অন্তিম প্রণয় পর্ব -০২

#অন্তিম_প্রণয়`[২]
#সুমাইয়া_মনি

হিয়ান তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বই মেলায় এসেছে। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে আসা হয় তাদের। বই মেলা শুরু হয়েছে এ মাসের প্রথম দিকে। থ্রিলার, ভৌতিক, এডভেঞ্চার, সাইন্স ফিকশন বই পড়তে খুব পছন্দ করে হিয়ান। বাংলার প্রকাশনী নামে একটি বুক শপে ৩০℅ ডিসকাউন্টে বই বিক্রি হচ্ছে। বই কিনার জন্য অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে। নিজের পছন্দ মতো সকলেই বই ক্রয় করছেন। শীতল ভাব কম। কড়া রৌদ্রে গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে সকলে। এ রৌদ্দের মধ্যে হিয়ানের বন্ধুরা লাইনে দাঁড়াবে না বলে ওঁকে একা রেখেই চায়ের দোকানে এসেছে। হিয়ান সেখানে একা দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠিক সামনেই একটি মেয়ে দাঁড়ান ছিল। হিয়ান ফোনের ওপর থেকে নজর সরিয়ে মেয়েটির পিঠের পানে একবার নজর বুলালো। তার মাথায় ঘন কালো লম্বা চুল গুলো পিঠ বেয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। গরমে মানুষ ঘেঁমে অস্থির। আর সেখানে এই মেয়ে কি-না চুল খোলা রেখে দিব্যি আরামে দাঁড়িয়ে আছে। একেই বলে মহিলা মানুষ। বিড়বিড় করে বাক্যটি বলে হিয়ান পুনরায় ফোন ঘাঁ’ট’তে আরম্ভ করল। সে মেয়েটির থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো।
কিছু সময় অতিবাহিত হয়। আচমকা মেয়েটি পিছনে ঘুরেই হিয়ানের বুকে এক হাত রেখে ধা’ক্কা দিয়ে কা’ঠি’ন্য স্বরে বলল,
‘বার বার পিছনে দাঁড়িয়ে চুল ধরে টা’ন দিচ্ছেন কেন? ব্য’থা পাচ্ছি যে আমি বুঝতে পারছেন না?’

প্রথমত হিয়ান মেয়েটির ধা’ক্কা’য় হক’চ’কিয়ে ওঠেছে। তার ওপর মি’থ্যা অপ’বাদে আহ’ম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে তার পানে। মেয়েটির চেহারায় রা’গে’র আভা উঠানামা করছে। হিয়ানকে ধা’ক্কা দেওয়ার ফলে অনেকেই তাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির বান্ধবি’রা ঘুরে পিছনে তাকায়। আয়না নামের মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে ইরিন?’
এতক্ষণে তাকে হে’ন’স্তা করা মেয়েটির নাম হিয়ান জানতে পারলো। ইরিন রা’গে চোখ মুখ ঘু’চিয়ে বলল,
‘কয়েক বার চুল ধ’রে টা’ন দিয়েছে। কিছু বলিনি। কিন্তু এবার আর স’হ্য হচ্ছিল না। ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু স্বীকার করছে না।’
‘যেটা আমি করিনি। সেটা কোন দুঃক্ষে স্বীকার করতে যাব?’ তে’জি কণ্ঠে হিয়ান বলল।
‘তাহলে কি ভূ’তে এসে টে’নে গেছে?’ গমগমে গলায় বলল ইরিন।
‘হতে পারে। যেভাবে খোলা চুল ছেড়ে এসেছে। এক দু’টি ভূ’ত সঙ্গে আসা স্বাভাবিক।’
‘আজা’ইরা কথা বলবেন না।’
‘শুনুন, প্রথমত আপনার চুল ধ’রা’র কোনো ইচ্ছে আমার নেই। টা’না’র কথা দূরেই থাক। দ্বিতীয়, আপনি আমাকে স্যরি বলবেন।’
‘নিজে ভু’ল করে আমাকে স্যরি বলতে বলছেন। কেমন বিরক্তিকর লোক আপনি?’ রা’গে শরীর রীতিমতো কাঁ’প’তে শুরু করেছে ইরিনের। ইতিমধ্যে হিয়ানের বন্ধুরা সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তাদের কথপোকথনে তারা বুঝতে পারে কী কারণে এখানে জ’ট’লা পাকিয়েছে। পুনরায় হিয়ানকে জিজ্ঞেস করল না।
‘যেটা আমি করিনি, স্যরি বলার প্রশ্নই আসে না।’ চো’য়া’ল শ’ক্ত করে বলল হিয়ান।
ইরিন আঙুল তুলে বলল,
‘স্যরি আপনাকে বলত….আহহ!’ কথার বাকি অংশ শেষ করার পূর্বে ব্য’থা’য় কুঁ’ক’ড়ে উঠল ইরিন। ফের কেউ জো’রে’শো’রে চুল ধ’রে টে’নে’ছে। তবে কে? অ’ন্যা’য়’কা’রী তার সামনেই! ইরিন সহ সকলে পিছনে ঘুরে তাকায়। তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিছন থেকে একটি পিচ্চি ছেলে হাসতে হাসতে দৌঁড়ে পা’লি’য়ে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। বয়স আনুমানিক চার কি পাঁচ হবে। ছেলেটির মা ইরিনের পানে মৃদু হেসে ছেলের হয়ে, ‘স্যরি’ উচ্চারণ করে চলে যায়।ইরিনের রা’গ ‌নিমিষেই উবে যায়। অনুতপ্ত বোধ ঝেঁ’কে বসল মনে। ঘুরে তাকাতে সা’হ’সে কুলচ্ছে না। ততক্ষণে হিয়ান ইরিনকে উদ্দেশ্যে করে ডাকল,
‘মিস.ইরিন এদিকে তাকান। কী কী যেন বলছেন? আবার বলুন?’
ইরিন ধীরে ধীরে ফিরে নিচু স্বরে বলল,
‘স্যরি!’
হিয়ান না শোনার ভান করে কানে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘হ্যাঁ, কী বলেছেন শুনিনি? আবার বলুন?’
‘দুঃখিত!’
হিয়ান ইরিনের অনুতাপ আদল দেখে মেকি হেসে বলল,
‘পরবর্তীতে কাউকে কিছু বলার পূর্বে একটু যাচাই-বাছাই করে নিবেন। আশা করি এমন ভুল আর হবে না?’
ইরিন এদিক সেদিক মাথা দুলিয়ে না সূচক জবাব দেয়।
‘আমি হিয়ান আহমেদ। নামটি মনে রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।’ ইরিনকে শেষ বারের মতো আপাদমস্তক একবার দেখে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে লাইন। তাদের উপেক্ষা করে হিয়ান আগে গিয়ে বই কালেক্ট করে।

বর্তমান..

নিলয়ের ডাকে হিয়ানের ঘুম ভা’ঙে। অতীতের কথা স্মরণ করে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে আলাপ পায়নি সে। সোজা হয়ে বসে চোখ ডলতে থাকে। অদ্ভুত ঘ’ট’না সহিত তাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল। বেশ স্মরণীয় সেই দিনটি ছিল।
‘লম্বা ঘুম দিয়েছিস। এবার নামতে হবে। আমরা এসে গেছি।’ নিলয় কথাটি বলে ওঠে দাঁড়ায়।
হিয়ান কিছুক্ষণ মৌন হয়ে বসে রয়। তারপর গাড়ি থেকে নামল। এখানে নিলয়ের বাড়িতে উঠেছে। হিয়ান এখন ঢাকা থাকে পরিবার নিয়ে। পড়া-লেখা কমপ্লিট করার পর একটি বেসরকারি কম্পানিতে জব হয়েছে। পরিবারের দায়িত্ব এখন তার। বাবা স্কুলের চাকরি ছেড়েছে বছর হয়ে এলো। ছেড়েছে বললে ভু’ল হবে। হিয়ানই তাকে আবসর নিতে বলেছে। পাঁচজন সদস্যের পরিবার। হিয়ান রা দু ভাই। সবার ছোট জবা। মেজ রিয়ান। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে৷ পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করায়। এতেই তার হাত খরচ চলে যায়। বাড়িতেও কিছু টাকা দেয় মাঝেমধ্যে। মোটামুটি তাদের পরিবার সুখী পরিবার হিসাবে গন্য।
বিয়ের উপলক্ষে চার দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে বরিশাল। জন্ম এবং বাল্যকাল বরিশাল কেঁটেছে। বছর খানিক আগেই পরিবার সহ ঢাকাতে শিফট হয়েছে। আপাতত ঢাকা তাদের শেষ গন্তব্য। বরিশাল আর একেবারে ফিরা হবেনা। হিয়ান নিজেও এটা চাই না। কালকে বৌ ভাতের পর ঢাকায় ব্যাক করবে। বিয়েতে আসার ইচ্ছে ছিল না তার। কারণ এখানে জড়িয়ে আছে প্রিয়তমার স্মৃতি! যা ক্ষণে ক্ষণে মনের পুরনো ব্যথা গুলো তাজা করে দিচ্ছে। বারংবার অজান্তেই মনে পড়ছে আগের স্মৃতি গুলো। যেগুলো এখন শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
__
সামিরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদের পানে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নাময় রাত তার খুব প্রিয়। বিদ্যুৎ ব্যতীত চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় চারপাশ স্নিগ্ধ দেখায়। এ অপরূপ দৃশ্য যে কারো মন কেঁড়ে নিতে সক্ষম। সরু নিশ্বাস সম্পূর্ণ করতেই ফোনের রিংটোন শোনা যায়। স্ক্রিনে মায়ের নামটি দেখে বিরক্ত হয়ে কেটে দেয়। পুনরায় কল আসলো৷ সামিরা এবার কল বি’চ্ছি’ন্ন না করে রিসিভ করল,
‘কী বলার জন্য কল দিয়েছো আম্মু?’
‘এভাবে কথা বলছিস কেন? এমনিতেই থাকিস আমাদের থেকে দূরে। কল দিয়ে একবারও আমাদের খোঁজ খবর নিস না। আমরা কল দিলে এমন বি’হে’ভ করিস যেন আমরা তোর পর কেউ।’ ক্রো’ধা’ন্বি’ত কণ্ঠে বললেন সায়রা বিবি।
‘পর তো কবেই হয়েছি। এখন শুধু পরের ঘরে যাওয়াটা বাকি আছে। বলে ফেলো কবে যাচ্ছি।’
‘শুক্রবার চলে এসো বাড়িতে। ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তোমাকে।’
মায়ের ওপর চ’র’ম বিরক্ত নিয়ে ফোন রেখে দেয় সামিরা।
সায়রা বিবি মেয়ের এরূপ আচরণে কষ্ট অনুভব করে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। মেয়ের সঙ্গে তাদের বনিবনা তেমন নেই।
একটা সময় ছিল। অতিরিক্ত শা’স’নে’র ফলে এক সন্তানকে হা’রি’য়ে’ছে। সামিরাকে হা’রা’তে চায় না। এজন্য সামিরার মনমর্জি মতন তারা চলতে দিয়েছে। কলেজ শেষ হবার পর সামিরা জে’দ ধ’রে’ছে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। তার এ আশা পূরণ করেছে। সামিরার বাড়িতে আসাযাওয়া নেই। বন্ধের দিনও বাড়িতে আসে না। ফোনে বাবা-মায়ের ভালো থাকার কথা জিজ্ঞেস করার সময় যেন তার হয়ে উঠে না। দিন দিন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা যতো ঘোচ’বার চেষ্টা করছে ব্য’র্থ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এ দূরত্ব যেন শেষ হবার নয়।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here