সুখের পাখি পর্ব ৬০ ও শেষ

#সুখের_পাখি

৬০(প্রথম খণ্ড)
তনু পরের দিন সকাল সকালই ফিরে এলো। ইচ্ছে করেই সে ইহানের সাথে একসাথে আসেনি। ফুপু আম্মাকে নিজে জানাতে চায় সে। ফুপু আম্মা ওকে আর ইহান ভাইকে একসাথে দেখলে কীভাবে নিবে?
ইহান সম্পর্কে তনুর আরেকটা ভুল ধারণা ভেঙে গেছে কাল। ইহান ভাই ওকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবার সময়ও তনুর একটু একটু ভয় লাগছিল। ওসব ভেবে এখন নিজেই লজ্জা পায় তনু। ইহান ভাই তার পছন্দের সব খাবার বাড়িতে আনিয়েছে। নিজের হাতে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। তনুর জড়তা তখনও কাটছিল না। ঘরে যেতে ইচ্ছে করেই দেরি করছিল। শেষমেশ মন ঠিক করে যখন ঘরে গেল, ইহান ওকে দেখে হাসল। তনু বলতেই যাচ্ছিল সে এখন কোনোকিছুর জন্য তৈরি না। তার আগেই ইহান আলতো করে দু’হাতে তনুর গাল চেপে ধরে বলল,

–‘তুমি এ ঘরে শুয়ে পড়ো। আমি পাশের ঘরে আছি। ভয় পেলে বা কিছু দরকার হলে আমাকে ডাকবে।’

তনু নিজের নিম্ন মন মানসিকতার কথা ভেবে অনুতপ্ত হচ্ছিল। ইহান ওর কপালে চুমু খেয়ে মৃদু হেসে বলল,

–‘তুমি তোমার কাছে ভীষণ পবিত্র। তোমার উপর আমি অপবিত্রতার ছায়াটুকু পড়তে দিতে রাজি না। তোমাকে হালাল করে তারপরই ছোঁবো। শুয়ে পড়ো।’

তনু ভাবছে যেভাবেই হোক, ফুপু আম্মাকে কষ্ট না দিয়ে সে ইহান ভাই আর তার বিয়ের জন্য ফুপুকে রাজি করাবে। বাবা বলেছিল, তোর ফুপু কষ্ট পাবে এমন কোন কাজ করিস না মা।
ইহান বাড়ি এলে সাবিনা ইহানের কাছে এলো। ইহান আজ মা’র চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। তনুর ব্যাপারটা মা’র থেকে লুকিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না সে।

–‘কিছু বলবে মা?’

–‘হুম। বলার তো ছিল। তুই কি এখন কোথাও বেরুচ্ছিস?’

–‘না। আজ বাড়িতেই আছি।’

সাবিনা ইহানের ঘরের গোছানো জিনিসপত্র আরও গোছানোর চেষ্টা করছে। ইহান মা’কে দেখল একবার।

–‘কী বলবে।’

–‘তুই তো বিয়ে করবি না। ভাবছি আহানের বিয়ে দিব। ঘরে তোর ভাবি আসবে। তোর তো অনেক মেয়ে ভক্ত আছে…

ইহান হেসে ফেলল।

–‘আমার মেয়ে ভক্তরা তোমার বড় ছেলেকে পছন্দ করলে আমি রাজি।’

–‘দূর! কথা এইটা না। তোর অনেক মেয়ে ভক্তদের মাঝ থেকে তুই কাউকে বিয়ে করে নিস। আমি আহানের সাথে তনুর বিয়ের কথা ভাবছি।’

–‘কিইইহ!’

ইহানের হাত থেকে চিরুনিটা পড়ে গেল। সে হতভম্ব, হতবুদ্ধি, হতবিহ্বল, বাকরূদ্ধ, হতভাগ্যও বটে। এটা তার মা! নাকি অন্য কারো মা? মা তার সাথে এরকম শত্রুর মত কাজ কেন করতে চাইছে? আহানের সাথে তনুর বিয়ে দিয়ে তার কোন জন্মের পাপের শাস্তি দিতে চাচ্ছে মা! তনু তার বউ না হয়ে ভাবি হবে! ভাবতেই চেঁচিয়ে উঠল ইহান।

–‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা? কী বলছ তুমি এসব?’

সাবিনা নির্বিকার। সহজ গলায় বলল,

–‘মাথা খারাপ হবে কেন? আমি যা বলছি ভেবেচিন্তেই বলছি। আর তুই এত রিয়্যাক্ট করছিস কেন?’

–‘রিয়্যাক্ট করব না!’

–‘কেন করবি? তোর সমস্যা কী?’

–‘সমস্যা তো আমারই মা।’

–‘আহানকে দেখে মনে হলো ও তনুকে পছন্দ করে।’

–‘আহান তনুকে পছন্দ করে! মাত্র এই কয়েকটা দিনে, তোমার বড় ছেলে তনুকে পছন্দ করে এটা তুমি ঠিকই ধরে ফেলেছ। আর পাঁচ বছর আগে থেকেই যে আমি তনুকে ভালোবাসি এটা তুমি ধরতে পারলে না! বাহ! তুমি কি শুধু আহানের মা? নাকি আমারও মা? মা হয়ে তুমি আমার সাথে এরকম শত্রুর মত আচরণ করতে পারলে? তুমি তনুকে আমার ভাবি বানাতে চাচ্ছ?’

ইহান মায়ের উপর রাগে ক্ষোভে এক দমে কথাগুলো বলে ফেলল। সাবিনা ইহানকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। ছেলের হাবভাবে এরকম কিছু একটাই আন্দাজ করেছিল সে। ইহানের মুখ থেকে এই সত্যি বের করার জন্যই সামান্য নাটক করতে হলো। ইহান যখন বুঝল রাগের মাথায় মা’কে সে সব বলে ফেলেছে, যা এতদিন চেষ্টা করেও বলতে পারেনি। তখন অপরাধী মুখে হেসে মা’কে দেখল।

–‘এইজন্যই আমি তোর মা বুঝলি গাধা। আমার থেকে লুকচ্ছিলি কেন? কথাটা আমাকে আগে কেন বলিস নি? আমি কি বুঝতাম না মনে করেছিস? তনু চলে যাবার পরে তোর মাঝে যে পরিবর্তন এসেছে তা দেখে আমি কেন? যে কেউ বলে দিবে তোদের মাঝে কিছু ছিল। আমার তো আরও আগে বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু তুই চালাক, আমাকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য আমার সামনে সারাক্ষণ তনুকে ধমকাতি, বেচারিকে বকতি। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম কবে তনু বাড়ি ফিরবে।’

ইহান মা’র উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সাবিনার কাঁধে চুমু খেয়ে বলল,

–‘তুমি সব জানতে?’

–‘তোকে পেটে ধরেছি আমি। তোর নাড়িনক্ষত্র জানি। আহানকে বুঝতে আমার সময় লাগলেও তুই আমার কাছে কাঁচের মত স্বচ্ছ।’

–‘তুমি রাগ করোনি তো মা?’

–‘রাগ করব কেন? তনু কি আমার পর? ওকে সারাজীবন আমার কাছে রাখার জন্য আমিই এমন কিছু করতাম। কিন্তু মেয়েটার যে আমার পাগলা ছেলেকে পছন্দ তা কে জানতো?’

–‘তনু তোমাকে জানাতে ভয় পাচ্ছে। তুমি যদি কষ্ট পাও। ওকে মেনে না নাও।’

সাবিনা বিস্ময়ে ইহানের দিকে ফিরল।

–‘ও মা! সত্যি?’

–‘হুম।’

–‘এটা তো সত্যিই পাগল মেয়ে। আমি কষ্ট পাব কেন? আর ওকে মেনেই বা নিব না কেন?’

–‘তার মানে তুমি মেনে নিবে?’

–‘চড় খাবি এবার আমার হাতে। তোদের বিয়ে কীভাবে করাব সেই কথা ভাবছি আমি।’

–‘মা, তোমাকে আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।’

–‘হু এখন তো বাসবিই। তলে তলে পাঁচ ছয়টা বছর কাটিয়ে দিয়েছ। এখন তো মা’কে ভালোবাসবেই।’

–‘তুমি আমার সোনা মা। আগে তুমি আমার মা। তারপর তোমার বড় ছেলের মা। আহান কি সত্যিই তনুকে পছন্দ করে, মা?’

–‘কী জানি! ওকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বিয়ের কথা তুললে কেমন এড়িয়ে যায়। পছন্দ কেউ থাকলেও তো বলবে নাকি? কিছুই বলে না।’

–‘তুমি কি এখন ওর জন্য আমার বিয়ে আটকে রাখবে?’

সাবিনা হাসতে হাসতে ইহানকে চড় দেখিয়ে বলল,

–‘নির্লজ্জ ছেলে! মা’র সাথে এসব কথা বলে কেউ?’

–‘আমার মা-ই সব। তোমার সাথে বলব না তো কার সাথে বলব?’

আহান ক্লিনিক থেকে ফিরেছে। ইহানের সামনে পড়ে যাওয়ায় ইহান ওকে একটু বাজিয়ে দেখল মায়ের কথা সত্যি কি-না। ব্যাটা সত্যিই তনুর উপর নজর দিয়েছে কি-না। ইহানের জিনিসে নরজ দেওয়া এর বহু পুরোনো স্বভাব। ইহান আহানের সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল।

–‘আমার সব প্রিয় জিনিস গুলোর উপর তোর এত লোভ কেন, বল তো?’

কপাল কুঁচকে আহান জানতে চাইল,

–‘মানে?’

–‘মানে যা আমার পছন্দ হবে সে জিনিসই তোরও ভালো লাগবে। কেন?’

–‘কী ফালতু বকছিস তুই!’

–‘আমি ফালতু বকছি? শান্তি আমার সাথে রিলেশনে আছে জেনেও তুই ওকে পছন্দ করিস নি?’

আহান হতভম্ব। এত বছর আগের কথা এখন কেন তুলছে ইহান? আহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

–‘আমি জানতাম না শান্তি তোকে পছন্দ করে। জানলে কখনও শান্তিকে আমার চোখে ভালো লাগতো না। আমি তোর মত…

–‘ওই থাম, থাম। চাইলেও তুই আমার মত হতে পারবি না।’

–‘সামনে থেকে সর। পথ ছাড়।’

–‘তনুকে পছন্দ করিস তুই?’

আহান ধাক্কার মত খেল। ওর মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।

–‘তনু!’

–‘দেখ তনুকে আমি বিয়ে করব। তুই কিন্তু ভুলেও ছোট ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিবি না। তাহলে এবার আমি তোকে কানা করে দিব। তোর জন্য শান্তিকে হারাতে হয়েছিল আমার। তনুর ক্ষেত্রে ওরকম কিছু হতে দিব না আমি।’

আহান বোকার মতো ইহানের মুখের দিকে দেখে মাথা নাড়ল। কিছু না বলেই চলে গেল। ইহান অবাক।

–‘এটা কী হলো! ঝগড়া করবে তো দূর কিছুই বলল না! কী হয়েছে আহানের? সত্যি সত্যিই ও তনুকে পছন্দ করে নাকি? ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল কেন?’

তনু কাঁদো কাঁদো মুখে ফুপু আম্মার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে তাকাতে পারছে না সে। সাবিনা রাগী রাগী গলায় বলল,

–‘তনু তুই! তুই আমার সাথে এরকম করতে পারলি? আরে আমি তোকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসা দিয়েছি। আর তুই কি-না… ভাবতেই অবাক লাগছে আমার।’

তনু এবার ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলল। সাবিনা ওকে কাঁদতে দেখেও নরম হলো না।

–‘তুই আমার বিশ্বাস ভাঙতে পারলি তনু?’

তনু সাবিনার পায়ের কাছে বসে পড়ল। হুট করে ও এমন কিছু করবে সাবিনা ভাবতে পারেনি। সাবিনার পা ধরে তনু বলল,

–‘ফুপু আম্মা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। তুমি যা বলবে আমি তা-ই করব।’

–‘আরে আরে। এই মেয়ে, পা ছাড় আমার।’

–‘আমি ইহান ভাইকে অনেক ভালোবাসি। তুমি আমাকে ওকে ছাড়তে বলো না। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি আমি। তার জন্য যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিব।’

ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথা বলতে পারছে না তনু। সাবিনা সত্যিই মুগ্ধ হলো। যাক, এই পাগল ছেলেটাকে নিয়ে তার আর কোন চিন্তা হলো না। তনুকে ধরে তুলল সে।

–‘আমি এতক্ষণ তোর সাথে মজা করছিলাম তনু। আমি কেন কষ্ট পাব? আমি তো আরও খুশি হয়েছি। তুই কোন অন্যায় করিস নি। পাগল মেয়ে, তোর মত ইহানকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।’

তবুও তনুর চোখের পানি থামছে না।

–‘তুমি আমার উপর রাগ করে নেই তো?’

–‘তোর কান্না না থামলে এবার সত্যিই রাগ করব। ফুপু থেকে শাশুড়ি মা হয়ে গেলে তখন বুঝবি।’

তনু নাক টানতে টানতেই বলল,

–‘আমি তোমার ভালো বৌমা হব। তোমার সেবাযত্ন করব।’
#সুখের_পাখি

৬০(শেষ অংশ)
বিয়ের দিনই তনু বুঝল সেলিব্রিটি বিয়ে করা কতটা মজা। এতক্ষণে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। এত এত ক্যামেরার ফ্ল্যাশ সরাসরি চোখে এসে লাগছে। চোখ জ্বালা করছে। আজ তার বিয়ে হচ্ছে এজন্য না কাঁদলেও ছবি তুলতে তুলতে কেঁদে ফেলবে শিওর। পোজ দিতে দিতে তনু মনে মনে বিরক্ত। তবুও মুখে হাসি রাখতে হচ্ছে। তার উপর প্রেসের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কয়েকবার হুঁচট খাচ্ছে। ইহানের সাথে তার কীভাবে পরিচয়? প্রথম দেখা কোথায়? ওদের কত বছরের রিলেশন? আগে কে প্রপোজ করেছিল? ম্যাম আপনি আমেরিকা ছিলেন বলেই কি আপনাদের সম্পর্কের কথা বাইরে আসেনি? আপনি এখন কোন হসপিটালে জয়েন দিচ্ছেন? আরও কতশত প্রশ্ন। এর মাঝে ইহান ভাই একবারও তার কাছে আসেনি। তনু যদি জানত বিয়ে করলে ইহান ভাই তাকে রেখে দুনিয়ায় সবাইকে সময় দিবে তাহলে বিয়েই করত না।

–‘ইহান ভাই, আপনি আমার সেই আগের ইহান ভাই-ই ভালো ছিলেন। আমার তো এসবে অভ্যেস নেই। আপনি কীভাবে এদের সহ্য করেন?’

–‘ম্যাম একটু স্মাইল।’

–‘আর কত স্মাইল করব রে গাধা? এবার তো আমাকে আমার জামাইয়ের কাছে যেতে দে।’

আহান হয়তো দূর থেকে তনুর বিরক্তির কারণ বুঝতে পারছিল। সে এসে প্রেসদের অন্যদিকে পাঠিয়ে দিল। তনু আহানকে দেখেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

–‘আহান ভাই, আমরা বাড়ি কখন যাব?’

আহান হেসে বলল,

–‘অভ্যাস করে নাও তনু। এখন থেকে রোজ তোমাকে এদের সামনা করতে হবে। বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। এখন কী একটু বসবে?’

–‘পানি খাব।’

তনু পানি খেয়ে বসল। চুলের খোঁপাটা কি খুলে যাচ্ছে? কী দিয়ে যেন চুল কাঁটাতারের মত শক্ত করে দিয়েছে এরা। এগুলো ছাড়াবে কী করে? তার সুন্দর চুলগুলো নষ্ট না হলেই হয়! চোখের আলগা পাপড়ি পিড়পিড় করছে। মুখে একগাদা মেকআপ নিয়ে আর থাকা যাচ্ছে না। তনু বাড়ি গিয়ে সবার আগে মুখ ধুতে চায়। আল্লাহ জানে এই একশো পর্দার ভারী মেকআপ তুলতে কতক্ষণ সময় লাগবে! জীবনে কোনোদিনও এত মেকআপ করেনি সে। দূরে দাঁড়ানো ইহানকে দেখছে তনু। সে হেসে হেসে কয়েকজনের সাথে কথা বলছে। ইহান ভাইয়ের হাসি দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে করতে পেরে সে মহাখুশি। এদিকে বউকে নিয়ে তার কোন চিন্তাই নেই। আহান তনুকে লক্ষ করল।

–‘তনু।’

–‘আহান ভাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন না। ফুপু আম্মা কোথায়? আর কতক্ষণ?’

–‘অস্বস্তি হচ্ছে তোমার?’

–‘হুম। জীবনে এত মেকআপ কখনও করিনি। খিদেও পেয়েছে।’

আহান তনুকে তার নিজের অতি গোপন একটা কথা বলতে এসেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তা বলা যাবে না।

–‘আমি দেখছি।’

আহান উঠতে নিলে তনু ওর একটা হাত ধরে ফেলল।

–‘বসুন। আহান ভাই সত্যি করে একটা কথা বলবেন? আপনি কাকে ভালোবাসেন? সে কি আপনার সাথে নেই? আপনি কি কখনও বিয়ে করবেন না? বলুন না কে সেই মেয়ে?’

আহান তনুর মুখের দিকে তাকাল। তনু কীভাবে বুঝল? মেয়েরা কি মুখ দেখেই সব বুঝে যায়?

–‘বিদেশে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছিল। সে পাকিস্তানি ছিল। তবুও আমরা বিয়ে করতাম। সে বলেছিল আমার দেশে এসে আমাকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবে। যা কিছুই হয়ে যাক আমাকে ছাড়বে না। আমি মা বাবা কাউকে জানাইনি। ভেবেছিলাম একেবারে ওকে সাথে নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিব। আমাদের দু’জনের ফেরার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছিল। তার দু’দিন আগেই তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়। জারা খুব স্পিডে গাড়ি চালাতো। আমি তাকে অনেক নিষেধ করেছি। সে আমার কথা শুনেছি। আমাদের দেশে আসা হলো না। বিয়ে… সে এখন এমন কোথাও আছে যেখানে চাইলেই আমি ওকে দেখতে পারব না। ওর কাছে যাওয়ারও কোন সুযোগ নেই।’

তনুর চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছিল তা সে নিজেও খেয়াল করেনি। কাঁদছে সে। আহান ভাইকে দেখে বোঝাই যায় না। ভালোবাসার মানুষটাকে ভীষণ বাজে ভাবে হারিয়েছে ও। আহান টিস্যু এগিয়ে দিল।

–‘মেকআপ উঠে যাবে।’

আহান আর বসল না। তনু ডাকল। তবুও দাঁড়াল না। ইহান তনুর কাছে আসতে না পারলেও ওর চোখ সারাক্ষণ তনুর উপরই ছিল। তনুকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে সে সবাইকে ছেড়ে তনুর কাছে চলে এলো। তনু আহানকে খুঁজছে। ইহান ওর পাশে বসে বলল,

–‘কী বলেছে ও তোমাকে? কাঁদছ কেন তুমি? এই আহানকে তো আমি ছাড়ব না। বিয়ের দিন আমার বউকে কাঁদিয়েছে। ওকে তো…

তনু রাগী মুখে ইহানের দিকে ফিরলে ইহান চুপ হয়ে গেল। তনুর রাগের আরেকটা কারণও আছে। সেটাও ইহানের অজানা না।

–‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না, ইহান ভাই।’

ইহান হতবুদ্ধি হয়ে গেল। ওর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। কেন বিয়ে করবে না এটাও জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

–‘মুখ বন্ধ করুন। এই অবস্থায় কেউ ছবি তুলে ফেললে আপনার কাম সারছে। আমি এখন বাড়ি যাব। আপনি বউ ছাড়া বিয়ে এনজয় করুন। আপনার শাদী আপনাকেই মোবারক হোক।’

–‘বিয়ে কেন করবে না? কোথায় যাবে তুমি? মানে কি?’

–‘আপনি বউ দিয়ে কী করবেন? আমাকে আপনি বিয়ে করছেন? নাকি প্রেস মিডিয়া আর ওইসব গেস্টদের? পুরোটা সময়ে কয় মিনিট আপনি আমার কাছে ছিলেন? আপনাকে তো আমি ভালোবাসিনি। আমার ওই ইহান ভাইকে লাগবে যে শুধু আমার ছিল। আমার বরকে আমি হাজার হাজার মেয়ের সাথে ভাগ করে নিতে পারব না। আপনি যদি শুধু আমার থাকতে পারেন তাহলে কবুল বলব। নইলে আল্লাহ হাফেজ।’

ইহান কিছু বলার আগেই প্রেস গুলো বর কনের একসাথে ছবি নেওয়ার জন্য চলে এলো। ইহান তনুকে মানানোর সময়টাও পেল না। তনু দাঁত কামড়ে ইহানকে দেখছে। ইহান তনুর দিকে না তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে ওর আরও কাছে ঘেঁষে এসে পোজ দিচ্ছে। ইহানের একটা হাত তনুর কোমরে চলে গেলে তনু জমে গেল। মুখের হাসি মুছে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কবুল বলার সময়ও তনু আহানকে খুঁজছিল। কোথায় গেল আহান ভাই? ইহান ওর কানের কাছে এসে বলল,

–‘কাকে খুঁজছ?’

–‘কাউকে না। আচ্ছা আহান ভাইকে দেখেছেন কোথাও?’

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। ক্লান্তিতে তনুর চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। মিতা কি তার বিয়েতে আসেনি? না, এসেছিল। স্টেজে উঠার আগে একবার শুধু দেখেছিল। তারপর তো তারই আর সময় হলো না। মিতা কি বিয়ে পড়ানোর আগেই চলে গেছে? তনু সময় নিয়ে মেকআপ তুললো। আহ! নিজেকে হালকা লাগছে এখন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে এলো সে। তখনই ইহান ঘরে ডুকলো। সে কিছু বলতে যাবে তনু থামিয়ে দিয়ে বলল,

–‘ইহান ভাই আজ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতেই হবে।’

–‘সিদ্ধান্ত!’

–‘আজকের মত যদি এরকম বাকিটা জীবন চলে তাহলে আমি আপনার সাথে থাকতে পারব না। সারাক্ষণ মুখে হাসি রেখে পুতুল হয়ে থাকা আপনার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু আমার পক্ষে না।’

ইহান হাসতে লাগল। তনুর রাগ হচ্ছে।

–‘একদিনেই তোমার এই অবস্থা! আমি চার বছর ধরে সহ্য করছি। এখন আমার সাথে তোমাকেও করতে হবে।’

–‘আমি পারব না। আমি সাধারণ মানুষ। বিয়েশাদি করে স্বামী সন্তান নিয়ে ঝামেলাহীন সংসার চাই… এই ছাড়ুন। দূরে দাঁড়ান। আজ একটা দফারফা না করে…

ইহান অনেকক্ষণ ধরে তনুর অভিযোগ গুলো শুনছিল। এবার আর সে তনুকে অভিযোগ করার সুযোগ দিল না। তনুর কানে কানে বলল,

–‘আজকের জন্য এই অভিযোগ গুলোই যথেষ্ট। তোমার বাকি অভিযোগ এখন তোলা রইল। পরে শুনব। অলরেডি তিনটা বাজে। আজকের রাত আমি তোমার অভিযোগ শুনে নষ্ট করতে চাই না।’

ইহান এক সপ্তাহের জন্য হারুনকে বলে তার সব কাজ পিছিয়ে নিল। পুরো সপ্তাহটা শুধু তনু আর সে। হারুন ওদের হানিমুনের সব ব্যবস্থা করেছে।

–‘সাবধানে যাবেন স্যার।’

–‘হারুন, বউ নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে এক সপ্তাহর জন্য আমি যেন তোমার একটা মিস কলও না পাই। বুঝেছ?’

–‘জি স্যার।’

বিয়ের পর তনুর হয়েছে এক জ্বালা। ফুপু আম্মাকে সে ভুলেও যদি ফুপু আম্মা ডেকে ফেলে তাহলেও ফুপু আম্মা রাগ করে। এক দিনে এত বছরের অভ্যাস পাল্টানো যায়? শাশুড়িকে মা ডাকতে হয়। অথচ ফুপু আম্মাকে মা ডাকতে তনুর লজ্জা লাগে।

–‘এবার আমাকে তাড়াতাড়ি দাদী বানিয়ে দিস মা। নাতি নাতনি নিয়ে আমুদ উল্লাস করার বয়স তো চলেই যাচ্ছে। আর কবে ওদের সাথে খেলব!’

তনু লজ্জায় রাঙা হয়ে সাবিনাকে ছেড়ে আহানের সামনে এসে দাঁড়াল।

–‘আহান ভাই, আপনি তো আমাকে ছোট বোনের মর্যাদা দিয়েছেন তাই না?’

–‘হুম।’

–‘তাহলে এটা আমার অনুরোধও না। আবদারও না। ছোট বোনের অধিকার চাইছি আপনার কাছে। দিবেন তো?’

–‘কী চাও তুমি বলো।’

–‘এখন না। আমি ফিরে এসে আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। আপনি কিন্তু আমার সাথে যাবেন। আমি যা বলব আপনাকে শুনতে হবে। আপনি না করতে পারবেন না।’

–‘ঠিক আছে।’

ইহান বেরুবার সময় আড়চোখে তনুকে দেখে বলল,

–‘ভাসুরের সাথে এত খাতির কবে হয়েছে তোমার? মতলবটা কী?’

তনু হেসে বলল,

–‘বান্ধবীকে ভাসুরের গলায় ঝোলাতে চাচ্ছি। সেজন্য ভাসুরকে হাতে রাখতে হচ্ছে।’

–‘বান্ধবী! মিতা?’

–‘কেন? ভাবি হিসেবে আমার এই বান্ধবীটিকে আপনার পছন্দ হয়নি?’

ইহান উদাস গলায় বলল,

–‘দুই বান্ধবী মিলে পাঁচ বছর কম জ্বালিয়েছ? এবার এক বাড়িতে এসে কী খেল দেখাতে সেটাই ভাবছি।’

–‘আপনাদের দুই ভাইয়ের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো। ইহান ভাই, আমাদের বিয়েতে শান্তি আসেনি?’

ইহান ত্যাড়া চোখে তনুকে দেখল। বলল,

–‘এখনও ইহান ভাই! ভবিষ্যতে ছেলেমেয়ের সামনেও কি ভাই ডাকবে?’

–‘আপনাকে তো আমার ইহান ভাই ডাকতেই ভালো লাগে।’

–‘কিন্তু স্বামীকে ভাই ডাকলে যে পাপ হবে।’

–‘শান্তি কেন এলো না?’

–‘ও সেকেন্ড টাইম প্রেগন্যান্ট। কিছু জটিলতার জন্য জার্নি করা নিষেধ। ওর সাথে আমার কথা হয়েছিল।’

তনু হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে লাগল। ইহান কিছুটা না, অনেকটা অবাক হলো। এভাবে হাসার মত কোন কথাটা বলেছে সে।

–‘হাসছো যে!’

–‘শান্তির ছেলে আপনাকে মামা ডাকবে।’

–‘আমার ছেলেও শান্তিকে আন্টি ডাকবে। শুধু তাড়াতাড়ি একটা ছেলে নিয়ে এলেই হয়। যেভাবেই হোক এক্সের থেকে প্রতিশোধ নিতেই হবে। আমার যদি ছেলে হয়, আর ওর সেকেন্ড বেবি মেয়ে হয়। তাহলে ওকে বিয়ান বানাবো।’

তনুর লজ্জা লাগলেও তার হাসি থামছেই না। ইহান মুগ্ধ হয়ে তার প্রিয়তমাকে দেখছে।

সমাপ্ত
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here