সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -৪১

পর্বঃ৪২
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)

রুমের মধ্যে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে রাইদা আর সায়নের নাম্বার ডায়াল করছে। প্রতিবার কল দিচ্ছে আর নাম্বার বন্ধ পেয়ে নিরাশ হচ্ছে। রাইদার অস্থিরতা দেখে মারিয়া বিছানা থেকে উঠে এসে রাইদার কাঁধে হাত রাখে।

‘কি হইছে আপা? কিছু নিয়া চিন্তায় আছেন?’,মারিয়া রাইদাকে জিজ্ঞেস করে।

‘নারে মারু কিছু না। তুই খেয়েছিস?’,মারিয়ার দিকে সৌজন্য হেঁসে রাইদা বলে।

‘হ্যা খাইলাম তো কিন্তু আপনে তো খাইলেন না।’

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না একদমই। বাবা তো এখনো আসেনি?’

‘না খালুর আইতে নাকি দেরি হইবো খালামনি কইলো।’

‘ তুই আমার বিছানায় শুয়ে পড় আমি পরে শুবো।’

রাইদার কথা মতো মারিয়া বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। রুমের আলো নিভিয়ে বারান্দায় বসে আবারো সায়নকে কল দেয়।

আধা ঘন্টা পর বারান্দা থেকে রুমে এসে টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নিয়ে মারিয়ার দিকে তাকায় বাহিরের থেকে আসা বৈদ্যুতিক আলোতে মারিয়ার ঘুমন্ত মুখ দৃশ্যমান হয়। বোতল থেকে পানি পান করে আবারো ফোনটা হাতে নেয়। রাত বাজে তখন প্রায় বারোটা। কলিংবেলের শব্দে রাইদা বুঝে তার বাবা চলে এসেছে। ফোন বিছানায় রেখে চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না খুঁজতে থাকে গায়ে দিয়ে বসার ঘরে যাওয়ার জন্য।

তড়িৎ গতিতে কেউ রুমে এসে রাইদাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। আচমকা এমন ঘটনায় রাইদা কেঁপে উঠে। পেটের উপর রাখা হাত জোড়ার উপর কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা রাখে রাইদার।

‘আরেকটু হলে মরেই যেতাম। সেই সকালে বেরিয়েছি তোমায় দেখে এরপর কতগুলো ঘন্টা কেটেছে। সারাদিন পর ফিরে তোমায় দেখা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। রি তুমি ছিলে আমার ভালোবাসা এখন হয়ে গেলে অভ্যাস, না অভ্যাস না বদঅভ্যেস যেটা আমি কখনোই ছাড়তে পারবো না আর ছাড়তেও চাই না।’,ধীর গলায় কথাগুলো বলে সায়ন।

রাইদা সায়নের কথার কোনো জবাব না দিয়ে বারান্দায় থাকা ফুল গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মূহুর্তে তার কি বলা উচিত খুঁজে পায় না।

‘কথা বলছো না কেনো? আমার উপর অভিমান করেছো? অনেক রেগে গেছিলাম তখন তোমার উপর তাই ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার প্রতি তোমার এই ছোট ছোট অনীহা আমায় বড্ড কষ্ট দেয়। দেখো তোমার উপর রাগ করেও থাকতে পারিনি ছুটে চলে এসেছি তুমিও এবার অভিমান কমিয়ে একটু জড়িয়ে ধরো আমায়।’

রাইদাকে শক্ত করে জড়িয়ে কথাগুলো বলে সায়ন। রাইদার কাছ থেকে এবারো কোনো উত্তর না পেয়ে সায়ন উত্তলা হয়ে যায়। রাইদাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে রাইদার হাত টেনে চুমু দেয়।

‘আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসেন আমি খাবার দিতে বলছি।’,রাইদা জড়তা নিয়ে কথাটা বলে।

‘পালাচ্ছো কেনো? সারাদিন পর কি এখন খেতে এসেছি? বাসায় ফিরবো চলো। এখানে থাকলে আমার খালি মনে হয় শ্বাশুড়ি তোমায় আমার থেকে রেখে দিবে। বাসায় ফিরে আগে আদর নিবো তারপর খাবো।’

রাইদার হাত জোড়া টেনে নিজের গালে রেখে বলে সায়ন। রাইদা মৃদু হেঁসে সায়নের গালে হাত বুলায়।

‘আমি বসার ঘরে যাচ্ছি তুমিও চলো শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে বলে বের হই। জামা পাল্টাতে হবে না যা পরে আছে সেভাবেই চলো সমস্যা নেই। এখন রাস্তা ফাঁকা আছে যেতে সময় লাগবে না।’

রাইদার খোঁপা করা চুলগুলো খুলে দিয়ে সায়ন বলে। রাইদার ইচ্ছে করছে না এখন নিজের রুম ছেড়ে ফ্ল্যাটে ফিরতে কিন্তু সায়নকে এই কথা বলবে সাহস করতে পারছে না। খালি মনে হচ্ছে এই কথা বললেই সায়ন চরম রেগে যাবে।

‘কি ভাবছো? চলো যাই।’
সায়নের ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রাইদার মায়া হয়। সারাদিন অফিস করে ফ্ল্যাটে ফিরেছিলো সেখান থেকে সোজা গাড়ি ড্রাইভ করে এতো রাতে তাকে নিতে এসেছে।

রাইদা রাগ করেছে ভেবে সায়ন রাইদাকে কাছে টেনে নেয় রাইদার রাগ ভাঙাতে।

হুট করে রুমের আলো জ্বলে উঠলে বিরক্তি চাহনিতে সায়ন আলো জ্বলানো ব্যক্তির দিকে তাকায়। রাইদা সায়নকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

‘ছি ছি দুনিয়া থেইকা লাজ শরম উইঠা গেছে এক্কেবারে। আমার মাইয়াডা ঘুমাইতাছে এইহানে ডাঙ্গর বেডা বেডি দরজা খুইল্লাই বাসর শুরু করছে।’,কথাগুলো মনে মাইমুনা শাড়ীর আঁচল টেনে মুখে রাখে।

মাইমুনার এমন কথাবার্তায় সায়ন প্রচন্ড বিরক্ত হয়।

‘খালামনি তুমি ভদ্রতা ভুলে গেছো। তুমি কি জানো না বিবাহিত কাপলদের রুমে নক করে ঢুকতে হয়? দরজা খোলা থাকুক কিংবা বন্ধ থাকুক দরজায় নক করা ভদ্রতা। আমাদের শরম লজ্জা আছে না নেই সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না নিজের চিন্তা করো।’,রাইদা মাইমুনাকে বলে।

‘বিয়ার সময় তো কানতাছিলি এই বিয়া করবি না কইয়া আর এহন মাস ঘুরার লগে লগেই এক্কেরে ঐ ছেমড়ার লগে আডার মতোই লাইগ্গা আছোছ। আমি এমন লাজহীন মাইয়া মানুষ দেহি নাই।’

মাইমুনার কথার শব্দে মান্নান রাফায়েত, রওশন আরা, মর্জিনা রাইদার রুমে আসে

‘ কি হলো আবার? মাইমুনা এতো রাতে চিল্লাচ্ছো কেনো?’,মান্নান রাফায়েত জিজ্ঞেস করে।

‘তেমন কিছু না খালা শ্বাশুড়ির পান খেতে ইচ্ছে করছে তাই একটু ফরমায়েশ করলো। এখন তো দোকান বন্ধ আমি না হয় কালকে এনে দিয়ে যাবো তখন খেয়ে নিবে।’,সায়ন বলে উঠে।

‘তুমি কেনো এতো রাতে এসেছো সেটা তো বললে না।’,রওশন আরা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘আপনাদের বাসায় আমার মূল্যবান সম্পদ মানে আমার বউ আছে তাই তো চলে এলাম বউকে নিতে। শ্বশুড় মশাই আমরা এখন বের হচ্ছি কালকে সকালে আপনার মেয়েকে পাঠিয়ে দিবো আবার।’

সায়নের কথা শুনে রওশন আরা চেতে যায়।

‘না রাই এখন যাবে না। তোমার যেতে হলে তুমি যাও। আজকের রাতটা এখানেই ও থাকবে। আমার মেয়েকে আমি এতো রাতে বের হতে দিবো না।’,রওশন আরা সায়নের কথার প্রতিবাদ করে বলে।

‘অনেক রাত হয়েছে তাছাড়া তোমার শ্বাশুড়ি চায় রাইদা এখানে কয়েকটা দিন বেড়িয়ে যাক যেহেতু ওর খালা আর খালাতো বোন এসেছে। তুমি বরং এখন খেয়ে ঘুমাও সকালে উঠে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করবো।’,মান্নান রাফায়েত বলে।

‘ঠিক আছে রাতটা থাকছি তবে আপনার মেয়েকে রেখে আমি কালকে ফিরবো না।’,সায়ন সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়।

‘কি অভদ্র পোলা মুরব্বিগো মুখের উপর কথা কয়। রিনা ছোডকালে তোমারে নিয়া লম্বা লম্বা কথা কইতো আর এই শিক্ষা দিছে? ছি ছি কি অভদ্র পোলা।’,নাক সিটকে বলে মাইমুনা।

‘বাবা চলো বসার ঘরে গিয়ে খেয়ে নেই আমার খিদে পেয়েছে।’,বিরক্ত হয়ে রাইদা বলে।

‘হ্যা চল আর জামাইকে তোয়ালে জামা দিয়ে আয়।’
কথাটা বলে মান্নান রাফায়েত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রওশন আরা ও বেরিয়ে যায়। সায়ন রাইদার হাত টেনে ধরলে মাইমুনা মুখে কাপড় গুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মাইমুনা যেতেই রাইদা হেঁসে সায়নের বুকে কিল দেয়।

‘আপনি সত্যিই অসভ্য লোক। গিয়ে গোসল সেরে আসেন আমি এখানেই আছি।’
রাইদার কথা শুনে সায়ন হেঁসে দেয়। নিজের তোয়ালে মান্নান রাফায়েতের গেঞ্জি, ট্রাউজার এনে দেয় রাইদা।

‘আমার দুইসেট কাপড় নিয়ে এসেছি এগুলো লাগবে না। বসার ঘরের সোফায় ব্যাগটা রাখা আছে। ব্যাগটা এনে দাও।’

‘তার মানে পুরো তৈরি হয়ে এসেছেন থাকার জন্য? ‘

‘তোমাকে নিতেই এসেছি পরে মাথায় এলো যদি শ্বাশুড়ি আসতে না দেয় তাই কাপড় সাথে করে নিয়ে আসলাম। বউ যেখানে আমিও সেখানে।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা চোখ রাঙিয়ে সায়নকে ধাক্কা দিয়ে বাথরুমে পাঠায়। বসার ঘর থেকে ব্যাগ এনে সায়নকে দেয়।
গোসল সেরে সায়ন বেরিয়ে দেখে রাইদা বিছানায় বসে ফোনে কিছু দেখছে। সায়ন এসে দাঁড়ালে রাইদা রুম থেকে বের হয় পিছন পিছন সায়নও যায়। খাবার টেবিলে মান্নান রাফায়েত অপেক্ষা ছিলো। সায়ন আর রাইদা আসতেই মর্জিনা তিনজনকে খাবার বেরে দেয়।
রওশন আর আর মাইমুনা রুমে বসে শলাপরামর্শ করছে। খাওয়া শেষ হতেই দু’জনে এসে উপস্থিত হয়।

‘রাইয়ের আব্বু আপনি ওরে নিয়ে রাইয়ের পাশের রুমে ঘুমান। আমি,মর্জিনা, মাইমুনা আমাদের রুমে শুবো। মারিয়া তো রাইয়ের রুমে ঘুমাচ্ছে রাই গিয়ে পাশে শুয়ে পরুক।’,রওশন আরা বলে।

রওশন আরার কথা শুনে সায়নের মুখে আঁধার নেমে আসে। সে বুঝতে পারে তার শ্বশুড়ি ইচ্ছে করে এমনটা করছে। মন খারাপ করা ছাড়া সায়নের হাতে এখন কিছু নেই। অসহায় দৃষ্টিতে রাইদার দিকে তাকায়। সায়নের চাহনিতে রাইদা তার মনের কথা বুঝে যায়। সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। পিছন পিছন সায়ন যেতে নিলে মাইমুনা আঁটকায়।

‘রাত হইছে মেলা গিয়া ঘুমাও।’,মাইমুনা সায়নকে বলে।

‘আমার ফোনটা বউয়ের রুমে আছে সেটা নিয়ে তারপর তো ঘুমাতে যাবো খালা শ্বশুড়ি। অনেক রাত হয়েছে আপনি গিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে ঘুমান।’,সায়ন হাই তুলে বলে।

সায়নের কথা শুনে মাইমুনা রুমে চলে যায়। সায়ন পা বাড়ায় রাইদার রুমে। রাইদা চুল আঁচড়াচ্ছিলো সায়ন এসে রাইদার হাত থেকে চিরুনী কেঁড়ে নেয়।

‘ঘুমাতে যাননি? কিছু লাগবে?’,রাইদা সায়নের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা লাগবে তো।’,সায়ন আদুরে গলায় বলে।

‘কি লাগবে জলদি বলেন আবার আপনার শ্বাশুড়ি এসে দেখলে কথা শুনাবে।’,দরজার দিকে তাকিয়ে রাইদা বলে।

‘তোমাকে লাগবে। বউ ছাড়া আমি ঘুমাবো কীভাবে? তুমি একটু শ্বশুড়িকে বলে ম্যানেজ করো প্লিজ।’,রাইদার হাত জোড়া টেনে সায়ন বলে।

‘আপনি না পুরো বাচ্চামি করছেন। একটা রাত ম্যানেজ করেন কষ্ট করে।’,সায়ন চুলগুলো হাতিয়ে বলে সায়ন।

সায়ন মুখ কালো করে রাইদার হাত জোড়া ছেড়ে চিরুনীটা রাইদার হাতে দিয়ে রুম থেকে চলে যায়। সায়নের অবস্থা দেখে রাইদা হেঁসে দেয়। রুমের দরজা লাগিয়ে রাইদা শুয়ে পড়ে।

সায়ন এসে মান্নান রাফায়েতের পাশে শুয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। ঘুম আসছে না কিন্তু তার রাইদার উপর অভিমান জমেছে।
….

পরেরদিন সকাল বেলা রাইদার ঘুম ভাঙে শব্দে। চোখ মুখ কুঁচকে ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু তবুও শব্দ কমে না। শেষে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে তাকায়। পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করে তাকালে দেখে সায়ন তাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চোখ ডলে রাইদা বুঝার চেষ্টা করে এটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি। বাহিরের শব্দে সায়নের ঘুমও ভেঙে যায়। চোখ খুলে সে তাকালে দেখে রাইদা তার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আপনি এখানে কি করে এলেন? মারিয়া কোথায়?’,সায়নকে প্রশ্ন করে রাইদা।

‘পায়ে হেঁটে এসেছি ঘুমাতে। বিরক্ত করো না একটু ঘুমাতে দাও সারারাত আমার ঘুম হয়নি।’,ঘুম জড়ানো স্বরে সায়ন বলে।

‘আচ্ছা ঘুমান কিন্তু আমাকে উঠতে দেন গিয়ে দেখি কিসের শব্দ হচ্ছে।’,সায়নের হাত সরানোর চেষ্টা করে রাইদা বলে।

‘উহু আমিও ঘুমাবো তুমিও ঘুমাবা। ঘুম না আসলে চুপ করে শুয়ে থাকবা তাও উঠতে দিবো না।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা বুঝে যায় সায়ন ঘুমের ঘোরে আছে। সে অপেক্ষা করতে থাকে সায়ন তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে।

ঘন্টা খানেক পর রাইদা বুঝতে পারে সায়ন গভীর ঘুমে তাই সে আস্তে আস্তে সায়নকে নিজের থেকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে। সায়নের যাতে ঘুম না ভাঙে সেইজন্য বাথরুম থেকে ব্লাশ আর ফোন নিয়ে গুটি পায়ে দরজা খুলে বাহির থেকে রুমের দরজা লাগিয়ে বসার ঘরের বাথরুমে যায় হাত-মুখ ধুতে।

হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরের সোফায় এসে রাইদা মান্নান রাফায়েতের পাশে বসে। আজকে মান্নান রাফায়েতের সাপ্তাহিত ছুটি তাই সে বাসায় রয়েছে। চা খেতে খেতে সে টিভি দেখছিলো।

‘জামাই কি ঘুমে এখনো?’,রাইদাকে জিজ্ঞেস করে মান্নান রাফায়েত।

‘হ্যা এখনো ঘুমে।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘তাহলে ওকে ডাক দিও না ঘুমাক। আমি একদম সকালে গিয়ে জামাইয়ের জন্য বাজার করে এনেছি।’

মান্নান রাফায়েতের আচরণে রাইদা খুশি হয়।
মারিয়ে এসে রাইদার হাত টেনে অন্য রুমে নিয়ে যায়।

‘কি হয়েছে মারু?’

‘মনির বিয়া ঠিক হইছে তাও এক বয়স্ক লোকের লগে।’

মারিয়ার মুখে এমন কথা শুনে রাইদার মনটা খারাপ হয়ে যায়।

‘কি বলিস এতো জলদি বিয়ে দিয়ে দিবে ওকে? তোর কাছে ওর নাম্বার থাকলে আমাকে দে।’

‘তোমার নাম্বার মনি হারাইয়া লাইছে আর আমার কাছেও আছিলো না তাই দিবার পারি নাই। আমার ব্যাগে কাগজ আছে তাতে ওর নাম্বার লেইখা রাখছি। খাড়াও ব্যাগ আনি তোমার রুম থেইকা।’

মারিয়া রুমে যেতে নিলে রাইদা তাতে আঁটকায়।

‘তোর ভাইয়া ঘুমাচ্ছে এখন যদি ঘুম ভাঙার পর আমাকে পাশে না দেখে তাহলে চিল্লাবে তাই এখন যাস না রুমে। পরে মনে করে নাম্বারটা আমাকে দিস। আচ্ছা তুই কখন ঘুম থেকে উঠছিস?’

‘মোর তো সেই ফজরের সময় ঘুম ভাঙছে। উইঠা নামাজ পইড়া ভাবছি একটু টিভি দেহি তাই দরজা খুইলা টিভির ঘরে আইসা দেহি দুলাভাই সোফায় বইসা ঝিমাইতাছে। গিয়া ওনারে ডাক দিতেই দেহি ওনার চোখ দুইডা লাল হইয়া আছে বুঝছি রাইতে ঘুমায় নায় তাই কইছি তোমার রুমে গিয়া ঘুমাইতে। দুলাভাই তারপর তোমার রুমে গিয়া দরজা লাগাইয়া দিছে।’

মারিয়ার কথা শুনে রাইদা বুঝতে পারে রাতে সায়নের কষ্ট হয়েছে ঘুমাতে।

‘ভালো কাজ করেছিস। এখন চল রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তোর মা খালা কি করতেছে।’

রাইদা আর মারিয়া রান্নাঘরে চলে যায়।

‘পোলাডা এক্কেরে ধলা। এতো ধলা পোলা মোর একদম পছন্দ না। বেডা মানুষ যদি ধলা হয় কেমন বিলাতি ইন্দুরের লাহান দেহা যায়।’,মাইমুনা মাছ কাটতে কাটতে বলে।

‘আমার কত ইচ্ছা ছিলো একমাত্র মেয়েকে ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ারি ছেলের কাছে বিয়ে দিবো কিন্তু শেষে এমন ছেলে মেয়েটার কপালে জুটলো যে কিনা নিজের বাপের কোম্পানিতে চাকরি করে। আচ্ছা নিজের বাপের কোম্পানিতে কেউ বেতন ভুক্ত চাকরি করে এমন শুনছিস কখনো?’,রওশন আরা মাইমুনার দিকে ফিরে বলে।

‘মোর বাপ দাদার জন্মেও এইডি হুনি নাই। বাপের সম্পদে তো পোলার পুরা অধিকার আবার চাকরি বাকরি কেন করবো? আইচ্ছা এমন তো না পোলার বাপে পোলারে সম্পদের ভাগ দিবো না?’

মাইমুনার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রাইদা। মারিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসি আটঁকানো চেষ্টা করছে। এতক্ষণ রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়ে রাইদা আর মারিয়া সব কথা শুনেছে। হঠাৎ রাইদাকে দেখে মাইমুনা থতমত খায়।

‘আহা খালামনি তোমার এতো চিন্তা কিসের? সায়ন সম্পত্তি পেলে মনে হচ্ছে তুমি ভাগ পাবা?’,রাইদা হাসতে হাসতে মাইমুকে বলে।

‘রাই তুই কিন্তু এখন তোর খালার সাথে বেয়াদবি করতেছিস। এগুলা শিখাইছি তোরে?’,রওশন আরা রাইদার দিকে চোখ গরম করে বলে।

‘কিছুই তো শিখাও নাই আর বেয়াদবি তাদের সাথে করা যায় যাদের সম্মান আছে। তোমার বোনের আত্মসম্মান আছে বলে মনে হয় না আমার।’

রাইদার কথা শুনে রওশন আরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে।

‘থাক আপা ওরে কিছু কইয়েন না ওর দোষ নাই। ঐ পোলাডায় মাইয়াডার মাথা খাইছে। আপনে কেন যে মাইয়াডারে পোলাডার লগে থাকবার দিছেন বুঝি না। আমি হইলে ঐ পোলারে জীবনেও মাইনা নিতাম না।’,মাইমুনা সুর টেনে কথাগুলো বলে।

‘সবই আমার কপাল বুঝলি মুনা। শান্তি নাই জীবনে।’,রওশন আর বিলাপ করতে বলে।

‘মর্জিনা খালা আমাকে এক মগ কফি বানিয়ে দাও। ঘুম থেকে উঠে আজগুবি কথাবার্তা শুনে মাথা ধরে গেছে। চা খেলে এখন মাথা ধরা কমবে না এক মগ তেঁতো কফি লাগবে।’,রাইদা মর্জিনাকে বলে।

‘নাশতা খাইয়া নাও এরপর বানাইয়া দিতাছি।’,মর্জিনা খালা জবাব দেয়।

‘না খালা সায়ন ঘুম থেকে উঠলে খাবো। আপাতত কফি দাও।’
কথাটা বলে রাইদা রান্নাঘর থেকে চলে যায়। রাইদার পিছন পিছন মারিয়াও যায়।

..

কোল বালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে সায়ন। রাইদা পাশে বসে সায়নের চুলে বিলি কাটছে। সায়নকে কীভাবে ঘুম থেকে ডাকবে বুঝতে পারছে না। গলা ঝেরে মনে মনে ঠিক করে কি বলবেন।

‘সায়ন উঠুন অনেক বেলা হয়েছে। বাবা আপনাকে ডাকছে কথা বলার জন্য। সায়ন উঠেন প্লিজ আমি এখনো খাইনি আপনি উঠলে খাবো।’,নিচু স্বরে সায়নের মুখের সামনে গিয়ে বলে রাইদা।

সায়ন নড়েচড়ে উঠলে রাইদা সায়নের বাহু ধরে ঝাঁকাতে থাকে।

‘কি হলো বিরক্ত করছো কেনো?’,ঘুম ঘুম চোখে রাইদার দিকে তাকিয়ে সায়ন প্রশ্ন করে।

‘এখন সকাল এগারোটা বাজে উঠেন।’

‘মাত্র এগারোটা বাজে অনেক সময় আছে আরেকটু ঘুমাই।’
কথাটা বলে রাইদা কোলে মাথা এলিয়ে দেয় সায়ন।

‘আপনি ভুলে গেছেন আমরা এখন আপনার শ্বশুড়বাড়িতে আছি। উঠেন না পরে না হয় আবার ঘুমিয়েন। আমি কিন্তু এখনো সকালের নাশতা খাইনি।’

রাইদার কথা শুনে মাথা তুলে তাকায় সায়ন।

‘উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আসেন আমি খাবারের টেবিলে অপেক্ষা করছি।’
কথাটা বলে রাইদা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থেকে সায়ন উঠে বাথরুমে যায়।

..

সায়ন আর রাইদা এক সাথে নাশতা খেয়েছে। সায়ন বেরিয়েছে মান্নান রাফায়েতের সাথে বাহিরে। রাইদা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রান্না দেখছে আর গ্রুপে মেসেজে আলাপ করছে। মারিয়া টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে সিরিয়াল দেখছে।

রাইদার ফোন বেজে উঠলে ফোন হাতে বিজের রুমে চলে যায়।

‘হ্যা অর্ক বল।’

‘রাসেল ভাই বাসায় প্রচন্ড অশান্তি করতেছে।’

‘হঠাৎ অশান্তি কেনো? অনু আপুর বিষয়ে জানতে পারছে নাকি কিছু?’

‘আমি যে অনু আপুকে সাহায্য করেছি এই বিষয়টা ভাইয়ের কানে আসছে। আমার তো তাতে সমস্যা নেই আমার সমস্যা অন্য জায়গায়।’

‘কি নিয়ে ভাবছিস তুই?’

‘রুহির বিষয়টা বাসায় কীভাবে বলবো সেটাই ভাবছি।’

‘রুহিকে নিজের মনের কথা বলছিস?’

‘রাই তুই তো জানিস আমি প্রেম ভালোবাসা দেখিয়ে রুহিকে কোনো আশা দিতে চাই না। হলে ওরে নিজের ঘরে বউ করে আনবো না হয় ওরে..’

‘আর না হয় কি অর্ক? তুই এভাবে হার মেনে নিবি? এক কাজ কর অনু আপুর মতো বিয়েটা করে নে।’

‘বাসায় অলরেডি অনু আপুর বিষয়টা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে এর মধ্যে আমি এমন কিছু করলে মা তো আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। তাছাড়া রুহির বাসায় এভাবে বিয়ে মানবেও না।’

‘তুই চিন্তা করিস না পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে একটা ব্যবস্থা হবে।’

রাইদার কথায় অর্ক কিছুটা আশ্বস্ত হয়।

‘তুই কই আছিস ভার্সিটি এলি না যে?’

‘আর কই থাকবো বাপের বাসায় এলাম একটু বাপের বউয়ের রান্না খেতে।’

রাইদার কথা শুনে অর্ক হেঁসে দেয়।

‘তাহলে আমরা পুরো গ্যাং চলে আসি?’

‘অনেক রান্না হচ্ছে তোরা সব চলে আয় বাপের বউকে একটু মজা দেখাই।’

‘ঠিক আছে রেডি থাক আসবো সময় মতো।’
অর্ক কল কেটে ক্যান্টিনের দিকে যায় সবাইকে ডাকতে।
রাইদা রান্নাঘরে গিয়ে বলে রান্নাবান্না বেশি করে করতে ওর বন্ধু খেতে আসবে। রওশন আর প্রথমে চেতে যায় কিন্তু মর্জিনা তাকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে।
..

সায়ন আর মান্নান রাফায়েত বাসায় ফিরে দুপুর বেলা। সায়নের হাতে অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট আর ব্যাগ দেখা যায়। মান্নান রাফায়েতের সঙ্গে বেরিয়েছিলো এলাকার বাজারে তখনই এসব কিনে নেয় সে।

মর্জিনা এসে ব্যাগগুলো নিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে সায়ন চোখ বন্ধ করে থাকে। মান্নান রাফায়েত গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেছে।

‘এইটা খান ভালো লাগবো।’
মারিয়ার কন্ঠ পেয়ে সায়ন চোখ মেলে তাকায়। আশেপাশে তাকিয়ে রাইদাকে না দেখে হতাশ হয়।

‘পিচ্চি তোমার আপু কোথায়?’,মারিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

সায়নের সরাসরি দৃষ্টিতে মারিয়া চোখ নামিয়ে ফেলে।

‘আপা নিজের রুমে আছে।’

মারিয়ার হাত থেকে সরবতের গ্লাসটা নিয়ে সায়ন রাইদার রুমের দিকে যায়। কি মনে করে আবার মারিয়ার দিকে ফেরত আসে। পকেট থেকে চকলেট বের করে মারিয়ার হাতে দিয়ে আবারো রাইদার রুমের দিকে চলে যায়। চকলেট গুলো হাতে নিয়ে মারিয়া অবাক দৃষ্টিতে সায়নের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।


(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here