সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -৪৪

পর্বঃ৪৪
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)

রাইদার মেসেজ পেয়ে আজকে অফিস থেকে জলদি বেরিয়েছে সায়ন। ফেরার সময় ফুলের দোকান চোখে পরলে সেখান থেকে রাইদার পছন্দের গাঁদাফুলের মালা কিনে নেয়।
ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করলে পিছনে শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখে সামনের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েটা দরজা খুলে উঁকি দিয়েছে।সায়নকে দেখে সৌজন্য মূলক হেঁসে মেয়েটা দরজা লাগিয়ে দেয়। হুট করে সায়নের মনে ভয় হয় রাইদাকে এখানে রাখলে যে কোনো সময় এই মেয়েটা এসে সব কথা বলে দিবে সেটা ভেবে।

দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকায় সায়ন। দরজা খুলে মুখে চওড়া হাসি টেনে দাঁড়িয়ে আছে রাইদা। রাইদার পরনে কালো রঙের সুতি শাড়ি সাথে কপালে টিপ আর দুই হাতে কালো রেশমী চুড়ি। এই টুকুতেই রাইদাকে দেখে সায়নের কাছে মনে হচ্ছে তার শ্বাস প্রশ্বাস আঁটকে যাবে।

সায়নকে মূর্তির মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাইদা হাত টেনে ফ্ল্যাটে ঢুকায়। দরজা লাগিয়ে নিজের খোলা চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে সায়নের দিকে প্রশ্ন সুচক চাহনিতে এগিয়ে যায়।

‘ফুল এনেছেন দিচ্ছেন না কেনো?’,সায়নের হাতে ফুল দেখে রাইদা বলে।

সায়ন ফুলের মালা গুলো রাইদার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ফুলের মালাগুলো নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায় রাইদা। পিছন পিছন সায়নও যায়।

‘গোসল সেরে আসেন আমি অপেক্ষা করছি।’,সায়নের হাতে তোয়ালে দিয়ে রাইদা বলে।

‘রি তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা? ‘,সায়ন অবাক হয়ে রাইদাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কেনো আমার আবার কি হবে? আমি একদম ঠিক আছি কিন্তু আপনি মনে হয় ঠিক নেই। কি হয়েছে আপনার?’,রাইদা সায়নের বুকের বাম পাশে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে।

রাইদার স্পর্শে সায়নের বুক কেঁপে উঠে। এই স্পর্শ, এই চাহনি সবই সায়নের কাছে অচেনা। তোয়ালে হাতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় সায়ন।
সায়ন যেতেই রাইদা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

‘আরে বউকে এতো ভয় পেলে কাছে কীভাবে আসবেন? আপনি দেখছি এখন আমাকে দেখলে চোখই মিলাতে পারছেন না।’

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রাইদার বলা কথাগুলো শুনে সায়ন। ইদানীং তার মনে হচ্ছে সে দোটানায় পড়ে গেছে। কীভাবে রাইদাকে সব বলবে সেটা ভেবে তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে বেসিনের কল ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়।

গোসল সেরে বেরিয়ে সায়ন দেখে বিছানার উপর কিছু ফুল পড়ে আছে কিন্তু রাইদা নেই। মাথা মুছে তোয়ালে বারান্দায় রেখে রান্নাঘরে যায় সায়ন। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে চুলায় বসানো পাতিলটা দেখতে ব্যস্ত রাইদা।

‘বিরিয়ানি? কে রান্না করলো?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে রাইদাকে।

‘আপনার বউ করেছে। আর কে করবে?’

রাইদার এমন জবাবে সায়ন অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

‘তুমি রান্না করেছো? হঠাৎ এসব?’

‘কেনো আমি রান্না করলে সমস্যা? মানছি পারফেক্ট হবে না কিন্তু খাওয়া যাবে। হাতে অনেক সময় ছিলো তাই ইউটিউব দেখে রান্নাটা করে এক্সপেরিমেন্ট করলাম।’

চুলগুলো খোঁপা করে রাইদা বলে। সায়নের নজর যায় রাইদার হাতের দিকে। চুড়ি খুলে ফুলের মালাগুলো কেটে দুই হাতে বালার মতো পরেছে রাইদা।

‘এই মালাটা খোঁপায় আঁটকে দেন।’,সায়নের দিকে একটা মালা বাড়িয়ে দিয়ে রাইদা বলে।

মালাটা হাতে নিয়ে সায়ন চেষ্টা করতে থাকে খোঁপায় ক্লিপ দিয়ে আটঁকাতে।

‘আচ্ছা কেউ যদি মিথ্যা বলে তাকে কি করা উচিত?’,রাইদা সায়নকে প্রশ্ন করে।

‘তার সাথে আর কথাই বলা উচিত না।’

‘কেউ যদি ধোঁকা দেয় তাহলে তার সাথে কি করা উচিত?’

‘হঠাৎ এসব কেনো জিজ্ঞেস করছো?’

‘এতো প্রশ্ন করেন কেনো? যেটা জিজ্ঞেস করেছি শুধু সেটার উত্তর দিবেন।’

‘তার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ধোঁকাবাজ মানুষরা কখনো কারো আপন হয় না।’

সায়নের উত্তর শুনে রাইদা মৃদু হাসে। ততক্ষণে রাইদার খোঁপায় ফুলের মালা সায়ন আঁটকে দিয়েছে। রাইদা ঘুরে সায়নের গলার পিছনে দু-হাত রেখে দাঁড়ায়। একহাত দিয়ে সায়ন রাইদার কোমড় আঁকড়ে ধরে।

‘আর কেউ যদি দু’টো কাজ এক সাথে করে তাহলে তাকে কি করা উচিত?’

এমন প্রশ্ন শুনে সায়ন আঁতকে উঠে।

‘কি আজগুবি প্রশ্ন করছো কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে তোমাকে বড় অচেনা লাগছে। যেই রি কে আমি চিনি সেই রি কে দেখতে পাচ্ছি না। কি হয়েছে বলো আমায়।’

সায়নের কথাশুনে রাইদা আবারো হাসে।

‘কেউ যদি দুটো অপরাধ একসাথে করে তাহলে তাকে ভয়ংকর কষ্ট দেওয়া উচিত। এমন কষ্ট দেওয়া উচিত সারাজীবন যাতে সে সেই কষ্ট ভোগ করে।’

কথাটা বলে রাইদা সায়নকে ছেড়ে প্লেট বের করে বিরিয়ানি বারতে থাকে। সায়ন স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রাইদার দিকে তাকায়।
বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে বসার ঘরে চলে যায় রাইদা। সায়নকে টেনে এনে বসায় খেতে। এক লোকমা মুখে দিতেই সায়নের বমি চলে আসে লবণ আর ঝালের কারণে। কষ্ট করে লোকমাটা গিলে নেয়। রাইদা গালে হাত দিয়ে সায়নের খাওয়া দেখতে থাকে।

‘কেমন হয়েছে? যদিও এটা বিরিয়ানি কম বিরিয়ানির ভর্তা বেশি মনে হচ্ছে। আপনার খাওয়া শেষ হলে আমি খাবো।’,রাইদা উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘অনেক মজা হয়েছে। তুমি অন্য কিছু খাও এখন বিরিয়ানি খেলে শরীর খারাপ করবে।’

সায়নের কথা শুনে রাইদার বড্ড হাসি পায়। সে হাসি চেপে রাখে আর সায়নের খাওয়া দেখছে। অতিরিক্ত লবণ আর ঝাল দেওয়া বিরিয়ানি বেচারা খাচ্ছে অথচ জানেই না রাইদা ইচ্ছে করে এগুলো বেশি দিয়েছে।

খওয়া শেষ করে সায়ন ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে খেতে থাকে ঝালে। রাইদা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রুমে চলে যায়।

সায়ন রুমে এসে রাইদাকে না পেয়ে বারান্দায় যায়। চুলগুলো খুলে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাইদা। দক্ষিণা বাতাসে রাইদার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উঠছে। বাহিরের আসা আলোতে রাইদার বিষাদ মাখা মুখটা স্পষ্ট। সায়ন এসে রাইদার পাশে দাঁড়ায়।

‘রি তোমায় কিছু বলতে চাই। তুমি কি কথাগুলো শুনবে?’
সায়নের গলা পেয়ে রাইদা পাশ ফিরে তাকায়।

‘ভালো লাগছে না কিছু শুনতে। ঘুম পাচ্ছে অনেক চলেন ঘুমাই।’

সায়নকে উপেক্ষা করে রাইদা শোবার ঘরে চলে যায়। হতাশ চোখে রাইদার যাওয়ার পানে সায়ন তাকায়। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি রাইদাকে সামনে বসিয়ে সব বলতে কিন্তু আবার মনে ভয়েরা বাসা বেঁধেছে যদি সব শুনে তার রি তাকে ভুল বুঝে তখন সে কী করবে?

সায়ন সকল চিন্তা ভাবনা দূরে ঠেলে রুমে যায়। বিছানার এক পাশে রাইদা বিপরীতে মুখ করে শুয়ে আছে তবে মাঝের কোল বালিশটা নেই। সায়ন কিছুটা অবাক হয় তবে তা প্রকাশ না করে রাইদার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। সায়নের আগমন টের পেয়ে রাইদা উঠে সায়নের দিকে ফিরে বসে।

বারান্দা দিয়ে আসা বৈদ্যুতিক আলোতে সায়নের বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে তাকায় রাইদা। চোখ খুলে পাশে বসা রাইদার দিকে তাকায় সায়ন। রুমের।মধ্যে পিনপতন নীরবতা চলছে। হাত বাড়িয়ে রাইদা সায়নের মাথায় বিলি কেটে দেয়।

ধীরে ধীরে সায়নের চোখ জোড়া ঘুমে বন্ধ হয়ে যায়। মিনিট বিশেক সায়নের পাশে বসেই রাইদা অপেক্ষা করতে থাকে সায়নের গভীর ঘুমের।

সায়নের ফোন হাতে নিয়ে রাইদা দেখে রাত এগারো টা বেজে গেছে। সাবধানে সায়নের ডান হাত টেনে বৃদ্ধা আঙুল টেনে ফোনের স্কিনে রাখলে ফোনের লকটা খুলে যায়। ফোনের লকটা খুলতেই ওয়ালপেপারে তার ঘুমন্ত একটা ছবি দেখতে পায় সে। রাইদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারে ছবিটা তখন তোলা হয়েছিলো যখন সে কুয়াকাটা থেকে ফেরার সময় গাড়িতে ঘুমিয়েছিলো।
শ্বাস ফেলে ঘুমন্ত সায়নের দিকে তাকায় রাইদা। সায়নের পানির বোতলে ঘুমের ওষুধ মিলিয়ে দিয়েছিলো সেটার প্রভাবে সায়ন এতো জলদি ঘুমাচ্ছে।

ফোনের ডায়াল লিস্টে গেলে সর্বপ্রথম বউ নামের সেভ করা নাম্বারটা তার নজরে আসে এরপর দ্বিতীয় নাম্বারটা আফরিন নামক নামে সেভ করা। আফরিন নামে ক্লিক করে নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে নেয়। ফোনের মেসেজ অপশনে গেলে আফরিনের সাথে সায়নের আদান-প্রদানকৃত মেসেজগুলো দেখতে পায়। বেশিরভাগ মেসেজই আফরিনের পাঠানো।

রাইদা মেসেজগুলো পড়তে শুরু করে। মেসেজগুলোতে ছোট বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর লিস্ট আছে আবার বাজারের লিস্টও আছে। সায়ন শুধু রিপ্লাই করে জানিয়েছে জিনিসগুলো সে দিয়ে যাবে।

মেসেজগুলো পড়ে রাইদার বুঝতে বাকি নেই ঐ সামনের ফ্ল্যাটের আন্টি যা বলছিলো সব সত্যি। আফরিন নামক মেয়ের উপস্থিতি ও আছে যার একটা সন্তান রয়েছে আর সে হয়তো সায়নের প্রথম স্ত্রী। গ্যালারিতে গেলে পাসওয়ার্ড না জানায় সে ঢুকতে পারে না। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এমনকি প্রায় এ্যাপই পাসওয়ার্ড ব্যতিতো রাইদা ঢুকতে পারে না। বিরক্ত হয়ে সায়নের ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে পড়ে। কি মনে করে শোয়া থেকে উঠে সায়নের ল্যাপটপ অন করে। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড একবার দেখেছিলো সেটা মনে করে আন্দাজ মতো দিলে লক খুলে যায়।

ল্যাপটপের ফাইলগুলোও পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড। ধৈর্য্য না হারিয়া রাইদা সবগুলো ফাইল দেখতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে একটা ফাইলে ক্লিক করে যেটা ওপেন হলে একটা ছবি ল্যাপটপের স্কিনে দৃশ্যমান হয়। একজন মেয়ে বসে আছে তার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। ছবিটা দেখে রাইদা এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ফোন ক্যামেরা বের করে ল্যাপটপের স্কিনে ধরে ছবি তুলে নেয়।

ল্যাপটপটা বন্ধ করে সে আবারো নিজের বালিশে শোয়। ইদানীং তার অভ্যেস হয়েছে সায়নের হাত ধরিয়ে ঘুমানোর আজও ইচ্ছে করছে তবে নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকে সে।

….

এক নাগাড়ে ফোন বেজে চলেছে তাতে সায়নের ঘুম ভাঙার পরও বালিশে মুখ গুঁজে আছে সে। কিন্তু কল করা ব্যক্তিটা নাছোড়বান্দার মতো কল দিতেই থাকে। একসময় বিরক্ত হয়ে বালিশ থেকে মুখ তুলে ফোনটা হাতে নেয়। কল রিসিভ করে ফোন কানে দিলে অপর পাশ থেকে তার সহকারীর গলা ভেসে আসে।

‘স্যার আপনি কি রাস্তায়? আটটায় মিটিং ছিলো অলরেডি নয়টা বাজে। বড় স্যার অনেক রেগে আছে আপনার উপর। আমি বলেছি আপনি জ্যামে আঁটকে আছেন।’

‘আমি তো ঘুমে ছিলাম। আজকে আলাপই পেলাম না এতো দেরি হয়ে গেলো। আচ্ছা আমি আসছি ফোন রাখো।’
কল কেটে সায়ন উঠে বসে। চোখ ডলে গলা ঝেরে রাইদাকে ডাকতে শুরু করে।

‘রি আমায় ডাকলে না কেনো? আজকে তো অফিসে গিয়ে তোমার শ্বশুড়ের ঝারি খেতে হবে।’

কথাগুলোর কোনো জবাব সে পায় না। চেখ মুখ কুঁচকে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে গেলে রাইদাকে দেখতে পায় না। বাথরুমের নক করতে নিলে দরজা দেখে খোলা। হুট করে সায়নের মনে পড়ে রাইদা হয়তো ভার্সিটিতে গিয়েছে। তোয়ালে নিয়ে গোসলে ঢুকে যায় সে। গোসল সেরে আলমারি খুলে পরিহিত জামা বের করতে।

আলমারি খুলে সে খেয়াল করে রাইদার জামা কাপড় গুলো আলমারিতে নেই শুধু তার গুলোই রয়েছে। সায়নের ফোনে আবারো তার সহকারী কল এলে বিষয়টা সায়ন খেয়াল করেও ভুলে যায়। রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে রাইদাকে কল দিলে নাম্বার ব্যস্ত দেখে। পরে কল দিবে ভেবে গাড়ি চালানোর মন দেয় সে।

অফিসে গিয়ে আরমান শেখের ঝারি খেতে হয়েছে সায়নকে সাথে বলা হয়েছে কাজ সব শেষ করলে তবেই সে বাসায় ফিরতে পারবে। এদিকে সকাল থেকে রাইদাকে দেখতে না পেয়ে সায়নের মনে কু ডাকছে। অনেকবার কল মেসেজ দিয়েও সে রাইদাকে পায় নি।

‘আপনার ডায়াল কৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে, কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।’

রাইদাকে কল দিলে অপরপাশ থেকে কথাগুলো বলে উঠে এক রমনী। সায়ন বিরক্ত হয়ে আবারো কল লাগায়।

‘কি হয়েছে কোনো সমস্যা? ‘, আরমান শেখ জিজ্ঞেস করে সায়নকে।

‘তোমার বউমা সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে এখনো তাকে কে পাচ্ছি না। দুপুর পর্যন্ত নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছিলে এখন বন্ধ দেখাচ্ছে। সারাদিনে একবারো ওর খোঁজ পেলাম না তাই চিন্তা হচ্ছে খুব।’,কান থেকে ফোন নামিয়ে সায়ন বলে।

‘এখন তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে বউমা নিশ্চয়ই ফ্ল্যাটে আছে। তুই এক কাজ কর ফ্ল্যাটে ফিরে যা বাকি কাজ কালকে করিস। কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল দিস।’,আরমান শেখ সায়নের কাঁধে হাত রেখে বলে।

অনুমতি পেয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে সাথে সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় সায়ন। পুরো রাস্তায় রাইদার নাম্বারে কল দিতে দিতে এসেছে কিন্তু ফোন বন্ধ। ফ্ল্যাটের সামনে এসে দেখে তালা ঝুলছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে এক প্রকার দৌড়ে শোবার ঘরে যায়। আলমারি খুলে নিজের সকল কাপড় চোপড় উল্টাপাল্টা করে দেখে কিন্তু রাইদার কোনো কাপড় খুঁজে পায় না। খাটের নিচে উঁকি দিলে শুধু তার লাগেজটা পায়। সাইড ড্রয়ার হাতালে সেখানে রাইদার ব্যবহৃত কোনো মেকআপ কিংবা গয়না পায় না।

হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্লোরে বসে দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে সায়ন। তার আর বুঝতে বাকি নেই রাইদা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

গত রাতের কথা মনে পড়লে সায়ন বুঝতে পারে কোনো ভাবে আফরিনের বিষয়টা রাইদা জেনে তাকে ভুল বুঝেছে। বসা থেকে উঠে ফ্ল্যাটে তালা না মেরেই সিঁড়ি দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে নামে সায়ন। দারোয়ান উপরে উঠছিলো সায়নকে এভাবে নামতে দেখে সে চমকে যায়। আটতলায় এসে দেখে সায়নের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ফ্ল্যাটে উঁকি মেরে কাউকে দেখতে না পেয়ে দরজা লক করে চলে যায় সে।

গাড়ি নিয়ে সায়ন ছুটছে রাইদার বাবার বাসায়। তার এখন মাথায় একটা জিনিসই ঘুরছে রাইদাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

বসার ঘরে রাইদা,মান্নান রাফায়েত, মারিয়া, রওশন আরা, মাইমুনা মিলে গল্প করছে। মর্জিনা ট্রে তে করে চা এনে সকলের সামনে দেয়। রাইদা গালে হাত দিয়ে বসে ভাবনায় ডুব দিয়েছে। চারিপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনো খবর নেই। ভোর হতেই সে এ বাসায় ফিরে এসেছে অবশ্য কেউ জানে না কেনো সে ফিরেছে। রওশন আরা মেয়েকে লাগেজ সমেত দেখে বেশ খুশি হয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য মাইমুনা অনেক প্রশ্ন করেছে কিন্তু রাইদা কোনো জবাব দেয়নি।
কলিংবেল বাজতেই মারিয়া গিয়ে দরজা খুলে। হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে সায়ন। রাইদা বাদে সকলে সায়নের দিকে তাকায়। রাইদা এমন ভান করে বসে থাকে যেনো সে আগে থেকেই জানতো সায়ন আসবে।

‘রি একটু এদিকে আসো তোমার সাথে কথা আছে।’,সায়ন রাইদার পিছনে দাঁড়িয়ে বলে।

‘আমি এখন ব্যস্ত আছি পরে কথা বলবো।’

রাইদার খামখেয়ালী উত্তরে সায়নের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। হাত টেনে রাইদাকে বসা থেকে দাঁড়া করিয়ে টেনে রুমে নিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। বসার ঘরে থাকা মানব গুলো বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তবে রাইদা আর সায়নের মধ্যে কোনো এক ঝামেলা হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই তাদের।

‘তুমি আমাকে না বলে লাগেজ নিয়ে এ বাসায় ফিরেছো কেনো?’

সায়নের এমন প্রশ্নে রাইদা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়।

‘আমি আপনাকে জবাব দিতে বাধ্য নই সরেন সামনে থেকে।’
সায়নকে উপেক্ষা করে রুমের দরজা খুলতে যায় রাইদা তখনই সায়ন হাত চেপে ধরে।

‘কি হয়েছে আমার জানতে হবে। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছো আবার ফোন বন্ধ এখন বলছো উল্টা পাল্টা কথা। সারাদিন চিন্তায় আমার কি অবস্থা হয়েছে একবার তাকিয়ে দেখেছো? আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখো। কি হলো তাকাও।’,রাইদার দু’গাল ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে সায়ন।

ব্যথায় চোখ বন্ধ করে সায়নের হাত সরানোর চেষ্টা করতে থাকে রাইদা।

‘আমার লাগছে ছাড়ুন। আমি যা করেছি বেশ করেছি। আপনার মতো মিথ্যাবাদীকে আরো বেশি কষ্ট দেওয়া উচিত।’

রাইদার এমন কথা সায়নের রাগে ঘি ঢালার মতো কাজ করে। রাইদাকে ছেড়ে না দিয়ে আরে শক্ত করে গাল চেপে ধরে।

‘কি বলছো আবার বলো। আমি মিথ্যাবাদী? কি মিথ্যা বলেছি আমি বলো। রি আজকে যদি তুমি আমার সাথে না ফিরো আমার রাগ দেখাতে আমি বাধ্য হবো।’

‘বউ বাচ্চা থাকতে আমাকে বিয়ে করেছেন এটা মিথ্যা না? নিজের ফ্ল্যাটকে অন্যের বলে সেখানে আমায় নিয়ে গেছেন এটা মিথ্যা না?’

রাইদার মুখে এমন কথা শুনে সায়ন রাইদাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে রাইদা সায়নের থেকে পিছিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। চেয়ার টেনে সায়ন এসে রাইদার সামনে বসে। রাইদার ডান হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে নেয় সায়ন।

‘ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনো। এভাবে চিল্লাপাল্লা -রাগারাগি করলে কথার কথা কিছুই হবে না উল্টো আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হবে।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা তাকায়। চুলগুলো এলোমেলো, শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা,চোখ জোড়া রক্তিম বর্ণ সাথে সায়নের ক্লান্ত মুখটা দেখে চোখ সরিয়ে ফেলে সে।

‘ফ্ল্যাটের বিষয়টা আমি মিথ্যা বলেছি শুধু তোমাকে নিজের কাছে রাখতে এছাড়া আমার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।’

‘এই কথাগুলো আমি জানি বলতে হবে না। শুধু শুধু আপনি কথা বলে সময় নষ্ট করছেন আমি একটুও ইচ্ছুক নই আপনার কোনো কথা শুনতে। আমার হাত ছাড়ুন। ‘

‘আমার কথা শুনো আগে। আফরিনের বিষয়টা ক্লিয়ার করতে দাও।’

সায়নের কথার মধ্যে রাইদা বলে,’আপনার কথা শুনবো তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো দেন।’

‘ঠিক আছে তুমি প্রশ্ন করো আমি উত্তর দিচ্ছি।’

‘আফরিন নামের মেয়েটা আপনার ফ্ল্যাটে ছিলো আপনার সাথে?’

‘হ্যা ছিলো কিন্তু..। ‘

‘আফরিন যখন আপনার সাথে ছিলো সে প্রেগন্যান্ট ছিলো?’

‘হ্যা ছিলো এখন ওর ছেলে আছে।’

‘আপনি ইচ্ছে করে আমার থেকে এসব কথা লুকিয়েছেন?’

‘হ্যা কথাগুলো লুকিয়েছি তুমি যাতে ভুল না বুঝো তাই।’

‘ব্যস হয়েই গেলো। আপনি নিজেই স্বীকার করলেন সব।’

‘বিশ্বাস করো আফরিন আমার স্ত্রী না।’

সায়নের কথার মাঝে হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় রাইদা।

‘আপনার কি মনে হয় যাচাই না করে এখনো আমি বসে আছি? ওয়েট প্রমাণ দেখাচ্ছি আপনাকে।’

কথাটা বলে ফোন হাতে নিয়ে একটা অডিও বের করে রাইদা। অডিওটা চালু করে সায়নের সামনে ধরে। অডিও বাজতে শুরু করে।

‘আপনি ইমতিয়াজ সায়নের কে হন? মানে আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক কি?’,রাইদা আফরিনকে প্রশ্ন করে।

‘আমি ওনার স্ত্রী আর আমাদের সন্তানও আছে কিন্তু আপনি কে? এতোকিছু কেনো জিজ্ঞেস করছেন?’,আফরিন জবাব দেয়।

এইটুকু কথোপকথন বেজে অডিওটা বন্ধ হয়ে যায়।

‘আফরিনকে আজকে কল দিয়েছিলাম সে কি বলেছে তা তো শুনলেনই এরপরে আপনার কথা আমি বিশ্বাস করবো সেটা কীভাবে ভাবলেন?’,ফোনটা রেখে রাইদা বলে।

রাইদার কথার প্রেক্ষিতে সায়ন কিছু বলতে চাচ্ছিলো এর মধ্যে তার ফোন বেজে উঠে। ফোন বের করে দেখে আফরিনের কল। রাইদার দিকে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করে সায়ন।
অপরপাশ থেকে আফরিন কিছু বললে সাথে সাথে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সায়ন।

‘রি আমি পরে এসে সব বলছি। আফরিন কল দিয়েছে একটু ইমারজেন্সী আমাকে যেতে হবে।’
কথাটা বলে দরজা খুলে সায়ন বেরিয়ে যায়। রাইদা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে।


(চলবে..)

(কোথাও বানান ভুল হলে অবশ্যই জানাবেন। পোস্টে রিয়েক্ট কমেন্ট করলে পোস্টটা রিচ পাবে তাই গল্প পড়ে অবশ্যই রিয়েক্ট, কমেন্ট করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here