সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব -৪০+৪১ ও শেষ

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আয়াত বিছানায় বসে আছে। আব্রাহাম আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। আব্রাহামের দৃষ্টি আয়াতের দিকে স্থীর তা দেখে, আয়াত লজ্জায় দু’হাতে নিজের মুখ আড়ালে করে নিল। আব্রাহামের দৃষ্টির আড়াল হতে, আব্রাহামের বুকেই মুখ লুকালো। আয়াতের কান্ড দেখে আব্রাহাম আলতো করে হাসলো। আয়াতের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে, আয়াতকে নিজের দু’হাতে আবদ্ধ করে ফেলল। দরজায় কলিং বেল বাজতেই দু’জন সজাগ হলো। আব্রাহাম আয়াতকে নিজের থেকে, ছাড়িয়ে দরজা খুলতে চলে গেল। আয়াত কাল রাতে আব্রাহামের আনা ব্যাগ গুলো খুলে দেখতে লাগলো। সেখানে তার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র রয়েছে। অনেক গুলো হিজাব, চুলের ক্লিপ, দু’টো শাড়ি, কয়েকটা সালোয়ার কামিজ। ছোটখাটো আরো অনেক গুলো জিনিস রয়েছে। আব্রাহাম কিভাবে জানলো? জিনিস গুলো তার প্রয়োজন। আয়াতের ভাবনার মাঝেই আব্রাহাম রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। আয়াতকে অবাক হতে দেখে বলল।

–এত অবাক হবার কিছু নেই। তুমি মুখে কথা রাখো কেনো? তোমার যে, প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ফুরিয়ে গিয়েছে। আমাকে বললেই পারো। সঠিক সময় মতো এনে দেই। কালকে দেখলাম ফেসওয়াশের কৌটা কেটে দুইভাগ করে ফেলেছো। সেখানে থেকে একটু একটু করে নিয়ে মুখে দাও। বলি কি আমার এতই দুর্দিন এলো। যে বউকে কৌটা কেটে মুখে ফেসওয়াশ মাখতে হবে।

–আমি তোমার মতো নাকি। অপচয় করা একদম ভালো কাজ না। আমি অপচয় করতে জানি না। তাই ফেসওয়াশ কৌটা কেটে আরো কিছু দিন ব্যবহার করি। এর মধ্যেও আলাদা একটা ব্যাপার আছে। এটা তুমি বুঝবে না।

–তুমি যে কথায় কথায় অভিমান করো। তোমার অভিমানের অপচয় হয় না। তোমার মতো মেয়ের কাছে থেকে অপচয় আশা করা যায় না। এর পরে থেকে অভিমান করলে, কম করে করবে। এত তোমার অভিমান গুলো অপচয় কম হবে। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত ফুঁসে উঠলো। রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তুমি যে আমাকে সময় দাও না। আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না। তার বেলা কি হবে? তোমার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না। এখনো বাসায় বসে থেকে কি করছো। তোমার কাজ ফুরিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কাজে যাও। বাসা থেকে বের হতে পারলে বাচোঁ। আল্লাহ জানে, আবার কোথাও বিয়ে করে বউ রেখে আসছো নাকি। বাহিরে যাবার এত কিসের তাড়া তোমার।

–ভালো কথা বললেই দোষ হয়ে যায়। আমার বউ কি দেখতে কম সুন্দর। যে আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত মুখ বাঁকালো। আয়াতের মুখ বাঁকানো দেখে আব্রাহাম শব্দ করেই হেসে উঠলো। আয়াতের মুখ বাঁকানোটা আব্রাহাম খুব সুন্দর ভাবে উপভোগ করে।

–তুমি আমার মুখ বাঁকানো টা উপভোগ করো। আর আমি তোমার হাসি উপভোগ করি। তোমার মুখের হাসি আমাকে এক আকাশ পরিমাণ শান্তি এনে দেয়। যে শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই। তুমি হসপিটালে যাবে না। কথাটা বলেই মুখটা মলিন করে ফেলল আয়াত। আজকে ভিষণ করে চাইছে। আব্রাহাম তার কাছে থাকুক। কিন্তু চাইলেই কি সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়। আব্রাহামের আশায় কত মানুষ বসে থাকে। সে আব্রাহামের দায়িত্ব পালন করতে বাঁধা দিতে পারে না। তার খুশির থেকে মানুষের সুস্থ হওয়াটা বেশি জুরুরি। আয়াতকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আব্রাহাম বলল।

–আজকে বাসায় আছি বলে, আমাকে সহ্য হচ্ছে না। আব্রাহামের কথা শুনে, আড়চোখে তাকালো আয়াত। আয়াতকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আব্রাহাম হেসে বলল।

–চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবে নাকি। ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমার বুঝি লজ্জা করে না। আব্রাহামের কথা শুনে আয়াত চোখ বড় বড় করে তাকালো। সেকেন্ডের মধ্যে নিজের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। আব্রাহাম আয়াতে শুয়ে দিল। তারপরে রেস্ট করতে বলে, বাহিরে চলে গেল। আয়াত বাহিরে উঁকি দিয়ে, পাশে থাকা আব্রাহামের ফোন হাতে তুলে নিল। ফোন হাতে নেওয়ার সাথে সাথে একটা মেসেজ আসলো। হিয়া দিয়ে সেভ করা।

“আব্রাহাম তুই কখন হসপিটালে আসবি? অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। এখনো হসপিটালে আসলি না। তোর কি শরীর খারাপ? তুই তো কোনোদিন এমন করিস না। আমি ফোন দিলে, তুই বিরক্ত হোস। তাই তোকে ফোন না দিয়ে, মেসেজ পাঠালাম। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। হিয়া। ”

মেসেজটা পড়ে গা জ্বলে উঠলো আয়াতের, এই মেয়েটাকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। আব্রাহামের সহপাঠী বলে, চুপচাপ সহ্য করে। যেদিন বেশি বাড়াবাড়ি করবে, সেদিন উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিব। আয়াতের ভাবনা মাঝেই আব্রাহাম খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। আব্রাহামকে দেখে চোখ গোল গোল করে তাকালো আয়াত। আয়াতকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আব্রাহাম বলল।

–এভাবে তাকানোর কোনো কিছু নেই। তোমার-ই বর সারাজীবন দেখতে পারবে। এখন অন্তত চোখটা নিচে নামাও। আর লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নাও।

–তুমি আজকে হসপিটালে যাবে না?

–বউ যদি রাগ করে, হসপিটালে গিয়ে কি মন টিকবে? তাই আমি সাত দিনের জন্য ছুটি নিয়েছি। এই সাতদিন আমি তোমার সাথে থাকবো।

–তাহলে হসপিটালে রোগীদের দেখবে কে?

–হসপিটালে আরেকজন নতুন ডক্টর এসেছেন। উনি দেখবেন। উনার জন্যই সাতদিন ছুটি নিতে পারলাম। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে তোমাকে নিয়ে, ঘুরতে যাব। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। কোনো কথা বলল না। চুপ খেয়ে নিল।

আয়াতের বাবা জরুরি তলব করে, আয়াতদের ডেকেছে। বিকেলে ঘুরে আব্রাহাম আর আয়াত শিকদার বাসায় গেল। ড্রয়িং রুমে সবাই মিলে বসে আছে। হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আব্রাহাম নীরবতা ভেঙে আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–তোমার ছোট চাচা কোথায়? এই বাসায় আসার পরে তাকে কোনোদিন দেখি নাই। শুধু তোমার চাচি আর চাচাতো ভাইকে দেখি। তোমার চাচা কি তোমাদের সাথে থাকে না।

–আমার চাচা আমাদের সাথেই থাকতো। কিন্তু চাচির সাথে ঝগড়া হবার পরে, চাচা আলাদা বাসায় থাকে। চাচার সাথে চাচির পড়ে না। চাচা চাঁচির কারনে ছেলেদের ওপরে, বাজে প্রভাব যেনো না পড়ে, তাই আব্বু চাচাকে আলাদা থাকতে বলেছে। আব্বুর সাথে চাচার যোগাযোগ আছে। আয়াতের কথায় আব্রাহাম ছোট করে উত্তর দিল ওহ্।

–তুমি হঠাৎ চাচার কথা জানতে চাইলে?

–উনাকে তোমাদের বাসায় কোনোদিন দেখি নাই। তাই জানতে ইচ্ছে হলো৷ আয়াত আর আব্রাহামের কথার মাঝে চৌধুরী বাড়ির সবাই চলে আসলো। মুহুর্তের মধ্যে আব্রাহাম চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। দু-চোখ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আব্রাহাম উঠে চলে যাবে। তখনই আয়াত আব্রাহামের হাত চেপে ধরে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল।

–তুমি যদি এখানে থেকে উঠে চলে যাও। তাহলে আব্বুর অসম্মান হবে। আমি চাই না। আমাদের জন্য আব্বু অসম্মান হোক। আয়াতের কথায় দমে গেল আব্রাহাম। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে, নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আব্রাহামে দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে বিদ্যমান। চৌধুরী বাড়ির কারো মুখ সে দেখতে চায় না। আবরার অসহায় দৃষ্টিতে আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে এ জীবনে আব্রাহামের থেকে মাফ পাবে না। আব্রাহাম একবার যখন তাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারমানে মরে গেলে-ও তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সফিউল চৌধুরীর অসহায়ত্ব কণ্ঠ ভেসে আসলো।

–আব্রাহাম জানি অনেক বড় ভুল করেছি। তার ক্ষমা পাব কি না তা আমি জানিনা। তবে তোর সাথে যে অন্যায় গুলো আমি সেগুলো সংশোধন করতে চাই। তোর বাড়ি, তোর অফিস আমি তোকে ফিরিয়ে দিতে চাই। আমি যেনো তোকে দেখাশোনা করি। সেজন্য তোর বাবা-মা আমাকে অফিসটা দিয়েছিল। আমি যেনো কোনো কর্ম করে, আমার ছেলে সহ তোকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারি। আমি তোর মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারি নাই। টাকা আর সম্পদের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার সবকিছু আছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই। আগে আমরা যখন সবাই মিলে, একসাথে থাকতাম। কিন্তু সুন্দর করে, আমাদের জীবন চলছিল। আমার টাকা পয়সা চাই না বাবা। আমার একটা সুন্দর সুখের পরিবার চাই। তুই আর আয়াত আমাদের বাসায় ফিরে চল। আমি ছলনা করে, তোর বাসা আমার নামে করে নিয়েছি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি। আমি তোর বাসা তোকে ফিরিয়ে দিব। আয়াত আব্রাহামকে একটু বোঝাও না। আব্রাহাম যেনো আমাদের সাথে বাসায় ফিরে যায়।

বাবার কথা শুনে চমকে তাকালো আহনাফ। বাড়িটা তার বাবার নামে আছে। আর সে আব্রাহামকে মারা জন্য ছুটে চলেছে। আব্রাহামকে তো তার কোনো কাজেই লাগবে না। তার থেকে-ও তার বাবা দিগুন চালাক। এটা জানা ছিল না আহনাফের। আপাতত আব্রাহামের চৌধুরী বাড়িতে যাওয়াটা আটকাতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করল মাথায়। তার বাবাকে খু*ন* করে হলে-ও, তার সব সম্পত্তি চাই। তার একটা পুরো রাজত্ব চাই। যেই রাজ্যে তার কথাই হবে শেষ কথা। আহনাফের কথার মাঝেই, আব্রাহামের রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এলো।

–আয়াত কি বলবে? আমি যা বলবো। আয়াত তাই শুনতে বাধ্য। আয়াত যদি আমার কথার বাহিরে যায়। তাহলে আমার সাথে আয়াতের সংসার করার প্রয়োজন নেই। যে বাসায় মানুষকে মানুষ বলে মূল্যায়ন করা হয় না। সেই বাসায় আমি ফিরতে চাই না। আমার নতুন বউটা একটু শশুর শাশুড়ীর ভালোবাসা পাবার জন্য তোমাদের কাছে গিয়েছিল। তোমরা কি করেছিলে? ভরা লোকজনের মধ্যে আমাদের অপমান করেছিলে। খালা আয়াতকে অনেক অপমান করতো। আয়াত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, কখনো কোনোদিন কোনো অভিযোগ করতো না। পর কোনো দিন আপন হয় না। সেটা আপনি আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দিয়েছেন খালু। আপনারা আপনাদের মতো ভালো থাকুন। আমাকে আমার মতো ভালো থাকতে দিন। আমি বেঁচে থাকতে, আয়াত কোনোদিন চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না। আয়াতকে যদি চৌধুরী বাড়িতে যেতেই হয়। তাহলে আমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে যেতে হবে। এখন আয়াত সিদ্ধান্ত নিক। সে কি করবে? আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত চুপ করে বসে রইলো। আব্রাহাম প্রচন্ড পরিমানে রেগে আছে। এখন আব্রাহামের কথার ওপরে কথা বলার সাধ্যি তার নেই। সে আব্রাহামের কথা শুনতে বাধ্য। আজাদ শিকদার আব্রাহাম কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে চাইলে, আব্রাহাম আজাদ শিকদারের কাছে মাফ চেয়ে উঠে দাঁড়ালো। আয়াতকে উদ্দেশ্য করে, কঠিন কণ্ঠে বলল।

–তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও। যদি আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে। তাহলে আমার সাথে আসতে পারো। না হলে এখানে থাকো। আমি বাসায় চলে গেলাম। আয়াত একটা উত্তরও করল না। আয়াত বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল বাবা-মা আসছি। বলেই আব্রাহামের পেছনে পেছনে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে বসা প্রতিটি মানুষের মুখে হতাশার ছাপ। হতাশার ছাপ নেই একটি মানুষের মুখে সে হলো আহনাফ। সে মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে। বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরলো।

বাসায় এসেই আহনাফ রাগে গজগজ করতে লাগলো। আহনাফকে অস্থির হতে দেখে, আরোহী আহনাফের পাশে বসে বলল।

–কি হয়েছে? তোমাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেনো? আমাদের বাসায় তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? বাবা-মার সামনে যাবার সাধ্যি আমার নেই। তাই তোমাদের সাথে যেতে পারি নাই। ও বাসায় কি হয়েছে?

–আরোহী বাড়িটা আব্রাহামের নামে নেই। বাবার ছলনা করে নিজের নামে লিখে নিয়েছে। আমরা এতদিন মরিচীকার পেছনে ছুটেছি। আমি আর বিলম্ব করতে চাইছি না। আজ রাতেই বাবাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছি। কথা গুলো বলেই কাউকে ফোন করল। দু’জনের কথা শেষ হতেই হাসতে শুরু করলো আহনাফ।

চলবে…..#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৪১(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে ছুঁই ছুঁই। আহনাফ চুপিচুপি নিজের বাবা-মেয়ের রুমে প্রবেশ করল। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় আহনাফ। উদ্দেশ্য একটাই বাবাকে খু*ন* করা। আহনাফ নিঃশব্দে বাবার বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের ছুরিটা বের করে, যখনই বাবাকে আঘাত করতে যাবে। তখনই একজোড়া শক্ত হাত আহনাফকে ধরে ফেলে। চমকে উঠে আহনাফ। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো। পেছনে তাকিয়ে আব্রাহামকে দেখে, আত্মা কেঁপে উঠলো। আবরার,রজনী, আয়াত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে, ছেলের গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তোর এত অর্ধ পতন হয়েছে। তুই কি মানুষের কাতারে পড়িস। নিজের বাবাকে খু*ন* করতে তোর বিবেকে বাঁধা দিল না। বাবার কথায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আহনাফ বলল।

–কিসের বাবা? কার বাবা? তুমি আমার নিজের বাবা না। তাহলে তোমাকে মারতে আমার কেনো বিবেকে বাঁধা দিবে? আহনাফের কথায় চমকে উঠলো সবাই। সবার মুখের পরিবর্তন আসলেও আব্রাহামের মুখের পরিবর্তন আসলো না। আব্রাহাম জানতো। আহনাফ এমন কিছুই বলবে। আব্রাহাম শান্ত কণ্ঠে বলল।

–আপনার ছেলের দোষ নেই খালু। আপনার ছেলেকে যা বোঝানো হয়েছে। আপনার ছেলে সেটাই বুঝেছে। আহনাফ ভাই তুমি ভুল ধারনা এতদিন মনে পুষে ছিলে। আমি তোমার বাবা ছেলে নই। তুমি আর আবরার ভাইয়া খালুর ছেলে। আব্রাহামের কথা শুনে, চমকে উঠলো আহনাফ। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।

–তুই আমার সাথে মজা করছিস। তুই বাবার ছেলে না মানে?

–মানেটা খুব সহজ। আমি তোমার ছোট খালার ছেলে, আর তুমি আর আবরার ভাইয়া আমার বড় খালার ছেলে।

–কিন্তু আমি একবার আব্বুকে বলতে শুনেছিলাম। আব্বু আম্মুকে বলছিল। আহনাফ আমাদের ছেলে নয়। তারপরে উনিও আমাকে বলেছেন। আমি আমার বাবার ছেলে নই। তাই তো তিনি আমাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে, দিয়েছেন। আমি টাকার নেশায় আর বাবার ওপরে জমে থাকা ক্ষোভে বাবাকে মা*রা*র* জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ছিলাম। যখন জানতে পারলাম। বাড়িটা তোর নামে, তখন আমার আরো রাগ হয়েছিল। প্রথমে তোকে মেরে, বাবাকে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকে তুই আমাকে কি কথা শোনালি।

–আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে, তোর মতো ছেলে আমি জন্ম দিয়েছি। তোর জন্য আব্রাহামকে আমি কত অবহেলা করেছি। অথচ ছেলেটাকে আমাকে তোর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, আমার পাশে ছায়া হয়ে থেকেছে। আমার সব বিপদ নিজের করে নিয়েছে। তোর মতো কুলাঙ্গারকে মে*রে* ফেলতে ইচ্ছে করছে।

–কিন্তু উনি যে বলল আমি তোমাদের ছেলে না। তাই জন্য আমি তোমাকে মারতে রাজি হয়েছিলাম। আহনাফের কথার মানে কেউ বুঝতে পারলো না৷ সফিউল চৌধুরী রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।

–উনি টা কে? সফিউল চৌধুরী কথা শুনে, আব্রাহাম তাচ্ছিল্য করে বলল।

–উনিটা খুব গভীর জলের মাছ। তাকে ধরা কি এতই সহজ। আপনি নিজ থেকে, সামনে আসবেন। নাকি আমি যাব। আব্রাহামের কথা শুনে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল আয়াতের চাচা। আয়াতের চাচাকে দেখে, আয়াত ও রজনী দু’জনেই চমকে উঠলো। নিজের চাচাকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে দুজনেই এগিয়ে যেতে চাইলে, আব্রাহাম থামিয়ে দেয়।

–আপনি সব সত্যি কথা বলবেন নাকি, আমাকে কিছু করতে হবে। আয়াতের চাচা একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে।

–আমি আরোহীকে পালাতে সাহায্য করি। আহনাফের সাথে যখন প্রেম করতো। আমি আরোহীকে সব সময় সাহায্য করতাম। আরোহীর বাবাকে সবাই অনেক ভালোবাসতো। আমার মা তার সব সম্পত্তি আমার বড় ভাই মানে, আরোহীর বাবাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেদিন থেকে আমার মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আমি আরোহীর বাবাকে একটু একটু করে শেষ করে দিব। আহনাফের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে ফেলি। তারপরে আরোহীকে বলি আহনাফের সাথে পালিয়ে যেতে, তাহলে আজাদ ভাইয়ের সন্মান একটু হলে-ও নষ্ট করতে পারবো। আজাদ ভাইয়ের একটু অসন্মান আমাকে আকাশ সমান তৃপ্তি দিয়েছিল। প্রতিশোধের নেশা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছেলো। আমি এখানেই থেমে ছিলাম না। আহনাফকে বলি আহনাফ তাদের বাবা মায়ের আসল সন্তান না। এর প্রমান হিসেবে দেখাই সফিউল চৌধুরী তার বাড়ি আব্রাহামের নামে লিখে দিয়েছে। আগুন ঘি ঢালার মতো, আমার এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল। আহনাফ ভাবতে শুরু করল সে প্রেম করে বিয়ে করেছে। তাকে কেউ মেনে নিল না। তার প্রাপ্য সম্পত্তি তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। তারপরে শুরু আহনাফের কালো পথে আসা। আমি আর আহনাফ মিলে অবৈধ ব্যবসা শুরু করি। আমাদের দিন বেশ ভালোই চলছিল। আহনাফ বস্তিতে আকাশ সেজে থাকতো। আবরার সব সত্যিটা জেনে যায়। আবরারকে ভয় দেখানো হয়। সে যদি সত্যিটা সবাইকে সবকিছু বলে দেয়। তাহলে রজনীকে মে*রে* ফেলা হবে। প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দমে যায় আবরার। এর মাঝে সফিউল চৌধুরী ছেলের ভালো অবস্থা দেখে গোলে যায়। ছেলের সাথে সবার আড়ালে সম্পর্ক তৈরি করে। বাবা ছেলে মিলে, আয়াতকে কি*ড*ন্যা*প* করে, আরোহীকে আব্রাহামের কাছে পাঠায়। কিন্তু আব্রাহাম খুব চালাক। সে আগে থেকেই সব তথ্য সংগ্রহ করছিল। সে যে আগে থেকেই জানতো আরোহী তার কাছে আসবে। আয়াতকে বস্তিতে লুকিয়ে রাখা হয়। আব্রাহাম আহনাফকে গু*লি* করে, আমি এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। আমি বস্তিতে চলে যাই আয়াতকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হই। আব্রাহাম আয়াতকে নিয়ে চলে আসে। আমি বস্তির বুড়িটাকেও খু*ন* করে আসি। যেনো আমার বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে না পারে। বুড়িটাকে টাকা লোভ দেখিয়েছিলাম। আয়াতকে আমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। কথা গুলো বলে থামলো।

–এত অল্পতে থামলে চলবে, আমাকে মাঝরাতে কোথায় নিয়ে গিয়ে ছিলেন। আয়াতের বাবাকে কিভাবে বিয়তে রাজি করালেন। আমাকে আহনাফ ভাইয়ের খোঁজ দিবেন বলে, সবার চোখে কিভাবে আমাকে খারাপ বানিয়েছেন। সেটাও বলবেন নাকি আবার মা*র* শুরু করবো।আব্রাহামের কথায় আয়াতের চাচা আবার বলতে শুরু করল।

–আমি আব্রাহামকে আমার গোপন রুমে নিয়ে যাই। তাকে আয়াতকে ঠকাতে বলি। যার বিনিময়ে সে পাবে তার আহনাফ ভাইকে। আমি জানতাম সফিউল চৌধুরী আহনাফের পালিয়ে যাওয়ার কারনে আব্রাহামকে দোষারোপ করে। আমি সুযোগ বুঝে দুর্বল জায়গায় আঘাত করি। আব্রাহাম আমার জালে পা দিয়ে দেয়। আমি আয়াতের বাবাকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করাই। আয়াতের বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার সব কথা মেনে চলে। আমার কথা রাখতে, আর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। বিয়ের দিন আমি আর আহনাফ আব্রাহামকে তুলে নিয়ে যাই। ভেবেছিলাম সবাই আব্রাহামকে ঘৃণা করবে। কিন্তু আব্রাহাম এতিম বলে, সবাইকে মাফ করে দিল। তখন থেকেই আব্রাহাম আর সফিউল চৌধুরীকে মা*র*তে* চাইতাম। কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হতাম।

–তোমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছো। কিন্তু আমি আব্রাহাম ব্যর্থ হয় নাই। আর কারো জন্য মায়া লাগে না। এবার সবাই নিজেদের কর্মের ফল পাবার জন্য প্রস্তুত হও। কথা গুলো বলেই কাউকে ইশারা দিয়ে ডাকলো। আহনাফ নিজের করা ভুল গুলো কথা ভেবে আফসোস করতে লাগলো। সে এমন সময় এসে নিজরে ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পারলো। তার ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশ এসে, সফিউল চৌধুরী, আহনাফ, আরোহী, আর আয়াতের চাচাকে নিয়ে চলে গেল। তারা হাজার মাফ চাইলেও তাদের জন্য কারো মনে এতটুকুও মায়া তৈরি হলো না। আব্রাহামের আবরারকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তাই আবরারের কোনো ক্ষতি সে করল না। আবরার যেভাবে তার ক্ষতি করেছিল। ঠিক সেই ভাবেই আয়াতের বাবাকে বুঝিয়ে তার উপকার করেছিল। আব্রাহাম কারো ঋন রাখে না। হয়তো শোধ করে দিল। পুরো বাড়ি নীরবতাময় হয়ে উঠলো। আব্রাহামের খালা আব্রাহামের হাত ধরে অনেক কেঁদেছে। তবুও আব্রাহাম তাদের বাসায় থাকে নাই। সুখের সন্ধানে প্রেয়সীকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো।

সময় স্রোতের ন্যায় তাল মিলিয়ে চলে যায়। এর মাঝে কেটে গিয়েছে ছয়টি বছর। আজকে আব্রাহাম আর আয়াতের বিবাহ বার্ষিকী। আয়াত বার বার করে বলেছিল। আজ যেনো আব্রাহাম হসপিটালে না যায়। তবুও আব্রাহাম চলে গিয়েছে। সময় বদলে গেলে-ও আয়াতের অভিমান করাটা এখনো বদলায়নি। আয়াত মন মরা হয়ে বসেছিল। তখনই আয়াতের চার বছর বয়সী মেয়েটা এসে, আয়াতে কোলে বসে বলল।

–আম্মু তুমি মন খারাপ করছো কেনো?

–তোমার আব্বু অনেক পঁচা তাই। আমাদের একটুও ভালোবাসে না। দেখলে আমাদের কথা না, ভেবে আমাদের রেখে হসপিটালে চলে গেল।

–আমি আব্বুকে ফোন করে বলে দিব। তুমি আব্বুকে পঁচা বলেছো।

–এই তোকে আমি সারাদিন দেখে শুনে রাখি। খাইয়ে দেই। ঘুরতে নিয়ে যাই। আর তুই সারাদিন আব্বু আব্বু করিস কেনো?

–দেখতে হবে না মেয়েটা কার? আমার মেয়ে অবশ্যই আমার দলে থাকবে। আমার নামে বাজে কথা বলে, মেয়ের কান ভারী করা হচ্ছে। আব্রাহামের কথায় দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করল আয়াত। আয়াতকে রেগে যেতে দেখে, আব্রাহাম হাসতে লাগলো। আব্রাহামকে হাসতে দেখে পরীও হেসে দিল। আব্রাহাম ভালোবেসে মেয়ের নাম রেখেছে পরী।বাবা-মেয়েকে হাসতে দেখে আয়াতও হেসে ফেললো।

(সমাপ্ত)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here