সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -২২+২৩

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২২

“তুমি আমার কলেজে কেন এসেছো রিফাত ভাই?”
নোভার প্রশ্ন শুনে রিফাতের ভ্রু যুগলের মাঝে খানিক ভাজ পড়ল।
“কোথাও লেখা আছে নাকি এটা তোর কলেজ?”
নোভা মাথা নাড়ালো।
রিফাত পুনরায় বলল,
“এখানে নোরা পড়ে। তার সাথেই মিট করতে এসেছিলাম। মাঝখান থেকে তোর ভাই আমাকে ফাঁসিয়ে দিল। তোর বডিগার্ড বানিয়ে দিয়ে সে পগারপার।”
নোভা চমকে উঠল। ‘নোরা!’ তবে কি তার অস্তিত্ব সত্যিই আছে পৃথিবীতে!
কষ্টটুকু গিলে ফেলল মূহুর্তেই। ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“বডিগার্ড কেন লাগবে আমার? আমি কি সেলিব্রিটি নাকি কোনো রাজ্যের রাণী? আমি একা একাই চলতে পারি।”
“আকাম করে বেড়াচ্ছিস তলে তলে। আর বাড়িতে এসে বিয়ে করার জন্য মাথা খাচ্ছিস। সেজন্যই তো আমার মূল্যবান সময় বলি দিতে হচ্ছে।”
নোভা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সত্যি আকাম করে বেড়াচ্ছে সে? এভাবে বলতে পারল লোকটা!

বড় বড় পা ফেলে ক্রমাগত গেইটের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল নোভা। রিফাতও দ্রুত পা চালালো।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নোভা রিকশায় চেপে বসল।
রিফাতের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“আমার আশেপাশেও যেন আমি আপনাকে আর না দেখি। আমি মরে গেলেও না। যদি আমি জীবিত অবস্থায় আপনাকে দেখি মনে রাখবেন সেদিনই হবে আমার শেষ দিন।”
রিফাত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হুঁশ এলো তখন, যখন রিকশা চলতে আরম্ভ করল।
দৌড়ে গিয়ে রিকশা থামিয়ে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“নেমে আয়।”
নোভা নামল না। এমনকি রিফাতের দিকে তাকাল অবধি না। রিফাত এবার কঠোর গলায় বলল,
“নেমে আয় বলছি। আমায় উগ্র হতে বাধ্য করিস না নোভা। ভালোয় ভালোয় নেমে আয়।”
নোভা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি নামব না। আপনার উগ্রতাকে আমি ভয় পাই না। মামা চলুন। এসব ভীতু লোকদের কথায় কান দিয়েন না। এরা ফাঁকা বুলি ঝাড়া ছাড়া আর কিছু পারে না। কিচ্ছুটি না।”
রিকশা আবার চলতে শুরু করল। রিফাত দু’হাত মুঠো করে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। সামলানোর ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই বিন্দুমাত্রও। পুনরায় দৌড় লাগালো সে। রিকশার হাতল চেপে থামিয়ে দিল।
লাফিয়ে রিকশায় চেপে বসে শক্ত হাতে নোভার কোমর আঁকড়ে ধরে বলল,
“এখন চলুন।”
নোভা বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে রইল।

বাসার কাছাকাছি মোড় ক্রস করার সময় রিফাত রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,
“মামা, বামে যান।”
নোভা বাইরের দিক থেকে নজর সরিয়ে রিফাতের দিকে তাকাল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি বাড়ি যাব।”
রিফাত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“কেন বাড়ি কেন যাবি? খুব তো ভালবাসতে শিখেছিস। আজ তোর শেখা ভালবাসার মাত্রা আমি গুনে গুনে হিসেব করব।”
নোভা জোর দিয়ে বলল,
“মামা রিকশা ঘুরান।”
রিফাত এবার কোমর আঁকড়ে রাখা হাতে জোর প্রয়োগ করল। হয়তো নখও বসে গেছে সেখানে। নোভা দাঁত কামড়ে যন্ত্রণাটুকু সহ্য করে নিল। টু শব্দটুকুও করল না। কিন্তু সময় পেরোতেই চোখের কার্নিশে জমা হলো খানিকটা নোনাজল। একসময় পাহাড়ি ঝর্ণার ন্যায় ধারা বেয়ে পড়তে শুরু করল।

দুই রুমের পরিপাটি একটা ফ্ল্যাট। ডাইনিং আর কিচেনের মাঝে সামান্য একটুখানি খোলা জায়গা। কিচেনটাও অসম্ভব সুন্দর করে গোছানো। ছেলেদের কিচেনও বুঝি এত গোছানো হয়! এত পরিপাটি হয়! বেডরুমের দেয়ালের সাথে ঝুলানো দুটো ভিন্ন রঙের গিটার। তারপাশেই দেয়াল জুড়ে একটা বুকশেলফ। তাতে দেশি বিদেশি লেখকের শ’খানেক বই। সিঙ্গেল সোফার উপর একটা বই উল্টে পড়ে আছে। আর বিছানার উপর একটা বই।
দ্বিতীয় তলার এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা একা রিফাত। বিশাল পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেবল চারজন মানুষ। শ্যাম, আবরার, ফাহিমা করিম আর নোভা। হ্যা নোভা! সেও তার একান্ত আপন। চেনা পৃথিবীর অচেনা মানুষগুলোর মধ্যে তারাই তো ওর চেনাজানা, আপনার। এখন সাথে যুক্ত হলো বোনের মত একজন। ইভানা।

নোভা কোণায় কোণায় নজর বুলিয়ে রিফাতের দিকে তাকাল। সে পকেটে হাত গুঁজে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। নোভা নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি দেখছো এভাবে?”
রিফাত অনূভুতিহীন গলায় বলল,
“তোর কোথায় কোথায় প্রেম বেড়েছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।”
নোভা কেশে উঠল। কলেজ ড্রেসের জামা টেনে ঠিকঠাক করে নিচের দিকে তাকাল।
রিফাত পুনরায় বলল,
“বল কোথায় কোথায় বেড়েছে প্রেম? সেখানটা ঝলসে দেব আমি।”
নোভা হাসল। এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আপাদমস্তক। দেবে ঝলসে?”
রিফাত পেছনে সরে দাঁড়াল। নোভা হেসে কিচেনের দিকে যেতে শুরু করলে রিফাত ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত মেলে বাঁধা দিয়ে বলল,
“কিচেনে প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
নোভা ভ্রুকুটি করে তাকাল।
রিফাত মাথার পেছনে চুলকে বলল,
“আমার কিচেনে আমার পরে কেবল আমার বউ-ই প্রবেশাধিকার পাবে।”
নোভার চোখ চিকচিক করে উঠল। পিছু হটে আগের জায়গায় ফিরে এসে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে চোখের জলটুকু আড়াল করে বলল,
“আমার ফিরতে হবে এখন।”
রিফাত কিছু বলার আগেই নজর পড়ল সাদা কামিজের কোমরের দিকটাতে। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে হকচকিয়ে গেল। আতঙ্কিত গলায় বলল,
“নোভা! কোমরে কি হয়েছে? রক্ত কেন বের হচ্ছে?”
নোভা ক্রস বেল টেনে ঢেকে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,
” ও কিছু না। এমনি ব্যথা পেয়েছি। আমি যাই, হ্যা?”
উল্টো ঘুরে দুপা ফেলতেই রিফাত হাত টেনে দাঁড় করিয়ে নিচু গলায় বলল,
“আমি করেছি এমন তাই না? তখন রিকশায়…”
নোভা মাথা নিচু করে রইল।

রিফাত আরও কিছুটা দুরত্ব ঘুচিয়ে দিল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ঠিক নোভার কোমর বরাবর। জামার উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্তবিন্দুর উপর স্পর্শ করে জামা সরানোর চেষ্টা করল। নোভা তৎক্ষনাৎ হাত আঁকড়ে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“কি করছো রিফাত ভাই!”
রিফাত কানে তুলল না একরত্তি মেয়েটার নিষেধাজ্ঞা। নিজের মর্জিমত পাতলা আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত করল মেদহীন ধবধবে ফর্সা কোমরের একাংশ। চোখ যেন ঝলসে গেল তার। ফর্সা চামড়ার উপর নখ দেবে গিয়ে লালচে ক্ষততে ভরে গেছে জায়গাটা। স্পষ্ট চার চারটে নখের আঁচড় নজর কাড়ল তার। কাঁপা কাঁপা হাতে আঘাতের জায়গাগুলো ছুঁয়ে দিতেই নোভা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। দু’হাত মুঠোবন্দি, চোখজোড়া বন্ধ ও শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
রিফাত বোধহয় আরও একটু বেসামাল হলো। হাতের সাথে সাথে এগিয়ে নিয়ে গেল মুখটাও। মাত্র কিছুক্ষণ আগে তার দেওয়া আঘাতেই একের পর এক স্পর্শ দিয়ে চলল কালচে পুরু ঠোঁটের। অল্প অল্প করে স্পর্শ করা অধরটাই এক সময় আক্রমণ চালালো পুরোদমে। স্পর্শে স্পর্শে মাতোয়ারা করতে শুরু করল অষ্টাদশী তরুণীর কোমল কলেবর।
মুঠোবন্দি করে রাখা একজোড়া হাতের দশটি আঙুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তারই আরাধ্যের কুচকুচে কালো চুলগুলো। চেপে ধরতে চাইল নিজের সাথে। অপরদিক থেকে পাওয়া স্পর্শ গুলো তীব্র থেকে আরও তীব্রতর ভাবে অনুভব করার প্রয়াস চালালো।
দু-হাতে কোমর আঁকড়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে রাখা রিফাতের হঠাৎই মনে পড়ল তার সীমানা সম্পর্কে। মনে পড়ল নিজের ভাই তুল্য বন্ধুর মুখটা। মায়ের মত এক মমতাময়ী নারীর কথা, এক নিষ্পাপ তরণীর স্নিগ্ধ মুখটা। যে এখন ঝোঁকের বসে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে। অথচ খানিক সময় বাদেই সে-ই নিজের সর্বস্ব খোয়ানোর অপরাধে অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হবে।
এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল রিফাত। নোভা ঘোর থেকে বেরিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে রিফাত মাথা নিচু করে বলল,
“এটা পাপ।”
নোভাও নত মস্তকে দাঁড়াল। বোধবুদ্ধি তো তারও লোপ পেয়েছিল।
“আই’ম সরি। আমার উচিৎ হয় নি এমন করা। আই রিয়েলি ভেরি সরি। আঘাত দেয়ার জন্য এবং অনধিকার সত্বেও স্পর্শ করার জন্য।”
নোভা চোখ তুলে তাকাল। ভেজা গলায় বলল,
“আমি তোমায় অধিকার দিতে চাই রিফাত ভাই। সারা জীবন আমাকে ছোঁয়ার অধিকার, ভালবাসার অধিকার।”

রাস্তার মোড়ে ফুচকার ভ্যান দেখে আবরার বাইক থামিয়ে দিল। ইভানা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল,
“কোনো সমস্যা?”
আবরার উত্তর না দিয়ে বলল,
“নামো।”
ইভানা বিনা প্রশ্নে নেমে এলো।
চাবি ঘুরিয়ে ভ্যানের কাছে গিয়ে বলল,
“মামা ফুচকা দিন তো।”
ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঝাল বেশি না কম?”
“মোটামুটি। তবে কম হলেই ভালো হয়।”
ফুচকাওয়ালা কে বলে ইভানার দিকে চেপে এসে নিচু গলায় বলল,
“এজন্যই বোধহয় তুমি এত মিষ্টি!”
ইভানা ভ্রুকুটি করে বলল,
“কি জন্য?”
“এই যে ঝাল খাওনা। সেজন্যই তো এত মিষ্টি।”
ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে তো আপনাকে মধুর হাড়িতে ভিজিয়ে রাখা উচিৎ।”
আবরার প্রশ্নাত্নক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ইভানা পুনরায় বলল,
“তাহলে যদি মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হয়।”
“আমি তেঁতো?”
ইভানা মাথা নাড়ালো।
“ঠিক তেঁতো নয়। স্বাদহীন। যাকে বলে পানসে।”
আবরার আরও একটু দুরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল,
“তুমি আমায় খেয়ে দেখেছো? কিন্তু কখন? আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে?”
ইভানা চোখ গরম করে তাকালে আবরার ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“আমি কি কাছে আসব?”
ইভানা ঠোঁট বেকিয়ে তাকাল। আবরার শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠতেই ইভানা অভিমানী গলায় বলল,
“আর কতদিন বলবেন?”
“যে পর্যন্ত মরে না যাই।”
ইভানা চমকাল। স্থির দৃষ্টিতে তাকাল আবরারের দিকে। ধীর গলায় বলল,
“তবে আমি আমার মৃত্যুর আগ মূহুর্তেও শুনতে চাই।”
আবরার মুচকি হাসল। এই তো সে দেখতে পাচ্ছে বসন্ত বিকেলে কুড়িয়ে পাওয়া এক ফোটা প্রেমের বসন্ত।

কথা অন্য দিকে ঘুরছে দেখে রিফাত দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
“চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
নোভা এক চুলও নড়ল না।
ভেজা গলায় বলল,
“আমায় এই সংসারের একচ্ছত্র অধিকারী বানিয়ে দাও না রিফাত ভাই। আমি সংসার করতে চাই। তোমার সংসার।”
রিফাত অনূভুতিহীন গলায় বলল,
“সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। আমি মরে গেলে আমার লাশের সাথে সংসার করিস। এখন বাড়ি চল।”
নোভা তবুও সরল না। আকুতি ভরা গলায় বলল,
“একটা দিনের জন্য দাও। একদিনের জন্য আমি এই সংসারের, এই রাজ্যের রানী হতে চাই।”
রিফাত কিছু বলল না। নোভা পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সামনে বসে বলল,
“ভিক্ষে হিসেবেই না-হয় দাও”

“তুই তো এত বেহায়া ছিলি না নোভা। তোর তো আত্নসম্মান প্রখর ছিল। বদলে গেলি কেন তুই?”
নোভা কষ্ট লুকিয়ে হেসে বলল,
“বেহায়া হয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায়, তবে আমি শত সহস্র বার বেহায়া হতে রাজি।”
রিফাত কিঞ্চিৎ সময় ভাবল। অতঃপর বলল,
“দিতে পারি একদিনের সংসার। তবে কথা দিতে হবে আমাকে ভুলে যাবি।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৩

পৌষের এক ম্যাড়ম্যাড়ে বিকেল। গোধূলির আকাশে তখনো লাল রঙের আবির্ভাব হয় নি। ডুবতে শুরু করে নি থালার মত সূর্যটা। নীড়ে ফিরতে শুরু করে নি পাখিরাও। কেবল কাজ শেষে সারাদিনের ক্লান্তি মেখে চিরচেনা আলয়ে ফিরছে শ্রমজীবী মানু্ষেরা। ফিরছে পরিবারের কাছে, আপনজনের কাছে।
ইভানার মনে সহসাই আষাঢ়ের মেঘ ভীড় করল। তীব্রভাবে গ্রাস করল সদ্য প্রেমে পড়তে চাওয়া মনটাকে। আর পাঁচটা সাধারণ স্ত্রীর মত সে পারবে না রোজ বিকেলে স্বামীর ঘর্মাক্ত মুখটা আঁচলে মুছে দিতে। পারবে না এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। পারবে না রোজ সন্ধ্যায় এক মূহুর্তের জন্য ওই রক্তলাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলতে-‘ইসস আমি যদি আকাশ হতাম, তবে রোজ লাল শাড়িতে নববধূ সাজতে পারতাম।’
সে তখন হেসে বলতো- ‘তুমি তো এমনিতেই নববধূ। রোজ নতুন করে প্রেমে পড়ি। নতুন করে ভালবাসি।’
ইভানার কান্না পেয়ে গেল। খুব কি বেশি চাওয়া ছিল তার?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ডুবতে শুরু করল প্রকান্ড, স্বাধীনচেতা সূর্যটা। পশ্চিম আকাশে ক্ষণে ক্ষণে জমতে শুরু করল একেক ফোঁটা রক্তবিন্দু। ক্রমেই তা পরিণত হলো রক্ত সাগরে। একসময় মিলিয়েও গেল। ইভানা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। দু’পায়ে অটল, অনড় মনোভাবে।
সন্ধ্যা নামার কিয়ৎকাল পর আবরার এসে পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। ইভানা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কিন্তু ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তন ঘটাল না। পুনরায় মনোনিবেশ করল বাইরে। ওই দূরের রাস্তায় মিটিমিটি জ্বলতে থাকা নিয়নের আলোয়।
আবরার গলা ঝেড়ে নরম গলায় শুধালো,
“মন খারাপ?”
ইভানা দৃষ্টি মেলল তার দিকে। স্থির দৃষ্টি। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মিলল না। প্রশ্নের উত্তরে সে ফিরিয়ে দিল আরও কঠিন এক প্রশ্ন।
“আমার চাহিদা কি খুব বেশি ছিল?”
আবরার বুঝতে পারল না। মনোযোগী ছাত্রের ন্যায় বুঝতে চেষ্টা করল। আওড়াল মনে মনে, বেশ কয়েকবার। তবুও বুঝতে না পেরে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না। কিসের কথা বলছো তুমি? আমি কি কোনো ভুল করে ফেলেছি? অথবা আমার পরিবার?”
ইভানা পুনরায় বাইরে নজর দিল। হাত উঁচিয়ে দূরের ল্যামপোস্ট দেখিয়ে বলল,
“ওই যে ল্যামপোস্ট দেখতে পাচ্ছেন? ওরা জানে আমার দুঃখ। আমার স্বপ্ন। আমার আশা, প্রত্যাশা। ওদের সাক্ষী রেখেই তো কত রাত স্বপ্ন বুনেছি। আপনি, আপনি এসে সব চুরমার করে দিলেন। ধূলিসাৎ করে দিলেন আমার চাওয়া পাওয়াগুলো। কিশোরী বয়স থেকে মনের গহীনে বয়ে বেড়ানো সবটুকু স্বপ্ন আপনি মিশিয়ে দিলেন মাটির সাথে। কেন আবরার? আমিই কেন?”
আবরার ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল। এতদিনেও মনে কোণে উঁকি না দেওয়া প্রশ্ন হঠাৎই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বিশালাকার বৃক্ষে পরিণত হওয়ার আগেই মলিন কণ্ঠে বলল,
“কাউকে ভালবাসো?”
ইভানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোঝাচ্ছে কি আর লোকটা বুঝছে কি! মনে মনে রাগ হলো ভীষণ।
শক্ত গলায় বলল,
“ভালবাসলেই কি? বিয়ে তো করে ফেলেছেন। এখন বললেই কি সব চুকেবুকে যাবে?”
“আমি তোমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন বলো নি কেন? তাহলে জল এতদূর গড়াতো না।” বাইরে তাকিয়ে বলল আবরার।
“তখন কি ভালবাসতাম নাকি। তখন তো বুঝিনি।”
আবরার চমকে উঠল। বিস্ময়ের সহিত বলল,
“বিয়ের পর ভালবেসেছো?”
ইভানা উত্তর দিল না। ভাবলেশহীন ভাবে পুনরায় শূন্যে দৃষ্টি মেলল। আবরার ধৈর্যহারা হয়ে হাত টেনে নিজের দিকে নিয়ে কড়া গলায় বলল,
“বলো বিয়ের পর ভালবেসেছো? তাহলে আমি নই কেন? আমি চোখের সামনে থাকতেও অন্য কাউকে কি করে ভালবাসতে পারো তুমি? আমি কি ভালবাসার ক্ষেত্রে এতটাই অযোগ্য?”
ইভানা তাকাল। তাকিয়েই রইল। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আবরার অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে তাকাবে না। অন্য কাউকে ভালবেসে আমার দিকে তাকাবে না তুমি। এভাবে তো নয়ই। এই দৃষ্টি আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ঝলসে দিচ্ছে আমার হৃদপিণ্ড।”
ইভানা হাসল। মলিন হাসি।
“আমি ভালবাসতে চাই না আবরার। যে ভালবাসা আমি চাইলেই এই দু’হাতে স্পর্শ করতে পারব না সেই ভালবাসা আমি চাই না। সেই মানুষটাকেও আমি চাই না, যাকে ঘুমের ঘোরে বিছানা হাতড়ে খুঁজে পাব না। আমি তাকেও চাই না, যে কেবল পরিপাটি হয়েই আমার সামনে আসবে। আমি তাকে চেয়েছি আজীবন, যে ক্লান্ত বিকেলে ঘর্মাক্ত শরীরে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়াবে। আমি এই আঁচলটা দিয়ে তার ঘাম মুছে দিয়ে দুচোখ ভরে দেখব সেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখটা। যার ঘামে ভেজা শার্টে আমি সুখ খুঁজে পাব তাকে চেয়েছি। আরাম, আয়েস, বিলাসিতা চাই নি আমি। আমি ভালবাসা চেয়েছি। আরাম, আয়েসের জীবন তো বাবার ঘরেও পেয়েছি আমি। তবে বিয়ের কি প্রয়োজন ছিল? এই জীবনটা আমি চাই নি আবরার। একদম চাই নি। আমি দুর্বল হতে চাই নি আপনার প্রতি। কেন নিয়তি আমায় বিরহের অনলে দগ্ধ করতে চাইছে? কেন আবরার? আমাকেই পেলেন এই জগতে?”

আবরার দুরুদুরু বুকে শুনল প্রত্যেকটি কথা। হাত বাড়িয়ে ইভানার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ছোট্ট একটা মেয়ে। সাদা নীল রঙের স্কুল ড্রেস, পিঠে গোলাপি রঙের একটা ব্যাগ, গোলাপি রঙের একটা সাইকেল, আর মাথার দুইপাশে দুটো ঝুঁটি। ব্যস, আবরার ফাইয়াজ ইস ফিনিসড। উপায় ছিল না যে আর।”
ইভানা চট করে তাকাল। মনে করতে লাগল পেছনে ফেলে আসা কিছু স্মৃতি। সেই ড্রেস, সেই সাইকেল, সেই দিনগুলো। খনিকের জন্য অতীতটা শান্তি দিলেও মাত্র একদিন পরের কথা মনে পড়তেই পুনরায় আষাঢ়ের দেখা দিল মনের আকাশে।

“ওফ! চলে যাব তো একদিন পরেই। তুমি এরকম গোমড়ামুখো হয়ে বসে থাকলে আমার ভালো লাগবে?”
আবরারের কথা শুনেও ইভানা ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইল।
আবরার কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ইভানার পাশে এসে বসল। সোফায় পা তুলে বসে থাকা ইভানা এবার নড়েচড়ে বসল । আবরার একটু চেপে গা ঘেঁষে বসল। ইভানা সরু চোখে তাকিয়ে সরে গেল। আবরারও ঠিক ততটাই এগিয়ে এলো। ইভানা ঠিক এভাবেই সরতে সরতে একদম কিনারায় এসে আঁটকে গেল।
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“এবার?”
ইভানা চলে যেতে উদ্যত হলো। উঠে দাঁড়াতেই আবরার হাত টেনে বসিয়ে দিল। ঘটনাক্রমে সোফার পরিবর্তে জায়গা পেল আবরারের উরুর উপর। তাল সামলাতে কাঁধের জায়গাটা খামচে ধরে ফেলল। আবরার মৃদু হেসে বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে বলল,
“সরতে সরতে একদম কোলে এসে বসলে?”
ইভানা চোখ মেলে তাকাল। মুগ্ধ চোখে কাছ থেকে প্রিয় মুখশ্রী দেখে পুনরায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। চোখ নামিয়ে বলল,
“ছাড়ুন। আমি মায়ের কাছে যাব।”
আবরার ছাড়ল না। শাড়ির নিচে হাত গলিয়ে কোমর স্পর্শ করে বলল,
“প্রেমে পড়ছো?”
ইভানা কেঁপে ওঠে মাথা নাড়াল।
কম্পিত কণ্ঠেই বলল,
“বোধহয় ভালবাসছি। একটু একটু করে।”
আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসল।
“একটু একটুতে হবে না। আমার ভালবাসার সাগর চাই। মহাসাগর। আটবছর ধরে জমাচ্ছি যে। হিসেব বরাবর করতে হবে তো।”

ঘড়ির কাঁটা সকাল নয়টার ঘরে। মিনিট দশেক বোধহয় বেশি বাজে নয়টার। ছুটির সকালে রিফাত দেরিতে ঘুম থেকে উঠতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। স্বভাবসুলভ ভাবেই সবে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সে। বিছানা থেকে নামার আগেই কলিংবেলের বিরক্তিকর শব্দটা কানে এসে ধাক্কা মারল। হেলতে দুলতে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখের ঘুম পগারপার। ঠিক যেন কর্পূরের মতো উবে গেল।

লাল টুকটুকে শাড়ি পরে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে দাঁড়িয়ে আছে নোভা। ঘোমটা দিতেও ভুল করে নি সে। রিফাত ভড়কে গিয়ে বলল,
“তুই? এই সময়? এভাবে?”
নোভা মুচকি হেসে বলল,
“প্রশ্নই করবে শুধু? ভেতরে আসতে বলবে না?”
রিফাত সরল না। জায়গাও দিল না নোভা কে ভেতরে যাওয়ার। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখানে কেন এসেছিস? তাও আবার বউ সেজে!”
নোভা ঠোঁট বেকিয়ে হাসল। হাস্যজ্বল মুখেই বলল,
“কাল সংসার চেয়েছিলাম তো। একদিনের সংসার।”
রিফাত শক্ত গলায় বলল,
“হবে না। চলে যা। এক্ষুণি।”
নোভা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“কেমন মানুষ তুমি? এভাবে চলে যেতে বলে কেউ? সত্যি সত্যি বউ এসে এভাবে সারপ্রাইজ দিলে তাকেও চলে যেতে বলতে এভাবে?”
“তাকে মাথায় করে রাখতাম।”
নোভা মলিন কণ্ঠে বলল,
“মাথায় তো থাকতে চাইছি না রিফাত ভাই। পায়ের কাছটায় ঠাঁই দাও।”
রিফাত হনহন করে চলে গেল ভেতরে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দরজায় হেলান দিয়ে। কি করে বোঝাবে মেয়েটাকে, এসব ঠিক হচ্ছে না। কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। একটা ভুলে নিজের আপনজনের সাথে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারবে না সে।

রান্নাঘরে অন্যমনস্ক হয়ে কাটাকুটি করছে নোভা। রিফাত সে-ই যে দরজা লাগিয়েছে ঘন্টাখানেক কেটে গেলেও খুলে নি। নোভা ডেকে হয়রান হয়ে কিচেনে এসে ঢুকেছে। ফ্রিজ খুঁজে সবজি বের করে কাটতে শুরু করেছে। মনে মনে ভাবছে -সংসার বুঝি এমনই হয়। মান অভিমানে ভরা। আচ্ছা এখানে ভালবাসাটা কোথায়!
হঠাৎই নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা মাথাচাড়া দিল মনের কোণে। নোভা তীর্যক হেসে আঙুলে কাঁচি চালিয়ে দিল। ব্যথার চাইতেও শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠল। পর মূহুর্তেই খুট করে শব্দ করে খুলে গেল বন্ধ দরজাটা। নোভা মুখ লুকিয়ে হাসল। যদিও হাতের যন্ত্রণায় চোখে জল জমতে শুরু করেছে।
হন্তদন্ত হয়ে নোভার দিকে ছুটে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে পিচ্চি? ঠিক আছিস?”
নোভা আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল,
“কেটে গেছে একটুখানি।”
রিফাত চোখ পাকিয়ে তাকাল। আঙুল ছুঁয়ে দেখে বলল,
“পাকনামি করতে কে বলেছে? আমি বলেছি রান্না করতে?”
নোভা মুচকি হাসল। মাথা নিচু করে বলল,
“রান্না করা বউদের দায়িত্ব।”
রিফাত টাসকি খেতে খেতেও খেল না।
চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“বউ হওয়ার খুব সখ?”
নোভা অমায়িক হেসে বলল,
“তোমার বউ হওয়ার।”
রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গিয়ে ঔষধ লাগাতে লাগাতে বলল,
“পাগলামি তোকে মানায় না নোভা। তুই তো বুঝিস বল। এটা কি ঠিক হচ্ছে? আন্টি আবরার জানলে আমায় ভুল বুঝবে। বাড়ি চলে যা।”
নোভা খানিক ভেবে বলল,
“যাব। তবে ভালবাসি বলতে হবে।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“ব্ল্যাকমেল করছিস?”
নোভা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। মুখে বলল,
“শুধু চাওয়াটা জানাচ্ছি। তুমি থাক। আমি রান্না সেরে নেই।”
“এক পা নড়ে দেখা। চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব।”
নোভা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“একদিন তো ভালোও বাসতে পারো।”
রিফাত দরজা দেখিয়ে বলল,
“ওই যে দরজা। আর ওই যে রান্নাঘর।”
নোভা হেসে বলল,
“তুমিও এসো। আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে থাকবে। সিনেমার মতন।”
রিফাত চোখ পাকিয়ে তাকাল।
“এভাবে করলে কিন্তু আমি আমার কথা রাখব না রিফাত ভাই। ভুলে যাব না তোমাকে। তুমি আমার সংসার আমায় পুরোপুরি উপভোগ করতে দিচ্ছো না। তুমি যেমন একটু একটু দিচ্ছো। সেরকম আমিও একটু একটু ভুলে যাব। সকালে ভুলে গেলে বিকেলে এসে হাজির হব ভালবাসার পশরা সাজিয়ে। বিকেলে ভুলে গেলে মাঝরাতে চলে আসব ভালবাসার স্বপ্ন নিয়ে। ঘুমিয়ে ভুলে গেলে জাগরণে চলে আসব। এখন ভাবো কি করবে?”

চলবে…

গঠনমূলক মন্তব্য করুন। ভালো খারাপ যাই হোক। অনেক দিন পর গত দুই পর্বের মন্তব্য পড়ে ভালো লেগেছে। নাইস, নেক্সট আর স্টিকার থেকে কিছু পাঠক বেরিয়ে এসেছে। এরকম হলে ভালো লাগে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here