সোনাবউ পর্ব ৮

#সোনাবউঃ
৮ম পর্বঃ
মোর্শেদা হোসেন রুবী
***************
মেরাজ আর স্বর্ণা পরস্পর সম্পর্কে দুরসম্পর্কের আত্মীয় হওয়াতে মুনিয়ার বিয়েতে দুজনই দাওয়াত পেয়েছে।মেরাজ খুব আগ্রহ করেই বিয়েতে এসেছে এবং তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলো স্বর্ণা।
সে নিজেকে স্বর্ণার ব্যপারে অধিক হকদার মনে করে এবং তার বিশ্বাস স্বর্ণা তাকে এখনো ভালোবাসে।
প্রথম স্বামী,প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা মানুষ ভুলতে পারেনা।কারন তারা শূন্য হ্রদয়ে এসে জায়গা করে নেয় বলে তাদের চলে যাবার পরও শক্ত ছাপ রেখে যায়।মেরাজের স্থির বিশ্বাস,স্বর্ণা ওকে ভোলেনি,মেরাজের বোকামীর ভুলে বেচারীকে অন্যের ঘর করতে হচ্ছে।মেরাজ শিঘ্রই ওকে সসম্মানে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনবেই আনবে।মেরাজের এমনটিই বিশ্বাস।
…..
……
বিয়ের দুতিনদিন আগে থেকেই মেরাজ মুনিয়াদের বাড়ীতে প্রচুর গিফট আর নাস্তাসহ আসলো।মুনিয়ার আম্মুতো যথেষ্ট খুশী মেরাজের এই বাড়তি আয়োজনে।কিভাবে মেরাজকে আপ্যায়ন করবে তিনি ভেবে পাচ্ছেননা।
মেরাজ স্বেচ্ছায় বিয়ের কিছু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলো।বরকে আংটি সে দিবে বলে মুনিয়ার মা’কে জয় করে নিল।
এতসব করার কারন একটাই এ বাড়ীতে তার প্রভাব বিস্তার করা।স্বর্ণার সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেতে হলে এবাড়ীতে তার একটা ইমেজ তৈরী করতে হবে, তারপর দরকার পরিবেশ!
..
মুনিয়াদের বাড়ীর প্রত্যেকটা সদস্য মেরাজের ব্যপারে তটস্থ হয়ে উঠল।সুযোগ বুঝে একদিন মেরাজ মুনিয়ার মায়ের কাছে স্বর্ণার প্রসঙ্গ তুলল।বিভিন্ন ভাবে নিজের দোষটাকে ভুলের মোড়কে ঢেকে নিজেকে ইনোসেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করার পূর্ণ চেষ্টা করল।সে নিজের ইচ্ছায় স্বর্ণাকে তালাক দেয়নি।একটা বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়ে..এবং মেয়েটি তার সম্পত্তির লোভে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে….ইত্যাদী নানান কথার ভাজে নিজের উগ্র-বদরাগী চরিত্রটাকে লুকিয়ে নিল মেরাজ।সে একথা বারবারই উল্লেখ করলো যে, তারই একটা ছোট্ট একটা ভুলের কারনে স্বর্ণা আজ নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন গোঁড়া ধার্মিকের ঘর করতে বাধ্য হচ্ছে।তার স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই,বোরকার ঘেরে বন্দী তার জীবন।মেরাজের এসব দেখে সহ্য হয়না।তাই স্বর্ণাকে সে স্বাধীন জীবন দান করতে চায়!
সব কথার শেষে বিনীত অনুরোধ জানালো,স্বর্ণাকে যেন তার সাথে একটিবার কথা বলবার মত পরিবেশ তৈরী করে দেয়া হয় যেন সে স্বর্ণাকে বোঝাতে পারে!

মুনিয়ার মা দুনিয়াবাদী মানুষ।ন্যায় -অন্যায়ের চেয়ে লাভ-লোকসানের হিসাবটা একটু বেশীই বোঝেন।তিনি এতে কোনো দোষের কিছু দেখলেন না,দুজনে কথা বলবে সমস্যা কি?
…..
বিয়ের দিন মেয়ের বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত মুনিয়ার আম্মু খুব ব্যস্ত ছিলেন।বিয়ে পড়ানো হয়ে যাবার পর তিনি স্বর্ণাকে আড়ালে ডেকে বললেন-“একটু সাহায্য করতে পারবি মা?”
-“জ্বী,বলুন?”
-“মুনিয়াকে সাথে দেবার জিনিসগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারছিনা,তুই আর সানিয়া মিলে একটু বাক্সটা গুছিয়ে দিতে পারবি?
-“খুব পারবো..!” বলে স্বর্ণা মুনিয়ার আম্মুর সাথে মুনিয়া সানিয়ার রূমে গেল।যাবার পথে আলিফের সাথে দেখা হলে ওকে জানালো সে মুনিয়ার লাগেজ গোছাতে সাহায্য করবে।আলিফ ওকে তীক্ষ্মচোখে জরিপ করে বলল-“বাইরের দিকে যেওনা কিন্তু…!”
-‘”বাইরে কি?আর তাছাড়া আমি বাইরে যাবো কেন?”
-“তা ঠিক,তবে তোমাকে দেখে আমারই মাথা ঘুরাচ্ছে..আমি চাইনা আর কারো ঘুরাক…আমি বাইরে আছি,লাগলে ফোন দিও!”
-“দেবো..!”
যাবার আগে আলিফ নিজের গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ইশারা করলো-“হবে নাকি একটা?”
স্বর্ণা চোখ পাকিয়ে তাকালে আলিফ হেসে সরে গেল।যেতে যেতে বলল-“আঁচল ঠিক করো!”
স্বর্ণা আঁচলটা খুব ভালো করে টেনে মুনিয়ার ঘরে ঢুকল।সানিয়া বড় লাগেজ আর একগাদা সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে।স্বর্ণাকে দেখেই হাফ ছেড়ে বলল-“উফ্,আমি সব গুলিয়ে ফেলছি স্বর্ণাপু..তুমি গুছাও!”
স্বর্ণা হেসে ঘোমটা সরিয়ে আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে বিছানায় উঠে পড়ল।বাম হাতের মোবাইলটা একপাশে রেখে দিল।তারপর হাঁটুগেড়ে উপুড় হয়ে সব জিনিসপত্র নিজের দিকে টেনে নিলো।তখনি খুট শব্দ হতেই তাকিয়ে মাত্র বলতে নিল-“সানিয়া,তুমি এগুলো আমাকে সামনে এনে দাও..কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল।ওর সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে আসল।গোটা দরোজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেরাজ।স্বর্ণা যে বেরিয়ে যাবে তার কোনো ফাঁকফোকড়ই সে রাখেনি।
স্বর্ণা মনে মনে রবকে ডেকে চলল-“ওগো,মাবুদ..তুমিই সম্মান দাও,তুমিই অপদস্থ করো।আজ এই গুনাহগার তোমার কাছে সম্মান ভিক্ষা চায়!তারপর বাম হাতে হাতড়ে মোবাইলটা তুলে নিলো হাতে।মেরাজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল-“মাই গড….তুমি এতো সুন্দর হলে কি করে সোনা?”
স্বর্ণা ঝট করে আঁচল কোমড় থেকে ছুটিয়ে দ্রুত বড় করে ঘোমটা দিয়ে ঘুরে মেরাজের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো।বাম হাতে কাঁপতে কাঁপতে আলিফের নম্বরটা হাতড়াতে লাগল।নম্বরটা এসেও মিলিয়ে গেল।পেছন থেকে মেরাজ বলছে-“দুচোখ ভরে তোমাকে দেখতেও দেবেনা?”
তখনই আলিফের নম্বরটা এসে যাওয়ার সাথে সাথে সেন্ড বাটন পুশ করল স্বর্ণা আর মনে মনে বলতে লাগলো,আল্লাহ্,ও যেন দ্রুত ধরে….! ”
স্বর্ণা মোবাইলটাকে সাবধানে শোকেসের ওপরে রাখল।তারপর মেরাজকে বলল-“সরুন,আমাকে যেতে দিন!”
-“তোমার সাথে খুব জরুরী কথা ছিলো জান্..!”
-“আপনি আমার জন্য পরপুরুষ,আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারেনা!”
স্বর্ণা ঘোমটার আড়াল থেকেই চারদিক তাকাল,মেরাজের ভাবগতিক ভালো না,আত্মরক্ষার জন্য কিছু একটা হাতে থাকা দরকার।মেরাজের এগোনোর শব্দে চট করে লাগেজ থেকে নেইল কাটারটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-“খবরদার,আর এক পাও এগোবেন না..ভালও হবেনা,আল্লাহকে ভয় করুন।খবরদার বলছি..!” স্বর্ণার দুচোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছে।
বাম হাতে ঘোমটা ধরে রেখেছে ডান হাতে নেইলকাটার।মেরাজ ওর বালখিল্যতা দেখে হাসলো-“তুমি এখনো সেই মিষ্টি মেয়েটিই রয়ে গেছো!”!
-“চুপ করুন,দরজা ছাড়ুন,আমি যাবো,আমাকে যেতে দিন!”
-“হেই..হেই..তুমি আমাকে রেপিষ্ট ধরে নিয়েছো নাকি? আই উওন্ট টাচ্ ইউ আ সিঙ্গেল মুমেন্ট।তোমার সাথে এমনটা আমি করতে পারিনা,জান্,আমি তো তোমার সাথে দাম্পত্য খেলা খেলতে চাই,প্লিজ, আমার কাছে ফিরে এসো,ঐ আলিফ তোমার উপযুক্ত না,তোমার দরকার আমার মত…!”
-“খবরদার”আমার স্বামীর নামে একটা বাজে উচ্চারন করবিনা,তুই তার নখেরও যোগ্য নস..!দরোজা..খোল্,বলছি!”
-“রিল্যাক্স,এতো এক্সাইটেড হয়োনা, দরজা তো খুলবোই।তার আগে গোটা বিয়ে বাড়ী জানুক যে,তুমি আমার সাথে এক কামরায় দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ ছিলে।তোমার সংসার ভাঙ্গার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট,তারপর তোমার জন্যে তো আমিই আছি!”
স্বর্ণা কাঁদছে।এমন সময় দরোজায় টোকা পড়লে মেরাজ হাসিমুখে দরোজা খুলতে গিয়েও নিজের চুলগুলোকে দুহাত দিয়ে এলোমেলো করে নিল।তারপর দরোজা খুলে সরতেও পারলোনা তার আগেই চোয়াল বরাবর প্রকান্ড মুগরের বাড়ী পড়লো যেন।মেরাজ পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখল আলিফ ঘরে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দিচ্ছে।স্বর্ণা দৌড়ে গিয়ে আলিফের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।আলিফ ওকে এক হাতে ধরে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল-“একটু সরে দাঁড়াও,জানোয়ারটাকে আগে একটু শায়েস্তা করে নেই..!”
-“না..আলিফ..প্লিজ চলো এখান থেকে!”

আলিফ মেরাজের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে স্বর্ণার মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে বলল-“জীবনে মানুষ হলিনা..!সারাজীবন স্বর্ণার কাছে পশুরূপে বেঁচে থাকবি।নিজের সম্মানটা নষ্ট করলি।তোর ভাগ্য ভালো এটা বিয়েবাড়ী নইলে আমার বউয়ের দিকে কুনজর দেবার জন্য তোর চোখ আমি ঠিকই উপড়ে ফেলতাম,কুলাঙ্গার কোথাকার।”
বলে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে গেল আলিফ।মেরাজ মুখে নোন্তা স্বাদ লাগায় দাঁতে হাত দিয়ে দেখলো হাতে রক্ত।…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here