পর্বঃ৪৬
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)
…
সায়নকে আসতে দেখে রাইদা উঠে ক্লাসের দিকে হাঁটা দেয়। পায়েল,ফাহিম,রুহি বুঝতে পারছে না কেনো রাইদা চলে গেলো কিছু না বলে। সায়ন হতাশ চোখে রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
ল্যাবে এসে রাইদা চুপ করে বসে থাকে। হাতে থাকা চিঠিটা ফেলতে গিয়েও কি মনে করে ভাজ করে ব্যাগে রাখে। একটুপর বাকিরা এসে রাইদাকে ঘিরে বসে।
অর্কের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে মিল্কশেকটা নেয় রাইদা।
‘সত্যি করে বল তো আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছিস?’,পায়েল রাইদার বাহুতে চিমটি কেটে জিনিস করে।
‘আমি ঝামেলা পাকাই?’,রাইদা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে পায়েলকে জিজ্ঞেস করে।
‘না ঝামেলা তো আমি পাকাই? তুই এতো ঝামেলা করিস যে তোর নাম ঝামেলার আম্মা দেওয়া উচিত।’,পায়েল রাইদার কথার ফোঁড়ন কেটে বলে।
‘বরের সাথে ঝগড়া করেছিস?’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।
‘ঝগড়া কেনো করবো?’,রাইদা জবাব দেয়।
‘তাহলে বেচারা ওমন আমসত্ত্বের মতো চুপসে ছিলো কেনো? নিশ্চয়ই কিছু একটা হইছে।’,বাপ্পি বলে উঠে।
‘আমরা আর এক সাথে থাকছি না উনি তাই চেষ্টা করছে আমাকে মানানোর।’
রাইদার কথা শুনে কেউ ঘটনার আগাগোড়া কিছুই খুঁজে পায় না।
‘হেয়ালি না করে ক্লিয়ার করে বল তো।’,অর্ক বিরক্ত হয়ে বলে।
‘ওনার আগের স্ত্রী এবং সন্তান রয়েছে সেজন্য আমি তাকে ছেড়ে চলে এসেছি।’
রাইদার কথা শুনে পাঁচজনই বিষ্মিত চোখে তাকায়।
‘কি বলছিস এইগুলা তোর মাথা ঠিক আছে? আমি নিজে ওনার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছি বিয়ে তো দূর প্রেম করার খবরও পাইনি।’,অর্ক রাইদার কথার জবাবে বলে।
‘শোন বিষয়টা এখন ফিফটি ফিফটি। মেয়েটা বলেছে সায়ন তার স্বামী আর সায়ন বলেছে মেয়েটা তার স্ত্রী না। আমি যতদূর সায়নকে চিনি সে এতো সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে আমাকে মিথ্যা বলবে না তার মানে মেয়েটা মিথ্যা বলছে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। অবশ্য এতে আমার আপাতত মাথাব্যথা নেই।’,রাইদা বলে।
‘তার মানে তুই জানিস এবং মানছিস বিয়ের বিষয়টা মিথ্যা? তাহলে সব মিটমাট করছিস না কেনো?’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।
‘ওনার সাথে আমার পুরোনো হিসেব বাকি তাই তো আমি ইচ্ছে করেই ধরা দিবো না। এই সুযোগে এক ঢিলে দুই পাখি মারবো।’
রাইদার কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়ায় না নিজেদের খাওয়া শেষ করে ল্যাবের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। সকলেরই জানা রাইদাকে দিয়ে জোর করিয়ে কিছু করা যায় না। রাইদা নিজে যেটা ঠিক করে সে সেটাই করে।
ল্যাব ক্লাস শেষ করেই রাইদা বন্ধুদের সাথে খেতে বাহিরে যায়।রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেনো জানি রাইদার আর খেতে ইচ্ছে হয় না। না খেয়েই সেখান থেকে বের হতে চায় কিন্তু অর্ক রাইদাকে যেতে দেয় না। জোর করে রাইদাকে বসালে সে অল্প খাবার খায়।
খাওয়া শেষ করে ভার্সিটিতে চলে যায় শেষ ক্লাসটা করতে। ক্লাসের মধ্যেই রাইদা বুঝতে পারে তার শরীর খারাপ লাগছে। অর্ককে বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। ভার্সিটির গেট পেরিয়ে রিকশা ডাক দেয়।
‘এই মামা যাবা?’,রাইদা রিকশাওয়ালাকে বলে।
‘মামা যাবে না কিন্তু আমি যাবো। চলো কোথায় যাবা নামিয়ে দেই।’,সায়ন বলে উঠে।
সায়নের কন্ঠ পেয়ে রাইদা ঘুরে পিছনে তাকায়।
‘আপনি এখনো যাননি?’,সায়নকে প্রশ্ন করে রাইদা।
‘তুমি যখন ক্লাসে গেলে সেই ফাঁকে একটু ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম এখন আবার আসলাম। ভাগ্যিস এসেছিলাম না হলে তো তুমি পালিয়ে যেতে।’
সায়নের কথার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রাইদা আবারো রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলতে শুরু করে।
‘মামা চলো তোমাকে দ্বিগুণ ভাড়া দিবো।’
‘আচ্ছা মামা বলো তো স্বামী-স্ত্রী এর মধ্যে কি ভুল বুঝাবুঝি হয় না? তোমার সাথে কি কখনো মামির ভুল বুঝাবুঝি হয়নি? রাগের মাথায় স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রী এর চলে যাওয়া টা কি উচিত বলো?’
সায়নের এমন কথায় রাইদা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। রিকশাওয়ালা কিছু না বুঝেই হাসতে হাসতে রিকশা টেনে চলে যায়।
রৌদ্র তাপে রাইদার মাথা ঘুরছে তারপরও সে হার না মেনে এগিয়ে যায় রিকশা খুঁজতে। প্রতিটা রিকশায় বাঁধা দেয় সায়ন যার ফলে রাইদা রিকশা পায় না। বিরক্ত হয়ে রাইদা হাঁটতে শুরু করে। রাইদার সাথে সাথে সায়নও হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর দু’জনে চলে এসেছে।
‘জেদ কেনো করছো রি? গাড়ি রেখে তুমি ক্লান্ত শরীরে হাঁটছ এটা আমার মোটেও ভালো লাগছে না।’,রাইদার হাত টেনে সায়ন বলে।
‘হাঁটছি তো আপনার কারণে। একটা রিকশাতেও উঠতে দিলেন না।’,রাইদা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে।
‘তুমি এখনো রেগে কথা বললে ছোট বেলার মতো রিনরিন একটা শব্দ হয়।’
‘আপনার কি মনে হয় মাঝ রাস্তায় এসব বললে আমি গলে যাবো?’
‘তুমি কি বরফ নাকি যে গলে যাবা?’
সায়নের কথা শুনে রাইদা জবাব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে আবারো হাঁটতে থাকে।
‘আমরা কোথাও বসে একটু কথা বলি? বেশি না দশ মিনিট সময় নিবো। আফরিনের সাথে তোমাকে কথা বলিয়ে দিলেই তুমি বুঝতে পারবা আমি মিথ্যা বলছি না।’,সায়ন রাইদার পথ আঁটকে বলে।
‘আমার কাছে ফালতু কাজের জন্য সময় নেই সরুন।’,সায়নের বুকে মৃদু ধাক্ক দিয়ে রাইদা বলে।
সায়ন রাইদার হাত ধরতে নিলে রাইদা মেইন রোডের দিকে চলে যায়। হুট করে রাইদার শারীরিক খারাপ লাগাটা বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে ঝাপসা দেখতে শুরু করে,মাথাটা ঘুরতে থাকে। দম নিয়ে রাস্তাটা পার হওয়ার চেষ্টা করতেই সায়ন এসে রাইদার হাত ধরে টান দেয়। সায়নের হাতের আলতো স্পর্শ পেয়েই ধীরে ধীরে রাইদার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে রাস্তার মাঝে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে রাইদা।
পাশ ফিরে রাইদাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে সায়ন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। মূহুর্তেই তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হুশ ফিরতেই রাইদাকে রাস্তা থেকে তুলে বুকে আগলে নেয়। মানুষজন এসে দু’জনকে ঘিরে ভীড় জমায়।
এক ছেলে রিকশা ডেকে দিলে রাইদাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয় সায়ন। পথিমধ্যে রাইদার চোখ মুখে পানি দেয় কিন্তু তাও জ্ঞান ফিরে না। সায়ন অস্থির হয়ে ফোন বের করে তার বাবাকে কল দেয়।
হাসপাতালের সামনে রিকশা থামলে রাইদাকে কোলে করে নিয়ে ইমারজেন্সীতে ছুটে সায়ন। হাসপাতালের ভেতরে থাকা মানুষজন সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইমারজেন্সী রুমের বাহিরে থাকা স্ট্রেচারে রাইদাকে শুইয়ে নার্সদের ডাকতে থাকে সে।
‘নার্স একটু জলদি আসুন আর ডাক্তারকে ডাকুন প্লিজ। আমার স্ত্রী এর কি হয়েছে একটু দেখুন। হুট করে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গেছে এখনো জ্ঞান ফিরছে না।’,ব্যস্ত গলায় সায়ন নার্সকে ডাকে।
‘আপনি সরুন ইমারজেন্সী রুমে ডাক্তার আছে। আমি রুগীকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।’,স্ট্রেচার নিয়ে নার্স ইমারজেন্সী রুমে ঢুকে।
‘আমিও একটু আসি প্লিজ। ওরে একা ছাড়লে চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাবো।’,সায়ন অনুরোধের স্বরে বলে।
‘আচ্ছা দেখি ডাক্তার অনুমতি দিলে আপনাকে প্রবেশ করতে দিবো।’,কথাটা বলে নার্স দরজা লাগিয়ে দেয়।
চিন্তিত হয়ে সায়ন পায়চারী করতে থাকে তখন সেই রিকশাওয়ালা চলে আসে ভাড়া নিতে।
‘দুঃখিত আপনি কিছু মনে করবে না আসলে স্ত্রী কে এই অবস্থায় দেখে আমার মাথা ঠিক নেই তাই আপনার ভাড়া দিতে ভুলে গেছি। এই নেন পুরো টাকাটা রেখে দেন আর দোয়া করেন আমার স্ত্রী যেনো দ্রুত সুস্থ হয়।’
রিকশাওয়ালার হাতে টাকা দিয়ে সায়ন বলে।
‘দোয়া করি বাজান তোমার বউ সুস্থ হইয়া যাইবো। এতো ভালোবাসার মানুষ থাকতে কেউ অসুস্থ থাকতে পারে না।’
কথাগুলো বলে রিকশাওয়ালা চলে যায়।
সায়ন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বাম হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষতে থাকে।
‘এক্সকিউজ মি আপনি ভেতরে আসতে পারেন।’,ইমারজেন্সী রুমের দরজা খুলে নার্স সায়নকে ডেকে বলে।
নার্সের ডাক শুনে সায়ন দ্রুত পায়ে হেঁটে ইমারজেন্সী রুমে প্রবেশ করে। বিছানার পাশে গিয়ে রাইদার জ্ঞানহীন শুকনো মুখটার দিকে তাকায়। হাত তুলে রাইদার হাতের উল্টো পিঠে হাত রাখে।
‘আপনি ওনার কে হন?’,ডাক্তার জিজ্ঞেস করে সায়নকে।
‘আমি ওর বর হই।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘আমার চেম্বারে আসুন বিস্তারিত কথা বলবো।’,কথাটা বলে ইমারজেন্সী রুম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে যায়।
রাইদার শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে সায়নও বেরিয়ে যায়।
‘আসবো?’,ডাক্তারের চেম্বারের দরজায় নক করে সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যা আসুন।’,ডাক্তার জবাব দেয়।
চেম্বারে ঢুকে চেয়ার টেনে সায়ন বসে।
‘আপনার স্ত্রী মনে হয় নিজের দিকে খেয়াল করে না। যতটুকু মনে হচ্ছে গরমে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার যা মনে হচ্ছে উনি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না, শরীর যথেষ্ট দুর্বল। প্রেশার ও দেখলাম লো। আজকে সারাদিনে কি খেয়েছে?’
ডাক্তারের কথা শুনে সায়নের কপালে চিন্তার ভাজ দেখা যায়।
‘আসলে গত কালকে ওর বাবার বাসায় বেড়াতে গেছে আমি ব্যস্ত থাকায় যেতে পারিনি তাই মনে হচ্ছে সেই সুযোগে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনি।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘এতো কেয়ারলেস হলে তো সমস্যা। ওনার দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখবেন। উনি বোধহয় অতিরিক্ত চিন্তাও করে। এই বয়সে অতিরিক্ত চিন্তা স্বাস্থ্যের জন্য খুব খারাপ। শরীর যথেষ্ট দুর্বল তাই আমি ঘুমের ইনজেকশন দিতে বলেছি নার্সকে। স্যালাইন আর কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি নিয়মিত খাওয়াবেন। স্যালাইনটা এখনই নিয়ে আসেন।’
প্রেসক্রিপশনে সব কিছু লিখে দিয়ে ডাক্তার বলে। সায়ন হাত বাড়িয়ে প্রেসক্রিপশনটা নেয়।
‘আচ্ছা স্যালাইনটা বাসায় দিলে সমস্যা? আমি আসলে আমার স্ত্রী কে হাসপাতালে রাখতে চাচ্ছি না।’,সায়ন ডাক্তারকে বলে।
‘না সমস্যা নেই। নার্স বা অভিজ্ঞ কাউকে ডেকে স্যালাইন লাগিয়ে নিবেন।’
‘ধন্যবাদ ডক্টর। ‘
ডাক্তারের চেম্বার থেকের বের হলে সায়ন তার বাবা আরমান শেখকে ইমারজেন্সী রুমের সামনে দেখতে পায়। দ্রুত কদম ফেলে এসে আরমান শেখের কাঁধে হাত রাখে সায়ন।
‘বউমা কেমন আছে? সিরিয়াস কিছু না তো?’,আরমান শেখ চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেনি তার উপর কোনো বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত সেই কারণে প্রেশার লো হয়ে গেছে। গরম সহ্য করতে না পেরে হারিয়েছে জ্ঞান। ডাক্তার এখন ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে আরেকটা স্যালাইন লাগাতে বলা হয়েছে আমি ভেবেছি ফ্ল্যাটে নিয়ে স্যালাইন লাগানোর ব্যবস্থা করবো।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘ফ্ল্যাটে নিলে একা একা কি তুই মেয়েটার যত্ন করতে পারবি নাকি? ওর এখন সেবাযত্নের প্রয়োজন। তুই বউমাকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে যা। তোর মা আছে,নিপা আছে ওরা বউমার দেখাশোনা করবে ঠিকভাবে।’
‘কিন্তু বাবা তোমার বউমা তো রাগ করবে।’
‘এতো বেশি বুঝিস কেনো? মেয়েটা অসুস্থ আর এখন তো ঘুমাচ্ছে। সুস্থ হলে তখন না হয় বুঝিয়ে বলবি।’
আরমান শেখের কথায় সায়ন ভাবনায় পড়ে যায় কি করবে।
‘তোর গাড়ি কোথায়?’,আরমান শেখ প্রশ্ন করে।
‘আরে ভুলেই গেছি গাড়িটা তো ভার্সিটির পাশে পার্ক করে এসেছি।’
‘তাহলে আমার গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যা আমি ড্রাইভারকে কল দিয়ে বলছি তোর গাড়িটা নিয়ে আসতে।’
‘তুমি তাহলে অফিসে ফিরবে কি করে?’
‘কেনো সিএনজি বা রিকশা ডেকে নিবো। অনেকদিন রিকশায় চড়া হয় না এই সুযোগে রিকশায় চড়লে মন্দ হয় না।’
আরমান শেখের কথা শুনে সায়ন আলতো হাসে।
‘ভেতরে চলো তোমার বউমাকে দেখে যাও।’
‘না এই অবস্থায় বউমাকে দেখবো না। সুস্থ হোক তখন একেবারে দেখবো তাছাড়া বাসায় যাচ্ছে দেখা তো হবেই। আমি চললাম বিকালে মিটিং আছে। বউমাকে নিয়ে সাবধানে যাবি আর আমাকে অবশ্যই আপডেট জানাবি।’
কথাগুলো বলে আরমান শেখ সায়নের কাঁধে চাপড় দেয়। সায়ন এসে আরমান শেখকে জড়িয়ে ধরে। একটুপর সায়নকে ছেড়ে হাসপাতাল থেকে আরমান শেখ বেড়িয়ে যায়।
কাউন্টারে বিল পে করে ইমারজেন্সী রুমে ঢুকে রাইদাকে কোলে তুলে নেয় সায়ন। কোলে করে গাড়ির কাছে এনে দরজা খুলে পিছনের সিটে শুইয়ে দেয়। গাড়ি লক করে চলে যায় ফার্মেসি থেকে ঔষধ আর স্যালাইন নিতে।
ঔষধ নিয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। দুপুরের সময় হওয়াতে বাসায় ফেরার রাস্তায় তেমন জ্যাম আঁটকায়নি। অন্য সময়ের তুলনায় দ্রুতই বাসায় পৌঁছে গেছে।
রাইদাকে কোলে তুলে বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল দেয় সায়ন। নিপা এসে দরজা খুলে চোখ বড়বড় করে তাকায়।
‘দরজার সামনে থেকে সর।’,নিপাকে ধমক দিয়ে সায়ন বলে।
‘খালাম্মা দেখে যান ভাই কারে নিয়া আইছে বাসায়।’,দরজা থেকে সরে নিপা চিল্লিয়ে বলে।
মিসেস রিনা রুমেই শুয়ে ছিলো নিপার ডাকে শোয়া থেকে উঠে আসে ততক্ষণে রাইদাকে কোলে করে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকেছে সায়ন।
নিপা সায়নের পিছুপিছু রুমে আসে এরপর মিসেস রিনাও আসে।
‘জলদি বিছানাটা থেকে জামাকাপড় সরিয়ে বালিশ টেনে দে এই পাশে।’,নিপাকে বলে সায়ন।
সায়নের কথা মতো নিপা জলদি জলদি কাজ করতে থাকে। মিসেস রিনা এসে সায়নের পাশে দাঁড়িয়ে রাইদার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকায়।
‘তোমার বউমা।’,মিসেস রিনার দিকে তাকিয়ে সায়ন বলে।
‘সেটা তো আমি দেখেই বুঝেছি কিন্তু কি হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছি না। মেয়েটা কি অসুস্থ? ‘,মিসেস রিনা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘বলবো সব একটু সময় দাও।’
নিপার কাজ হয়ে গেলে রাইদাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় সায়ন। রাইদাকে ঠিকঠাক শুইয়ে সায়ন এসে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তারিত সব বলে। সব শুনে সায়নের মায়ের খারাপ লাগে।
‘মেয়েটা হুট করে এমন নিজের প্রতি অবহেলা শুরু করলো আর তুই ওর দিকে একটু খেয়াল দিলি না? তা কি নিয়ে তোদের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে সেটা তো বললি না। কি করেছিস তুই আবার?’
মায়ের প্রশ্নের কি জবাব দিবে সেটা সায়ন খুঁজে পায় না। এই মূহুর্তে আফরিনের বিষয়টা তার মাকে বললে সে যে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা ভালো করেই সায়ন জানে তাই তো বিষয়টা লুকায়।
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? তবে মেয়েটাকে বাসায় এনে ভালোই করেছিস।’
‘আরে মা তেমন কোনো ঝামেলা না ছোটখাটো যেটা সবার সংসারেই হয় আর কি। আমি ফার্মেসির কাউকে ডেকে আনছি স্যালাইন লাগানোর জন্য।’,কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সায়ন।
মিসেস রিনা এসে রাইদার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘নিপা একটা তোয়ালে ভিজিয়ে আন মেয়েটার মুখ মুছে দেই। মুখটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড ক্লান্ত আর দুর্বল। শোন তোয়ালে দিয়ে তারপর গিয়ে ফ্রিজ থেকে মাংস নামা আমি আসছি রান্নাঘরে। মেয়েটার জন্য কিছু রান্না করে রাখবো যাতে ঘুম ভাঙলে খেতে পারে।’
মিসেস রিনার কথা মতো নিপা একটা তোয়ালে ভিজিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তোয়ালে দিয়ে রাইদার মুখ,গলা আর হাতগুলো মুছে দেয় সে।
কিছুক্ষণ পর সায়ন একজন ছেলেকে নিয়ে আসে সে রাইদার হাতে ক্যানোলা পড়িয়ে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে চলে যায়। রুমের দরজা আঁটকে সায়ন ঢুকে গোসল করতে। গোসল সেরে বেরিয়ে রাইদার কাছে আসে।
রাইদা গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। হাত বাড়িয়ে রাইদার বন্ধ নয়ন জোড়ায় স্পর্শ করে সায়ন। তার ইচ্ছে করছে রাইদাকে জড়িয়ে ঘুমাতে কিন্তু এই মূহুর্তে রাইদার অসুস্থতার কথা ভেবে নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে ফেলে। রাইদার ডান হাত টেনে চুমু দেয় তারপর নিজের গালে ছোঁয়ায়।
বালিশ টেনে রাইদার দিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। রাইদার স্পর্শ পেতে তার হাত টেনে নিজের বুকে রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে।
নিভু নিভু চোখে রাইদা এদিক ওদিক তাকায়। তার মাথাটা এখনো ঘুরছে সেই সাথে তন্দ্রায় চোখ জোড়া লেগে যাচ্ছে। বাম হাত টেনে উঠাতে নিলে ব্যথা অনুভব করে তারপরও হাতটা টেনে কপাল চেপে ধরে। পাশ ফিরতে নিলে দেখে সায়ন তার পাশে ঘুমাচ্ছে তাও তার হাত ধরে। আবছা আবছা সবকিছু দেখে রাইদার সব গুলিয়ে যায়। তন্দ্রায় চোখ জোড়া বন্ধ করে আবারো ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।
..
হুট করে রাইদার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে সিলিং এর দিকে তাকায়। অপরিচিত সিলিং দেখে সে শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করে। মাথাটা ভার হয়ে আছে বুঝতে পেরে ডান হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে উঠে বসে। চোখ জোড়া বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। ঘুমের রেশ কেটে গেলে চোখ খুলে তাকায়। পুরো রুমে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পায় না। রুমের আলো নেভানো তবে বাহির থেকে যথেষ্ট আলো আসছে যার দরুন পুরো রুম স্পষ্ট। পাশে তাকালে দেখে কেউ নেই। বাম হাতে ভারী কিছু অনুভব করলে দেখে হাতে ক্যানোলা লাগানো তার সাথে স্যালাইন চলছে।
রাইদা বুঝতে পারছে না সে কোথায় কিংবা তার হাতে ক্যানোলা কেনো। মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিলো কিন্তু কিছুই মনে করতে পারে না। ক্যানোলা থেকে স্যালাইনের নলটা খুলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু দুর্বল শরীরে সায় দেয় না। উঠতে নিলেই মাথা ঘুরতে শুরু করে আবারো। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। খাট ধরে ধীরে ধীরে উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে থাকে। আলো না জ্বালিয়েই বাথরুমে ঢুকেই বেসিনের কল ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিতে থাকে। চোখ মুখে পানি দেওয়া হলে মাথা নুইয়ে কলের নিচে রাখে। বেশ কিছুক্ষণ কলের পানির নিচে মাথা রাখায় অনেকটা ভালো লাগতে থাকে। মাথা তুলে ভেজা চুলগুলোর পানি ঝাড়াবার চেষ্টা করে।বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটা তোয়ালে খুঁজে পায়। তোয়ালে টা দিয়ে মাথা মুছতে থাকে। মাথা মুছতে মুছতে রুমে এসে চারিপাশে তাকায়। ওয়ারড্রবের উপর সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দেখে রাইদা এগিয়ে এসে হাতে নেয়।
‘তাহলে এটা সায়নের রুম!’,রাইদা বিরবির করে বলে।
প্যাকেট আর লাইটার রেখে রুমের দরজার সামনে গিয়ে খোলার চেষ্টা করে বুঝে দরজা বাহির থেকে লাগানো। দরজায় নক করতে থাকে কয়েকবার কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বিছানায় এসে বসে।
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রাইদা মুখ তুলে তাকায়। নিপা দরজা খুলে রাইদাকে দেখেই চিল্লাতে থাকে।
‘খালাম্মা ভাবী ঘুম থেকে উঠছে।’
নিপার চিল্লানীতে রাইদা চরম বিরক্ত হয়।
‘ভাবী কখন উঠছেন? আপনি দরজা ধাক্কাইছেন?’,নিপা এসে রাইদার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।
মিসেস রিনা রুমে প্রবেশ করলে রাইদা বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
‘আরে বসো তুমি। নিপা রুমের লাইট জ্বালা।’
রাইদা মিসেস রিনার দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করে কিন্তু চিনতে পারে না তবে আন্দাজ করতে পারে এটা কে।
নিপা আলো জ্বালিয়ে দিলে সাথে সাথে রাইদা চোখ বন্ধ করে ফেলে। এমনিতেই মাথাটা ভার হয়ে আছে তার উপর আলো চোখে পড়ায় অসহ্য লাগতে শুরু করে তার।
‘কখন উঠছো তুমি? স্যালাইনটা তো শেষ হয়নি। মাথা ভেজা কেনো তোমার? মাথায় কি পানি দিয়েছো। তোয়ালেটা দাও আমি মাথা মুছে দিচ্ছি।’,মিসেস রিনা একের পর এক কথা বলতেই থাকে আর রাইদার মাথা মুছতে থাকে।
‘সায়ন কোথায়?’,রাইদা হুট করে জিজ্ঞেস করে।
‘সায়ন তো বাহিরে গেছে চলে আসবে। নিপা ওর জন্য খাবার নিয়ে আয়। কি খাবা তুমি? সুপ রান্না করেছি সেটা আনতে বলি?’
মিসেস রিনার কথার কোনো জবাব রাইদা দেয় না। নিপা চলে যায় রান্নাঘরে।
‘কয়টা বাজে এখন? আমার ফোন কোথায়?’,রাইদা আবারো জিজ্ঞেস করে।
‘বাজে তো রাত সাড়ে দশটা। তোমার ফোন কোথায় সেটা সায়ন বলতে পারে। সায়নকে কল দিয়ে আমি এখনই বাসায় আসতে বলতেছি।’,মিসেস রিনা জবাব দেয়।
রাইদা মিসেস রিনার দিকে তাকিয়ে তাকে ভালো করে দেখে। মিসেস রিনা হেঁসে রাইদাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
নিপা বাটি ভর্তি সুপ এনে দিলে মিসেস রিনা তা রাইদাকে খাওয়াতে শুরু করে। রাইদা চুপচাপ খেতে থাকে।
‘কি ব্যপার বউমাকে পেয়ে ছেলেকে ভুলে গেছো? কই আমাকে তো এভাবে কখনো খাইয়ে দাওনি।’
সায়নের কন্ঠ পেয়ে রাইদা তাকায়। লাগেজ টেনে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সায়ন।
‘এখনই বউমার সাথে হিংসে করছিস বাকি দিন তো পড়েই আছে। কই ছিলি তুই?’
‘কই আর থাকবো বলো ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম নিজের লাগেজ আনতে আর ফ্ল্যাটটা তালাও মেরে আসলাম। তোমার বউমা তো শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে কিন্তু জামাকাপড় কিছুই আনেনি তাই কিছু শপিং করলাম তার জন্য। তুমি এক কাজ করো সুপটা রেখে যাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি। এখন ওর বিশ্রাম দরকার। সকালে আরামসে তোমার বউমার সাথে গল্প করবা এখন যাও।’
‘হ্যা মেয়েটাকে খাইয়ে ঔষধ খাওয়াবি। একদম বিরক্ত করবি না ওকে বিশ্রাম নিতে দিবি। তুমি খেয়ে ঘুমাও কালকে আমরা আলাপ করবো।’
রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে মিসেস রিনা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিপাও চলে যায় তার পিছুপিছু।
দরজা লাগিয়ে সায়ন এগিয়ে আসে রাইদার দিকে। রাইদার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে নিলে সায়ন এসে তাকে আগলে নেয়।
‘একটা চুমু খাই? একদিন একরাত কষ্ট দিয়েছো সেটার বদলে একটা ছোট্ট চুমু খেলে পোষাবে না তাও তুমি যেহেতু অসুস্থ তাই এইটুকুতেই পুষিয়ে নিবো।’
কথাগুলো বলে সায়ন রাইদার ভেজা চুল গুলো মুখের সামনে থেকে সরায়।
‘একদম না দূরে থাকুন।’
রাইদার কথা শুনে সায়ন হেঁসে রাইদার ওষ্ঠ জোড়া আগলে নেয়।
…
(চলবে..)