সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব -২২+২৩

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আয়াতে’র মা এসে দরজা খুলে দিল। আব্রাহাম’কে দেখে, রক্তিম চোখে আব্রাহামে দিকে তাকালো। আব্রাহাম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আবরার এক হাতে, আব্রাহাম’কে ধরে রেখেছে। আয়াতে’র বাবা ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। আয়াত বাবার পায়ে, তেল মালিশ করে দিচ্ছিলো। দরজার সামনে দু-চোখ যেতেই, দু’নয়ন থমকে গেল। অশ্রুকণা গুলো চোখের কোণে এসে ধরা দিল। ফ্লোরে থেকে, উঠে দাঁড়ালো। আস্তে করে দরজার দিকে এগিয়ে আসলো। আয়াত’কে এগিয়ে আসতে দেখে, আয়াতে’র আম্মু গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

–আর এক পা এগোবি না। যতদুর এসেছিস। সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। যদি পারিস। নিজের রুমে গিয়ে, বিশ্রাম কর।

–আম্মু আমাদের ভেতরে আসতে দিন। আমি সবটা আপনাদের বুঝিয়ে বলছি। বলল আবরার।

আয়াতে’র আম্মু কিছু বলতে যাবে। তার আগেই আজাদ শিকদারের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসলো।

–ও ছেলে আমার বাসায় প্রবেশ করতে পারবে না। তুমি আসলে আসতে পারো। কিন্তু ও ছেলেকে আমার বাসার মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে না।

মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ’টা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে নিরবতায় রেশ গিরে ধরেছে। সবাই’কে অবাক করে দিয়ে, আয়াত কষে আব্রাহামে’র গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আব্রাহামে’র শরীর দুর্বল হওয়ায়। হঠাৎ আক্রমণে দু’কদম পিছিয়ে গেল। আবরার ধরতে গেলে, আব্রাহাম হাত দিয়ে থামিয়ে দিল। আয়াত চিৎকার করে বলে উঠলো।

–আমার বাবার সন্মান নষ্ট করে, তোমার শান্তি হয় নাই। আবার কি করতে এসেছো? আমার বাবাকে মেরে ফেলতে এসেছো? তোমার যদি এতই অভিনয় করার ছিল। আমাকে জানাতে, আমি’ও তোমার সাথে অভিনয় করতাম। একজনে অভিনয় করে, তেমন মজা নেই। দু’জন মিলে, অভিনয় করতাম। অনেক মজা হতো। তোমার যখন এতই খেলার ইচ্ছে ছিল। তুমি গেম খেলতে পারতে। আমার জীবন নিয়ে কেনো খেললে? তোমাকে নিয়ে আমার অনেক বিশ্বাস ছিল। তুমি এভাবে আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলে, কোন সাহসে এই মুখ নিয়ে আমার সামনে আসলে, তোমার লজ্জা করল না। কোন মুখে আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালে।

–আয়াত একটা বার আমার কথা শুনো। আমি ইচ্ছে করে..

–আবরার ভাইয়া। আপনি এই বাসার জামাই। আপনি যখন এই বাসায় আসবেন। তখন দয়া করে বাহিরের মানুষ’কে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবেন না। একই কাজ যদি বারবার হয়। তাহলে আমি ভুলে যাব। আপনি আমাদের বাসার জামাই। আপনি আপনার ভাইকে নিয়ে এখনই আমাদের বাসা থেকে চলে যান। এই মানুষ’টা আমার সামনে থাকলে, আমি কি করে ফেলবো। এটা আমি নিজে-ও জানি না। আমি সবকিছু শেষ করে ফেলবো। আব্রাহাম’কে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান৷ শেষর কথা গুলো আয়াত চিৎকার করে বলল। আয়াতে’র চিৎকারে শিকদার বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল কেঁপে উঠলো। এর আগে আয়াত’কে কেউ কখনো এত রাগ করতে দেখে নাই । আজাদ শিকদার মেয়ের এমন আচরণে বেশ অবাক। আয়াতে’র আম্মু আয়াত’কে ধরতে আসলে, আয়াত আবার চিৎকার করে উঠলো।

–আম্মু একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তুমি আবরার ভাইয়া’কে বলো। আমার সামনে থেকে আব্রাহাম’কে নিয়ে যেতে। আমি আব্রাহামে’র মুখ দেখতে চাই। আবরার ভাইয়া সবকিছু জানার পরে-ও, কেনো আমার সামনে আব্রাহাম’কে নিয়ে আসলো। আব্রাহাম’কে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বলো আম্মু। আমি কিন্তু কিছু একটা করে ফেলবো। আয়াত পাগলে’র মতো চিৎকার করছে, আর কথা গুলো বলছে। দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে। আয়াতে’র অবস্থা দেখে, আয়াতে’র আম্মুর চোখে-ও পানি চলে আসলো। প্রতিটি মানুষ নিরব হয়ে গিয়েছে। আয়াতে’র কথার জবাবে উত্তর দেওয়ার মতো সাহস, কারো হচ্ছে না।

–আয়াত তুমি নিজের রুমে যাও। এভাবে চিৎকার করবে না। তোমার শরীর এমনিতেই ভালো না। এভাবে চিৎকার করলে, তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে।

” এই শান্ত মস্তিষ্কের খুনিকে তুমি, আমার সামনে থেকে চলে যেতে বলো আব্বু। ওর ছায়া-ও আমি দেখতে চাই না। এই ছেলে একটা শান্ত মস্তিষ্কের খুনি। কোনো খুনির জায়গা আমাদের বাসায় নেই। ”

–তুমি রুমে যাও। আমি ওদের বিদায় করার ব্যবস্থা করছি।

আয়াতে’র আম্মু আয়াত’কে জোর করে, রুমে নিয়ে চলে গেল। আয়াত চলে যেতেই আজাদ শিকদারের গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেল।

–আবরার তোমাকে কি বলা হয়েছে। তুমি শুনতে পাও নাই। তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে চলে যাও। তোমার আমাদের বাসায় আসতে হলে, তুমি একা আসবে। কোনো স্বার্থপর ছেলেকে নিয়ে আসতে পারবে না।

–আংকেল আমার কথা’টা শুনুন। আমি ইচ্ছে করে, এমন’টা করি নাই। প্লিজ আমাকে আর একটা সুযোগ দিন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। কখনো আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না। আমি খুব বাজে ভাবে, পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলছি। আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনাদের সব কথা মেনে চলবো। আমাকে শুধু একটা সুযোগ দিন। কত মানুষ কত বড় বড় ভুল করে, তারা যদি ক্ষমা পায়। তাহলে আমি কেনো, মাফ পাব না।

–আমি তোমাকে মাফ করে দিব। তুমি আমাদের সন্মান ফিরিয়ে দাও। আমার মেয়ের চোখের পানি গুলো ফিরিয়ে দাও। আমার মেয়ে যে, এত কষ্ট পেয়েছে। সেই কষ্ট গুলো, মুছে দাও। মানুষের যতো কটু কথা শুনেছি। সেগুলো কথা ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাকে মাফ করে দিব। আয়াতে’র বাবার কথা শুনে, আব্রাহাম মাথা নিচু করে ফেলল। আব্রাহাম’কে চুপ থাকতে দেখে আজাদ শিকদার, আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–আবরার তোমাকে কিছু বলেছি। আবরার আর কোনো কথা বলতে পারলো না। আব্রাহাম’কে নিয়ে, বাহিরে চলে আসলো। আজাদ শিকদার দরজা লাগিয়ে দিয়ে, সোফায় গিয়ে বসলো। দু-হাত মাথার ওপরে রেখে, চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল।আয়াতে’র আম্মু আয়াত’কে রুমে নিয়ে আসলো। মেয়েকে ভালো-মন্দ কথা শোনাতে লাগলো। মায়ের কথা শুনে, আয়াত কিছুটা শান্ত হলো।

ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। আবরার বাসার সামনে এসে, কলিং বেলে চাপ দিল। রজনী ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। কলিং বেল বেজে ওঠায়, দ্রুত পায়ে এসে, দরজা খুলে দিল। আবরার রজনী’কে দেখে একটু অবাক হলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। গম্ভীর মুখ করে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না রজনী। আস্তে করে দরজা লাগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আবরার ফ্রেশ হয়ে এসে, কোনো কথা না বলে, খেতে শুরু করল।

–তুমি এত স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে কেনো? আমি খেয়েছি কি-না একটা বার জানতে চেয়েছো?

–আমি তো স্বার্থপরই। আমি আবার কবে ভালো ছিলাম। আগে যখন রোজ রোজ এসে বলতাম। তুমি খেয়েছো কি না। আমাকে দশ কথা শুনিয়ে দিতে, কথা শুনতে শুনতে মানুষ। একটা সময় নিরব হয়ে যায়। তার আর কিছু বলতে ভালো লাগে না। সবকিছু ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দেয়। ভাগ্য তার জীবন যেদিকে নিয়ে যাবে। সে-ও সেই দিকেই যাবে।

–তোমার খালি ত্যাড়া বাঁকা কথা। এভাবে সংসার করা যায় নাকি। আমি যেভাবে এই বাসায় আছি। এটাকে অন্তত সংসার করা বলে না। এভাবে চলতে থাকলে, আমি আর এই বাসায় থাকতে পারবো না।

–থাকতে বলেছে কে? আমি তোমাকে থাকতে বলেছি। তোমার মন চাইলে, তুমি বাবার বাসায় চলে যেতে পারো। সমস্যা নাই। ডিভোর্সের পরে, সব দোষ। আমি আমার কাঁধে নিয়ে নিব। তোমাকে কেউ দোষ দিতে পারবে না।

ডিভোর্সের কথা শুনতেই রজনী বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। অসহায় দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকিয়ে। মানুষ’টা কেমন বদলে গিয়েছে। তাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না। মানুষ’টা আগে কথা বললে, তার কথার মধ্যে ভালোবার খুঁজে পেত রজনী। আজকাল ভালোবাসা তো দূরে থাকলো। মানুষ’টার কাছে থেকে ভালো ব্যবহার টাই পায় না রজনী। আবরারের কথা শুনে, রজনী অভিমানী কণ্ঠে বলল।

–আমি কালকেই বাবার বাসায় চলে যাব। আর কখনো আসবো না। সারাদিন না খেয়ে বসে আছি। আমি যদি না খেয়ে মরে-ও যাই। তাহলে কেউ আমাকে তাকিয়ে দেখবে না। আমার যদি উপায় থাকতো। তাহলে, আমি এখনই বাবার বাসায় চলে যেতাম।

–ব্যাগ গুছিয়ে রাখো। আমি গিয়ে সকালে রেখে আসবো। আবরারের কথা শুনে, ক্রোধ নিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। রাগে ক্ষম ক্ষম করতে করতে,নিজের রুমে চলে গেল। রজনী’র কান্ড দেখে, আবরার হালকা হাসলো। মহারাণী দেখছি অভিমান করতে শিখে গিয়েছে। এত সহজে যে, তোমার কাছে ধরা দিব না পাখি। তোমার মনে আমার জন্য পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসা তৈরি করবো। তারপরে তোমার কাছে ধরা দিব। আগে তোমাকে বাবার বাসায় রেখে আসি।

“গুরুত্ব বোঝাতে হলে, দূরত্ব সৃষ্টি করতে হয়। ”

আবরার রুমে এসে দেখলো। রজনী মন খারাপ করে, বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে। আবরার গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।

–এই মেয়ে, উঠে খেয়ে নাও। না খেয়ে অসুস্থ হবে, এটা আমি মানতে পারবো না। তুমি অসুস্থ হওয়া মানে, এই বাসায় আরো কিছু দিন থাকা। এটা আমি মেনে নিতে পারবো না। খেয়ে সুস্থ থাকো। কালকে সকালে তোমাকে, তোমার বাবার বাসায় দিয়ে আসতে পারলে বাঁচি। আবরারের কথা শুনে, রজনী রক্তিম চোখে আবারের দিকে তাকালো। আবরার সেদিকে পাত্তা না দিয়ে, রজনী’কে জোর করে তুলে, খাইয়ে দিল।

পরের দিন সকাল বেলা আয়াত ঘুম থেকে উঠে। ড্রয়িং রুমে আসলো। সবাই’কে অবাক করে দিয়ে, আয়াত তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–বাবা আমি বিয়ে করতে চাই। তুমি ছেলে দেখা শুরু করো। এভাবে আর কত লোকের কথা শুনবে।

আয়াতে’র কথাটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো, আজাদ শিকদার গম্ভীর হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াতের আম্মু রক্তিম চোখে তাকালো মেয়ের দিকে, তার মেয়ে এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেল। বাবার কাছে এসে, নিজের বিয়ের কথা বলছে। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ’টা কেমন শীতল হয়ে উঠলো।

চলবে…..#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

“বেহায়া মেয়ে এসব তুই কি বলছিস। তুই ভুলে যাচ্ছিস। তুই কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস। লজ্জা সরম সব ভুলে গিয়েছিস। আব্রাহাম নামের ছেলে’টা আমার মেয়েটা’কে, একদম শেষ করছে ফেলছে। এমন বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিস কেনো আয়াত? তোকে সাবধান করছি। ভালো হয়ে যা। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। যে, একবার তোর জীবন থেকে চলে গিয়েছে। তাকে আর তোর জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে, আসার চেষ্টা করিস না। যে, একবার তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে বারবার তোকে ছেড়ে চলে যাবে। মায়ের কথা শুনে মলিন হাসলো আয়াত। শান্ত কণ্ঠে বলল।

–আমি আব্রাহাম’কে নয়। তোমাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবো। সেদিন বাবা তোমাকে, আমার বিয়ের কথা বলছিল না। আমি শুনে ছিলাম। আয়াতে’র কথা শুনে, আয়াতের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।

–তুই ভেবে চিন্তে কথা বলছিস তো আয়াত। পরে আবার তোর মত বদলে ফেলবি না তো?

–তোমার মেয়ের ওপরে ভরসা রাখতে পারো।

–জেদের বসে কোনো সিদ্ধান্ত নিস না মা। জীবনের একটি ভুল সিদ্ধান্ত, সারাজীবনের কান্না। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না। একটা মানুষের সাথে তুই সারাজীবন থাকবি। আমার কথার অর্থ তুই বুঝতে পারছিস। আয়াত কিছুক্ষণ নিরব রইলো। তারপরে মলিন মুখে বলল।

–আমি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বলেই আয়াত নিজের রুমে চলে গেল। আয়াত চলে যেতেই, রজনী ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল। রজনী’কে দেখে, রজনী’র আম্মু রজনীর দিকে এগোতে যাবে। তখনই রজনী বলল।

–আম্মু আমি ক্লান্ত। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। প্রচুর মাথা ব্যথা করছে। ঘুমোতে পারি। আমাকে কেউ বিরক্ত করবে না। কথা গুলো বলার সময়, রজনীর গলাটা কেমন ধরে আসছিল। রজনীর আম্মু ঠিক ধরতে পারলো। তার মেয়ের কিছু হয়েছে। সবার সামনে কিছু বলা যাবে না। আড়ালে ডেকে নিয়ে জানতে হবে।

রজনী নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আজকে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে, সে তো আবরারের থেকে মুক্তি চেয়েছিল। আবরার তাকে আজ, মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। তার তো খুশি হবার কথা। তাহলে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেনো? ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। সে কি অসহ্য যন্ত্রণা। যা সহ্য করার নয়। রজনীর মনে হচ্ছে, তার জীবন থেকে সে, বিশাল কিছু হারিয়ে ফেলছে। কেনো এত কষ্ট হচ্ছে? ইচ্ছে করছে, দৌড়ে আবরারের কাছে চলে যেতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না আবরার। কিন্তু সব চওয়া যে পূর্ণ হয় না। এটার নামই জীবন। রজনী ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

সন্ধ্যা বেলায় রজনী রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। ড্রয়িং রুমে আয়াতে’র বিয়ের কথা হচ্ছিল। আয়াতে’র বিয়ের কথা শুনে, রজনীর চক্ষুদ্বয় বেড়িয়ে আসার উপক্রম। আস্তে করে মায়ের কাছে গেল। মায়ের কানে ফিসফিস করে বলল।

–আম্মু আব্বু এসব কি বলছে? কার সাথে আয়াতে’র বিয়ে দিবে? আয়াত কি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে?

–আয়াত নিজেই তোর বাবার কাছে বিয়ের কথা বলেছে। মেয়েটা একদম পাগল হয়ে গিয়েছে।

–আম্মু এসব তুমি কি বলছো? তোমার মেয়ে সব লজ্জা সরম ভাত দিয়ে খেয়ে ফেলছে? আমি আয়াতে’র সাথে কথা বলে আসি। বলেই রজনী আয়াতে’র রুমের দিকে চলে গেল।

আয়াত নিজের রুমে বসে, খাতায় কিছু একটা লিখছিল। এমন সময় রজনীর আগমন। এই সময়ে রজনীর আগমন একটু অবাক করা বিষয় ছিল। কিন্তু আয়াত এতটুকু অবাক হলো না। নিজের কাজে মনযোগ দিল। রজনী আয়াতে’র কাছে গিয়ে বলল।

–শুনলাম তুই নাকি বিয়ে করবি। কথা গুলো বলতে বলতে আয়াতে’র হাতের দিকে তাকালো। আয়াতে’র হাতে রজনীর ডায়েরি। রজনী চোখ বড় বড় করে, আয়াতে’র দিকে তাকালো। সেই সাথে মনে এসে হানা দিল ভয়। আয়াত সবকিছু দেখে ফেলে নাই তো। আব্রাহাম’কে নিয়ে, তার প্রথম অনুভূতির কিছু লাইন লিখা আছে। রজনী দ্রুত আয়াতে’র হাত থেকে ডায়েরি’টা নিয়ে নিল। রাগান্বিত হয়ে বলল।

–কোন সাহসে তুই আমার ডায়েরি’তে হাত দিয়েছিস। কারো জিনিসে হাত দেওয়ার আগে, তার থেকে অনুমতি নিতে হয়। এটা তুই জানিস না।

–আমার অনুমতি ছাড়া তুমি আব্রাহাম’কে ভালোবাসতে পারো। তোমার অনুমতি আমি তোমার ডায়েরিতে হাত দিতে পারি না।

–ডায়েরিটা আমার জিনিস। কিন্তু আব্রাহাম তোর জিনিস না।

–আব্রাহাম-ও আমার জিনিস। ওর দিকে তাকাতে হলে-ও, আমার অনুমতি নিতে হবে।

–তুই তো অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবি। তাছাড়া আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অন্য পুরুষের প্রতি আমার সকল অনুভূতির মৃত্যু হয়েছে। তাই এই বিষয় নিয়ে আমাকে কথা শোনাতে আসবি না। আমি আমার স্বামীকে ভালোবেসে ফেলছি। রজনী’র কথা শুনে, আয়াত হালকা হাসলো।

–তোমার সাথে মজা করলাম। দেখি তুমি কি বলো? কখন আসলে? আবরার ভাইয়া আসে নাই। রজনী আর কিছু বলল না। নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করল। আয়াত বেলকনিতে চলে গেল।

আজকে আয়াত’কে দেখতে এসেছে। পাত্র পক্ষের সামনে আয়াত বসে আছে আয়াত। আয়াতে’র পাশেই আয়াতে’র বেস্ট ফ্রেন্ড আরহা দাঁড়িয়ে আছে। পাত্রের নজর আরহার দিকে, বিষয়টি আয়াতে’র নজর এড়ালো না। সে মনে মনে হাসলো। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে, পাত্রপক্ষ চলে গেল। আয়াতে’র বিয়ের খবর শুনে, আবরার তৎক্ষনাৎ শিকদার বাড়িতে আসলো। আবরারকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে, কিছুটা চমকে উঠলো রজনী। আবরার কোনো কথা না বলে, আজাদ শিকদারের কাছে গেলেন। তার কাছে গিয়ে নরম কণ্ঠে বলল।

–আব্বু আমি আপনার সাথে একান্তে, কিছু কথা বলতে চাই। যদি আমার সাথে একটু আড়ালে আসতেন।

–আব্রাহামে’র বিষয়ে কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার মেয়েটা নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমি’ও চাই। আমার মেয়েটা পুরোনো ক্ষত ভুলে, সবকিছু নতুন করে শুরু করুক। তুমি বা তোমার ভাই। এতে অন্তত বাধাগ্রস্ত হবে না।

–আব্বু আমি আপনার সিদ্ধান্ত’কে সন্মান করি। আপনাকে কিছু কথা জাননো প্রয়োজন। আমার কথা গুলো, শুনে যদি আপনার সিদ্ধান্ত অটল থাকে, কথা দিচ্ছি। মুখ দিয়ে দু’কথা বের করবো না। নিরবে স্থান ত্যাগ করবো। আয়াতে’র বিয়ের আগে আমার কথা গুলো একবার শুনুন।

–বেশ তবে চলো বাহিরে। বাহিরে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা হবে। আবরার রজনীর বাবাকে ধরে বাহিরে নিয়ে গেলেন। দু’জন মিলে পাশাপাশি হাঁটছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আবরার নিরব রয়েছে। তা দেখে আজাদ শিকদার বেশ বিরক্ত। আবরার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল। আবরারের কথা শুনে, আজাদ শিকদার স্তব্ধ হয়ে গেল। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে। নরম কণ্ঠে উত্তর দিল।

–তোমরা আমাকে এসব কথা আগে, জানাও নাই কেনো?

–অনেক বার জানাতে চেয়েছি৷ কিন্তু ভয়ের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। আমার মনে হলো, আজকে সঠিক সময়। আজকে না জানালে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। ছেলেটা’কে এভাবে নিঃস্ব করে দিবেন না আব্বু। আমরা ছাড়া ছেলেটার কে আছে? আমরা ওকে ভালো না বাসলে, আব্রাহাম’কে কে ভালোবাসবে। আমার কথা গুলো আপনি একটু ভাববেন। আমার কোনো জোর নেই। আপনি যেটা বলবেন। সেটাই হবে। দীর্ঘ চার ঘন্টা আয়াতে’র বাবাকে বুঝিয়ে, আয়াতে’র বাবার মন গলাতে সক্ষম হয়েছে আবরার। আয়াতে’র বাবা গম্ভীর হয়ে বলল।

–তুমি যা বললে, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে। তাহলে আমি আব্রাহাম’কে মাফ করে দিব। বাবার মতো আব্রাহাম’কে ভালোবাসবো। জানি সবাই বাবা হয়ে উঠতে পারে না। তবে বাবা হবার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার আয়াত মানবে তো। আমি যে, মেয়েটার বিয়ে ঠিক করে ফেলছি। তার কি হবে।

–আমি সবকিছু সামলে নিব। আপনি শুধু আমাকে সাপোর্ট করবেন। আয়াত আব্রাহাম’কে এখনো ভালোবাসে। সাময়িক কারণে আব্রাহামে’র ওপরে অভিমান করে আছে। দু’জন একসাথে থাকলে, ওদের ভালোবাসা অভিমান’কে হার মানিয়ে দিবে। আব্রাহাম অনেক অসুস্থ। ওর ওপরে প্রচুর শারীরিক ভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। আয়াতে’র বিয়ে কথা আব্রাহাম জানে না। জানলে হয়তো ছুটে চলে আসতো। আপনি বললে, আয়াত আপনার কথা শুনতে বাধ্য। আয়াত আপনাদের অনেক ভরসা করে।

রজনী বাসায় বসে চিন্তা করছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত দু’টো বাজতে যায়। পাঁচ ঘন্টা হলো দু’জন মিলে বেড়িয়েছে। এখনো আসছে না। প্রচুর চিন্তা হচ্ছে, আয়াতের আম্মু ডাইনিং টেবিলের ওপরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কত অপেক্ষা করবে। রাত তো কম হলো না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, আবরার আর আজাদ শিকদার বাসায় আসলো। আজাদ শিকদার’কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আবরার চলে যেতে লাগছিল। তখনই আজাদ শিকদার গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

–তুমি কোথায় যাচ্ছো? রাত তো কম হলো না। আজকে যাবার দরকার নেই। যা কাজ আছে। সব সকালে হবে। আমার মুখের ওপরে কথা বলা পছন্দ করি না। আমি যা বলবো। সব শুনতে হবে। চুপচাপ ভেতরে যাও। তুমি শুধু আমার বাসার জামাই না। তুমি আমার ছেলে। তাই বাবা হয়ে, আমি তোমাকে শাসন করতেই পারি। আজাদ শিকদারের কথায় আবরার হেসে দিল। চারজন মিলে, খেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেল। আবরার রুমের মধ্যে এসে, উসখুস করছে। আজকে কতদিন পরে, রজনীর সাথে দেখা। মেয়েটা’র মুখ কেমন মলিন হয়েছে গিয়েছে। ঝগড়ুটে মেয়েটা আজ শান্ত হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা আবরারের কেমন জানি সহ্য হলো না। রজনী’কে রাগিয়ে দেওয়ার কাজে গেলে পড়লো।

–বলছিলাম কি তুমি আমাকে ডিভোর্স কবে দিবে। আজকে একটা মেয়ে দেখে আসলাম। কি বলবো তোমাকে। এত সুন্দর। চোখ বন্ধ করলেই তাকে দেখতে পাচ্ছি। কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তুমি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সাথে সাথে, আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করে,বাসায় নিয়ে আসবো। সারাদিন রুমের মধ্যে বসিয়ে রেখে দেখবো। মেয়েটা এত সুন্দর খালি দেখতেই ইচ্ছে করে।

–চরিত্রহীন!

–চরিত্রহীন ছেলের সাথে একা একা এক রমে আছো। তোমার ভয় লাগছে না। বলেই রজনী’র কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আবরারকে পাশে দাঁড়াতে দেখে, অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল রজনী। তখনই আবরারের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে জান্নাত নামটা জ্বলজ্বল করছে। আবরার কল রিসিভ করল। ওপর পাশে থেকে মেয়েলি কণ্ঠে রাগ ভেসে এলো।

–ফোন তুলতে এত সময় লাগে। সারাদিন কি এমন কাজ করসি। ঐ তোকে ডক্টরের চাকরি কে দিয়েছিল৷ তোকে সুইপারের চাকরি দেওয়া উচিৎ ছিল। তাড়াতাড়ি ভিডিও কল দে। একটা দরকারে ফোন দিয়েছি। না হলে তোর মতো উজবুক’কে এত রাতে কে দেয়।

–তোর মা কি জন্মের সময়! তোর মুখ মধু দেয় নাই। সব সময় নিমপাতার মতো কথা বলসি। কথাটা বলেই কল কেটে ভিডিও কল দিল। মেয়েটার আবরারকে কি জানি দেখালো। আবরার কিছুক্ষন কথা বলে কল কেটে দিল। পাশে তাকিয়ে দেখলো। রজনী মন খারাপ করে, তার দিকে তাকিয়ে আছে। দু-চোখে অশ্রুকণা গুলো এসে জমা হয়েছে। একটু পরেই বৃষ্টিতে রুপান্তরিত হবে। আবরার রজনী’র কাছে এগিয়ে যাবে৷ তার আগেই রজনী বিছানায় চলে গেল। কোনো কথা না বলে, বালিশের নিচে মুখ গুঁজে দিয়ে কান্না করতে লাগলো। রজনী’র কান্না আবরারের সহ্য হলো না। কেমন জানি বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। রজনীর কাছে গিয়ে, রজনীর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো। রজনী আবরারের হাত সরিয়ে দিল৷ আবরার রজনী’কে তুলে বসালো। নরম কণ্ঠে বলল।

–কি হয়েছে কান্না করছো কেনো? রজনী কোনো কথা বলল না। আবরারের সামনে থেকে সরে যেতে চাইলে, আবরার শক্ত করে রজনী’কে নিজের সাথে মিলিয়ে নিল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here