#সোনাবউঃ
৭ম পর্বঃ
মোর্শেদা হোসেন রুবী
***************
গত কয়েকদিন ধরে বারান্দায় স্বর্ণাকে দেখা যাচ্ছেনা।সে একদমই আসেনা।আলিফকে দেখা যায় মাঝে মাঝে,বুয়াকে ঘর মুছতে দেখা যায় কিন্তু স্বর্ণাকে না।দরোজা জানালায় ভারী পর্দা দেয়া থাকে বলে ঘরের ভেতরটা দেখা যায়না।
মেরাজ ড্রয়ার খুলে বাইনোকুলারটা বের করল।গতকাল এটা কিনে এনেছে।চোখে লাগিয়ে রেঞ্জ -লেংথ সব সেট করে নিলো।মনটা আনন্দে নেচে উঠল।
বাইনোকুলারটা চোখ থেকে সরিয়ে তাকাল,কিছুই দেখা যাচ্ছেনা কেবল বাতাসে দরোজার পর্দা পতাকার মত উড়ছে।কিন্তু বাইনোকুলার চোখে লাগালেই পর্দার সামান্য ফাঁকা দিয়েও স্বর্ণাকে মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।মেরাজ জুম করে স্বর্নার ফেসটা ক্লোজ করায় মনে হলো স্বর্ণা ওর এক হাত দুরে বসে আছে,চাইলেই ধরা যাবে।প্রাণভরে স্বর্ণার নিষ্পাপ মুখখানি দেখে মেরাজ সিদ্ধান্ত নিলো, যে কোনো মূল্যেই হোক স্বর্ণাকে আবার তার হ্রদয়রাজ্যের শূন্য সিংহাসনে রাণীর আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।তাতে যা করা দরকার মেরাজ সব করতে প্রস্তুত।
……
আলিফের আজ কলেজ খুলেছে।ওকে নাস্তা খাইয়ে বিদদায় দিয়ে দুপুরের রান্না বসিয়েছে স্বর্ণা।এমন সময় বেল বাজলে আই হোল দিয়ে দেখে দরোজা অল্প খুলে বলল-“কে? কাকে চান?
-“ভাবী..আমিইই..ময়নার মা..চিনছেন গো ভাবীই…?”
স্বর্ণা গেটটা পুরোটা খুলে দিয়ে বলল-“ওহ্..ময়নার মা..কেমন আছেন?তা এদিকে কি মনে করে?”
-“কি মনে কইরা আহুম গো মা…আমগো মিরাজ বাইয়ের মনে কি যে অশান্তি…আহ্হা,চোখে দেইখা সহ্য হয়না।এই বউটা হেরে ফালাইয়া থুইয়া গেছেগা!”
স্বর্ণা মনে মনে চমকে উঠল,’মেরাজের বৌ জেসমিন চলে গেছে?”তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
.-“কি বলতে এসেছেন,সেটা বলেন ময়নার মা…আমার কাজ আছে!অন্যের খবরে আমার দরকার কি!””
-“ও.ও…..তা আপনার শাউরি কো?”
-“ঘুমিয়ে…কেন ডাকবো?”
-“আরে..না..না..না..না..আমি আপনের কাছে আইছি।”
বলে শাড়ীর আড়াল থেকে একটা খাম বের করে স্বর্ণার হাতে দিয়েই”যাইগা ভাবী” বলেই পগারপার।
স্বর্ণা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই খামের মুখ ছিড়ে বের করলো এক বিশাল পাতার চিঠি।
..
বুকটা ধ্বক করে উঠলো স্বর্ণার।এ যে দেখছি মেরাজের হাতের লেখা!ভুল দেখছে না তো?
প্রথম লাইনটা দেখল স্বর্ণা-“আমার সোনা বউ”দিয়ে শুরু করেছে।স্বর্ণা চিঠিটা না পড়ে একেবারে শেষ লাইনে চলে গেল দেখার জন্য যে চিঠিটা মুলতঃ কার! যা ভেবেছিলো তাই…শেষ লাইনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-“অপেক্ষায় থাকবো!”তোমার মেরাজ!”
……
…..
স্বর্ণার বুকে হাতুড়ীর বাড়ী পড়া শুরু হলো যেন।মনে হচ্ছে হাতে কোনো জাহান্নামের আগুনের তৈরী পাতা ধরে রেখেছে।ছি..ছি..সে অন্যের বিবাহিতা।আর এটা অনেক বড় গুনাহ যে সে পরপুরুষের লেখা পড়ছে।স্বর্ণার ভেতরে মেরাজের প্রতি অনুকম্পার চেয়ে আল্লাহভীতিটাই প্রবল হয়ে উঠল।সে যদি এই চিঠির একটি লাইনও স্বেচ্ছায় বা কৌতুহলবশতঃ পড়ে তবে সে পরকীয়ার মত ভয়াবহ পাপ এবং একজন জেনাকারীর গুনাহে লিপ্ত হয়ে যাবে।
যার দুনিয়াবী শাস্তিই হলো রজম।আখেরাতে তো আছেই!
স্বর্ণা দ্রুত হাতে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিলো!চিঠিটা ফেলার পর মনটা হালকা লাগলেও চিঠির প্রথম আর শেষ দুটো লাইন হ্রৎপিন্ডে আঘাত করতে লাগল।স্বর্ণার ভয় করতে লাগল,মেরাজ কি শুরু করেছে এসব!একজীবনে নিজের ঘরে কষ্ট দিয়েছে,আজ যখন সে সুখে স্বামীর সংসার করছে তখন সে কালবোশেখীর কালো মেঘের মত ওর জীবনাকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে এসেছে।স্বর্ণা সারাদিন ঠিকমতো কোনো কাজেই মন বসাতে পারলোনা!বুকের ধুকপুকানী এতটুকু কমেনি!
…..
….
মেরাজ ভোরে তো বটেই..রাতের অন্ধকারেও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে একটি নজর স্বর্ণাকে দেখার আশায়।কিন্তু ইদানীং ও বারান্দায় আসা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে।বিশেষ করে চিঠিটা পাঠানোর পর থেকে।মেরাজ ভাবনায় পড়ল,নাহ্..অন্য ফন্দি বের করতে হবে।
একা মনে বিড়বিড় করতে লাগল সে’-“তোমাকে না পেলে আমার জীবন মরুভূমিই থেকে যাবে সোনা…তুমি চলে আসো.. প্লিজ!”দুচোখ বন্ধ করে বিয়ের পরপরের দিনগুলির কথা ভাবতে লাগল মেরাজ।আহা!কি সুন্দরই না ছিলো সেই দিনগুলি!”
…..
আজ অনেক বছর পর মেরাজ শুক্রবারেরর জুম’আ পড়তে বেরিয়েছে।হঠাৎই ইচ্ছে হলো।নামাজ শেষে বেরিয়ে আসার পথে আলিফের সাথে দেখা হলো,আলিফ আরেকজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।মেরাজের অন্তর্দাহ বাড়ল-‘আমার শান্তির পায়রাটাকে নিয়ে গিয়ে নিজে সুখে বিভোর হয়ে আছিস,অথচ সে তো আমারই ছিলো..ভুল করে তোর কাছে চলে গেছে,আমার জিনিস আমার ফেরত চাই’ মনে মনে যখন এসব ভাবছে মেরাজ তখন আলিফকে চলে যেতে দেখে ধ্যানভঙ্গ হলো।দ্রুত পা চালিয়ে ওকে ধরল-“কি রে,একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস দেখি,দেখাই পাওয়া যায়না,তা আছিস কেমন?”
আলিফ সামান্য হেসে বলল-“ভালো!”
-“একদিন তোর বাড়ী যাবো ভাবছি..তোর বউর হাতে চা খেয়ে আসবো..কি বলিস!নিজে থেকে তো শালা ডাকবি না!”
-“চা খেতে ইচ্ছে হলে বল্,এখনি খাওয়াই,মানা তো করিনি..!” আলিফ সুচতুরভাবে উত্তরটা দিলে মেরাজ কিছুটা হকচকিয়ে গেল।তারপর বলেই বসল-“তবু বাড়ীতে নিবি না,বউ’র হাতে চা খাওয়াবিনা?”
আলিফ বুঝতে পারছে মেরাজ কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছে তাই সে অফেন্সকেই এখানে ডিফেন্স হিসেবে ব্যবহার করাটা ঠিক মনে করল,মেরাজের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে বলল-বন্ধু,তোর তো মাশাআল্লাহ..অনেক টাকা পয়সা,তুই কি সেগুলো জনে জনে ডেকে সিন্দুক খুলে দেখিয়ে বেড়াস?'”
-“নাহ্..তা কেন করবো..এটা কেউ করে নাকি?”
-“কেন করেনা,তা তো জানিস?”
-“অবশ্যই,জানবো না কেন? মানুষের কুদৃষ্টি পড়বে, লোভ জাগবে,বাড়ীতে চোর আসবে,হিংসুক তৈরী হবে…এটা না জানার কি আছে!আসলে এসব বলে তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস বুঝলাম না…!”
আলিফ মেরাজের হাতটা তখনো ধরে রেখেছে।এবার বাম হাতটাও ওর কাঁধে রেখে বলল-“প্রত্যেক মুসলমানের কাছে সবচে উত্তম সম্পদ হলো তার দ্বীনদার স্ত্রী’এটা আমার কথা না এটা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা।তাই আমার এত দামী সম্পদকে আমি জনে জনে দেখিয়ে বেড়ানো পছন্দ করিনা,সেটাকে সিন্দুকে লুকিয়ে রাখাটাই নিরাপদ মনে করি।আর কেউ সেটার দিকে নজর দিলে তার চোখ উপড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবোনা!” বলে সামান্য হেসে বলল-“যাই রে,অনেক কথা বললাম,মনে কষ্ট নিস না”!বলে আলিফ চলে গেলে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল।
….
শুয়ে বসে কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছেনা স্বর্ণা।কথাটা আলিফকে জানাবে কিনা তাও বুঝে উঠতে পারছেনা।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে এসেছে তখনি কপালে চুমুর স্পর্শে চোখ মেলে দেখল আলিফ চলে এসেছে।মাথা থেকে টুপি খুলে তা একপাশে রেখে দিয়ে বলল-“কি ব্যপার অসময়ে শুয়ে আছো যে?”
-“না..এমনিই!”
এমন সময় আলিফের মোবাইলটা বেজে উঠল।আলিফ ফোন ধরে সালাম দিয়ে স্বর্ণাকে ইশারায় জানালো যে ‘বাবা’ ফোন করেছেন!স্বর্ণা উৎসুক হয়ে বসে রইল।ফোন রেখে স্বর্ণার দিকে তাকালো-“বাবা ফোন করেছিলেন!”
-“হমম…বুঝলাম,কিন্তু কেন করেছিলেন তা তো বললেন না!”
-“তোমার ফুপাত বোনের বিয়ে,সামনের বৃহঃবার যেন তোমাকে নিয়ে দিয়ে আসি সেজন্য অনুমতি চাচ্ছিলেন!”
-“ওওহ্..তা আপনি কি বলেন,যাবো? ”
-” যেতে তো হবেই..আত্মীয়ের বিয়ে না? কিন্তু ঐ যে তোমাকে দুদিন আগে রেখে আসতে বলছে,ঐটাতেই তো সমস্যা!”
-“সমস্যা কেন?”
-“জানোই তো…তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা “!আলিফ স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল!স্বর্ণা মুখ নিচু করে ফেলল।
-“থাক্,একবারে বৃহঃবারেই রাতে যাবো,আগেভাগে যেয়ে কাজ নেই!”
-“বাসায় ওরা মাইন্ড করবেনা?”
-“করলে করুক,আপনাকে একা রেখে কোথাও যাবোনা..!”
-“প্রমিজ?”
স্বর্ণা আলিফের কাঁধে মাথা রেখে বলল-“প্রমিজ”!
আলিফ ঘাড় ফিরিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল-“চলো,ভাত দেবে,খুব খিদে পেয়েছে!”
-“ওহ্..স্যরি,স্যরি,চলুন!”
……
মায়ের ফোন পেল মেরাজ।ফোনেই মায়ের মুখে শুনল বৃহস্পতিবার মুনিয়ার বিয়ে।বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল মেরাজের।মনে পড়ল মুনিয়া স্বর্ণার ফুপাত বোন।ওর আর স্বর্ণার বিয়েতে মুনিয়ারা এসেছিলো। তারমানে স্বর্ণাদের পরিবার এ বিয়েতে থাকবে,জোর সম্ভাবনা স্বর্ণাও থাকবে।এইতো মোক্ষম সুযোগ মিলেছে।
এই দাওয়াত কিভাবে মিস করতে পারে মেরাজ?
……
চলবে……