সেদিন বসন্ত ছিল ২ পর্ব – ৪+৫+৬

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৪

কথার মারপ্যাচে আবরারের নাম প্রকাশ্যে আসতেই মৃত্তিকা চমকে উঠল। বিস্ময়ের সহিত ইভানা কে দেখে চমকপ্রদ কণ্ঠে বলল,
“আপনি আবরারের স্যারের ওয়াইফ! আমি তো ভাবতেই পারছি না। আপনিই সেই ভাগ্যবতী! ও মাই গড! ম্যাম আপনি জানেন না আপনি কাকে পেয়েছিলেন। আই কান্ট বিলিভ, আমি আপনাকে সামনে থেকে দেখছি!”

ইভানা হকচকিয়ে গেল অকস্মাৎ এরূপ আচরণে। অপ্রস্তুত হেসে বলল,
“রিল্যাক্স মৃত্তিকা। আসতে আসতে বলো। এক কাজ করি, আমরা বরং বাসায় গিয়ে কথা বলব এসব নিয়ে, কেমন? এখন তোমার ব্যাপারটা নিয়ে এগুতে হবে।”

মৃত্তিকা মেনে নিল। পরের জন্য তুলে রাখলেও মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করল।

মায়ের জোড়াজুড়ি আর ভাইয়ের কড়া চোখের চাহনিতে এহসান বাধ্য হলো মৃত্তিকার সন্তানের দায়িত্ব নিতে। মৃত্তিকার দায়িত্ব সে কোন কালেই নিতে রাজি নয়। নেহাতই গ্যারাকলে ফেঁসেছে।
মৃত্তিকাও নাখোশ এহসানের মত নারী লোভী পুরুষের সাথে সারাজীবন থাকতে। কিন্তু ওই, একজন মা; সর্বপরী একজন আটপৌরে বাঙালী নারী সে।এতেই কাত হলো কবুল বলতে রাজি হতে। সন্তানের একটা পরিচয় চাই তো!

এগারো তলা ভবনের চতুর্থ তলার একটি সুসজ্জিত বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইভানা দৃষ্টি মেলে রেখেছে অন্তরীক্ষের পানে । মৃদুমন্দ সমীরণে হালকা নড়েচড়ে উঠছে বাঁধনমুক্ত কেশপল্লব। আর্নোর জলের ধারালো ঘ্রাণ যেন তার নাসিকা বেদ করে ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। নিলীমার দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় বলল -আচ্ছা, জলেরও ঘ্রাণ হয়! শব্দগুলো হারিয়ে যায়। প্রতিত্তোর আসে না।

চোখের পর্দায় ভাসতে থাকে আহনাফ ও এহসানের মা শেলী সরকারের কিছু কথা। ভদ্রমহিলার আবরারের নাম শুনতেই চমকে ওঠার কথা। ইভানাকে কাছে টেনে নেওয়ার কথা এবং তার ভাগ্য নিয়ে হাপিত্যেশ করার কথা।
মনের কোণে দানা বাঁধে কিছু প্রশ্ন, কিছু অজানা সমীরণ মেলানোর তাগিদ। কেন চমকাল শেলী সরকার? কেন আবরারের নাম শুনতেই কাছে টেনে নিল তাকে? কেনই’বা তার ভাগ্য নিয়ে এত হাপিত্যেশ তার? কই তার নিজের তো নেই!

ধ্যানমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এলো মৃত্তিকার ডাক শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাল। ছয়টা বেজে গেছে! কিভাবে এতোটা সময় পার হলো টেরই পেল না সে। এহসানের বাড়ি থেকে এসেছে তিনটার পরপরই। স্মৃতিচারণ করতেই বুঝি বেলা ফুরালো।

ইভানা কে টেনে বিছানায় বসিয়ে মৃত্তিকা আয়েস করে বসল। ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে মৃত্তিকা উচ্ছ্বসিত কিশোরীর ন্যায় বলল,
“ম্যাম, আপনি জানেন না আমি আপনাকে দেখে ঠিক কতটা খুশি। আপনি জানেন আমি আপনাকে দেখার জন্য রীতিমতো প্রার্থনা করতাম। একবার.. শুধু একবার দেখার জন্য।”
ইভানা ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকাল। এত আহামরি কিছু তো সে নয়! তবে এত উন্মাদনা কিসের? বোধগম্য হয় না তার।
কথার পৃষ্ঠে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করল সে।
“কেন? আমাকে দেখার জন্য কিসের এত উন্মাদনা তোমার? আমাকে চিনলেই বা কিভাবে?”

মৃত্তিকা অমায়িক হাসল। চেহারায় ভেসে উঠল সুখময় দীপ্তি। ফুরফুরে গলায় বলল,
“স্যার বলেছে..আবরার স্যার।”

ইভানা সচকিত ভঙ্গিতে তাকাল। উৎসুক দৃষ্টিতে মৃত্তিকা কে ঝাঁঝরা করে বলল,
“কি বলেছে? সবাই কে সে আমার কথা বলে বেড়াতো নাকি?”

মৃত্তিকা মাথা নিচু করে ফেলল। ইভানা সন্দিহান চোখে পরখ করল। পরক্ষণেই সাহস যোগাতে কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে মাটি? আমাকে বলো।”

মৃত্তিকা নিচু গলায় বলল,
“একচুয়ালি ম্যাম আমি স্যারকে খুবই পছন্দ করতাম। বলতে পারেন এক তরফা ভালবাসা। স্যার আমাকে সুযোগ দেন নি কখনো। আমিও দূর থেকেই দেখতাম তাকে। এমন একজন মানুষ কে ভাল না বেসে থাকা যায় বলুন! হয়তো স্যার বুঝতে পারতেন আমার চাহনি। সেজন্যই একদিন ডেকে নিয়ে গেলেন কফিশপে। আর্নোর তীরে একটা কফিশপ আছে, আপনি দেখেছেন হয়তো। যেখানে আমি প্রথম আপনাকে পেলাম। স্যার জানালেন তার প্রেয়সীর কথা। চুপিচুপি ভালবাসার কথা। এক পিচ্চির কথা। যাকে তিনি গত সাত বছর ধরে ভালবেসে গেছেন। এক তরফা ভালবাসা। জানেন, সেদিনের পর আমি আর ভালবাসার দৃষ্টি দেই নি মানুষটার ওপর। তাকিয়েছি সম্মানের দৃষ্টিতে। অনিশ্চিতে থেকেও কতটা ভালবেসে গেছেন একা একা, নীরবে। একসময় আমার আইডল হয়ে গেলেন তিনি। আপনাদের বিয়ের পর স্যার আমাকে আরও একবার ওই কফিশপে নিয়ে যান। সেদিন তার কণ্ঠে সুখ ঝরেঝরে পড়ছিল জানেন! মানুষটা যেন ভালবাসার জন্যই জন্মেছিলেন। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি, কেন এত ভালবাসলেন। আপনি যে ভালবাসার মতোই একজন মানুষ। আপনাকে ভাল না বেসেও থাকা যায় না। মেইড ফর ইচ আদার বলে একটা ব্যাপার আছে, সেটা বোধহয় কেবল এবং কেবলমাত্র আপনাদের জন্যই সৃষ্টি। ”

ইভানার অক্ষিকোটরে জমা হয় বিন্দু বিন্দু নোনাজল। একসময় তা গড়িয়ে পড়ে কার্নিশ বেয়ে। স্মৃতিতে ভেসে উঠে ছোট ছোট অসংখ্য মধুময় মূহুর্ত। শ্বাসকষ্টের রোগীর মত শ্বাস নিতে না পেরে কেঁপে কেঁপে উঠল। হা করে অক্সিজেন টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। ছটফট করতে লাগল অনবরত।

মৃত্তিকা দিশাহীন বোধ করল। ছুটে গিয়ে পানি এনে বলল,
“ম্যাম; ম্যাম…পানি। নিজেকে সামলান।”

ইভানা পানির গ্লাস হাতে নিল। এক ঢোক গিলেও ফেলল। স্বাদহীন তরল গলা ভেজালেও হৃদয় ভেজাতে ব্যর্থ। নির্বিকার দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকালে মৃত্তিকা অপরাধী মুখে বলল,
“আই’ম সরি ম্যাম।”

ইভানা মলিন হাসল। নিয়তির ওপর আজ বড্ড অভিমান হলো তার। কি হতো, যদি আর কিছুটা সময় একসাথে থাকার সৌভাগ্য হতো। খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো!

“তুমি আবরারের সব কথা জানতে মৃত্তিকা?”
ইভানার এহেন ধারাল প্রশ্নে মৃত্তিকা কেঁপে উঠল। কি বলতে চাইছে সে!
ইভানা স্বাভাবিক ভাবেই পুনরায় বলল,
“আমি নর্মালি জানতে চাইছি মাটি। তুমি ওর কাজ সম্পর্কে জানতে? ও কোথায় যেতো বা কার সাথে মিশতো?”
মৃত্তিকা অপ্রস্তুত হেসে বলল,
“স্যারের সবটাই আমার নখদর্পণে ছিল একসময়। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তবুও কিছুটা তো জানিই। সরি ম্যাম।”

ইভানা যেন হাতে চাঁদ পেল। নড়েচড়ে বসে বলল,
“তোমার কি মনে হয় তোমার স্যার সুইসাইড করতে পারে?”

মৃত্তিকা এবার সরাসরি তাকাল ইভানার চোখের দিকে। কি করতে চাইছে সে! বোধগম্য হলো না তার। ঐ চোখ তো ভারত মহাসাগরের চাইতেও গভীর। ঐ চোখে লুকানো প্রশ্নোত্তর তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
ইভানা পুনরায় বলল,
“বলো না মাটি। তোমার মনে হয় আবরার আত্মহত্যার মত জঘন্য একটা কাজ করতে পারে? পারে আমাকে এভাবে ভাসিয়ে চলে যেতে?”

মৃত্তিকা যেন সাহস পেল। ধীর গলায় বলল,
“অসম্ভব। স্যার এটা করতে পারে না। ওমন হাসিখুশি এবং ভাল বাসতে জানা একটা মানুষ এভাবে মরে যেতে পারে না।”

ইভানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এটা সেও জানে। তার আবরার এই কাজ করতে পারে না। কখনোই না।

ইভানা কে অবাক করে দিয়ে মৃত্তিকা নিচু গলায় বলল,
“আবরার স্যারের সুইসাইডের ঘটনার দিনের আগের দিন আমি স্যার কে দুপুরের পর পর ল্যাবে যেতে দেখি। পেট্টিসিয়ার সাথে হাসতে হাসতে ল্যাবে ঢুকছিলেন। কিন্তু তারপর আর বের হতে দেখি নি এবং পরদিন ক্লাসেও এলেন না। সন্ধ্যায় জানতে পারলাম তার এক্সিডেন্টের কথা। এই হাসিখুশি লোকটা কি করে এই কাজটা করতে পারে ম্যাম?”

ইভানা নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল কিছু সময়। বুকটা ধড়ফড় করছে তার। শ্বাসরোধ হয়ে আসে পুনরায়। শক্ত খোলস ক্রমশ নরম হয়ে আসতে থাকে। পর মূহুর্তেই মনে পড়ে প্রিয়তমের বিদায় বেলার সেই থেঁতলে যাওয়া মুখ। কত কষ্ট বিজরিত সেই মূহুর্ত। নরম আবরণ তৎক্ষণাৎ হিংস্রতায় ছেয়ে যায়। মস্তিষ্কে বিচরণ করতে থাকে দু’টো নাম। ইমরান; পেট্রিসিয়া!

দ্রুতবেগে রুম ত্যাগ করে ফোন লাগায় বাংলাদেশে অপেক্ষারত এক যুবকের ফোনে।
থমথমে গলায় বলে,
“আপনার আসার সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে ইমরান!”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৫

বছর তিনেক পূর্বের ধুলোপড়া ফাইল উল্টেপাল্টে জহুরি দৃষ্টিতে অবলোকন করছে ইমরান। মলিন, ম্যাড়মেড়ে পৃষ্ঠায় খুঁজে চলেছে চমৎকৃত কোনো যোজনা। কিন্তু নাহ; নজরে এলো না এমনতর কোনো চিহ্ন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাইল রেখে সম্মুখে দৃষ্টি মেলল সে।

মোটা, লম্বা মতন একজন লোক। বয়সে তার দ্বিগুণের কাছাকাছিই হবে। চোখেমুখে পাষবিক হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ এই লোকটা নাকি মানুষের ন্যায়ের ঝান্ডাধারী। পেশায় আইনরক্ষক সে।

ইমরানের সরু দৃষ্টি দেখে লোকটা নড়েচড়ে বসল। ফর্সা কপালের মাঝ বরাবর দু-তিনটে লম্বাটে ভাজ পড়ল। ইমরান পাত্তা দিল না সেসবে। নিজের বাম গালে সগৌরবে লেপ্টে থাকা জন্ম দাগে আলতো হাতে চুলকে মনস্থির করল হাতের ফাইলে।
মনে মনে ভাবল- কিছু তো একটা আছে যা ঠিক নেই। কিন্তু এখানে তো সবই ঠিকঠাক। তাহলে ঘাপলাটা ঠিক কোন জায়গায়?”

উপরমহলের স্পেশাল অনুমোদনে তিন মাসের জন্য ইতালিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে ইমরান। গত পরশুই পা দিয়েছে সে এই ভিনদেশের মাটিতে। আজই প্রথম বার পুলিশ স্টেশনে। তিন বছর আগের করা সাধারণ ডায়েরি (জি ডি) পর্যবেক্ষণ করে খুঁজতে চেষ্টা করে কোনো একটা ফাঁকফোকর। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ফাঁকফোকরের কোনো জায়গাই রাখে নি। সব কেমন স্বচ্ছ, স্পষ্ট!

গভীর রাত। ঘড়ির কাটা যখন দুটোর ঘরে, সেই সময়টায় আরাবী অস্ফুটে গুঙিয়ে ওঠে। একবার ; দু’বার ;তিনবার হতেই নোভা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। গালে কপালে হাত ছোঁয়াতেই টের পেল মারাত্মক জ্বরের আভাস। বিকেল থেকে হালকা গরম হওয়া শরীরটা এখন পুড়ে যাচ্ছে উষ্ণতায়। দিশাহীন বোধ করে একুশ বছর বয়সী পরিপক্ব মনের মেয়েটি। এক ছুটে গিয়ে কাপড় আর কুসুম গরম পানি এনে পট্টি দিতে শুরু করে ছোট্ট কপালটাতে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট ছোট হাত পাগুলোতে ছুঁয়ে দেয়। জ্বরের তীব্রতা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আচমকা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠে সে। দলা পাকানো কান্নারা হৃদয় উগলে বেরিয়ে আসে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে রিফাতের নাম্বার ডায়াল করল।
ঘুমন্ত রিফাত সহসা প্রেয়সীর ফোন পেয়ে হকচকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে ফোন কানে তুলে বলল,
“নোভা; কি হয়েছে? সব ঠিক আছে?”
প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যে এসে কান্নারা যেন বাঁধন হারা হয়ে গেল নোভার। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
রিফাত নরম গলায় বলল,
“আমি আসব পিচ্চি? কি হয়েছে আমাকে বলো?”
নোভা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
“আরাবী; আরবীর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে রিফাত। কমছে না কিছুতেই। তুমি এসো এক্ষুণি। কি করব এখন আমি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ও কেমন যেন করছে রিফাত। তুমি এসো,এসো।”

রিফাত তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। উসকোখুসকো অবস্থায় এলোমেলো পায়ে দৌড়ে ছুটে আসে আত্নার টানে। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেও যায় গন্তব্যে।
নোভা রিফাত কে দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে কেঁদে ফেলল। রিফাত ছোট্ট আরাবীর অবস্থা দেখে সাথে সাথে ডাক্তার কে জানায়। পরামর্শনুযায়ী ওষুধ দিতেই ঘন্টাখানেকের ভেতর হালকা ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়। প্রাণ ফিরে পায় নোভা। রিফাতের কঠিন মনটাও শান্ত হয়।

পরদিন ফাহিমা করিম সবটা জানতেই নোভার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকান। নোভা নেংটী ইঁদুরের মত গুটিগুটি পায়ে রিফাতের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। রিফাত মুচকি হেসে বলল,
“মা; তুমি ঘুমোচ্ছিলে তাই ডাকি নি। ঘুম কম হলে তো তুমি-ই অসুস্থ হয়ে যাবে। তখন কাকে রেখে কাকে সামলাব আমি? আমার এই মাকে নাকি আমার ছোট্ট মা’টাকে। সেজন্যই ডাকি নি। ভুল হয়ে গেলে এই যে কান ধরছি; মাফ করে দাও অনুগ্রহপূর্ক। নইলে বলো ওঠবসও করতে রাজি। করব?”

ফাহিমা করিম মৃদু হাসেন। এরা ছিল বলেই তো বেঁচে আছে। রাগ কি করে করবে! এগিয়ে এসে রিফাতের উসকোখুসকো চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। রিফাত তাকিয়ে রয় অনিমেষ।

সপ্তাহ খানেক আগে পাকিস্তান থেকে একজন গবেষণাবিদ যোগ দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরেন্স এর গবেষণাগারে। নাম ইরেশ। লম্বাচওড়া ইরেশের ভাষ্যে সর্বদা রয়েছে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত। সহজ কথাও সহজভাবে বলতে পারে না যেন। অশ্লীলতার ছাপ সর্বত্র। ইভানা ভেবে পায় না এহেন একটা লোক কি করে এখানে কাজের সুযোগ পেল। পরক্ষণেই ভাবে, প্রতিভা! তার মেধা, তার অধ্যবসায়ই হয়তো তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
তবে ভাবনার বিষয় আরও জটিল হয় যখন দেখে ইরেশের সকলের সঙ্গে আগে থেকেই ভীষণ ভাব।
তারা কি আগে থেকে পরিচিত? নাকি অন্য কিছু?

পেট্রিসিয়ার কাছে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেও কোনো সুরাহা করতে পারে নি সে। মেয়েটা যেন মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। একটা ইনফরমেশনও এদিক ওদিক না করার পণ নিয়েছে। এই একটা মেয়ে যদি মুখ খুলতো তবে সেই কবেই জানতে পারতো সেদিন আবরার ল্যাবে আসার পর ঠিক কি হয়েছিল? আবরার কি চলে গিয়েছিল ল্যাব থেকে? নাকি রয়ে গিয়েছিল কোথাও? নাকি অন্য কিছু?

মাস খানেক মৃত্তিকার কাছে পেট্রিসিয়ার ব্যাপারে জানার পর থেকে কম চেষ্টা করে নি সে তার মুখ খুলার। সব চেষ্টা বিফলে দিয়ে সে নির্বিকার। নির্বিঘ্নে নিজের মৌনব্রত পালন করেই চলেছে ।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে ইমরান যোগ দিয়েছে গবেষণাগারে। জুনিয়র গবেষণাবিদ হিসেবে। জনা দশেক মানুষের মাঝে নতুন মুখ সে। গবেষণার গ না জানা ইমরান গবেষণার পেছনে দিনরাত ব্যয় করার অঙ্গিকার করেছে। ইমরানের আসল উদ্দেশ্য এবং পরিচয় জানে কেবল জনা কয়েক লোক। তারা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাকিদের কাছে সে কেবলই একজন বাঙালী তরুণ গবেষক।

একজন দায়িত্বরত মেধাবী গবেষক হারিয়ে ইউনিভার্সিটি, ইতালি তথা গোটা বিশ্বের যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের সম্পদ বিনষ্ট করার পেছনের মুখগুলোকে নিশ্চয়ই সামনে আনা সম্ভব। এই দায়বদ্ধতা থেকেই ইমরান নামক ছেলেটি একের পর এক বাঁধা টপকে নিজের লক্ষ্যের দিকের এক একটা সিঁড়ি অতিক্রম করছে। এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের খুব কাছে। কিন্তু এরপর? কি আছে ভবিতব্যে! স্থিরকৃত লক্ষ্যে পারবে পৌঁছাতে ? নাকি নতুন কিছু হারাবার সবে শুরু!

করিডোরে দাঁড়িয়ে বহুদূরে বয়ে যাওয়া আর্নোর জলে দৃষ্টি মেলে রেখেছে মৃত্তিকা। শেষ বিকেলের এই প্রহরে শরীরটা অবশ হয়ে আসছে তার। মনটাও ভীষণ অবসন্ন। ইভানা মৃত্তিকার মলিন চেহারা দেখে চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শত আঘাত সয়ে মুখে হাসি মৃদু হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। মিহি গলায় শুধায়,
“মন খারাপ বাচ্চাটার?”
মৃত্তিকা মাথা নিচু করে চোখের কোণের জলটুকু মুছে নেয়। ইভানা তা দেখে ধীর গলায় বলল,
“নিজের ভালো থাকার ভার নিজের হাতেই রাখতে হয়।এই গুরুদায়িত্বটা যখনই অন্যের হাতে দেবে, ঠিক সেই লগ্নেই শুরু হবে তোমার খারাপ থাকা সূচনা।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৬

ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে ইভানা যেন উত্তাল সমুদ্রের তরঙ্গের মাত্রা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে এক পশলা কথার বৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বলল সেদিনের কথা। যেদিন মৃত্তিকা কে নিয়ে প্রথমবার ঢু মেরেছিল আহনাফ সরকারের আলয়ে।
ইমরান মনোযোগী ছাত্র। প্রতিটি সুক্ষ্ম বর্ণও শ্রবণ করছে প্রবল মনোযোগের সাথে। যদি একটা দিশা পাওয়া যায়। ঠিক যেমনটা বলা হয়- ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’

সেদিন-
বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে এহসান বিক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“আপনি কে হন এমন, যে এখানে এসে নাক গলাচ্ছেন আমাদের ব্যাপারে? কথায় তো মনে হচ্ছে ভদ্র মহিলা। অন্যের ব্যাপারে এত কৌতুহল কিসের? থাকুন না আপনার মত। আপনার পেটে তো আর বাচ্চা আসে নি। আপনার গায়ে লাগছে কেন?”

ইভানা ধারালো দৃষ্টি ফেলল এহসানের উপর। কড়া গলায় কিছু বলার আগেই আহনাফ এহসান কে থামিয়ে দিল। উচ্চস্বরে বলল,
“এহসান! মুখ সামলে। আমার কলিগ মিস ইভানা আফরোজ। তার সাথে তুমি এমন ব্যবহার করার অধিকার রাখো না।”

ইভানার তপ্ত মেজাজ আরও তেতে উঠল। আহসানের মুখে মিস শুনতে শুনতে বিরক্ত সে। কঠিন অথচ শান্ত, স্থির গলায় বলল,
“মিস নয় মিস্টার সরকার ; মিসেস ইভানা আফরোজ। সিনিয়র সাইনটিস্ট আবরার ফাইয়াজের স্ত্রী। এই ভুল পরেরবার আর বরদাস্ত করব না আমি। মাইন্ড ইট। আর মিসেস সরকার আপনি…”

বাকিটা বলার আগেই শেলী সরকার কম্পিত হস্তে ইভানার চিবুক স্পর্শ করল। ইভানা চমকে উঠল। সহসা এহেন আচরণ তাকে চমকাতে বাধ্য করল। কৌতুহলী চোখে তাকাল শেলী সরকারের মুখাবয়বের পানে। তিনি অপলক চেয়ে থেকে ভেজা গলায় বললেন,
“তুমি আবরারের স্ত্রী? ইভানা?”

ইভানা মাথা নাড়ালো। শেলী সরকার ইভানার কপালে আদুরে চুম্বন ছুঁয়ে চেয়ে রইল আরও কিছু সময়। কিয়ৎক্ষণ পর আফসোসের সুরে বললেন,
“আবরার টা তোমারে এই অবস্থায় রেখে অকালেই চলে গেল। কি এমন হয়েছিল, যে তার একবার তোমার এই মিষ্টি মুখটার কথা মনে পড়ে নি। এই মিষ্টি মুখটার কথা মনে পড়লে কি মরা যায় এভাবে? এই অসময়ে স্বামী হারিয়ে অভাগীর মত বেঁচে আছো। কপাল মা কপাল। সবই কপালের লিখন। খণ্ডাবে কার সাধ্যি। নিয়তির ওপর তো আর হাত চলে না। শুধু আফসোস! অল্পবয়সী মেয়ে তুমি। জীবনের ক’দিন দেখছো আর। এখনই স্বামী হারা।”

ইভানা সময় নিয়ে কথাগুলো শুনল। মস্তিষ্কে ধারণ করল। অতঃপর ধীর গলায় বলল,
“আপনি আবরার কে চিনতেন? আগে থেকেই? কিভাবে? আবরার এসেছিল এখানে? শুধুই কি মিস্টার সরকারের কলিগ বলে চিনতেন? মিসের সরকার আমাকে বলুন। প্লিজ বলুন আমাকে।”

শেলী সরকার নিশ্চুপ, নিশ্চল, নির্বিকার।
ইভানা হাজারো অনুনয়,অনুরোধ করেও আর একটা শব্দও বের করতে পারে নি কণ্ঠনালী বেদ করে।

ইমরান নিশ্চুপ বসে রইল কিছুক্ষণ। কি কারণ থাকতে পারে মিসেস সরকারের চুপ হয়ে যাওয়ার পেছনে? কি লুকোলেন সে? আহসানের কলিগ হিসেবে পরিচয় থাকতেই পারে। তবে এই লুকোচুরি কিসের? সুরাহা করতে পারল না এই ছোট্ট একটা প্রশ্নের। অগ্যতা মাথা ভর্তি চিন্তা নিয়ে পুনরায় ঝাপ দেয় চিন্তা সায়রে ডুবো সাঁতার কাটতে।

হাইড্রোজেন সালফেট গ্যাসের কড়া গন্ধ যখন ল্যাবের ভেতরটায় লুটোপুটি খাচ্ছে, তখন ইমরান সেফটি মাস্কের উপর দিয়েই নাক চেপে ধরল। সেই অবস্থাতেই ইভানাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কিভাবে কাজ করেন বলুন তো এখানে?গন্ধে তো নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে চাইছে।”

ইভানা কাজে মনোযোগ রেখেই মৃদু হাসল। হাতের টেস্টটিউবে নজর রেখে নিচু গলায় বলল,
“আপনার গুমঘরের চেয়ে ভালো আছে। মর্গের গন্ধ বুঝি আর উন্নত? সেগুলো তে নাড়িভুড়ি বের হয় না?”

ইমরান আড়চোখে আশেপাশে তাকাল। কাউকে এদিকে মনোযোগ দিতে না দেখে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বলল,
“আপনার ল্যাবের থেকে খানিকটা উন্নত তো বটেই।আর আমি কি সারাক্ষণ মর্গে গিয়ে শুয়ে থাকি লাশেদের সঙ্গে?আপনি তো আঠারো ঘন্টাই এখানে পড়ে থাকেন।”

ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“যার কাজ যেখানে, তাকে তো সেখানেই থাকতে হবে।”

ইমরান মাথা নাড়লো। এটাই তো ধ্রুব সত্য। কাজ যেখানে টানবে তাদের তো সেখানেই ছুটতে হবে, থাকতে হবে। সে ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক।

বেশ খানিকটা সময় পর ইভানা হাতের কাজ সেরে ইমরানের দিকে নজর দিল। ইমরান তখনও ইভানার কাছাকাছিই নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগের সহিত কার্যকলাপ দেখছে তার। ইভানা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“কি ব্যাপার ইমরান ; আপনি শুধু আমার লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকছেন কেন?”

ইমরান ভ্রুকুটি করে তাকাল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
“আপনার ল্যাজ আছে নাকি? কই দেখি!” বলেই মুখ টিপে হাসল সে।
ইভানা হেসে ফেলল। বলল,
“গোমড়ামুখো অফিসার হাস্যরসাত্মকও আছে দেখছি।”

ইমরান এবারে স্থির দৃষ্টি ফেলল। ভরাট গলায় বলল,
“আপনার সাথে মশকরা করতে আমার ভয় ভয় লাগে ইভানা।”

ইভানা অবাক হলো। আশ্চর্যান্বিত নেত্রে তাকিয়ে বলল,
“কিসের ভয়? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?”

ইমরান মৃদু হেসে বলল,
“বাঘিনী।”

দুটো মুখে লেগে থাকা হাসির ছটা দেখে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত কামড়াচ্ছে আহনাফ। ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। মনে মনে চাপা গালির বন্যা ফুলঝুরি ছুড়ছে অনবরত। বিরবির করে বলে-
“কই আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তো এত খই ফুটে না মুখে! হাসির দেখাও মেলে না। তখন তো এমন অবস্থা হয়, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এখন কিসের এত হাসাহাসি এই চ্যাংড়া ছেলের সাথে!”

দূর্ভাগ্যবশত ইরেশ বিরবির করে বলা কথাগুলো শুনে ফেলে। পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল,
“জ্বলছে?”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আহনাফের জ্বলে না; সে জ্বালাতে অভ্যস্থ।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here