অন্তিম প্রণয় পর্ব -০৫ ও শেষ

#অন্তিম_প্রণয়`[৫]
#সুমাইয়া_মনি
#অন্তিম_পর্ব

‘কী করছো ইরিন?’
‘বসে রইছি, তুমি?’
‘শুয়ে। কেমন আছো?’
‘ঢং দেখাও?’
‘কেন?’
‘সারাদিন কথা হয় তবুও জিজ্ঞেস করছো কেমন আছো?’
‘তাতেও সমস্যা।’
‘হ্যাঁ!’
‘আচ্ছা বাদ দেও। তোমাকে একটি মজার ঘটনা বলি।’
‘বলো।’
‘আমি একদিন আমার দুঃসম্পর্কের কাকার বাড়িতে একটা কাজে গিয়েছিলাম।’
‘তারপর?’
‘কাকার সাথে অনেক কথা হলো। এক পর্যায় কাকা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমরা কয়টা গরু পালি।’
‘তারপর?’
‘আমি নিরুত্তর। কারণ আমি আসলেই জানি না আমরা কয়টা গরু পালি।’
‘কী? সত্যি?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘সত্যিই জানি না। আসলে আমি বাসা থেকে বের হই ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে। আসার সময়ও একই! আমি কখনো ঘরের কোনো কাজ করিনি। আশে পাশের কলোনিতে কার ঠ্যাং ভেঙেছে, কার ছেলে-মেয়ে হয়েছে, কার মেয়ে পালিয়ে গেছে, কার ঘরে ঝা’মে’লা লেগেছে, কার ঘরে চো’র ঢুকেছে। কোনো খবরই আমি রাখি না। আমাদের গরুর কাছে যাওয়ার কথা তো দূর। তাই আমি জানি না যে আমরা গরু কয়টা পালি। কাকা যখন অন্য কথায় ব্যস্ত ছিল তখন আমি বাহিরে বের হয়ে মা’কে কল দেই। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করি যে আমরা গরু কয়টা পালি। মা যখন বলল দুইটা পালি। তখন আমি ভেতরে এসে কাকা’কে বলি আমরা দুইটা গরু পালি।’
অপর পাশে ইরিন কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছে। হিয়ানের কথায় প্রতিত্তোরে কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না। তবুও বিরক্ত স্বরে বলে,
‘তোমার বাবা দুইটা গরু না বরং তিনটা গরু পালে। একটি হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর বাকি দু’টি গোয়াল ঘরে বাঁধা। ওদের সাথে তোমাকেও বেঁধে রাখা উচিত।’
‘তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?’
‘অন্যের বিষয় মাথা ব্যথা নেই বুঝলাম। কিন্তু নিজের বাড়িতে কয়টা গরু পালে সেটাও জানো না। তোমাকে গরু উপাধি দিলে ভুল হবে। গা’ধা উপাধি দেওয়া উচিত।’ ক্ষুপ্ত স্বরে বলে ইরিন।
‘বুঝতেছি না আমাকে সম্মান করছো নাকি অপমান?’
‘তোমাকে সম্মান করছি পা’ডা, ছা’গ’ল, গা’ধা, ম’হি’ষ, গা’ধা এসব বলে।’
‘আরেকটা বাদ পড়েছে, বা’ন’র!’
‘হ্যাঁ! সেটাও তুমি।’
‘তাহলে মানছো আমি চালাক। কারণ বা’ন’র কিন্তু চালাক প্রকৃতির পশু।’
‘তুমি মোটেও চালাক না। একটা পা’গ’ল। আমার নিজের বাসায় কয়টা গরু পালে, অথচ আমিই বলতে পারি না! পা’গ’ল নয়তো কী!’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ইরিন।
‘হেই! তোমাদের বাসাতেও গরু পালে নাকি?’
‘আমি আমার কথা বলছি না। তোমার কথা বলছি। গা’ধা কোথাকার।’ একপ্রকার চিল্লিয়ে বলল।
‘আচ্ছা বুঝেছি আমি একটা গা’ধা!’
‘তুমি কেমন সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। কপালে বউ জুটবে না। যদিও জুটে সে বিয়ের দুই দিনের মাথায় কপালে লাথি মে’রে চলে যাবে ।’
‘সে যাক! দ্বিতীয় বিয়ে করব।’
‘কী যে বলব তোমায়।’ দাঁত কটমট করে বলল।
‘ভালোবাসি বলো!’ হেসে হেসে বলে হিয়ান ।
‘ঠে’ঙ্গা! তোমার কপালে ঠে’ঙ্গা।’
এটা বলে ফোন কেঁটে দেয় ইরিন। হিয়ান ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে উঁচু স্বরে হেসে ফেলে।

কল্পনা থেকে বেরিয়ে হিয়ান মৃদু হাসে। আগের কথা মনে পড়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। বুক চিঁড়ে দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌন হয়ে রয়। কিন্তু এ মুহূর্তে নিজেকে মৌনতায় ডুরে রাখা অসম্ভব। তার জন্য অপেক্ষা করছে সদ্য বিয়ে করা নববধূ! আজ তার বাসর রাত। দেখতে দেখতে সপ্তাহ কেঁটে গেছে। আজ তার বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
নববধু অপেক্ষা করছে বাসর ঘরে। ঐ বাড়ি থেকে ফিরে ছাদে এসে বসেছে। ইরিনের অতীত ভুলতে হবে তাকে। বের হতে হবে তার কল্পনা থেকে। তবে পুরোপুরি মুছে ফেলা অসম্ভব!
মনটা কেন যেন কু ডাকছে। শরীর হাত-পা হালকা অনুভব হচ্ছে। এমন অনুভূতি আজ প্রথম অনুভব করছে। চোখ বন্ধ করে বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। সব চিন্তাভাবনা পাশে রেখে নিচে নেমে এলো। রুমে যাওয়ার পূর্বে মায়ের সঙ্গে কিছু বাক্যবিনিময় করল। ভেতরে আসার পর বিছানায় তার অর্ধাঙ্গিনীকে ঘোনটা নেটে বসে থাকতে দেখতে পায়। হালকা ভাবে ফুল দ্বারা সাজানো হয়েছে বিছানা। গোলাপ ফুলের সুভাষ ছড়িয়ে আছে চারদিক। হিয়ান বিছানার পাশে এসে বসল।
প্রথমে কী বলে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই নববধূ মাথার ঘোনটা সরিয়ে তীর্যক চোখে তাকায়। আকস্মিক ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয় হিয়ান। সে বলে,
‘বনিতা করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। না আছে আপনার নাটক দেখার।’
হিয়ানের বুঝতে অসুবিধা হলো তার নববধূর কথা। পরক্ষণে ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? কিসের নাটকের কথা বলছেন?’
‘সামিরা আমার নাম।’
‘সুন্দর নাম।’
‘আপনি সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেন কীভাবে বলতে পারেন?’
‘উদাহরণ?’
সামিরা বিছানা থেকে নামে। তার টলি ব্যাগ থেকে কিছু পেপার জাতীয় কাগজ বের করতে লাগলো। হিয়ান অবাক হয়ে সামিরার আচরণ দেখছে। জানা-শোনা হীন ভাবে তার সঙ্গে সামিরার বিয়ে হয়েছে। প্রথম দিন তার এমন ব্যবহার তাকে ভাবুক করে তুলছে। সামিরা তেড়ে এসে কতগুলো রঙিন চিরকুট হিয়ানের মুখ-মন্ডলের ওপর ছুড়ে দেয়। হিয়ান তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী এগুলো? এমন বিহেভ কেন করছেন?’
‘পড়ুন! একটা একটা করে সব চিরকুট পড়ুন। বুঝতে পারবেন আপনি কোনো দুধের ধোঁয়া তুলশী পাতা নন!’
হিয়ান আরো ক্ষেপে যায়। কথা না বাড়িয়ে একটি একটি করে সব চিরকুট তুলে একে একে পড়তে আরম্ভ করে। প্রথম একটি চিরকুট পড়ে হিয়ান পা থেকে মাটি যেন আলগা অনুভব করে। সেটিতে লিখা ছিল,
‘হিয়ান কেন এমন করলে? এই ছিল তোমার আমার জন্য ভালোবাসা? আমার কাবিনের বিষয়টি নিয়ে মজা করেছিলাম। তুমি সিরিয়াস হয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে? একটি বারও বুঝলে না কতটুকু সত্য ছিল আমার কথায়। এভাবে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি ক্ষণে ক্ষণে ম’রে যাচ্ছি। চলে এসো প্লিজ! চলে এসো। ইতি ইরিন।’
সম্পূর্ণ পড়ে সরস চোখে সামিরার পানে তাকায়। সামিরার চাহনি অগ্নিশর্মার ন্যায় রূপ ধারণ করেছে। রা’গ, ক্ষো’ভ, ঘৃ’ণা তার মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাহলে সেই অচেনা রমণী সামিরা ছিল? যে কি-না হিয়ানকে শা’স্তি’যো’গ্য বলে দাবি করেছে?
‘পড়ুন! সব গুলো পড়ুন। আপনার জন্য আমার বোনকে আমি হারিয়েছি। আমার মা-বাবা হারিয়েছে তার আদরের বড়ো মেয়েকে। আপনি খু’নি। আমার বোনকে আপনি তিলে তিলে খু’ন করেছেন।’
হিয়ান নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। তার দুনিয়া যেন উলোটপালোট হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘তু..তুমি?’
‘সামিরা। ইরিনের ছোট বোন সামিরা আমি।’
হিয়ান ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। এ কোন ভাগ্যের চক্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে সে? এর থেকে বের হবার মূল উৎস কী?
সামিরা আঙুল তাক করে হিয়ানকে আরো বলল,
‘সেদিন কেন আপুর সম্পূর্ণ কথা শুনলেন না? কেন বুঝলেন না আপু আপনার সাথে কাবিনের বিষয়টি নিয়ে প্রাঙ্ক করেছিল। আপনার ভালোবাসাকে একটু যাচাই করতে চেয়েছিল। এটাই কী ছিল আপুর ভুল? মৃ’ত্যু দিয়ে ভুল শুধরাতে হলো ইরিন আপুকে।’
হিয়ান অস্ফুটে স্বরে শুধালো,
‘মৃ’ত্যু?’
‘হ্যাঁ, সু’ই’সা’ই’ড করেছে আপু, সু’ই’সা’ই’ড!’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললো সামিরা।
হিয়ানের চোখে পানি টলমল করছে। বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ইরিন নিজের বিষয় এতটাই গোপন রেখেছে যে নিজের পরিবারের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি। সে আদৌও জানত না তার একটি বোন আছে। এক মুহূর্তের জন্য চাইছে এসব মিথ্যে হয়ে যাক। কোনো মীরাক্কেল হোক! এতদিন সে ভেবেছিল প্রিয় মানুষটি ভালো আছে, সুখে আছে। আর আজ বুঝতে পারলো তার এক প্রান্তের দুনিয়া অ’ন্ধ’কা’র হয়ে গেছে বহু আগেই। সামিরা চোখের পানি মুছে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল,
‘বিচ্ছেদ করেছেন আপুর সঙ্গে। সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বি’চ্ছি’ন্ন করেছেন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা অনেক ভাবে করেছে। কিন্তু আপু বৃথা! য’ন্ত্র’ণা সহ্য করতে করতে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। আপনি আপুর বিষয় কিছু জানতেন না৷ আমার ফ্যামিলিও কেউ জানতো না আপনার বিষয়। আপুর মৃ’ত্যু’র পর ওর ডায়েরী এবং এই চিরকুট গুলো খুঁজে পাই। আপনার একটি ছবিও পেয়েছিলাম। সেন্টারে আপনাকে প্রথম দেখে রা’গে-দুঃখে তখন বোনের মৃ’ত্যু’র প্রতি’শোধ নিতে চেয়েছিলাম। পরক্ষণেই মত পাল্টাই। যখন জানতে পারলাম আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি ভেবে রেখেছি প্রতি’শোধ এবার আমি নেবই।’
হিয়ান কান্নারত কণ্ঠে ইরিনের পানে চেয়ে বলল,
‘মে’রে ফেলো আমায়।’
সামিরা হিয়ানের কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আমি আপনার স্ত্রী না। আমাদের বিয়ে সকলের সামনে হলেও। বাস্তবে হয়নি। কাজিকে আমি টাকা দিয়ে নকল বিয়ে করিয়েছি শুধু মাত্র আপনাকে… ‘ বলতে বলতে কলার ছেড়ে দেয় সামিরা। হিয়ান চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। অঝোরে চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। দৃষ্টি নিচু রেখে বলল,
‘নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতাম। ভেবেছিলাম কাবিন হয়েছে আমি ওর থেকে দূরে চলে যাই। ও ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। ওঁকে ছাড়া প্রতিটা মিনিট, ঘন্টা কীভাবে অতিবাহিত করেছি কেবল আমি এবং রব ভালো জানে। আমারই ভুল ছিল। ভুল!’
‘সবাইকে আমিই বলব। সবার জানা উচিত আপনি আমার বোনের খু’নি! শা’স্তি তারাই দিতে আপনাকে। আমি না। কারণ আমার বোনের প্রিয় মানুষটিকে আমি মে’রে ফেলতে পারব না।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে সামিরার। নিজেকে শক্ত রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। হিয়ান চিরকুট গুলো বুকে জড়িয়ে নেয়। হেঁটে বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়। অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের পানে তাকিয়ে বলল,
‘আমাকে একা রেখে চলে যেতে পার না। আমাদের প্রণয়ের অন্তিম না হয় অন্যভাবে হবে। আসছি আমি! আসছি।’ বলতে বলতে চিরকুট গুলো বুকে জড়িয়ে রেখে রেলিং এর উপর থেকে ঝা’প দেয়। সাত তলার ওপর থেকে পড়ে মৃ’ত্যু হয় হিয়ানের। নিথর দেহখানা পড়ে আছে তার চিরকুটের সঙ্গে। র’ক্তে মিশে গেছে লেখাগুলো। সামিরা সকলকে রুমে এনে দেখে হিয়ান নেই। বারান্দায় ছুটে এসে উঁকি দিয়ে হিয়ানের র’ক্ত’মা’খা নিথর দেহ দেখে দেখালে পিঠ ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে পরিবারের সকলে। সে চেয়েছিল তাকে শা’স্তি দিতে। তবে মৃ’ত্যু দিয়ে নয়। জীবিত অবস্থায়ই! তার ভাবনাচিন্তা এতটাও জ’ঘ’ন্য ছিল না। হিয়ান নিজেই নিজেকেই শাস্তি দিয়েছে।
সামিরা মুখ চেপে কেঁদে তাঁরা ভরা আকাশের পানে চেয়ে বলল,
‘অবশেষে আপনাদের অন্তিম প্রণয়ের অবসান ঘটলো! হতেই তো পারতো এই প্রণয়ের মনোরম উপসংহার! কেন হলো না, কেন?’ তীব্র এক য ন্ত্র ণা দা য় ক প্রশ্ন। যার উত্তর নিরুত্তর!

সমাপ্ত।

কিছু কথা।

গল্পটি রহস্য দিয়েই শেষ করলাম। যদি মনে খু্তখু্ত থেকে থাকে, তাহলে বাকি রহস্যগুলো আপনারা নিজেরাই কল্পনা করে ভেবে নিবেন। ধন্যবাদ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here