সুখের পাখি পর্ব -৫১+৫২

#সুখের_পাখি

৫১
তনু মিতাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছে। সৌরভ ভাই বলেছে এখানে আসবে। এখনও আসছে না কেন? তনু খুব ভয়ে ভয়ে সৌরভ ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য এসেছে। শান্তির কথাটা সৌরভ ভাইকে জিজ্ঞেস করবে। ইহান আর সৌরভ স্কুল লাইফের বন্ধু। সৌরভ ভাই নিশ্চয় শান্তির কথা জানবে। কাল রাতের ওই ঘটনার পর তনুর মনে ভয় ঢুকে গেছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে ওই মেয়েটাই ইহান ভাইয়ের পুরোনো প্রেমিকা শান্তি। নইলে অত রাতে ইহান ভাই তাকে জড়িয়ে ধরে ওভাবে কাঁদছিল কেন? বারবার কেন বলছিস, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেও না তনু। তনু তো কোথাও যাবে না। তারপরও ইহান ভাই ভয় পাচ্ছিল কেন?
সন্ধ্যায় ওই স্বামী স্ত্রীকে দেখে আসার পর থেকেই ইহানের মাঝে অস্থিরতা লক্ষ করেছে তনু।

–‘মিতা, আমার না ভীষণ ভয় হচ্ছে রে।’

–‘ভয় কিসের বল তো? আমরা লোকটাকে রিকোয়েস্ট করব যাতে আজকে আমাদের দেখা করার ব্যাপারে ইহানকে কিছু না জানায়।’

–‘এই জন্য আমার ভয় হচ্ছে না।’

–‘তাহলে?’

–‘কালকের ওই শান্তি যদি সত্যি সত্যিই ইহান ভাইয়ের শান্তি হয় তখন! তখন কী করব আমি?’

–‘তুই না বলেছিস তনু ওই মেয়ের স্বামী বাচ্চা আছে। মেয়েটি জামাই আর বাবুকে ছেড়ে এসে আবার তোর ইহানের ঘাড়ে ঝুলবে তা ভাবছিস কেন?’

–‘জানি না। আমার কেমন ভয় হচ্ছে। ইহান ভাইকে ওরকম ভাবে কাঁদতে আমি কোনোদিনও দেখিনি।’

সৌরভকে আসতে দেখে তনু সোজা হয়ে বসলো। এখন তার অনেক সাহস দরকার। সৌরভ ওদের দেখে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে হাসল।

–‘কী ব্যাপার ভাবি! অত তলব করে ডাকার আসল উদেশ্যটা কী? আমার ভাইটা কোথায়?’

সৌরভ লক্ষ করলো ওরা কেউ মজা করার মুডে নেই। ওদেরকে যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে। সৌরভ নড়েচড়ে বসে বলল,

–‘কী হয়েছে তনু? ইহান কি আবার রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?’

তনু তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,

–‘না,না। ইহান ভাই বাড়িতেই আছে।’

সৌরভের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। তাকে এখানে ডেকে আনার উদেশ্য এখনও বুঝতে পারেনি সে।

–‘তাহলে?’

তনু ইতস্তত করছে। কীভাবে বলবে সে কথাটা। সৌরভ তনুকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে নিজেই বলল,

–‘কিছু বলবে তনু?’

–‘হ্যাঁ। আসলে… সৌরভ ভাই, আপনি শান্তিকে চিনেন?’

–‘কোন শান্তি?’

–‘ওই যে, ইহান ভাইয়ের গা-গ…

তনু বলতে পারছে না দেখে মিতা বলে উঠল,

–‘আপনার বন্ধুর এক্স। শান্তি। ওকে চিনেন না আপনি?’

সৌরভ এবার আসল কারণ বুঝল। এইজন্য ওরা ওর সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল! ইহান এসব জানে?

–‘শান্তিকে চিনব না কেন? চিনি। ও আমাদের সাথেই পড়ত।’

–‘তনু ওর কথাই বলছে।’

সৌরভ সরাসরি তনুর উদেশ্যে প্রশ্ন করল,

–‘শান্তির ব্যাপারে কী কথা বলবে?’

তনু এক এক করে সৌরভকে সব খুলে বলল।

–‘কাল আপনাদের কাছ থেকে যাওয়ার সময় রাস্তায় একটা মেয়ের সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল। সাথে মেয়েটার স্বামী, বাচ্চা ছিল। বৃষ্টির মধ্যে ওদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই ইহান ভাই কেমন হয়ে যায়। বাড়ি গিয়ে কান্নাও করেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইহান ভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ কিছু না ভেবে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।’

–‘কিন্তু তনু শান্তি তো দেশে থাকে না। ওর হাজবেন্ডের সাথে বাইরে থাকে।’

–‘আপনি কি খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন ওরা দেশে এসেছে কি-না?’

–‘তা হয়তো পারব। তবে শান্তি আর ইহানের জীবনে ফিরে আসবে না। এ নিয়ে তুমি ভয় পেও না। ও ভীষণ ভালো মেয়ে। আমরা তো ওকে চিনি।’

তনুর মনের মধ্যে কোন ভয় কাজ করছে তা শুধু ও-ই জানে। শান্তি হয়তো ইহান ভাইকে ভুলে গেছে। কিন্তু ইহান ভাই তো এখনও ওকে ভুলতে পারেনি। নইলে কাল ওকে দেখার পর ইহান ভাই অমন ভাবে কাঁদবে কেন? শান্তিকে ওর স্বামীর সাথে দেখে ওর নিশ্চয় কষ্ট হয়েছে। তনু ভয় পাচ্ছে ইহান ভাই যদি এখনও শান্তিকে ভালোবাসে তাহলে সে কী করবে? ইহান ভাই তার সাথে থেকে অন্য একজনের জন্য এখনও কষ্ট পাবে এটা তনু কখনও মেনে নিতে পারবে না। সে নিজের চোখে এতটাও ছোট হতে পারবে না যে, ও জানবে মানুষটা পুরোপুরি ওর না। তবুও তার সাথে থাকবে। তনুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ইহান ভাই যদি শান্তিকেই এখনও ভালোবাসে তাহলে তনু ওকে ছেড়ে চলে যাবে। সৌরভ চলে যাবার আগে মিতা বলল,

–‘আমরা যে আজ আপনার সাথে দেখা করেছি তা প্লিজ আপনার বন্ধুকে বলবেন না।’

সৌরভ হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,

–‘চিন্তা করবেন না। আমি ইহানকে কিছুই বলব না।’

–‘সৌরভ ভাই, শান্তির সাথে আমার দেখা করাতে পারবেন?’

সৌরভ তনুর কথায় বিস্মিত হলো। তনু আসলে কী চাইছে!

–‘ওকে দেখার আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কাল হয়তো নিজের অজান্তেই ওই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আমি ওর সাথে একটা বার কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ ওই ব্যবস্থাটা করে দিবেন?’

সৌরভ কিছু ভাবল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–‘দেখি। শান্তি দেশে এলেও কতদিন থাকবে তা তো জানি না। যদি ওর সময় হয়।’

শান্তি দেখল তার সামনে একটা ফুটফুটে মেয়ে বসে। মেয়েটা তার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার সে কী চেষ্টা! মেয়েটাকে দেখে কেনই যেন মায়া হলো ওর। আপন আপন মনে হতে লাগল ওকে। সেদিন বৃষ্টির রাতে ইহানের সাথে এই মেয়েকেই দেখেছিল ও। শান্তি শব্দ করে গলা পরিষ্কার করল। উঁহু তনু তার দিকে ফিরছে না। কথা শুরু করল সে। খুব নরম গলায় বলল,

–‘তোমার নাম তনু?’

–‘হুম।’

–‘ইহানের কাজিন তুমি?’

ছলছল চোখে তনু শান্তিকে দেখল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাত্র। তারপর মাথা নুইয়ে বলল,

–‘হুম।’

শান্তি মনে মনে হাসছে। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে! কিসের ভয়? ইহানকে ওর থেকে চুরি করে নিবে ও!

–‘তনু।’

–‘হু।’

–‘আমাকে তুমি চেনো?’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল তনু। চিনে সে। শান্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তনুও মাথা নীচু করে মুখে তালা দিয়ে বসে আছে। শান্তি তনুকে দেখছে। এই মেয়েকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সে। মেয়েটা ইহানকে এতটা ভালোবাসে! ইহানের ভাগ্যে হয়তো তনুই লেখা ছিল। তাই তো সে ইহানের জীবন থেকে চলে গেছে। অনেকটা সময় পর শান্তি স্নেহভরা কণ্ঠে বলল,

–‘ইহানকে তুমি ভালোবাসো তনু?’

তনুর চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কান্না পাচ্ছে তার। গলায় কিছু আটকে আছে। যার জন্য কথা বলতে পারছে না।

–‘আমাকে বলো তনু। আমি তোমার ইহানকে তোমার থেকে কেড়ে নেব না। আমার এখন সুন্দর একটা সংসার আছে। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে এমন একটা স্বামী আছে। আমার ছেলেকে তো দেখেছ তুমি। ওদের ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। ওরাই এখন আমার পৃথিবী। ওদের ছেড়ে আসার কথা কল্পনাও করতে পারি না আমি। বলো, তুমি ইহানকে ভালোবাসো?’

–‘হুম। কিন্তু ইহান ভাই আমাকে ভালোবাসে না। ও এখনও আপনাকে ভালোবাসে।’

শান্তি হাসল। তনু কেঁদেই ফেলেছে।

–‘ইহান তো একটা পাগল। ও আমাকে কবেই ভুলে গেছে। শুধু নিজের বাবার উপর জেদ করে আমাকে মনে রেখেছে। ইহান নিজেও জানে না আমার জায়গা ও অনেক আগেই তোমাকে দিয়ে ফেলেছে তনু। আমি ওর চোখ দেখেই বুঝেছি। প্রথম দিন ও আমাকে দেখে খুশি হতে পারেনি। ওর সাথে সেদিন তুমি ছিলে। ও বারবার তোমাকে দেখছিল। আমার সাথে তোমার পরিচয় হোক এটা ইহান চায়নি তখন। আমি ওর চোখ দেখে সব বুঝে যাই। তাই তো সেদিন ওভাবে চলে গেল।’

তনু অভিমানী গলায় বলল,

–‘আপনি উনার চোখ দেখে সব বুঝতে পারেন। আমি তো পারি না।’

শান্তি শব্দ করে হেসে ফেলল।

–‘আরে বোকা। আমি কি ভালোবাসা থেকে বুঝি? অভিজ্ঞতা। এত বছর সংসার করে এটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। ছেলেদের চোখ দেখে মনের কথা কিছুটা পড়তে পারি।’

–‘সেদিন আপনাদের সাথে দেখা হলে বাড়ি ফেরার পর ইহান ভাই অনেক কেঁদেছে। ওকে এমনভাবে কাঁদতে আমি কখনও দেখিনি। আপনার জন্য এখনও ওর কষ্ট হয়।’

কথাগুলো বলেই তনু ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। তার চোখে যে আজ কী হয়েছে!
শান্তি নিশ্চুপ তনুকে দেখে যাচ্ছে। অনেকটা সময় দু’জন চুপ থেকে কেটে গেল।
তনু শান্তির দিকে সরাসরি তাকাতে না পারলেও আড়চোখে ওকে দেখছে। কয়েকবারই শান্তির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেছে।

–‘তুমি ইহানকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো তনু। তখন আমরা দু’জনই ছোট ছিলাম। অবুঝই বলা যায়। আবেগকে ভালোবাসা ধরে নিয়েছিলাম। আমাদের ভালোবাসা ছিল না তনু। ভালোলাগা ছিল। ভালোবাসা কী তা আমি বিয়ের পর বুঝেছি। ও আমাকে ভালোবাসার আসল মানে বুঝিয়েছে। আমি তো লাইফে মুভ অন করে গেছি তনু। কিন্তু ইহান পারেনি। ওর ধারণা ওর বাবার জন্যই ও আমাকে পায়নি। বাবার প্রতি রাগ থেকে ইহান এখনও সেখানেই পড়ে আছে। তুমি ওর হাত ধরে ওকে জীবনে এগিয়ে নিয়ে চলো। তুমি আমাকে কথা দাও তনু, ইহানকে তুমি অনেক, অনেক, অনেক ভালো রাখবে। ওকে সব সময় ভালোবাসবে। কখনও ওকে ছেড়ে যাবে না।’

–‘আপনি অনেক ভালো শান্তি আপু।’

শান্তি অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে ফেলল। তার চোখ ছলছল করলেও ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি লেগে আছে।
তনু এখানে আসার কথা বাড়িতে কাউকে বলে আসেনি। ইহান ভাই, ফুপু আম্মা তাকে খুঁজবে। তাই আর না বসে তনু উঠে গেল। তনু চলে যাবার পরও শান্তি বসে রইল। উঠলো না সে। হঠাৎ শান্তির কী হয়ে গেল, সে-ও এখন তনুর মতই কাঁদতে লাগল। তনুকে কয়েকটা মিথ্যা কথা বলেছে সে। ইহানকে সে-ও এখনও ভুলতে পারেনি। ওকে পুরোপুরি ভাবে ভুলে যাওয়া সম্ভবও না। ওর জীবনের প্রথম ভালোবাসা, প্রথম পুরুষ তো ইহানই ছিল।

–‘হয়তো তুমি ইহানকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসো। তাই বলে আমার ভালোবাসাও ওর জন্য কম ছিল না তনু। আমাদের ভালোবাসা কোন আবেগ ছিল না। আমরা সত্যিই দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছিলাম। আমাদের এক হওয়া ভাগ্যে লিখা ছিল না। ও তোমার ছিল বলেই আমি ওকে হারিয়েছি। আমার এখন সব আছে। তবুও বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে। এই কষ্টটা সারাজীবন আমাকে একাই ভয়ে যেতে হবে। কাউকে জানাতে পারব না আমি। তোমাকে না। ইহানকে তো না-ই। তুমি ওকে ভালোববেসো। ভালো রেখো। আমার কথা ওকে মনে পড়তে দিও না।’
#সুখের_পাখি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫২
বাড়ি ফিরেই তনু ইহানের সামনে পড়ে যায়। ইহান ওকে বাইরে থেকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

–‘কোথায় গিয়েছিলে?’

তনু ভয় পেয়ে যায়। ইহান ভাই যদি জানে সে শান্তির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তাহলে নিশ্চয় রাগ করবে। চট করে তনু মিথ্যা কথা বলে ফেলল।

–‘মিতাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।’

–‘ও।’

তনু স্কলারশিপ পেয়ে গেছে। ইহানই ওর কাগজপত্র জমা দিয়েছিল। এই কথা জানার পর থেকেই তনুর মন খারাপ হয়ে আছে। যা মানুষের স্বপ্ন থাকে। কত চেষ্টা করেও পায় না। তা পেয়েও তনু খুশি না। সে ইহানকে ছেড়ে কোথাও যাবে। ইহান বিষয়টা তার মা’কে বললে সাবিনাও তনুকে বোঝায়।

–‘এই পাগলী! যাবি না মানে কি? মানুষ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পায় না। তুই পেয়েও যাবি না বলছিস!’

তনু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

–‘আমি একা গিয়ে ওখানে থাকতে পারব না ফুপু আম্মা।’

–‘খুব পারবি। না পারলেও পারতে হবে। তোর বাবার স্বপ্ন ছিল তুই প্রতিষ্ঠিত হবি। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে না মা। রাজি হয়ে যা রে তনু। কয়টা বছরই তো। তারপর তো ফিরেই আসবি।’

সেই রাতেই তনু ইহানের ঘরে এসে হাজির। তার কথা সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল।

–‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার পড়াশোনার দরকার নেই।’

ইহান কিছুটা শক্ত গলায় বলল,

–‘তোমার ফিউচার নষ্ট করার জন্য আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। তুমি যদি এখন আমার জন্য এতবড় সুযোগ মিস করো। তাহলে এরজন্য সারাজীবন আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।’

তনু কান্না চেপে ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইহানকে সে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না।

–‘কেন যাবে না তুমি? আমি বলেছি না আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার।’

তনু চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ইহান ওর সামনে এসে দাঁড়াল। দু’হাতে তনুর মুখ তুলে ধরার সাথে সাথে তনু কান্নায় ভেঙে পড়ে ইহানের বুকে মুখ লোকালো। ইহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

–‘একদিন তুমি অনেক বড় হবে তনু। সেদিন তোমার জন্য আমার গর্ব হবে। তোমার নিজের একটা পরিচয় হবে। তখনও আমি তোমার পাশে থাকব। এখন যেমন আছি।’

তনু কিছু বলছে না। তার পিঠ ফোলে ফোলে উঠছে। ইহানের শার্ট শক্ত করে ধরে রেখেছে ও। তনুর কান্না কি ইহানকে কষ্ট দিচ্ছে না? তার বুকের ভেতরও তো কষ্ট হচ্ছে। দু’হাতে তনুকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

–‘তুমি এরকম করলে যে আমারও কষ্ট হবে তনু। তুমি এত অবুঝ কেন? আমি যদি কোনোদিন তোমার সাথে না থাকি তখন কে দেখবে তোমাকে? তোমার নিজের জন্যই তোমাকে পড়তে হবে। আমি তো সবসময় তোমার সাথে না-ও থাকতে পারি। তুমি যে আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে, আমিই যদি না থাকি তখন তোমার নিজেরটা নিজেকে দেখতে হবে না!’

তনুর কান্না আরও বেড়ে গেল। ইহান জোর করে ওকে ছাড়িয়ে মুখ সোজা হয়ে ধরল। এখনও ফোঁপাচ্ছে মেয়েটা। লাল লাল চোখ দু’টো দেখে ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। চোখের পানি দিয়ে গাল ভেজা। কয়েকটা চুল ভেজা গালে লেপ্টে আছে। ইহান ওর ভেজা চোখের পাতায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। তনু ডুকরে উঠল। নাকের পাটা ফোলে ওঠার সাথে সাথে ওর ঠোঁট দু’টো থরথর করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে ইহানের আদর গ্রহণ করছে তনু। চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রু ইহানের হাতের উপর পড়ল। এই মুহূর্তে ইহান কিছু না ভেবে নিষিদ্ধ একটা কাজ করে ফেলল। সে কোনোদিনও তনুর সাথে এরকম কিছু করতে চায়নি। কিন্তু তনুকে কাঁদতে দেখে নিজের সাথে করা ওয়াদা ভুলে গেল সে। কিছুক্ষণ পর তনুকে ছেড়ে দিয়ে ইহান বলল,

–‘তুমি আমার কথা শুনবে। আমি সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারব তনু। মাত্র তো কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি। অপেক্ষা করব আমি। তোমার ইহান ভাই শুধু তোমারই থাকবে। তোমার পরে আমার জীবনে আর কেউ আসতে পারবে না।’

তনুর যাবার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ইচ্ছে না থাকলেও তনুকে যেতে হবে। নিজের ঘরে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছিল তনু। ফুপ হাজার বার করে জিজ্ঞেস করেছে, সব নেওয়া হয়েছে তো? ভালো করে দেখে বল কী কী বাকি রয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে ঝামেলা পড়লে কে দেখবে তোকে? তনু তা-ই দেখছিল। কিছু বাদ পড়েছে কি-না। তখনই ফোন বেজে ওঠে। মিতা তাকে সান্ত্বনা দিতে কল করেছে নিশ্চয়।
কল তুলে নিরাসক্ত গলায় তনু বলল,

–‘বল।’

–‘কই তুই?’

মিতার গলা শুনে তনু নড়েচড়ে বসল।

–‘কী হয়েছে তোর? এত উত্তেজিত লাগছে কেন তোকে?’

–‘এক্ষুনি একবার আসবে পারবি তুই?’

–‘কোথায়? কেন? কী হয়েছে বলবি তো।’

–‘এসে নিজের চোখেই দেখে যা।’

–‘আচ্ছা আসছি আমি।’

তনু ভেবেছিল মিতার কিছু হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার সময়ও সে মিতার কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছিল। আসার পথে কয়েকবার মিতাকে কল করে। এখানে এসেও তনু ভাবেনি এমন কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। ইহান আর শান্তি একটা টেবিলে সামনাসামনি বসে আছে। ইহানের মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে শান্তির চোখে একরাশ ব্যথা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। তনু ওদেরকে একসাথে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মিতা ওর হাত ধরে আড়ালে টেনে নিয়ে গেল।

–‘দেখলি তো! নিজের চোখেই দেখ। যাবার আগে এই ছেলের আসর রূপ দেখে যা। আমি বললেও তো বিশ্বাস করতি না। এখন নিজের চোখে দেখ। নিজের কানে শোন।’

ওরা দু’জনের কেউই কোনো কথা বলছে না। ইহানই আগে জিজ্ঞেস করল।

–‘কেমন আছো শান্তি?’

–‘ভালো। তুমি ভালো আছো তো ইহান?’

–‘আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি খারাপ আছি? আমিও ভালোই আছি। খারাপ থাকব কেন বলো?’

–‘হু। কী করছো আজকাল।’

–‘তেমন কিছু না। গানটান গাই। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে।’

–‘একটা সময় আমি তোমার গানের গলার প্রশংসা করতাম। তুমি ওসবে পাত্তা দিতে না। গানবাজনা তোমার ভালো লাগতো না বলতে।’

–‘মাঝে মাঝে ভালো লাগার জিনিস গুলোকেও ধরে রাখা যায় না। দূরে চলে যায়। তখন খারাপ লাগা জিনিস গুলোকেই আঁকড়ে ধরতে হয়।’

শান্তি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কান্না গিললো। তার উপর ইহান এখনও রেগে আছে।

–‘কাউকে ভালোবাসো ইহান?’

–‘তা জেনে তোমার কী কাজ? এসব জানার দরকার আছে কোন?’

শান্তি চুপ করে রইল। ইহান ওকে কথা দিয়ে কষ্ট দিতে চাইছে।

–‘আমার একটা ছেলে আছে। জানো তার কী নাম রেখেছি?’

ইহান কিছু বলল না। শান্তিই বলল,

–‘ওর নাম শান।’

কথাটা শুনেও ইহানের কোন ভাবান্তর হলো না। তবে সে বুঝতে পারছে শান্তি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে। শান নামটা ইহানই ভেবেছিল। শান্তির ‘শা’। ইহানের শেষের অক্ষর ‘ন’। শান। শান্তি ইহানের পছন্দ করা নামটা ওর ছেলের রেখেছে।

–‘তুমি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করোনি?’

–‘ভালো লাগে না। তাই ছেড়ে দিয়েছি।’

কথা বলতে বলতে ইহান পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। শান্তি বিস্মিত চোখে ওকে দেখছে।

–‘তুমি সিগারেট খাও!’

ইহান কিছু না বলে হাসল। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। শান্তি যেন নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সিগারেটের গন্ধ ইহান সহ্যই করতে পারত না। আজ কি-না ইহান তার সামনে বসে নিজেই সিগারেট খাচ্ছে! শান্তি বুঝতে পারছে এই ইহানের সাথে আগের ইহানের কোন মিল নেই। ইহান পুরোপুরি পাল্টে গেছে।

মিতা ফিসফিসে গলায় বলল,

–‘আরও দেখবি? দেখার ইচ্ছে আছে? চল এখন। এখানে নাটক হচ্ছে।’

তনু নড়ল না। ইহান ভাই আরও কী বলে সব দেখে এবং শুনে যাবে সে।

–‘তুমি এতটা পাল্টে গেলে কীভাবে ইহান? তুমি তো এমন ছিলে না।’

আস্তে আস্তে ইহানের শান্ত ভাবটা চলে যাচ্ছে।

–‘তুমি পালটাও নি? তুমি এমন ছিলে?’

–‘আমার কথা ভিন্ন। আমি একজন মেয়ে। আমাদের না চাইতেও অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়।’

ইহান এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। গলার স্বর চড়ে যাচ্ছে ওর।

–‘কিছুই পালটাতে হতো না। সবকিছুই আগের মত থাকত। যদি তুমি আমার কথা শুনতে। শুনোনি তুমি। আমার সাথে বেরিয়ে আসোনি। নিজের বাবা মা’র কথা শুনেছ। আমি বলেছিলাম, আমার সাথে চলো শান্তি। তুমি আসোনি। বাবার কথা বিয়ে করে নিলে। আমার কথা একবারও ভাবলে না। আমার জন্য তোমার সব পাগলামি মিথ্যা ছিল। তোমার ভালোবাসা একবিন্দু সত্য ছিল না। সব নাটক ছিল। সব। নইলে তুমি আমার সাথে আসতে। তোমার জন্য এতগুলো বছরেও আমি আমার বাবার সাথে কথা বলি না। তোমার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়েছে। তুমি সব ভুলে গিয়ে দিব্যি সংসার করছ। ছেলে মানুষ করছ। স্বামীর চোখে আদর্শ স্ত্রী হয়ে থাকছ। অথচ আমাকে দেখো…

তনু আর শুনতে পারল না। মুখে হাত চেপে কেঁদে ফেলল ও। মিতা ওকে টেনে ওখান থেকে নিয়ে চলে এলো।
ইহানের চিৎকারে এখানের অনেক মানুষই ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখছে। তা লক্ষ করে। গলা পরিষ্কার করে নিল ইহান। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,

–‘এখন সেসব কথা বলার আর কোন মানে নেই। যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি চলে না গেলে আমি তনুকে পেতাম না। তুমি নেই বলেই তনু আমার জীবনে এসেছে। ওকে আমি যতটা ভালোবাসি, তার থেকে ও আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। তনুকে দেখেছ তো তুমি? ওইদিন আমার সাথে ছিল। আমি এখন শুধু তুনকেই ভালোবাসি। ওকেই বিয়ে করব। তুমিও তোমার স্বামী ছেলে নিয়ে সুখে থাকো। আমি এখন উঠব। তনু স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছে। কাল ওর ফ্লাইট। আমাদের জন্য দোয়া কোরো। বিয়েতে দাওয়াত দিলে আসবে তো? আচ্ছা উঠি। বাই।’

চলবে 🍂
চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here