীবনে, যাকে তুমি পছন্দ করো বা যে তোমাকে করে?’
–‘না। এমন কেউ আসেনি যাকে আমি পছন্দ করি। কিন্তু এমন অনেকেই ছিল যে আমাকে পছন্দ করত। তার মধ্যে থেকে একজন কুলাঙ্গার আমাদের গ্রামের মাতব্বরের ছেলে। ও নাকি আমাকে পছন্দ করত! ভালোবাসতো। ওসব ওর ভালোবাসার নমুনা! আমার জীবন তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছিল।’
–‘ওহ।’
–‘আমাদের স্কুলে পড়ত তুহিন। ও-ও নাকি আমাকে পছন্দ করতো। ভালোবাসার কথাও কয়েকবার বলেছিল।’
–‘সাদাফ ভাইও।’
তনু চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘কি! সাদাফ ভাই?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘মিথ্যে কথা। সাদাফ ভাই আমাকে পছন্দ করবে কেন? ওর তো গার্লফ্রেন্ড আছে।’
–‘কেউ নেই। মিথ্যে বলেছে ও।’
–‘কেন?’
–‘সাদাফ ভাই বুঝে গিয়েছিল তুমি ওকে পছন্দ করো না। আমাদের কথাও জানতো ও।’
–‘তখন তো আপনি আমাকে ভালোবাসতেন না।’
ইহান হাসল। তনু ওর হাসির মানে বুঝতে না পেরে বলল,
–‘হাসছেন কেন? বলুন সাদাফ ভাই কীভাবে জানল।’
–‘তুমি কি আমার ভালোবাসা কখনও বুঝোনি তনু?’
–‘না। কীভাবে বুঝব?’
–‘আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। শুধু তা মেনে নিতে চাচ্ছিলাম না।’
–‘কেন?’
–‘বলবো। তার আগে বলো প্রথম প্রেম ভুলা যায়?’
–‘তার আগে আপনি আমাকে বলুন কেন আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন? ভালোবাসতেন তবুও কেন স্বীকার করেননি? আপনি জানেন আপনার আচরণে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি? কত রাত কেঁদেকেটে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি? আপনি আমাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে হতো।’
–‘তোমার সব কষ্ট শোধ করে দিব তনু। তোমাকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছি তার থেকে অনেক গুণ ভালোবাসা দেব। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
তনুর রাগ এখনও কমছে না। কী বাজে লোকরে বাবা। বদের বদ। মহা বদ।
–‘কী প্রশ্ন?’
–‘প্রথম প্রেম ভুলা যায়?’
–‘না। আপনি আমার প্রথম প্রেম। আমি জীবনেও আপনাকে ভুলতে পারব না। যদি আপনি আমাকে ভালো না-ও বাসতেন তবুও না। আমি সারাজীবনই আপনাকে ভালোবেসে যেতাম। হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে হতো তবুও আপনি আমার মনে থাকতেন। ভুলতে পারতাম না আপনাকে।’
ইহান ভাবনায় পড়ে গেল। এই মেয়ের এমন চিন্তাভাবনা দেখে তার রীতিমতো ভয় হচ্ছে। শান্তির কথা একে জানালে তনু এটাই ভাববে ইহান এখনও শান্তিকে ভুলতে পারেনি।
–‘এ বাবা!’
তনু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। ইহান ভয় পেয়ে গিয়ে বলল,
–‘কী হয়েছে?’
–‘তার মানে তুহিনও আমাকে কখনও ভুলতে পারবে না। আমিও আপনার মত ওকে অনেক বার ফিরিয়ে দিয়েছি। অনেক অপমান করেছি। বেচারা মনে মনে কত কষ্টই না পেয়েছে! আমি এতটা পাষাণ কীভাবে হতে পারলাম? ওকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে বললেও পারতাম। ওই মাতব্বরে হারামি পোলা মরুক গিয়ে। ওর জন্য আমার কোনরকম লাগবে না। কিন্তু সাদাফ ভাই… সাদাফ ভাইও তো তাহলে আমাকে ভুলতে পারবে না। সাদাফ ভাই কত ভালো মানুষ। উনিও আমার জন্য কষ্ট পাবে! আমি একা একটা মেয়ে এতগুলো মানুষের কষ্টের কারণ হলাম! আমাকে এতগুলো মানুষ কেন পছন্দ করলো? সাধারণ একটা মেয়ে আমি। দেখতে ঠিকঠাক। পড়াশোনায় মোটামুটি। তার বাইরে গুণের ‘গ’ ও নেই আমার মাঝে। আমি চাই না কেউ আমাকে পছন্দ করুক। তবুও কেন সবাই…
ইহান দার্শনিকের মত বলল,
–‘আমি যে তাকে ভালোবাসি তা ওর রূপের জন্যও নয়,গুণের জন্যও নয়। ভালো না বেসে থাকতে পারি না বলে বাসি।’ শীর্ষেন্দু সাহেব খুব সুন্দর এই লাইটা বলে গেছেন। ওরাও তোমার রূপ,গুণ দেখে ভালোবাসেনি বুঝলে?’
–‘ তা তো বুঝলাম। কিন্তু এখন যদি ওরা সবাই আমার জন্য একটা করে হলেও বদদোয়া করে তখন? তখন আমি ভালো থাকব কীভাবে? জীবনে সুখী হবো কীভাবে?’
তনুর কথা শুনে ইহান হাসতে লাগল। ওকে হাসতে দেখে তনুর রাগ লাগছে।
–‘হাসবেন না তো। আমার সুখের সাথে কিন্তু আপনার সুখও জোড়া।’
–‘যে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে সে কখনও তোমাকে বদদোয়া দিবে না। বরং সে তোমাকে না পেলেও তোমার ভালো চাইবে। দূর থেকে হলেও তোমাকে খুশি দেখতে চাইবে।’
–‘এই কথাটা কে বলে গেছে?’
–‘তোমার খুব কাছের কেউ।’
–‘কে সে?’
–‘ইশতিয়াক আহমেদ ইহান।’
–‘ কথাট ভুল। কচু চাইবে না। কে বলেছে ভালোবাসার মানুষকে বদদোয়া দেয় না? আমি কি আপনাকে সত্যিকারে ভালোবাসি নি? আমি তো ঠিকই আপনাকে এত এত বদদোয়া…
থেমে গেল তনু। আর বলিস না। আর বলে নিজের কপালে শনি নাচাস না তনু। তনুকে চুপ হয়ে যেতে দেখে ইহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখছে।
–‘থেমে গেলে কেন? বলো। তুমি আমাকে বদদোয়া দিতে তনু! আল্লাহ! যে মেয়ে আমাকে বদদোয়া দিত তাকে ভালোবেসেছি আমি!’
এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাই তনুর জন্য মঙ্গল। এটা ভেবেই মুখে তালা দিল ও।
–‘বলো কী কী বদদোয়া দিতে আমাকে? বলো তনু। নইলে কিন্তু … আমাকে রাগাতে চাও তুমি?’
–‘না।’
–‘তাহলে বলো।’
উপায় নেই। নাছোড়বান্দার হাত থেকে এত সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না। তনু মিনমিন করে বলল,
–‘আপনার বউ…
–‘স্পষ্ট করে বলো।’
–‘আপনার বউ যেন কালো হয়। মুটি হয়। আপনার থেকে অনেক খাটো হয়। দাঁত উঁচু হয়। আপনার জীবন যেন ছারখার করে ফেলে। শান্তিতে বাঁচতে না দেয় আপনাকে।’
–‘থামো, থামো। কান দিয়ে রক্ত চলে আসবে। এসব বদদোয়া দিতে তুমি আমাকে? কিন্তু আমি তো তোমাকেই বিয়ে করব। এখন তোমার বদদোয়া যদি লেগে যায় তাহলে যা হবার তোমার হবে। আমি তো ওরকম বউ নিয়েই ঘর করতে পারব।’
তনু ফ্যালফ্যাল চোখে বোকার মত ইহানের দিকে চেয়ে রইল। ইহান অনেক কষ্টে হাসি চাপছে। তনু একবার কল্পনায় নিজেকে ওরকম রূপে দেখে নিল। ইয়া আল্লাহ!
–‘না আল্লাহ না। সবার সব দোয়া কবুল করতে হয় না। তুমি তো জানো আমি একটা পাগল। তুমি আমার কথা না শুনে ওদেরকে আমাকে ভুলিয়ে দিও। কেউ যেন আমাকে মনে না রাখে। আল্লাহ তুমি তুহিন, সাদাফ ভাই ওদেরকে সুন্দর গুণবতী বউ পাইয়ে দিও। আমিন।’
#সুখের_পাখি
৪৬
ফুপা এসেছে। তনু পুরো বাড়ি খুঁজেও ইহানকে পেলো না। কেমন মানুষ ইহান ভাই! নিজের বাবা এতদিন পর বাড়ি এসেছে সে তো এয়ারপোর্ট থেকে ফুপাকে আনতে যায়ই নি, উল্টো এখন বাড়ি থেকেও কোথায় চলে গেলে। তনু উদাস হয়ে ফুলির কাছে এসে টুলে বসে পড়ে বলল,
–‘ফুপাকে তুমি আগেও দেখেছ ফুলি আপা?’
–‘হ। আমি তো অনেক বছর ধরেই এই বাড়িতে আছি। খালুজান কখনো ছয় মাসের বেশি বাড়ির বাইরে থাকে নায়। এইবারই এক বছরের উপরে থাকল।’
–‘হুম। আমি এখানে এসেছি এক বছরের কিছুটা বেশি সময় হবে। তখন থেকে ফুপা একবারও আসেনি। এইবারই প্রথম।’
–‘হুম।’
তনু গালে হাত দিয়ে বসে কিছু ভাবছে। ফুপা একটু আগেই বাড়ি এসে পৌঁছেছে। অনেক ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও তনু এখন ফুপার সামনে গেল না। মানুষটা কতটা পথ জার্নি করে এসেছে। ঘরে যাক, ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নিক। তারপর কথা বলা যাবে। ফুপা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এসেছে যখন আজ না হোক কাল হলেও দেখা হবে।
–‘ফুলি আপা।’
–‘বইলা ফেলো তনু।’
–‘ফুপা বাড়ি এলো ইহান ভাই উনাকে আনতে গেল না। এমনকি বাড়িও নেই। ইহান ভাই এমন করে কেন? ফুপার সাথে ওর কিসের এত শত্রুতা! নিজের বাপ তো নাকি! বাপের সাথে ছেলের সম্পর্ক এরকম হবে কেন?’
–‘সে অনেক কাহিনী তনু। তুমি বুঝবা না।’
–‘তুমি বলো। বললেই বুঝব।’
–‘আরেকদিন। আজ আমার অনেক কাজ।’
–‘তুমি নাহয় কাজ করতে করতেই বলো। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না, সত্যি।’
–‘বড় ভাইজানরে তো চিনোই। বড় ভাইজান…
তনু কথার মাঝে ফুলি আপাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–‘কে? আহান ভাই?’
–‘হ্যাঁ। আহান ভাই ছোট থেকেই খালুজানের নকশা কদমে চলে। খালুজান যা বলবে সেটাই করবে। ছোট ভাইজান সব সময়ই একটু জেদি। নিজের মত চলতে পছন্দ করে। খালুজান বড় ভাইজানরে ডাক্তারি পড়তে কইল, ভাইজান তা-ই করল। ছোট ভাইজানরেও ডাক্তার বানাইতে চাইছিল। কিন্তু ছোট ভাইজান হইব ইঞ্জিনিয়ার। এই নিয়া অনেক ক্যাঁচাল হইছে। শেষ পর্যন্ত ছোট ভাই নিজের জেদেই টিকে থাকছে।’
–‘সামান্য এই বিষয় নিয়ে বাবা ছেলের মধ্যে এরকম রেষারেষি! আজব কারবার!’
ফুলি হাসল। বলল,
–‘এইটা তো পরের কথা। আগে আরও ঘটনা আছে। এমনি এমনি কি ছোট ভাইজান বাপের বিরুদ্ধে গেছে? তারও একটা কারণ আছে। ওই ঘটনার পর থেকেই তো খালুজান যা বলে ভাইজান তার উল্টো করে।’
–‘আরে আল্লাহ! সবই বলছো কিন্তু আসল ঘটনাই বলছো না। দূর! তুমিও না…
ফুলি হাসছে।
–‘ছোট ভাইজান খালুজানরে না আদাজল খাওয়াইছে! ভাইজান পারেও! এত রাগ, এত জেদ।’
–‘তুমি আসল কথা বলবে?’
–‘কইতাছি তো। ধৈর্য রাখো না। আগে আগেপিছের টুকটাক ঘটনা গুলা বইলা নেই। দোষ বড় ভাইজানেরও কম না। বড় ভাইজানই সব গণ্ডগোলের মূল। বাপরে তো সে-ই কান পড়া দিছে।’
–‘তুমি বড্ড পেঁচাচ্ছ ফুলি আপা।’
–‘ছোট ভাইজান যখন কলেজে পড়ে তখন এক মেয়েরে পছন্দ করত।’
এইটুকু শুনে তনুর কান ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। সে কি ঠিক শুনেছে? নাকি শুনতে ভুল হয়েছে? ফুলি আপা কী বলল!
–‘পছন্দ করত!’
–‘হ। শুনছি মেয়েটাও নাকি ভাইজানরে পছন্দ করত। ছেলে মেয়েরে আর মেয়ে ছেলেরে পছন্দ করলে কী হয় বুঝোই তো। প্রেম ভালোবাসা।’
তনু নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। চোখ জ্বালা করতে লাগল ওর। ইহান ভাই কলেজে থাকতে একটা মেয়েকে পছন্দ করত! তনুর চোখ টলমল করছে। সে কোনোরকমে জিজ্ঞেস করল,
–‘মেয়েটাকে তুমি চেনো ফুলি আপা?’
–‘না। আমি চিনমু কেমনে কও? তখন তো আমি এই বাড়িতে কাজ করতাম না।’
তনুর কেনই যেন কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ফুলি আপা নিশ্চয় তার সাথে মজা করছে। হ্যাঁ মজাই তো। নইলে ইহান ভাই কি তাকে জানাত না! অবশ্যই জানাত।
–‘ছোট ভাইজান কলেজে এসব করে বেড়াইতেছে এই কথা আবার বড় ভাইজান খালুজানের কানে লাগাইলো। খালুজানও সব শুইনা রেগেমেগে মেয়ের বাপের কাছে বিচার দিল। মেয়ের বাপ ওর কলেজ পাল্টাইলো। ভাইজানের লগে সম্পর্ক ভাঙতে কইলো।’
তনু কথাগুলো শুনে বাকরূদ্ধ হয়ে গেল। এতকিছু হয়েছে অথচ তনু কিছুই জানে না! না জেনেই সে পাগলের মতো ইহান ভাইকে ভালোবেসে গেছে। ইহান ভাই এইজন্যই তাকে বারবার ফিরিয়ে দিত! ওই মেয়ের জন্যই তনুকে ভালোবাসতে পারত না। ওই মেয়েকে কি ইহান ভাই এখনও মনে রেখেছে? ভুলেই বা যাবে কীভাবে? জীবনের প্রথম ভালোবাসা কি ভুলে যাওয়া যায়?
তনু এরকম আরও অনেক কথা ভাবছে। ফুলি এখনও বলে যাচ্ছে। সাবিনা দরজার সামনে থেকে বলল,
–‘বেলের শরবত করেছিস ফুলি? তোর খালুজানকে দিয়ে আয়। আর রান্নাটা কতদূর? তুই যা তো। আমাকে দেখতে দে।’
কথাগুলো বলে সাবিনার চোখ তনুর উপর পড়লো।
–‘তনু তুই কাঁদছিস কেন মা?’
তাড়াহুড়ো করে চোখ মুখে জোর করে মুখে হাসি এনে বলল,
–‘চোখে কিছু গিয়েছে ফুপু আম্মা।’
–‘যাবেই তো। রান্নাঘরে এসে বসে আছিস। ধোঁয়ায় চোখ দিয়ে পানি বেরুচ্ছে। যা তো, ঘরে যা।’
–‘হু।’
তনু রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এক ছুটে ঘরে এসে দরজা দিল। ফুলি আপার কাছে ওই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করার সাহস তনুর নেই। মেয়েটা যদি এখনও ইহান ভাইকে ভালোবাসে তাহলে? ইহান ভাই কলেজে থাকতে… তাহলে তো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। এতগুলো বছরেও কি মেয়েটার বিয়ে হয়নি। তনু কান্নায় ভেঙে পড়ে মেঝেতে বসে পড়ে বলতে লাগল,
–‘আপনি আমাকে কেন ঠকালেন ইহান ভাই? কেন আমাকে কষ্ট দিলেন? বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন এই কষ্টই কি যথেষ্ট ছিল না? আপনাকে আমি কোনোদিনও পাব না। আমার সেই সামর্থ্য নেই। আপনি আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা যখন আমি মনকে মানিয়ে নিয়েছি তখন কেন আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখালেন? আমাকে একটা বার ওই মেয়ের কথা বলতেন। শত কষ্ট হলেও আমি আপনাকে কক্ষনো বিরক্ত করতাম না। এই ঘরে দাঁড়িয়ে সেদিন আপনার বলা কথাগুলো কি তাহলে মিথ্যে ছিল! কেন বললেন আপনিও আমাকে ভালোবাসেন? কেন এরকমটা করলেন আমার সাথে?’
তনু কান্নার তোড়ে কথা বলতে পারছে না। সবকিছু যেন এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তনুর নিজের বলতে আর কিছুই রইল না। ইহান ভাই তাকে না অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার আগেও ইহান ভাইয়ের জীবনে অন্য কেউ এসেছে।
–‘সেদিন এইজন্যই জিজ্ঞেস করেছিলেন প্রথম প্রেম ভুলা যায় কি-না! আপনি আজও ওই মেয়েটাকে ভুলতে পারেননি, তাই না? ওর কথা আজও আপনার মনে পড়ে।’
তনুর জীবনটা এমন কেন? এত কাঁদতে হয় কেন তার? ছোটবেলায় মা মারা গেল। মায়ের মুখ তনুর মনে নেই। মা কেমন ছিল জানা নেই বলেই হয়তো মায়ের জন্য তার তেমন কষ্ট হয় না। মাতব্বরের ছেলের জন্য গ্রাম ছাড়তে হলো। জন্মস্থান ত্যাগ করতেও কি কম কষ্ট হয়েছিল। এখানে এসে মায়ের মত ফুপু পেয়েছিল। কোন দুঃখ ছিল না। কিন্তু মাঝ থেকে বাবা চলে গেল। বাবাকে হারিয়ে তনু পৃথিবীই হারিয়ে ফেলেছিল যেন। ইহান ভাইকে একান্ত আপন মানুষ হিসেবে পেতে চাইত। সেটাও কত কষ্টের পর সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন? সবই কেমন মিছে মিছে লাগছে। এই পৃথিবীতে তনু একা কেন? কেন তার আপন কেউ নেই?
ইহান বাড়ি ফিরেই একবার তনুর খোঁজ করেছে। ফুলির কাছে জানতে পারল তনু ঘরে দরজা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ইহান কিছুটা বিরক্ত হলো।
–‘সারাটা দিন ওকে না দেখে এদিকে আমি অস্থির হয়ে মরি। আর সে মহারাণী নাকি ঘরে দরজা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমার জন্য একটুও মন কাঁদে না ওর!’
ফুলির থেকে ইহান এটাও জানলো, বাবা এসেছে। ইহান হু হা কিছুই বলল না। দুপুরের পরে নিজেই একবার তনুর ঘরের সামনে থেকে ডেকে এলো।
–‘এত ঘুম! বাবাহ! ঘুমাও ঘুমাও, তোমার ঘুম আমি বের করব।’
বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে চলে এলো সে। মা এসে কতক্ষণ কানের কাছে প্যানপ্যান করে শেষে রাগ করে চলে গেল। ইহান মা’কে রাগিয়ে মজা পায়।
–‘যা না বাবা। তোর বাবার সাথে কথা না বল, একবার সামনে যাবি তো!’
–‘সময় হলে যাব। আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না।’
–‘এখন গেলে সমস্যা কী?’
–‘এখন দেখছো না আমি শুয়ে আছি।’
রাতে ইহান ফুলিকে দিয়ে ঘরে খাবার আনিয়ে নিল। বাবার সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়া অসম্ভব। সাবিনা এসে তনুকে ডেকে তুললো। ওর ফোলা ফোলা চোখ মুখ দেখে সাবিনা কপাল কুঁচকে জানতে চাইল,
–‘কী হয়েছে রে তনু? তোর চোখ মুখ এমন ফোলা ফোলা লাগছে কেন?’
তনু হেসে বলল,
–‘অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি তো এইজন্যই।’
খাবার টেবিলে এই প্রথম ফুপার সাথে দেখা হয় তনুর। ফুপা মানুষটা ভালোই। তনু যে এবাড়িতে এতদিন ধরে থাকছে ফুপার তা নিয়ে কোন রাগ নেই। তাকে যে ফুপা আজ প্রথম দেখছে এটাও উনার আচরণে বোঝা গেল না। বেশ হেসে হেসেই ফুপা ওর সাথে কথা বলেছে। পড়াশোনার ব্যাপারে নানান কথা জিজ্ঞেস করেছে। ওকে উৎসাহ দিয়েছে। ফুপার সাথে কথা বলে তনুর ভালো লাগছিল। মানুষটাকে তার কাছে একটুও রাগী মনে হয়নি। শুধুমাত্র যদি ফুপু আম্মার মন রাখার জন্য ওর সাথে কথা বলত তাহলে এরকম আন্তরিকতা থাকত না। খাবার টেবিলে ইহানকে না দেখে তনুর আবার সেই মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ফুপা কেন ওদের মেনে নিল না। ফুপা মেনে নিলে ইহান ভাইকে তনু কখনও পেত না।
ঘরে এসে তনুর আবার কান্না পেল। মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে সে। একটা বার শুধু চোখে দেখবে। মেয়েটা কি ওর থেকেও সুন্দর! সৌন্দর্য দেখে নিশ্চয় ইহান ভাই ওকে পছন্দ করেনি। ভালোবাসা কি রূপ, গুণ দেখে হয়?
ফোন বাজলে ইহানের কল দেখে তনুর ভেতরে চেপে রাখা কান্না ঠুকরে বেরিয়ে এলো। কল তুলল না ও।
ওদিকে ইহানের অস্থিরতার সাথে সাথে রাগও বাড়ছিল। তনুর হয়েছে কী হ্যাঁ? সে যে নিচে যায়নি তা কি তনুর চোখে পড়েনি? তনু ছাদে আসছে না কেন? আর ফোন রেখেই বা কোথায় গেছে?
–‘নিশ্চয় শ্বশুরের সাথে গিয়ে মিল লাগাচ্ছে। আমি আগে নাকি শ্বশুর আগে? আমাকে সময় না দিলে শ্বশুরটা হবে কীভাবে শুনি?’
চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা