পর্বঃ৫৩
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)
…
বিয়ের গাড়ি এসে থামে সায়নের বাসার নিচে। রাইদা গাড়ি থেকে নামতে নিলে সায়ন্তিকা এসে আঁটকায়।
‘ভাবী একটু পর বের হও। সবাই মাত্র ভেতরে গেছে বললো একটু পর তোমাদের যেতে।’,সায়ন্তিকা রাইদাকে বলে।
‘এসব এখন না করলে হয় না? এমনিতেই কত রাত হয়ে গেছে রি সারাদিন এসব ভারী শাড়ি গহনা পরে আছে ওর তো কষ্ট হচ্ছে।’,সায়ন সায়ন্তিকাকে বলে।
‘আরে সমস্যা নেই সারাদিন থাকতে পেরেছি এইটুকু সময়ে কিছু হবে না।’,রাইদা সায়নকে বলে।
‘সব হলে আমি তোমাকে কল দিবো থাকো এখন। ড্রাইভার আঙ্কেল আপনিও চলেন কাজ আছে।’,কথাগুলো বলে সায়ন্তিকা গাড়ির দরজা লাগিয়ে চলে যায়।
ড্রাইভার ও গাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। সায়ন আর রাইদা গাড়ির পিছনের সিটে বসা।
সায়ন বাম হাত বাড়িয়ে রাইদার ডান হাতের আঙুল গুলো নিজের আঙুলে পেঁচিয়ে নেয়। রাইদার ডান হাত তুলে উল্টো পিঠের মেহেদী দেখতে শুরু করে।
‘মেহেদী কখন দিলা? আমার নাম লেখা আছে?’,রাইদাকে প্রশ্ন করে সায়ন।
‘আজকে সকালে দিয়েছি। খুঁজে দেখেন আপনার নাম পান কিনা।’,কথাটা বলে রাইদা নিজের বাম হাতও সায়নের সামনে ধরে।
রাইদার দুই হাতের উল্টো পিঠে সায়ন সুক্ষ্ম চোখে খুঁজতে শুরু করে। অনেকক্ষণ খোজা খুঁজি করেও সায়ন নিজের নাম খুঁজে পায় না রাইদার হাতে।
‘খুঁজে পাচ্ছি না কেনো? নাকি আমার নাম লেখাই হয়নি?’
‘আপনি যে কানা সেটা আমি জানতাম এই যে দেখেন এখানে লেখা।’
‘কানা কে সেটা সবাই জানে। এটা তো আমার নাম না জাস্ট ছোট করে আমার নামের অক্ষর লেখা। আমার নামটা লিখতে পারতে না? শুধু অক্ষরই লিখলে তাও দেখা যায় না।’,কথাটা বলে সায়ন রাইদা হাত ছেড়ে দেয়।
সায়নের চেহারা দেখে রাইদা বুঝে যায় সে মন খারাপ করেছে। হুট করে রাইদা হেঁসে নিজের দুই হাতের তালু সায়নের সামনে ধরে। সায়ন আঁড়চোখে তাকালে দেখে রাইদার দুইহাতের তালুতে তার নাম স্পষ্ট করে লেখা। এটা দেখে খুশিতে রাইদার হাত টেনে চুমু দেয় সে।
‘এই না হলে আমার বউ। তুমি সে এখন থেকে মিসেস ইমতিয়াজ সায়ন সেটা তো সবাইকে জানাতে হলেও হাতে আমার নাম লেখাটা প্রয়োজন ছিলো।’
‘আপনিও অদ্ভুত আপনার কথাবার্তা ও অদ্ভুত।’
সায়ন রাইদার হাতের মেহেদী দেখছিলো তখন সায়নের ফোন বেজে উঠে। ফোন বের করে দেখে সায়ন্তিকার কল। কলটা কেটে ফোন আবারো পকেটে রাখে।
‘শুনো আমার আলমারিতে একটা নীল শাড়ি আছে ঐইটা পরবা। তোমাকে প্রথমবার ঐ শাড়িটাতে বিয়ে করেছিলাম তাই আজকেও নতুন বউ রুপে তোমাকে ঐ শাড়িতেই দেখতে চাই। এই নাও আলমারির চাবি।’
কথাগুলো বলে সায়ন রাইদার হাতে চাবি দেয়। রাইদা চাবিটা নিয়ে মুঠোবন্দি করে ফেলে।
সায়ন গাড়ি থেকে বেরিয়ে রাইদার হাত ধরে রাইদাকে বের করে। দুজনে একসাথে হাঁটতে শুরু করে। বাসার দরজার সামনে সায়নের মা মিস্টি, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাইদা আর সায়ন আসতেই সে চামচ দিয়ে একটু মিষ্টি তুলে প্রথমে রাইদা এরপর সায়নের মুখে দেয়। পানির গ্লাস নিয়ে দু’জনকে পানি খাইয়ে দেয়।
সায়ন্তিকা রাইদার হাতে একটা কাঁচি দেয় দরজার সামনের ফিতা কাঁটার জন্য। রাইদা কাঁচিটা নিয়ে ফিতাটা কাটে।
সায়ন্তিকা এগিয়ে এসে রাইদার কানে কানে বলে,’ওয়েলকাম টু হোম ভাবী। ভার্সিটিতে যা জ্বালিয়েছে সব শোধ বাসায় নিবো।’
সায়ন্তিকার কথা শুনে রাইদা হেঁসে দেয়। রাইদার হাসির কারণ বুঝতে না পেরে সায়ন প্রশ্ন বোধক চাহনিতে সায়ন্তিকার দিকে তাকায়। সায়ন্তিকা সায়নের চাহনি উপেক্ষা করে রাইদার হাত ধরে হাঁটা দেয়। সায়নও যেতে নিলে কাজিনরা এসে সায়নের পথ আঁটকায়।
‘সর সব আমি রুমে যাবো। এসব পাল্টে গোসল করতে হবে।’,সায়ন গম্ভীর গলায় বলে।
সায়নের এক কাজিন ভাই বলে,’ভাই আজকে আর তোমাকে আমরা ভয় পাবো না। তোমার জামা কাপড় সব ঐ রুমে আছে সেখানে গিয়ে চেঞ্জ গোসল যা ইচ্ছা করো কিন্তু তোমার রুমে এখন যেতেই পারবা না।’
‘মা এসব কি ওদের সরতে বলো।’,সায়ন মিসেস রিনাকে ডেকে বলে।
‘তোমার ব্যপার তোরা বুঝ আমার কাজ আছে এখনো অনেক আবার ঘুমও পাচ্ছে। রুমে গেলাম আমি।’,কথাটা বলে মিসেস রিনা নিজের রুমে চলে যায়।
সায়ন বিরক্ত হয়ে নিচের একটা রুমে ঢুকে জামা পাল্টাতে। সায়ন্তিকা রাইদাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে সায়নের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমের আলো জ্বালালে রাইদা দেখে রুমের চারিদিকে ফুল লাগাচ্ছে দু’টো মেয়ে।
রাইদা আলমারির কাছে গিয়ে তালা খুলে শাড়ি বের করে। তার লাগেজ আগেই রুমে আনা হয়েছিলো সেই লাগেজ খুলে প্রয়োজনীয় বাকি জিনিস নিয়ে বাথরুমে ঢুকে।
শাড়ি পাল্টে গোসল সেরে বাথরুম থেকে রাইদা বের হয়। চুল মুছতে মুছতে তার নজর যায় বিছানার দিকে। মেয়ে দু’টো নেই সায়ন্তিকা একা বিছানার ফুলগুলো ঠিক করছে।
‘শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলা কেনো গিয়ে রেস্ট করতা।’,রাইদা সায়ন্তিকাকে বলে।
‘কি যে বলো না ভাবী মনে হচ্ছে তুমি কিছু বুঝো না। এই শাড়িটা পরছো কেনো? আমি তোমাকে যেটা উপহার দিয়েছি সেটা পরো।’,সায়ন্তিকা রাইদাকে পরোখ করে বলে।
‘তোমার ভাইয়ার আবদার ছিলো আমি যেনো এই শাড়িটা পরি আজকে রাতে। তোমার শাড়িটা পরবো কালকে এটা নিয়ে মন খারাপ করো না।’
‘কি যে বলো ভাবী ভাইয়ার চাওয়া আগে তারপর আমাদের চাওয়া। তুমি আমাদের কাছে একেবারে চলে এসেছো এটাতেই আমরা খুশি।’
রাইদা নিজের লাগেজ খুলে একটা ব্যাগ বের করে এনে সায়ন্তিকার হাতে দেয়।
‘এটা আমার পক্ষ হতে তোমার জন্য ছোট একটা উপহার।’
‘সত্যি ভাবী? আমি অনেক খুশি হয়েছি। রুমে গিয়ে খুলে দেখবো ভেতরে কি তবে তুমি আমার জন্য উপহার এনেছো এটাই অনেক।’
সায়ন্তিকা খুশিতে গদগদ হয়ে রাইদাকে জড়িয়ে ধরে। রাইদাও হেঁসে সায়ন্তিকাকে জড়িয়ে ধরে।
‘তুমি রুমে থাকো আমি বাহিরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।’,কথাটা বলে সায়ন্তিকা বের হয়।
রাইদা রুমের আলো নিভিয়ে বসে থাকে। একটুপর বাহির থেকে সায়নের কাজিন,সায়ন্তিকা আর সায়নের গলা পায় রাইদা। সায়ন সবাইকে ধমক দিচ্ছে কিন্তু কেউ সায়নের কথা শুনছে না। সকলের দাবি না মানলে রুমে প্রবেশ করতে দিবে না।
এরপর কি হলো রাইদার অজানা তবে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে বারান্দার দরজার পিছনে গিয়ে লুকায়।
রুমে প্রবেশ করে সায়ন আলো জ্বালাতে নিয়েও কি মনে করে সুইচ টিপে ড্রিম লাইট জ্বালায়।
ড্রিম লাইটের আলোতে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে রাইদাকে দেখতে পায় না। ভ্রু কুঁচকে বাথরুমের দরজায় নক করলে দেখে দরজা খোলা। এবার তো সায়নের কপালে চিন্তার ভাজ পরে। বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পুরো বারান্দায় রাইদাকে দেখতে না পেয়ে ঘুরে রুমের দিকে যেতে নিলে দেখে বারান্দার দরজার নিচে শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে।
রাইদা চুপ করে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করছে সায়ন কোথায়। অনেকক্ষণ সায়নের সাড়া না পেয়ে দরজার আড়াল থেকে উঁকি দেয় কিন্তু সায়নকে দেখতে পায় না।
‘লোকটা আমাকে না খুঁজেি শুয়ে পড়লো নাকি? ধ্যাত এই লোকটাও না। ‘,বিরবির করে কথাগুলো বলে দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে রুমে প্রবেশ করে রাইদা।
হুট করে সায়ন এসে রাইদাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘আপনি কই ছিলেন? দেখলাম না কেনো?’,রাইদা সায়নকে জিজ্ঞেস করে।
‘দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি দরজার পিছন থেকে বেরিয়ে এসেছো তাই আমাকে খেয়াল করনি। লুকিয়ে ছিলে কেনো? একটু হলে তো আমি বাহিরে গিয়ে ওদের বকাঝকা করতাম। এমনিতেই ক্যাশ শর্ট থাকায় ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তারপর রুমে ঢুকতে হয়েছে তার উপর বউ মিসিং থাকলে মাথা তো গরম হয়ে যেতো।’
সায়নের কথা শুনে রাইদা জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। সায়ন রাইদাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘হাসছো কেনো? হাসির কি বললাম?’
‘এমনিতেই হাসছি। চলেন বারান্দায় গিয়ে বসি। রুমে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে।’
‘ছাদে যাবা? চলো ছাদে যাই।’
রাইদার হাত টেনে সায়ন বলে।
‘কিন্তু সবাই তো বাহিরে আছে এখন দেখলে কি ভাববে?’
‘কি ভাববে মানে? আমরা কি চোর নাকি যে দেখলে সমস্যা? তাছাড়া সবাই রুমে চলে গেছে চলো ছাদে যাই।’
সায়নের কথার সাথে পেরে উঠে না রাইদা। সায়ন দরজা খুলে রাইদার হাত ধরে বের হয়। রাইদা চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না বুঝে যায় সবাই যার যার রুমে।
সিঁড়ি বেয়ে সায়ন রাইদার হাত ধরে ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ছাদের তালা খোলা দেখে ভ্রু কুঁচকে সায়ন রাইদাকে রেখে ছাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।
রাইদা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে সায়নের কাজিনরা ছাদে আড্ডা দিচ্ছিলো যেই সায়নকে দেখলো সবাই হুড়োহুড়ি করে বসা থেকে দাঁড়ায়। সায়ন ওদের কিছু বলে তা রাইদার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। সায়নের কথা শুনে কাজিরা সব ছাদ থেকে দ্রুত নেমে যায়।
সায়ন এসে রাইদার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে রাইদা সায়নের হাত ধরে ছাদে যায়।
‘ওদেরকে কি বলেছেন? সবগুলো ভয়ে দৌড়ে পালালো।’,রাইদা সায়নকে প্রশ্ন করে।
‘সবগুলো মিলে বিড়ি খাচ্ছিলো তাই একটু টাইট দিলাম।’,হাসতে হাসতে সায়ন বলে।
‘আপনি নিজেও খান তার বেলায়? পোলাপান খেলেই দোষ আর আপনি খেলে দোষ না?’
‘কই আমি তো এখন খাই না শুধু মাঝে মাঝে তোমার চিন্তা হলে একটা দু’টো খাই। তুমি এভাবে পাশে থাকলে আর কখনোই খাবো না।’
হাঁটতে হাঁটতে রাইদা এসে ছাদের কিনারায় গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। মাথা তুলে আকাশে তাকায়। আকাশটা কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব বিলিন। অন্ধকার আকাশে মেঘেরা ছুটাছুটি করছে। ধীর হাওয়াতে রাইদার আর্ধ ভেজা চুলগুলো দুলছে। সায়ন পাশে দাঁড়িয়ে বুকের উপর দুই হাত ভাজ করে রেখে রাইদাকে দেখছে।
‘আজকে কি আমাকে কথাটা বলা যায় রি?’
সায়নের প্রশ্ন শুনে রাইদা পাশ ফিরে তাকায়।
‘কোন কথাটা?’
‘যেই কথাটা তুমি এতো বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছো নিজের মধ্যে। ‘
‘আপনার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি একটু স্পষ্ট করে বলুন।’
‘আট বছর আগে আমার করা কোন ভুলের জন্য তুমি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো? এটা জানতে না পারলে আমি স্থির হতে পারবো না।’
সায়নের কথা শুনে রাইদার চোখমুখে আঁধার নেমে আসে।
‘ভালো লাগছে না কিছু পরে কথা বলবো এ বিষয়ে।’
কথাটা বলে রাইদা যেতে নিলে হাত টেনে ধরে সায়ন।
‘তুমি শুধু আমার উপর রাগ করে আছো তা না এর পিছনে আরো কাহিনী আছে তাই না? কি হয়েছিলো আমায় বলা যায় না?’
সায়নের কথা শুনে রাইদা পিছনে ঘুরে তাকায়।
‘পুরনো ঘা কেনো তাজা করছেন সায়ন? আপনার উপর আমার রাগ কমে গেছে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমি আপনার উপর অনেক রেগে ছিলাম কিন্তু এক সময় বুঝতে পারলাম আপনাকে আমার পাশে প্রয়োজন।’
‘আমি তো সবসময়ই তোমার পাশে আছি সেটা তুমি চাইলেন কিংবা না চাইলেও। তোমার সারাজীবনের সুখ দুঃখের দায়িত্ব আমার। ভেতরে যে সব কথা জমিয়ে রেখেছো সেগুলো বলে নিজেকে হালকা করো। কি হয়েছিলো আমায় বলা যায় না?’
সায়নের আকুল আবেদন শুনে রাইদা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
সায়নের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে আবারো ছদের গ্রিল ধরে দাঁড়ায়।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,’আট বছর আগে আমি যখন নানুবাড়িতে ছিলাম আমার বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বড় মামা-মামি আর তার ছেলে মেয়েরা বেড়াতে এসেছিলো মামার শ্বশুড়বাড়িতে। যেহেতু বাড়িতে শুধু আমি আর নানু ছিলাম তাই মামা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকতে এসেছিলো। মামার বড় মেয়ে দেখা করেই চলে গিয়েছিলো রয়ে গিয়েছিলো মামা আর তার ছেলেরা। মামার বড় ছেলে অর্থাৎ আমার মামাতো ভাই সেই সময়ে আপনারও বড় ছিলো। উনি এসে আমার আশে পাশে ঘুরঘুর করতো খালি কথা কথায় গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো। প্রথমে বিষয়টা আমি স্বাভাবিক ভাবেই নেই কিন্তু এক পর্যায়ে আমি গোসলে গেলেও সে এসে পুকুরপাড়ে বসে থাকতো। এই পর্যন্ত তাও নিজের মনের ভুল ধারণা ভেবেছিলাম কিন্তু এক রাতে।’
বাকি কথা বলতে গিয়ে রাইদার গলা ধরে আসে। সায়ন এগিয়ে এসে রাইদার কাঁধে হাত রাখে।
রাইদা চোখ বন্ধ করে আবারো বলতে শুরু করে।
‘আমি আর আমার ছোট মামাতো ভাই ঘুমাচ্ছিলাম। ছোটটা আমার এক বছরের ছোট হবে তাই সে বায়না করেছিলো আমার সাথে ঘুমাবে। মামা আর বড় ভাই অন্য রুমে শুয়ে ছিলো। মাঝ রাতে আমার ঘুম ভাঙে কারো স্পর্শে। কেউ আমার শরীরে হাত বুলাচ্ছিলো। ভয়ে চোখ খুলে দেখার সাহস হচ্ছিলো না আমার। সেই মূহুর্তে কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শরীরে করা বিশ্রী স্পর্শ গুলো কাঁটার মতো বিঁধতে শুরু করলে আমি নড়াচড়া করতে শুরু করি এতে সে ভাবে আমার ঘুম ভেঙে গেছে তাই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায় তখন চোখ খুলে বুঝার চেষ্টা করি কে ছিলো। চেহারা দেখতে পাইনি তবে বাহিরে কাশির শব্দে বুঝতে পারি ভাইয়া জেগে আছে তখন আর বুঝতে অসুবিধা হয়না এতক্ষণ কে ছিলো আমার রুমে। সেই রাতে সারা রাত ঘুম হয়নি আমার। খালি মনে হচ্ছিলো কবে ভাইয়া চলে যাবে। এর পরের দিন সকালেই ভাইয়া চলে যায় ভেবেছিলাম আমি বেঁচে গেছি কিন্তু কে জানতো সামনে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।’
কথাগুলো বলে রাইদা আবারো থেমে দম দিয়ে বলতে শুরু করে।
‘সেদিন ছিলো আমার শেষ পরীক্ষা। ঘুম থেকে সকাল বেলা উঠে উঠানে বসে পড়ছিলাম। বাড়িতে শুধু আমি ছিলাম নানু কোথায় গিয়েছিলো জানতাম না। হুট করে দেখি বড় মামা এসে আমার পাশে বসে। আমার চুল গুলো দেখে বলে আঁচড়ে তেল লাগিয়ে দিবে। আমিও খুশি মনে তেল এনে মামার হাতে দেই। আমি তাকে নিজের পিতার মতো সম্মান করতাম কিন্তু তার মনে যে আমাকে নিয়ে খারাপ বাসনা ছিলো জানতাম না। তেল দেওয়ার নাম করে সে বিশ্রী ভাবে আমার পিঠে কোমড়ে হাত দিচ্ছিলো। অনেকক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পেরে আমি জোর করে সেখান থেকে উঠে ঘরে চলে যাই। ঘরে গিয়ে আমার কান্না চলে আসে সকলের এমন ব্যবহারে। নিজেকে তখন পণ্য মনে হচ্ছিলো। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সবাই নিজের খারাপ উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছিলো। রুমেই বিছানার উপর চুপ করে বসে ছিলাম কিন্তু মামা রুমে চলে আসে। তাকে দেখে ভয়ে আমি নামতে নিলে আমার হাত চেপে ধরে। উল্টা পাল্টা নোংরা কথা আমাকে বলতে শুরু করে। বিছানায় আমাকে ফেলে দেয়। জানেন সেই মূহুর্তে মনে হচ্ছিলো আমার সম্মান এখনই শেষ হয়ে যাবে। সাহস করে চিল্লাতে শুরু করি। মামা আমাকে ধমকে থামানোর চেষ্টা করে এতে আমি চিৎকার দেই। সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে তাকায় হুট করে নানু দৌড়ে আসে। নানু এসে আমাকে মামার হাত থেকে বাঁচায়। নানুকে দেখে মামা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর আমি নানুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করি তবে নানু আমাকে বলেছিলো এই ঘটনা যেনো কাউকে না বলি। আর আমি বলতামই বা কাকে? আমার মা তখন আমায় পছন্দ করতো না আর বাবা থাকতো নিজের কাজে ব্যস্ত। অসহায়ের মতো মুখ বুঁজে সব সহ্য করেছি। বাবাকে কল দিয়ে এরপর অনেক কান্নান কাটি করে বলি যেনো আমাকে তার কাছে নিয়ে আসে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম ঐখানে আমি থাকলে অঘটন ঘটতে সময় লাগবে না। কেউ আমায় ভালোবাসতো না সবাই আমার সুযোগ নিতে চাইতো।’
কথাগুলো বলে রাইদা কান্নায় ভেঙে যায়। সায়নে এসে রাইদাকে জড়িয়ে ধরে। কি বলে রাইদাকে শান্তনা দিবে তা সায়নের অজানা। রাইদাকে কাঁদতে দেখে সায়ন নিজের কান্না চেপে রাখে।
‘এ রকম ঘটনার পর আমি কি করে কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতাম বলেন। ছোট মামা ব্যস্ত থাকায় নানু এসে আমাকে জানায় আপনি আর আপনার নানু ঢাকা ফিরবেন আমি যেনো আপনাদের সাথে ফিরি তখন মনে ভয় হলেও রাজি হয়ে যাই। আপনাকে প্রথম থেকেই আমার অপছন্দ ছিলো আবার আমার সাথে ঘটা ঘটনার পর মনে হতো আপনিও ওদের মতো সুযোগ সন্ধানী। সেই জন্যই যখন লঞ্চে উঠি আমি চুপ করে আপনার নানুর পাশেই বসে ছিলাম যাতে আপনার কোনো মতলব থাকলে তা আদায় করতে না পারেন। তবে বাথরুমে যাওয়ার সময় দেখলাম আপনি এক লোককে ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ থেকে ফেলে দিচ্ছেন এটা দেখে অনেক ভয় পেয়েছিলাম। ভয়ে আপনার সাথে আর কথা বলাও সাহস হয়নি। লঞ্চের আলো নেভার পর আপনি যখন আমার গাল স্পর্শ করেছিলেন ভেবেছিলাম আপনারও মনে আমার জন্য খারাপ ইচ্ছে আছে কিন্তু আপনি শুধু আমার গাল স্পর্শ করে হাত ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন এরপরও সারারাত মনে ভয় নিয়ে শুয়ে ছিলাম।’
রাইদা থামলে সায়ন বলতে শুরু করে,’লঞ্চে সে রাতে তোমার ব্যবহারে আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি আমার থেকে দূরে থাকতে চাইছো কিন্তু আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারছিলাম না বারবার ইচ্ছে করছিলো তোমার সাথে কথা বলি। আমাদের পাশে বসা লোকটা তোমার দিকে কুদৃষ্টি দিচ্ছিলো এমন কি আমাকে আড়ালে ডেকে বলছিলো তোমাকে যেনো ডেকে এনে তার কাছে দশমিনিটের জন্য দেই সেই জন্যই রাগে মাথায় লোকটাকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেই। সাঁতার জানতো তাই লোকটা বেঁচে গেছে। আমিও তোমার উপর রাগ করেছিলাম আমার সাথে কথা বলছিলে না তাই তুমি যখন বাথরুমে যাও তোমার ব্যাগে থাকা ফোনটা নিয়ে চুরি করে নিজের নাম্বার ডায়াল করে তোমার নাম্বারটা নিয়ে নেই যাতে তোমাকে না হারাই। বিশ্বাস করো তোমাকে নিয়ে আমার মনে কখনোই ভালোবাসা ব্যতিতো অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। তখনো আমি চাইতাম তোমাকে নিজের করে এখনও সেটাই চাই। তুমি তো আমার উপর রাগ করে নানুর সাথে শুয়েছিলে আর কাঁথা দিয়ে চেহারা ডেকে রেখেছিলে যার জন্য আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করি তোমাকে দেখার কিন্তু এর মধ্যে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় লঞ্চের তখন উপায় না পেয়ে নানুর অপর পাশে শুই। আমি শুধু তোমার মুখ স্পর্শ করতেই নানুর গায়ের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়েছিলাম। এরপর মনে হয় তোমার ঘুম ভাঙলে তো আমাকে ভুল বুঝবা তাই তো তোমার গালে আলতো স্পর্শ করে হাত সরিয়ে নেই। তোমার এক হাত নানুর গায়ের উপর ছিলো তাই আমিও তোমার সেই হাত ধরেই ঘুমানোর চেষ্টা করি। ভোর বেলা ঘুম ভাঙলে কাঁথার বাহিরে তোমার ঘুমন্ত মুখটা দেখে নিজের ফোনে ছবিও তুলে নিয়েছিলাম দেখার জন্য। এরপর তো তুমি আমাকে মিথ্যা বলেই পালালে লঞ্চ ঘাট থেকে।’
‘আমি ভয় পেয়েছিলাম মনে হচ্ছিলো অঘটন ঘটবে তাই লঞ্চ ঢাকায় যাওয়ার সাথে সাথে সবাই যখন নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন বাবাকে কল দেই আর বাবাও ঘাটেই ছিলো। আপনি যাতে আমার ঠিকানা না জানেন তাই ব্যাগ নিয়ে আপনাকে মিথ্যা বলেই বাবার কাছে চলে গিয়েছিলাম।’
সায়ন রাইদার মুখ উঁচু করে চোখের জল বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয়।
‘কতবার যে তোমায় কল করেছি শুধু একটু কথা বলার জন্য কিন্তু তুমি বারবার আমার গলা শুনে কল কেটে দিতে। একদিন তোমার মা কল ধরলো সাহস করে বললাম আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই শ্বাশুড়ি আমাকে বাহবা না দিয়ে উল্টো ধমক দিয়ে আমার মামা বাড়িতে নালিশ পাঠালো। মায়ের নাম্বার যোগাড় করে আমার নামে কতকিছু বললো তাও আমি ভেবেছিলাম শ্বাশুড়ি নিশ্চয়ই বুঝবে কিন্তু সে আমাকে হতাশ করে মাকে বললো যেনো আমাদের পরিবারের কেউ তাদেরকে বিরক্ত না করে। তোমাকে আমার হাতে কখনোই তুলে দিবে না এটাও বলেছিলো। মা আমাকে সেদিন বকেনি বুঝিয়েছিলো হয়তো সে ভেবেছিলো আমার বয়সের আবেগ যা এক সময় কমে যাবে কিন্তু যত দিন গেলো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তীব্র হতে শুরু করলো। চারিদিকের কিছুই ভালো লাগতো না শুধু তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করতো। গ্রামে কল দিয়ে খোঁজ নিতাম তুমি গ্রামে গেছো কিনা এর মধ্যে তোমার নাম্বারও টাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই বন্ধ নাম্বারে বিগত আট বছর ধরে কল দিতাম আর আশা করতাম এই বুঝি তোমার কন্ঠ শুনতে পাবো।
আমাদের দ্বিতীয় বার গ্রামে দেখাটা কাকতালীয় না। আমি খবর পেয়েছিলাম তুমি গ্রামে আছো তাই তো ছুটে গিয়েছিলাম তোমায় খুঁজতে। প্রথম রাতেই তোমার কথা শুনে বুঝেছিলাম তুমিই আমার সেই হারানো রি যার আশায় এতো বছর আমি অপেক্ষা করেছি।’
রাইদা অবাক হয়ে সায়নের কথাগুলো শুনছিলো। এমন কিছু সে কখনোই আশা করেনি।
‘দুনিয়ার সব পুরুষ খারাপ না রি। সবার মনে খারাপ চিন্তা থাকে না কেউ কেউ মন থেকে ভালোবাসে। শুধু সেই মানুষটার থেকে না পালিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করা উচিত। তোমার দিক থেকে তুমি সঠিক আবার আমার দিক থেকে আমিও সঠিক শুধু আমাদের মাঝে যেই ভুল বুঝাবুঝি গুলো ছিলো সেগুলো নতুন জীবন শুরু করার পূর্বে মিটিয়ে নেওয়াটা জরুরী ছিলো।’
‘তাহলে শেষ সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি?’
‘সঠিক সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছো তবে আট বছর আমাকে অপেক্ষা করিয়ে। সেদিন যদি না পালিয়ে আমার কথা শুনতা তাহলে এত গুলো বছর নষ্ট হতো না। আরো আগে আমাদের বিয়ে বাচ্চা সব হতো।’
সায়নের কথা শুনে রাইদা সায়নের বুকে কিল দিয়ে বলে,’ধ্যাত অসভ্য লোক।’
‘দুই দুইবার বিয়ে করা বউয়ের সাথে অসভ্য করবো না তো কার সাথে অসভ্যতা করবো বলো? এবার বোধহয় আমাদের রুমে যাওয়া উচিত।’
কথাগুলো বলে সায়ন রাইদাকে কোলে তুলে হাঁটা দেয়।
‘আরে সিঁড়ি দিয়ে আমি নামতে পারবো নামান আমাকে। এভাবে আপনার কষ্ট হবে। নামান বলছি।’
নিপা পানির বোতল নিয়ে সায়ন্তিকার রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখনই
তার নজরে সায়ন আর রাইদা আসে। নিপাকে দেখে লজ্জায় রাইদা সায়নের বুকে মুখ লুকায়। সায়ন হাসতে হাসতে রাইদাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
দরজা আঁটকে বিছানায় বসা রাইদার দিকে এগিয়ে যায় সায়ন। রাইদা মুখ কালো করে পাশ ফিরে শোয়। সায়ন বিছানায় এসে রাইদাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। রাইদা সায়নের বুকের উপর মাথা রেখে শোয় আর সায়ন রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
পরম ভালোবাসা আর ভরসার স্থান পেয়ে রাইদা নিশ্চিন্ত হয়।
…
(চলবে..)
(৩০০০শব্দের বিশাল পর্ব দিয়েছি আশা করি আপনাদের ভালো খারাপ মন্তব্য পাবো। আমি রিচেক দিয়েছি তাও যদি বানান ভুল থাকে আমাকে অবশ্যই জানাবে।)