“আপনাকে এই মূহুর্তে চেপে ধরে যদি একটা চুমু খাই তবে আপনার ফিলিংস জন্মাবে?”
সামনে বসা স্বল্প পরিচয়ের সুদর্শন পুরুষটির মুখে এহেন কথা শুনে ইভানা চোখ বড় বড় করে তাকাল।
বিদেশী গোছের ছেলেটি ঠোঁট টিপে হাসল ইভানার মুখাবয়ব দেখে। ইভানা তা বুঝতে পেরে কপট রেগে গিয়ে বলল,
“আপনি এবার সত্যি সত্যি পশ্চিমাদের মত ব্যবহার করছেন মিস্টার আবরার ফাইয়াজ।”
লোকটি পুনরায় হাসল। বলল,
“আপনি তো মানছেন না ব্যাপারটা। তাই বাধ্য হচ্ছি আমি।”
“আপনি পাবলিক প্লেসে বসে চুমু-টুমু, হাতা-হাতি,জড়াজড়ি যাই বলুন না কেন আমি রাজি হচ্ছি না।”
আবরার চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিস্ময়ের সহিত বলল,
“হুয়াট ডু ইউ মিন বাই জড়াজড়ি অর হাতা_হাতি?”
ইভানা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল।
“ঠিক এজন্যই আমি চাইনা এরকম পশ্চিমা টাইপ ছেলে। আমি চাই একজন পিওর বাঙালিকে বিয়ে করতে।”
আবরার শার্টের কলার উঁচিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল,
“আমি আপাদমস্তক বাঙালি ইভানা।”
ইভানা নিজের নাম পর পুরুষটির কণ্ঠে শুনে খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
“আচ্ছা তাই! একটা বৈশিষ্ট্য বলুন তো আপনার বাঙালি চরিত্রের।”
আবরার সময় নিল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“আমি রাতে লুঙ্গি পরে ঘুমাই।”
ইভানা কিঞ্চিৎ সময় চুপ করে রইল। পরক্ষণেই শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। আবরারের ঠোঁটের কোণেও তখন মৃদু হাসির রেশ।
ইভানার হাসির শব্দে রেস্টুরেন্টের বাকি সদস্যরা আড়চোখে তাকাল। হয়তো বিরক্তও হলো। বুঝতে পেরে ইভানা নিজেকে সামলে নিল।
আবরার পুনরায় বলল,
“এবার করবেন তো আমাকে বিয়ে?”
ইভানা কিছুটা সময় নিয়ে কথা গুছিয়ে নিল। হুটহাট কথা সে গুছিয়ে বলতে পারে না।
আবরার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভানার দিকে।
“আপনি বাঙালি হলেও বহু বছর আগে চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। মনে প্রাণে বাঙালি হলেও বাইরের আবরণটা কিন্তু পশ্চিমাদের দখলেই চলে গেছে। হয়তো তাদের কালচারেই অভ্যস্থ। কিন্তু আমি মোটেই এরকম কাউকে চাই না। আমি চাই আগাগোড়া বাঙালি একজন পুরুষ। যার প্রথম ও শেষ প্রায়োরিটি থাকব আমি। হ্যা অবশ্যই বাবা মায়ের পর। বাবা মায়ের পর তার একান্ত আপন মানুষটা যেন আমিই হই। তাকে নিয়ে যেন আমি ইনসিকিউর ফিল না করি। উঠতে বসতে খেতে শুতে সব সময় তাকেই আমার চাই। আমি বাঙালিয়ানা শুধু মনে মনে ধারণ নয়, রীতিমতো লালন করি। আপনি পারবেন? পারবেন না। আপনি জানেন, বাঙালি মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী ব্যতীত আর কারো কথা ভাবতে পারে না। সবার উর্ধ্বে স্বামী। তাই আমি এমন একজন কে চাই যাকে এক ডাকেই আমার শিওরে অপেক্ষমান দেখতে পাব।”
আবরার রসিকতার সুরে বলল,
“এককথায় অন ডিউটি হাসবেন্ড চাই, রাইট?”
ইভানা মাথা নেড়ে হাসল। সম্মতি সূচক ইশারা পেয়ে আবরার মৃদুস্বরে বলল,
“ঠিক আছে। আমি যদি অন ডিউটি হাসবেন্ড হয়ে যাই তবে বিয়ে করবেন?”
ইভানা মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি সোজা কথা বলছি আপনি বুঝতে পারছেন না? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। তার একমাত্র এবং অন্যতম কারণ হচ্ছে আপনি ইতালি প্রবাসী। আপনাকে বিয়ে করলে আমাকে দেশ ছাড়তে হবে। সেটা আমি ইহজন্মে পারব না। আবার পতিধর্ম বলেও একটা ব্যাপার আছে। সেটাও এড়াতে পারব না। কোনটা করব আমি? আপনি বলছেন অন ডিউটি হাসবেন্ড হবেন। কিন্তু আমি তো দেশ ছাড়ব না। আপনিও দেশে ফিরবেন না। এদিকে আপনার ছুটি মাত্র পনেরো দিন। বিয়ের ধুমধাম শেষ হতেই সপ্তাহ কেটে যাবে। এসেছেন দুদিন আজ। নয়দিন হলো। বাকি ছয়দিন। ছয়দিনের একদিন গোছগাছ করতেই লাগবে। রইল পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিন আপনি অন ডিউটি হাসবেন্ড হবেন? এরকম ক্ষণিকের আনন্দ আমি চাই না। আমি বিলাসিতা চাই না। চাই না আরামদায়ক জীবনযাপনের সুযোগ। দেশের মাটিতে দুমুঠো খেয়ে রাত হলে স্বামীর বাপাশে একটু জায়গা হলেই আমি খুশি। আপনি পারবেন দিতে? পারলে বলুন। আমি নিজে গিয়ে সব আত্মীয়ের বাড়িতে কার্ড বিলি করে আসব।”
আবরার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমনও মেয়ে হয়?
ইভানা আফরোজ। পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে চলতি বছরেই। লম্বা, ফর্সা ছিমছাম গোছের মেয়ে। ছেলে পক্ষের প্রথম দেখায় পছন্দ হয়ে যাওয়ার সব গুণাবলি নিয়েই তার জন্ম। চরিত্রটা বাঁধিয়ে রাখার মত। সময়ের তুলনায় মানসিকতা বেশিই পরিপক্ব তার। অন্য পাঁচটা মেয়ের মত আরামদায়ক জীবনযাপন চায় না সে। চায় এক টুকরো সুখ, শান্তি।আর চায় প্রিয়জনের সঙ্গ। তেইশ বছরের জীবনে একটা প্রেম ঘটিত জটিলতায় সে জড়ায়নি। চেয়েছে কেবল একজনেরই হাত। অপেক্ষা করেছে তার। হবু স্বামী। তাই তো বিয়েতে এত বাছবিচার তার।
আবরার ফাইয়াজ লাল রঙা বেনারসি শাড়ির আঁচলে হাত বুলিয়ে মা ফাহিমা করিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, ওমন বউ কোত্থেকে পছন্দ করলে বলো তো। একেবারে নাটরের কাঁচাগোল্লার মত ।”
ফাহিমা করিম ছেলের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে বলল,
“তোর পছন্দ হয় নি?”
আবরার এক প্রস্ত হেসে বলল,
“হয় নি আবার। বললাম না কাঁচা গোল্লার মত বউ। কাঁচাই খেয়ে ফেলা যাবে।”
শেষোক্ত কথাগুলো বিরবির করে বলল আবরার।
ফাহিমা করিম মুচকি হেসে মনোযোগ দিলেন শাড়ি গোছানোর দিকে। আবরার নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে সব। আধুনিক সাজ পোশাক ছেড়ে লাল রঙা বেনারসিটার উপর নজর আঁটকে গিয়েছিল তার। ইভানা কি ভাববে, না ভাববে চিন্তা না করেই টুক করে কিনে নিয়ে চলেন এসেছিল। ইভানার রুচিবোধ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা তখন ছিল আর না এখন আছে। কেবল ছবি দেখেছিল দুটো। তাতেই বিয়ের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আবরার।
তবে আজ রেস্টুরেন্টের ক্ষণিক সাক্ষাতের পর মনে হচ্ছে আরও আগে কথা বলা উচিৎ ছিল। শেষ পর্যায়ে এসে জানতে পারল মেয়েটা বিয়ে করতে রাজি নয়। কারনটা তার প্রফেশন। আবরার তাচ্ছিল্য হাসল। এই নাকি সুখী হওয়ার জন্য কারি কারি টাকা লাগে। তবে সে কেন টাকা দিয়ে এক রমণীর মন কিনতে পারল না।
তার দামী মনটার জন্য কি ভালবাসা প্রয়োজন? তবেই কিনতে পারবে অমূল্য অদৃশ্য মনটা?
ইভানা চোখ মুখ কুঁচকে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে বহুক্ষণ সময় নিয়ে। সামনে বসে আছে তার মা মাকসুদা খানম এবং বাবা ইয়াসিন মোন্তাজ। মেয়ের বিরক্ত মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে মাকসুদা খানম নিজেও বিরক্ত হলেন।
ইভানা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“আমি বিয়ে করব না মা। এই ছেলে কে তো নয়ই।”
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে ইভানার এই কলের পুতুলের মত বিয়ে করব না, বিয়ে করব না শুনতে শুনতে বিরক্ত মাকসুদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“তোর কি অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে? থাকলে বল। বিয়ের দিন কোনো কেলেঙ্কারি ঘটালে আমি কিন্তু গলায় দড়ি দেব। ”
ইভানা বিরক্ত ভঙ্গিতে নিশ্বাস ফেলল। এই মহিলার কথায় কথায় গলায় দড়ি দেওয়ার কথা শুনে বিরক্ত ইভানা। বিরক্ত ইয়াসিন মোন্তাজ এমনকি ক্লাস টেনে পড়ুয়া ছেলে ইভানও।
“আমার কোনো সম্পর্ক নেই মা। থাকলে আমি নিজেই পালাতাম এই অত্যাচার থেকে। আফসোস। বড্ড আফসোস হচ্ছে। এতগুলো প্রপোজাল লিস্ট থেকে একজন কে সিলেক্ট করা উচিৎ ছিল।”
মাকসুদা খানম কড়া চোখে তাকালেন। ইয়াসিন মোন্তাজ মুখ টিপে হেসে হাত চাপা দিলেন মুখের উপর। মাকসুদা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ইভানা পুনরায় বলল,
“মা তুমি একটা রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। আমি দ্বিমত করব না। কিন্তু এই ছেলেটা না। দয়া করো।”
ইয়াসিন মোন্তাজ এবার সিরিয়াস হলেন। বললেন,
“কি হয়েছে ইভা মা আমার? এই ছেলের কি সমস্যা? এর চেয়ে তুমি রিকশাওয়ালা কে বিয়ে করতে চাইছো। খুলে বলো। না বললে বাবা বুঝবে কি করে?”
ইভানা টলমল চোখে বাবার দিকে তাকাল। বাবাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।
“আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না। আর না পারব এই দেশ ছাড়তে। এই বিয়ে করলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য বাবা। কি করব আমি? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বাবা। তুমি বলো না এই বিয়ে ভেঙে দিতে।”
ইয়াসিন মোন্তাজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে। তুমি তোমার ফোনটা দাও তো। আমি কথা বলি আবরারের সাথে। আমার মেয়েকে কাঁদায় সে। কি এমন চাকরি করে যে আমার গুনবতি মেয়েটার জন্য তা ছেড়েছুড়ে আসতে পারবে না। দাও ফোন। আমি কথা বলছি। এমন ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে কিছুতেই দেব না। কদাপি নহে।”
ইভানা চোখ মেলে বাবার মুখের দিকে তাকাল। মাকসুদা খানম পারে না বাবা মেয়েকে গিলে খেয়ে নেয়।
মিনিট পাঁচেক পর ইয়াসিন মোন্তাজ রুমে ফিরে এলেন। ইভানা তখনো সোফায় বসে আছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। মাকসুদা খানম কটমট করে তাকাল বারান্দা হতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসা ইয়াসিন মোন্তাজের দিকে।
ইয়াসিন সাহেব মন খারাপ করে বলল,
“মা রে আমিতো মহা বিপদে ফেঁসে গেছি।”
ইভানা বাবার মুখের দিকে তাকাল। অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে
নিজের চিন্তা ভুলে গেল সে। বাবার জন্য উদ্বিগ্ন হলো। কপালে হাত রেখে জ্বর পরীক্ষা করে বলল,
“কি হয়েছে বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?”
ইয়াসিন মোন্তাজ মৃদু স্বরে বললেন,
“শরীর ঠিক আছে। মনটা ঠিক নেই। আমার ভুলের জন্য কতগুলো মানুষের সম্মান রাস্তায় মিশে যাচ্ছে। আমার নিজের সম্মান তো বাদই দিলাম।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তার বাবাও কি মায়ের মত ড্রামা করছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করল। কিন্তু নিজ পিতার মুখাবয়বে ছলচাতুরীর লেশমাত্র পেল না।
ইভানা নরম কণ্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে বাবা? এরকম ভাবে বলছো কেন? তোমার জন্য অন্য লোকের মানসম্মান কেন যাবে?”
ইয়াসিন মোন্তাজ ধীর গলায় বলল,
“বিয়ের কার্ড বিলি করা হয়ে গেছে। দু একদিনের মধ্যে আত্নীয় স্বজন চলে আসবে আবরারের বাসায়। এখন তুমি বলছো বিয়ে করবে না। এতে মান সম্মান যাবে না? আমাদের নাহয় আত্নীয় স্বজন কম। কিন্তু ওদের তো এই বিয়ে নিয়ে অনেক প্ল্যানিং। যা চলছে গত ছয়মাস ধরে। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। বিয়েটা তো আমার মতামতেই ঠিক হয়েছিল। যাই হোক কি আর করা যাবে। তুমি তো রাজি না।”
ইভানা চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিল। বাবার হাত ধরে বলল,
“আমাকে একটু সময় দাও বাবা।”
ইয়াসিন মোন্তাজ কণ্ঠে আদর মিশিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে মা। সময় নাও। ছেলেটা কিন্তু খারাপ না।”
ইভানা হাসল। মলিন হাসি। যার শব্দ হয় না। কেবল ঠোঁটের কোণটা একটুখানি প্রসারিত হয়।
বিছানায় চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকা আবরারের ফোনটা বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠলো। বিরক্ত হয়ে ফোনের স্কিনে তাকাল। কিন্তু স্কিনে প্রিয় ঠিকানার নাম্বার দেখে মুচকি হাসল। বলল,
” হ্যা আংকেল বলুন।”
ইভানা ফোঁত করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আংকেল নই। আংকেলের মেয়ে। অ্যাপয়েনমেন্ট দেয়া যাবে?”
#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#সুচনা_পর্ব
চলবে…