#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_১৫
#Tabassum_Kotha
“আপনি নিচে কিছু না বলেই চলে এলেন কেনো?”
টাওয়াল হাতে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে তুর্য। মাত্রই পরনের শার্ট টা খুলেছিলেন শাওয়ারে জন্য।
তুর্যর উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।
— কেনো কিছু বললেন না। তাফসি যেটা করতে চলেছে সেটা ভুল। কেনো আপনি তাকে ফেরালেন না?
তুর্য খুবই শান্ত গলায় বললেন,
— তুমি এখনও ক্লাসের জন্য যাও নি? সময় হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার নিচে ওয়েট করছে তোমার।
— একদম কথা ঘুরাবেন না। ক্লাসের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা।
— কারো পারসোনাল ম্যাটারে নাক গলানো ব্যাড ম্যানার। সো নিজের চরকায় তেল দাও।
— তাফসি আমার বোনের মতো। আমি বেঁচে থাকতে ওর জীবন নষ্ট হতে দিতে পারি না। সো আমি নাক গলাবোই।
— সবকিছু তাফসির চোখের সামনে। তবুও যদি সে অন্ধের মতো রায়ানকে বিশ্বাস করে তবে আমার ই বা কি করার আছে।
— আছে অনেক কিছু আছে। এতো সহজে হার মানা ঠিক না। তাফসির ভালোর জন্য যেখানে আমরা একটা অকাম্য বিয়ের সম্পর্কে জরিয়েছি সেখানে আরেকটু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
হীর এর মুখ থেকে ‘অকাম্য বিয়ে’ শব্দটা শুনে তুর্যর বুকটা মুচড়ে উঠে। সত্যি তো এই বিয়েটা তো হীর তাকে ভালোবেসে করে নি। দায়ে পরে জোর করে তার গলায় এই বিয়ে নামক ফাঁস ঝোলানো হয়েছে। তুর্যর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকেই তার সামনে চলে এসেছে। শুধুমাত্র দায়িত্বের খাতিরে যেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেখানে ভালোবাসা আশা করা টা তুর্যর ই বোকামি হয়েছে।
“তুমি কি সত্যি শুধু তাফসির জন্য বিয়ে টা করেছিলে?”
নিজের মনকে অনেকটা মিথ্যে আশা দিয়ে হীর কে প্রশ্ন টা করে তুর্য।
“হ্যাঁ। আর কি কারণ থাকতে পারে বলুন!”
হীর কোনোকিছু না ভেবেই উত্তর দিয়ে দেয়।
হীর এর উত্তরে তুর্যর হৃদয় ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে যায়। এতোদিন তার মনে হতো হয়তো হীর ও তাকে ভালোবাসে কিন্তু আজ তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে হীর তাকে ভালোবাসে না। কখনই ভালোবাসে নি।
— এতো কি ভাবছেন! কিছু তো বলুন! তাফসিকে আপনি বোঝান। বড় আব্বুও বাসায় নেই। এই সুযোগ টাই নিচ্ছে রায়ান।
— মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। গেট মি অ্যা কফি।
এতোক্ষণ পর্যন্ত বকবক করেও কোনো লাভ হলো না। তুর্যর এতো উদাসীন ভাব তাও আবার তাফসির প্রতি! কিছুতেই মানতে পারছি না। কেনো কিছু করছেন না উনি!
.
শাওয়ারের নিচে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য। চোখ বন্ধ করে পানির প্রতিটি ফোঁটা কে নিজের বুকে জমে থাকা কষ্টের সমুদ্রে মিশিয়ে নিচ্ছে। আজ এই ঝর্ণার ঠান্ডা পানিও তার মনকে শান্ত করতে পারছে না। বুকের বা পাশটায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। কোনো কিছুই ভাবতে পারছে না সে। হয়তো হীর কখনই তাকে ভালোবাসতে পারবে না। হয়তো তাকে সারাটা জীবন এভাবেই হীর এর অচেনা হয়ে থাকতে হবে। এমনও হতে পারে তাফসির জীবনে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর হীর তুর্য কে ছেড়ে চলে যাবে! না, তুর্য সেটা হতে দিতে পারে না। হীর কে হারিয়ে যে সে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু কোন অধিকারে সে হীর কে নিজের করে রাখবে!
এসব ভাবতে ভাবতে তুর্যর দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু কণারা ঝরে যাচ্ছে। চোখের পানি আর ঝর্ণার পানি একসাথে মিশে নিচে পরছে। দুটো পানি আলাদা করা না গেলেও হয়তো চোখের পানির পরিমাণ ই সেখানে বেশি।
.
সারাদিনে তুর্য আর হীর এর সাথে তেমন কথা বলে নি। হয়তো কিছু বলতে গেলে তার কষ্টগুলো কান্নার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসতো।
হাজার চেষ্টা করেও তাফসিকে কিছুই বোঝাতে পারি নি। আমার কোনো কথাই শোনার জন্য প্রস্তুত না সে। এদিকে তুর্যও আমার সাথে কথা বলেন নি সারাদিনে। কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম! পুরো দিনটাই খারাপ গেলো। আচ্ছা কাল রাতের জন্য তুর্য আমার উপর রাগ হয়ে আছেন কি? এই কারণে কি কথা বলেন নি। কাল রাতে বাসায় থেকে যাওয়ার আগের ঘটনার জন্যেই হয়তো এখনও রাগ করে আছেন। কিন্তু এখানে রাগ করার অধিকার টা আমার। ওই জেসিকার সাথে লুতুপুতু করেতে পেরেছেন অথচ আমি রাগ করতে পারবো না।
হীর কে রুমের দিকে আসতে দেখে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টা তুলে তুর্য ব্যালকনিতে চলে যায়। হীর এর সাথে চোখ মেলাতে চায় না সে। কিন্তু প্রতিদিন বাড়ির বাইরে থাকা সম্ভব নয় তাই এই উপায় বের করেছে সে। হীর রুমের ভিতর কাউচে হেলান দিয়ে তুর্যর ভিতরে আসার অপেক্ষা করছে। কাল রাতের জন্য তুর্য এখনও রেগে আছে কি না সেটা জানতে চায়।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দুই আঙ্গুলের ভাঁজে নিয়ে চেয়ারটায় গা এলিয়ে দেয় তুর্য। সিগারেট টা যতো পুড়ছে তার থেকেও বহুগুণ জ্বালা পোড়া করছে তুর্যর হৃদয়। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী গুলো যেনো তুর্যর পোড়া হৃদয়ের অবস্থার প্রতীকী।
আমার ভালোবাসার মূল্য তো অনেক দূরেই থাক আমার কোনো কথার মূল্যও এই মানুষটার কাছে নেই।আমার মানা করার পরেও দিব্বি স্মোক করে যাচ্ছেন। আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও হয়তো আমার শেষ কথাটা রাখবেন না উনি।
তুর্যর রুমে আসার অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে হীর ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হীর এর সামনে যাওয়ার সাহস পায় না তুর্য। কেন যেন তার ভীষণ ভয় করছে যদি হীর বলে দেয় যে সে তাকে ভালোবাসে না! হীর এর মুখ থেকে এই সত্যি টা সে কিভাবে সহ্য করবে! তাই রাতটা সে ব্যালকোনিতেই কাটিয়ে দেয়।
.
পরদিন ভোর থেকেই চৌধুরী মেনশনে রায়ান আর তাফসির বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। আফজাল সাহেবের ফিরে আসার পূর্বে তমা বেগম বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে চান। তাফসির মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যা কিছু হয়েছে তাতে রায়ানের কোনো দোষ নেই। তাফসির ইচ্ছা অনুযায়ী ছোট করে একটা হলুদের ফাংশনেরও আয়োজন করেছেন তমা বেগম। তবে বিয়েতে রায়ানের বাবা মা কেউ রাজি নয়। আফজাল সাহেবের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে রায়ান আবার সেই আফজাল সাহেবের মেয়েকেই বিয়ে করতে যাচ্ছে। এতে তারা মোটেও খুশি নন। তাই তাফসির ইচ্ছায় বিয়ের পর রায়ান কে চৌধুরী মেনশনেই রাখবেন তমা বেগম। এতে অবশ্য রায়ান এর সুবিধা হবে হির এর থেকে তার ইনসাল্ট এর প্রতিশোধ নিতে। আফটার অল হীর রায়ানের ইগো হার্ট করছে।
ঘুম থেকে উঠে তুর্য কে রুমে কোথাও পেলাম না। আজকে অনেক বেলা করেই ঘুম ভেঙেছে। এদিকে রাত এ কিছুই খাওয়া হয় নি। ভীষন খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়ার জন্য নিছে নামতেই আমার চোখ ছানা বরা। পুরো বাড়িকে বউ এর মতো সাজানো হয়েছে। প্রথমে কারণ টা বুঝতে না পারলেও কিছুখন পর মনে পরলো কালকে তাফসি আর রায়ান এর বিয়ে। কাল বিয়ে অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না আমি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে চলে গেলাম। এত খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে এখন পুরো বাংলাদেশের খাবার আমি একা খেতে পারব।
খাওয়া দাওয়া শেষে রুম এসে বসে আছি অনেকক্ষন। কিন্তু তুর্য এখনও ফিরে আসেন নি। এদিকে ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। কাল যাওয়া হয় নি। আজ না গেলেই না। আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করেও তুর্য না ফিরলে আমি ক্লাসের জন্য বেরিয়ে পরলাম।
আজ সারাদিনে একবারও তুর্য আমাকে কল করেন নি। এমনকি ক্লাস শেষে নিতেও আসেন নি। কি এমন অপরাধ করে ফেলেছি আমি যার কারণে তুর্য আমাকে এভাবে অ্যাভোইড করছেন! সেদিন রাতের জন্যই কি এমন করছেন? ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে এলাম। এক্সট্রা ক্লাস থাকায় বাসায় ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছে। আজ নিশ্চয়ই তুর্য আমার জন্য চিন্তা করছিলেন! সেদিন যখন ওই লোকগুলো আমার পিছু নিয়েছিল তুর্য আমার জন্য কতোটা হাইপার হয়ে গিয়েছিলেন। তুর্য সত্যি আমার অনেক চিন্তা করেন। তাহলে আজ একটা ফোনও কেনো করলেন না! আমিও না ওভার থিংকিং করি। হয়তো বিজি ছিলেন। আর জরুরি তো নয় যে সবসময় চিন্তা আর ভালোবাসার প্রদর্শনী করতে হবে!
যতোটা আশা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম, ততোটাই হতাশ হতে হলো আমাকে। তুর্য বাসায় নেই। আমি যাওয়ার পর অফিসে গিয়েছেন এখনও ফিরেন নি সেখান থেকে।
রুমে ঢুকার কিছুক্ষণ পরেই বড় আম্মু রুমে এলেন।
— এই ব্যাগ টা ধর।
— এটাতে কি আছে বড় আম্মু?
— তোকে আমি আমার ছেলের বউ মানি না। আর কখনও মানবোও না। কিন্তু যেহেতু তুর্য তোকে বিয়ে করেই নিয়েছে তাই তুই এই বাড়ির বউ।
আমি কিছু বলছি না। মাথা নীচু করে সব শুনছি।
— আমি চাই না চৌধুরী বাড়ির মান সম্মানে আরও দাগ লাগুক। এই ব্যাগে একটা কয়েক টা শাড়ি আর কিছু গয়না আছে। তাফসির বিয়েতে এগুলো পরবি।
— বিয়েতে আমার থাকাটা কি জরুরি?
— তুর্যর ওয়াইফ হিসেবে হলেও থাকাটা জরুরি। ছোট একটা ফাংশন হবে। কিন্তু তবুও চৌধুরী বাড়ির বউকে পারফেক্ট হতেই হবে।
বড় আম্মুর মুখের উপর আর কিছু না বলে চুপচাপ ব্যাগ টা নিয়ে নিলাম। যদিও আমি এই বিয়ের বিপক্ষে কিন্তু আমার যে আর কিছুই করার নেই, চুপচাপ থাকা ছাড়া।
বড় আম্মু চলে গেলে ব্যাগ খুলে হলুদ রঙের শিফনের শাড়ি টা বের করে নিলাম। বুকের বা পাশে চিন চিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তুর্যর সাথে কথা হয় না আজ দুই দিন পার হয়ে গিয়েছে। কেনো তুর্য আমার মনের অবস্থা বুঝেন না? তাকে ছাড়া আমার একটাদিনও যেনো এক দশক এর মতো কাটে। তুর্য কি এখনও জেসিকাকেই চায়? আমি কি তাদের পথিমধ্যে আসছি!
.
হলুদ একটা শাড়ি আর কাঁচা ফুলের গয়নায় সেজে বসে আছে তাফসি। হলুদের সাজে তাকে ঠিক রূপকথার কোনো হলুদ পরীর মতোই লাগছে। তাফসি তার সাজ শেষ করে আয়নায় নিজেকে দেখছে। অতঃপর তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তার জীবনের কাল বৈশাখী ঝড়ের যেনো অবসান ঘটেছে। এতো ঝড় ঝাপটার পর অবশেষে তার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে। আজ সে মহাখুশী। তার এই খুশির তুলনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দিয়েও হবে না।
তমা বেগম তাফসি তৈরি হয়েছে কি না দেখতে এলে মেয়ের হাসি মুখটা দেখে তার অন্তর জুরিয়ে যায়। আজ কতোদিন পর তাফসির মুখে হাসি দেখছে সে। সে যেনো এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তমা বেগম আড়াল থেকেই মেয়েকে দেখে চলে যান। কেনো যেনো তার ইচ্ছা করছিল না তাফসির হাসি থামতে দিতে।
তুর্যর বাড়ি ফেরার আগেই তাফসির হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তুর্য বাড়ি ফিরলে সবার আগে তমা বেগমের সাথে তার দেখা হয়।
— কোথায় ছিলি তুই তুর্য? আজকে তাফসির হলুদ ভুলে গেছিস তুই?
— প্লিজ আম্মু আমাকে এই ড্রামায় ইনভল্ভ্ড্ করো না। তাফসি ইচ্ছা করে কুয়োয় ঝাপ দিচ্ছে আর তুমি তাকে এগিয়ে দিচ্ছো।
— তুর্য! তুই শুধু আমাদের ভুলটা দেখছিস। তুই একবারও তাফসির খুশি টা দেখছিস না। আর কেউ না জানুক তুই জানিস তাফসি রায়ানকে কতোটা ভালোবাসে। আমারমেয়ের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। তুই কি তোর বোনের জন্য এতোটুকু করতে পারবি না?
তুর্য তমা বেগমের কথার উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আজকাল বাড়ির মানুষগুলোর সাথে তেমন কথা বাড়ায় না সে। কে কি করলো এই দিকে খুব কমই খেয়াল করে সে। সময় যতো এগোচ্ছে তার মধ্যেকার উদাসীন ভাবটা যেনো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
হলুদ শাড়ি টা কোনো রকম গায়ে জড়িয়ে নিলাম। বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাফসির হলুদের প্রোগ্রামে যাওয়ার। কিন্তু তাফসি আজ ভীষণ খুশি। দ্বিতীয় বার তার সুখ মাটি করতে চাই না। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা কিছু গয়নায় নিজেকে সাজালাম। জানি না কেমন লাগছে আমাকে। আসলে সাজগোজের হাত একদমই কাঁচা আমার।
দরজায় চোখ পরতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে আমার। তুর্য দরজায় দাঁড়িয়ে। পুরোপুরি ভাবে একদিন পার হয়ে গেছে তাকে আমি দেখি নি। কতো কথা জমে আছে আমার। কতো অভিযোগ বাকি আছে তাকে করা হয় নি!!
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_১৬
#Tabassum_Kotha
তুর্যর ফোন অনবরত বেজে চলছে। দুই বার ইগনোর করলেও তৃতীয় বার ফোনটা হাতেই নিতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে আমার। স্ক্রিনে ইংরেজি অক্ষরে জেসিকার নাম টা ভেসে উঠছে। হঠাত্ করেই আমার হাত দুটো কাঁপতে থাকে। এতোদিন পরে আবার জেসিকা তুর্য কে কন্টাক্ট করেছে। তার মানে তুর্য আর জেসিকার মধ্যকার সম্পর্ক এখনও চলছে! এতোদিন আমার যেটা মনে হতো তাহলে সেটাই সঠিক। তুর্য এখনও জেসিকাকেই ভালোবাসেন। মোবাইল টা আগের স্থানেই রেখে দিলাম। বুকের বা পাশে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যাকে আমি ভালোবাসি সে কেনো অন্য কাউকে ভালোবাসে?সে আমার জীবনসঙ্গী অথচ তার মনের আসনে অন্য কারো অধিকার। কিভাবে মানবো আমি এসব!
তাফসিকে সবাই হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। রায়ানদের বাড়ি থেকে হলুদ এসেছে। কিন্তু তাফসি বলেছিল রায়ানের বাবা মা বিয়েতে রাজি না তাহলে হলুদ কিভাবে এলো! তবে কি এই বাড়িতে থাকার জন্য এটা রায়ানের নতুন প্ল্যান? অবশ্য এটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
তাফসিকে হলুদ ছোঁয়াতে গেলে তমা বেগম হীর কে বাঁধা দেয়।
— তুই আমার মেয়ের হলুদে হাত দিস না।
— কেনো বড় আম্মু? তুমিই তো আমাকে আসতে বলেছিলে।
তমা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বলেন,
— তোকে আসতে বলেছিলাম শুধু মেহমানদের দেখানোর জন্য। পারলে তোকে আমি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও সহ্য করতাম না। দায়ে পরেই আনতে হয়েছে। একবার আমার মেয়ের সব সুখ খেয়েছিস। দ্বিতীয় বার তাফসির ওপর তোর ছায়াও পরতে দেবো না আমি।
— আমি তাফসির খারাপ চাই না বড় আম্মু।
— সেটা তো শুরু থেকেই দেখে আসছি। এখন যা তো এখান থেকে। তোর প্রয়োজন শেষ এখানে। আমার তাফসি আজ অনেক খুশি। তোকে দেখলে আবার ওর মন খারাপ হবে।
মাথা নিচু করে ছাঁদ থেকে নেমে এলাম। জানি না এই বাড়ির মানুষগুলো কখন আমাকে বিশ্বাস করবে। প্রথম প্রথম ভীষণ কষ্ট হতো এসব শুনে কিন্তু এখন সব সয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাফসির বিয়ের জন্য হাফসা ফুপি আম্মু আর কিয়ারাও এসেছেন।
নিচে কোনো কাজ না থাকায় রুমে চলে গেলাম।
রুমে বিভীষিকাময় অন্ধকার।কেনো যেনো মিনিট দশেক আগেও ঘরটা আলোকিত ছিল। কিছুদিন ধরে অন্ধকার দেখলেই ভয় ভয় করে। তুর্যর অন্ধকার ভীষণ পছন্দ। বিয়ের আগে যতোবার তার রুমে আসতাম রুম অন্ধকার করাই পেতাম। কিন্তু এতোদিন পর আবার কেনো! তবে কি তুর্য তার অতীতে ফিরে যেতে চাইছেন? না এই সামান্য ব্যাপার টা কে এতো বড় করা আমার ঠিক হচ্ছে না।
অন্ধকারে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কেউ আমার কোমর চেপে ধরে আমাকে বাঁচায়। নিজেকে সামলে স্বাভাবিক হতেই সেই চিরচেনা ঘ্রাণ আমার ইন্দ্রিয় কে সজাগ করে। এই ঘ্রাণ টা আমাকে প্রতিনিয়তই মাতাল করে তুলে। তুর্য তার হাত আমার কোমরে স্লাইড করছেন। না চাইতেও তার প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে শিহরণ জাগায়। কি আছে এই মানুষটার মধ্যে! কেনো তার সামনে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাকে ভালোবাসার একটা কারণও নেই। অথচ তার থেকে দূরে থাকার হাজার টা কারণ আছে। তবুও নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তার কাছেই ধরা দেই বারংবার।
তুর্য তার হাত স্লাইড করতে করতে আমার উন্মুক্ত পিঠে রাখেন। ব্যাকলেস ব্লাউজ হওয়ায় খুব সহজেই তার দুটো হাত পিঠে জায়গা করে নেয়। চোখ বন্ধ করে তার প্রতিটি স্পর্শ অনুভব করছি। মন বারবার বলছে তার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে তার মধ্যে মিশে যেতে। তুর্যর গরম নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। ক্রমশ নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। তুর্য আমার মুখটা তার দু হাতের আজলে নিয়ে নেশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে এক সাগর ভালোবাসা জমাট বেঁধে রয়েছে। এই ভালোবাসার একমাত্র অধিকারী কি আমি? তুর্য পরম আবেশে আমাকে বুকে জরিয়ে নেয়। না আজ আর কোনো সংশয় নেই। তার ভালোবাসায় শুধু আমার অধিকার!
হঠাত্ সেন্টার টেবিলে রাখা তুর্যর মোবাইল টা বাজতে শুরু করে। অন্ধকার ঘরে মোবাইল স্ক্রিনে জেসিকার নাম টা জ্বলজ্বল করছে।
মনে পরে থাকা ভালোবাসার পর্দা টা ঝট করেই সরে যায়। তুর্য আমাকে ভালোবাসেন না। এতোক্ষণ যা ছিল সবই মায়া ছিল, ছলনা ছিল, মোহ ছিল!
তুর্য হীর এর মোহে এতোটাই ডুবে আছে যে দুইবার করে বেজে বন্ধ হয়ে যাওয়া মোবাইল এর রিংটোনের শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছাতেই পারে নি।
অসহ্য লাগছে তুর্যর স্পর্শ। সে আমাকে ভালোবাসে না তবে কেনো এতো কাছে আমার? তার সব মোহ কি আমার শরীরের প্রতি? তুর্যর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে বেশ জোরে তাকে ধাক্কা লেগে যায়। তুর্য টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যান।
এই ঘটনায় তুর্য হতভম্ব হয়ে যায়। প্রতিবারের মতো এবারও হীর তাকে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু তার সহ্যেরও একটা সীমা আছে যা আজ অতিক্রম হয়েছে।
তুর্য নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে হীর হাত চেপে ধরে। মুহূর্তেই তার চেহারার রং পাল্টে যায়। রাগে তার ফর্সা মুখ টা সম্পূর্ণ লাল হয়ে গিয়েছে।
— তোমার প্রব্লেম টা কি? কেনো তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না?
— হাত ছাড়ুন তুর্য। আমি ব্যথা পাচ্ছি।
— তোমার হাতের ব্যথা টা তুমি সহ্য করতে পারছো না কিন্তু কখনও ভেবেছো কি আমি কিভাবে এতো ব্যথা সহ্য করবো!
— ছাড়ুন তুর্য আমাকে। আপনি আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন।
— তোমার দেওয়া ব্যথার কাছে এটা কিছুই না। কেনো করো তুমি এসব? আমাকে কষ্ট দিয়ে অনেক শান্তি পাও তুমি তাই না!
— আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।
— ইউ আর! তুমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। কজ ইউ আর মাই ওয়াইফ ড্যাম ইট।
— আমি আপনার ওয়াইফ! আমি আপনার ওয়াইফ নাকি আপনার রক্ষিতা? শুধু শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্যেই আমার প্রয়োজন তাই না।
হীর এর কথায় তুর্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হীর এর মুখ থেকে এই কথা শুনতে হবে, এটা তার কল্পনাতীত ছিল। তার ভালোবাসাকে হীর এতো সহজে চাহিদার নাম দিয়ে দেবে এটা সে তার কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি।
— আপনি আমাকে কি মনে করেন? যখন যেভাবে ইচ্ছা তখন সেভাবে ব্যবহার করবেন? আমি মানুষ নাকি কোনো বস্তু? আমার কোনো অনুভূতি নেই? আপনাকে শারীরিক সুখ দেওয়াই কি আমার একমাত্র কাজ? যখন আপনার ইচ্ছা হয় কাছে টেনে নেন!
— জাস্ট শাট্ আপ হীর।
— কেনো? আমি চুপ করবো না। আপনার কোনো চাহিদা মেটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভালোতোবাসেন না তবে কেনো কাছে আসেন? আমার শরীর টাই বুঝি আপনাকে টানে! আমার মন আমার অনুভূতি আমার ভালোবাসা এসবের কোনো মূল্য নেই তাই না!
— তোমার মুখ থেকে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না হীর।
— আপনাকে শুনতে হবে। অন্য কাউকে ভালোবাসেন অথচ আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান লজ্জা করে না? ছিঃ কতোটা নোংরা আপনি আর কতোটা ঠুনকো আপনার ভালোবাসা!
আর কিছু বলার আগেই তুর্য হীরের গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এতোক্ষণ অনেক চেষ্টা করেও সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। হীর কে সে ভালোবাসে, সেই হীর ই আজ তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে।
তুর্যর চড়ের মাত্রাটা এতোটাই জোরালো ছিল যে হীর মেঝেতে ছিটকে পড়ে। হীর কে নিচে পরা দেখে তুর্য হন্তদন্ত হয়ে তাকে উঠায়। হীর এর ঠোঁট কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। তুর্য তার আঙুল দিয়ে কাঁটা জায়গা স্পর্শ করতে গেলে হীর তাকে বাঁধা দেয়।
— ছোবেন না আপনি আমাকে। আপনার প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে ঘৃণায় ভরা কাঁটা বিধিয়ে দেয়। আপনার প্রতিটা স্পর্শের উদ্দেশ্য একমাত্র আমাকে ব্যবহার করা।
হীর এর প্রতিটি কথা যেনো তুর্যর হৃদয়ে ধাঁরালো ছুরির মতো আঘাত করছে।
— ভুলে যাবেন না তুর্য, আমি আপনার রক্ষিতা নই। যাকে আপনি যখন খুশি বিছানায় টেনে নেবেন।
তুর্য তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। তার মাথায় ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো রাগ টগবগ করছে। সে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে হীর কে শান্ত করার। কিন্তু হীর যেনো কোনো কিছুই শোনার জন্য প্রস্তুত না। এক পর্যায়ে তুর্য এক হাতে হীর এর চুলের মুঠি চেপে ধরে। আরেক হাতে হীর এর চোয়াল চেপে ধরে হীর এর মুখ তার মুখ বরাবর এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— তুমি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছো হীর। অনেক বার ট্রাই করেছি তোমার সব অপমান ইগনোর করতে। বাট তুমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছো। রক্ষিতার মানে জানো তুমি? ব্যবহার করা কাকে বলে ফিল করেছো কখনও? আমার স্পর্শে তোমার ঘৃণা হয় তাই না হীর। দেন এই ঘৃণা শুধু তোমার মনে কেনো থাকবে! এখন যেমন তুমি আমার স্পর্শ কে ঘৃণা করো আজকের পর থেকে তুমি নিজেকেও একইভাবে ঘৃণা করবে।
হীর কে বিছানায় ফেলে তার উপর নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয় তুর্য। তুর্যর এমন আকস্মিক হামলায় হতবাক হয়ে যায় হীর। হীর এর দুই হাত বিছানার সাথে চেপে ধরে আছে সে। তুর্য কে নিজের উপর থেকে সরানোর জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে ঠেলছে হীর। কিন্তু তুর্যর শক্তির কাছে সে কিছুই না। চেষ্টা করতে করতে একটা সময় হীর ক্লান্ত হয়ে পরে। তু্র্য এখনও তার উপর আগের ভংগিতেই শুয়ে আছে।
— আমাকে ছাড়ুন বলছি। এভাবে আমার সাথে জোর করতে পারেন না আপনি।
হির এর হাত দুটো আরও শক্ত চেপে ধরে তুর্য।
— আমি কি পারি আর না পারি আজ সেটা তুমি খুব৷ ভালো করেই বুঝতে পারবে।
তুর্য এক হাতে হীর এর মুখ চেপে ধরে হির এর গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।
হীর এর দু চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু তুর্যর সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার কাজে ব্যস্ত। প্রথম দিকে হীর বাধা দিলেও একটা সময় সে শান্ত হয়ে যায়। একটা জীবন্ত লাশ এর ন্যায় বিছানায় পরে থেকে একটা ভয়ংকর রাত এর স্বীকার হচ্ছে।
.
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। অনুষ্ঠানে থাকা প্রতিটি ব্যক্তি আজ খুশি ছিল। সবচেয়ে বেশি তাফসি। অবশেষে তার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে কাল। কালকের দিনের অপেক্ষায় যেনো তার সময় থমকে গিয়েছে। দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। উত্তেজনা আর আশংকায় তার ঘুম উবে গিয়েছে।
সবার আনন্দের ভিরেও একজন ভীষণ কষ্টে আছে। বিছানায় শুয়ে এক প্রকার ছটফট করছে কিয়ারা। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তার প্ল্যান অনুযায়ী তো হীর কে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা ছিলো। তবে হীর কি করে তুর্যর বউ হয়ে গেলো? সবাই তো! কেন হলো এমন?
বিছানা ছেড়ে উঠে যায় কিয়ারা। তাফসির বিয়ের দিন তুর্য কে ফাঁসানোর জন্য তার ড্রিংক স্পাইক করেছিল কিয়ারা। সেটা ভুলবশত হীর খেয়ে নেয়। তবে রায়ান আর হীর এক বিছানায় পৌঁছানোর পিছনে তার কোন হাত ছিল না। সে যাই করেছিল সবটা তুর্য কে পাওয়ার জন্য। কিন্তু হলো তার সম্পুর্ণ বিপরীত। তুর্য কে তো সে পেলোই না উল্টো হীর আর তুর্যর বিয়ে হয়ে গেলো। এখন তার কি হবে? তবে কি সে তার ভালোবাসা কে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে? না এতো সহজে নিজের ভালোবাসার দাবি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে সে না। ছলে বলে কিংবা কৌশলে যে করেই হোক তুর্য কে সে হাসিল করবেই!
চলবে…
[