স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-০৬||
টোয়া আমাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই আমি শান্ত হতে পারিনি।ফুঁপাতে ফুঁপাতে একদম বেহালিশ হয়ে যাই। টোয়া দিকবিদিকশূন্য হয়ে আমাকে নিয়ে সোঁজা বিছানার উপর বসায়।পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্থির অস্থির গলায় বললো,
“কী হয়েছে তোর?আমাকে খুলে বল?হঠাৎ কেন কাঁদছিস তুই?”
আমি চুপ হয়ে যাই।টোয়াকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে মুখ দিয়ে শব্দ বের হয়নি।শুধু নিস্তব্ধ হয়ে অসাড়ভাবে বসে থাকি।টোয়া বার কয়েক আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও যখন আমার থেকে উত্তর পায়নি তখন সে একপ্রকারে হাল ছেড়ে দেয়।তারপরও আমাকে স্বাভাবিক করতে কতই না চেষ্টা,
“সব ঠিক হয়ে যাবে,সানা।মন খারাপ করিস না।আল্লাহ ভরসা।আল্লাহই পাশে আছেন।”
বলেই খানিক থামে।তারপর চিবুকে আলতোভাবে ধরে চোখের পানি মুছে দেয়।মৃদু গলায় বললো,
“কফি করে দিই?”
আমি দু’পাশে মাথা ঝাঁকাই।
“অন্যকিছু বানিয়ে দিই?”
আবারও দু’পাশে মাথা ঝাঁকাই।টোয়া ব্যর্থ হয়ে বললো,
“তাহলে শুয়ে পড়।শরীরটা হালকা হবে। ”
আমি স্থির দৃষ্টিতে টোয়ার দিকে তাকাই।সে জবাবের অপেক্ষা না করে উঠে যেয়ে বাতি অফ করে।ফিরে এসে বিছানা কিণার থেকে একটা বালিশ টেনে এনে বললো,
“এভাবে বসে থাকলে মন আরো খারাপ হবে,বুঝলি?ঘুমালে কিছু মনে পড়বে না।শুয়ে পড়।”
আমি টোয়ার কথায় সম্মতি দিয়ে বাধ্যমেয়ের মতো গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ি।
সকালে খুব দেরী করে আমার ঘুম ভাঙ্গে।যখন চোখ মেলি তখন বুঝতে পারি অনেকটা বেলা হয়ে গেছে।টোয়া রুমে ছিল না।সে অনেক আগেই উঠেছে হয়তো।আমি কাচুমাচু দিয়ে বিছানা থেকে নামি।তারপর বাথরুমে যেয়ে মুখে কয়েক ছিটকে পানি ছিটিয়ে ফ্রেশিং কাজটা সেরে বাইরে আসি।চেয়ারের হাতল থেকে টাওয়ালটা নিয়ে হাতমুখ মুছে তারপর একটু বেলকনির দিকে যাই। বাইরে ঝলমলে রৌদ্দুর পরিবেশ।পাখিরা চারপাশে কিচকিচ করছে।দূর বহুদূর থেকে মানুষের গুঞ্জন, গাড়ির হর্ণ,সাইরেনের শব্দ আসছে।ঘড়ি না দেখলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি এখন বেলা দশটা বৈ-কি!
তবে এত বেলা করে ঘুম থেকে কেন উঠলাম আমি?কালরাত ঠিকমতো ঘুম হয়েছে ত আমার?নাকি ঘুমের ভানে সারারাত তন্দ্রাচ্ছন্ন কেঁটেছে!টোয়ার কন্ঠস্বরে আমার ভাবনার ছেদ ঘটে।পেছনে তাকিয়ে টোয়া মোবাইল হাতে দাড়িয়ে।কিছু বলার আগেই টোয়া বললো,
“কখন জেগেছিস ঘুম থেকে?”
আমি ধীরস্থির গলায় জবাব দিই,
“কিছুক্ষণ হলো।”
টোয়া গালে আলতো হাত রেখে বললো,
“কালরাত তোর যে অবস্থা হলো আমি খুব ভয় পেয়েছি।আকাশকেও না জানিয়ে পারি নি।তোর অবস্থার কথা শুনে সেও অস্থির হয়ে যায়। রাত থেকে ওর কলের উপর কল।এখনো কল করছে।এই নে কথা বল ওর সাথে।”
বলেই মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ক্ষীণ চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি।আর টোয়ার উপর খানিকটা রাগও হতে থাকে!কি দরকার ছিল ওকে আবার এ’কথা জানানোর!?এখন আবার কি থেকে কি জিজ্ঞেস করে!
ভেবেই গলায় একটা খাঁকারি টানি।দৃঢ়তা বজায় রেখে বললাম,
“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো খুবই অস্থির এবং চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠস্বর।বললো,
“সানা তুই ঠিক আছিস ত?কি হয়েছে তোর?কেউ তোকে কিছু বলেছে? কান্না করলি কেন ?কেন কান্না করলি? বল।”
কতগুলো প্রশ্নবিদ্ধের মুখে এখন আমি!কি জবাব দিব? কি উত্তর হবে এ প্রশ্নগুলোর?সত্যটাই কি বলব?বললে ত আমার মান-সম্মানের প্রশ্ন!নিমিষে চোখবুঁজে আসে আমার।
তবে!নাহ কিছুতেই সত্যটা বলা যাবে না।ভেবেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম,
“এখানে এসেছি আজ অনেকদিন হলো ত তাই হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।তাই আর কি খানিকটা মন খারাপ হয়েছে।”
“মিথ্যে বলছিস তুই।এমন একটা বিষয়ের জন্যে কেউ এভাবে ভেঙে পড়ে না।কেন মিথ্যে বলছিস আমাকে!খুব অস্থির লাগছে আমার।কালরাত থেকে আমার চোখে এক ছিটেকও ঘুম আসে নি।বিশ্বাস কর তুই!সত্যিটা বল,প্লিজ সানা!”
“আকাশ আমি মিথ্যে বলছি না।তাছাড়া, তোর থেকে সত্যটা লুকিয়ে আমার কি লাভটা হবে!”
“বুঝলাম।কুমিল্লায় দুপুরেই ত ব্যাক করছিস,না?”
“দুপুরের আগেই ব্যাক করার চিন্তাভাবনা করছি।”
“দুপুরের আগে!আর আমার সাথে দেখা!”
“আকাশ দেখা মনে হয়না করতে পারবো।”
“কেন?”
“আমার এখন বেরুতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“তাহলে আমি তোদের বাসার নিচে আসছি।রাখ।”
“এই না না!আকাশ কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবার!”
কথাটি বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে কেটে যায়।আকাশের কল কাটায় আমার ভেতরে কিছুটা ধাক্কা লাগে। এখানে আসতে অস্থির হয়ে কল কেটেছে নাকি আমার কথায় রাগ হয়ে কল কেটেছে তার কারণ আমি জানি না!
তবে জানতে কেনজানি ইচ্ছে হয়নি।ফোনটা সুন্দরভাবে আবার টোয়ার হাতে দিয়ে দিই।তারপর বললাম,
“রেডি হয়ে নে।বাসায় যাবো।”
বলেই বিছানার উপর রাখা জামাকাপড়ের ব্যাগের দিকে এগিয়ে যাই।
আমার কথায় টোয়া খানিকটা চমকায়!খুব অবাক হয়ে বললো,
“আর আকাশের সাথে দেখা!?”
আমি হাঁটার মাঝে থেমে যেয়ে টোয়ার দিকে ফিরে বললাম,
“কাল রাতে দেখা হলো।আজ না হলে অসুবিধে নেই।”
“ওটা ত আকস্মিক! আকস্মিক আর ফিক্সড টাইম ত এক নয়!”
“কথা ছিল কি-দেখা করা।দেখা হলো।সো আকস্মিক আট ফিক্সড কোনো কথা নয়।”
বলেই আমি আমার ব্যাগ হাতে নিয়ে জামাকাপড় গুলো গোছাতে থাকি।টোয়া আমার কথার উপর কথা বলতে আর ভাষা খুঁজে পায়নি।চুপ হয়ে যায়।সে হয়তো ভাবেওনি আমি এমন কিছু বলব!
বেলা বারোটার দিকে আমি এবং টোয়া যাত্রাবাড়ী বাস কাউন্টারে আসি।আমি কাউন্টার থেকে দুটো টিকিট নিয়ে ওয়েটিং রুমে যাই।টোয়া তার ব্যাগটা পাশের সিটে রাখতে রাখতে বললো,
“তখন একটা মেসেজ টোন এসেছিল।কে যেন মেসেজ করেছে।”
“দ্যাখ কে করেছে।”
“হু দেখতেছি।”
বলেই টোয়া ব্যস্ত হয়ে যায় ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতে।তারপর মোবাইল বের করে এনে অন করে দেখলো আকাশের মেসেজ।টোয়া মেসেজটি পড়ে কিছুটা হতাশ হয়।আর হতাশের কারণ আমার জন্যেই।আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আকাশ বললো-সেইফ জার্নি।তোর দিকে খেয়াল রাখতে।
বায় দ্য ওয়ে,মেসেজ করে এ’কথা আমায় বললো,তবে বলার ত উচিত ছিল সে নিজেই তোকে!ঝগড়া করলি নাকি?”
“এমনিতে।বললো দেখা করতে।আমি করতে চাইনি সেজন্যে।বাদ দে এমন ঢং ঢাং।এমন ঢং ঢাং সহ্য হয় না।আচ্ছা,উঠ মনে হয় বাস আসার সময় হয়ে গেছে।”
বলেই দাড়িয়ে যাই।তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে টোয়াকে সঙ্গে করে রাস্তার কিণারে এসে দাড়াই।আর দিকে দিকে গাড়ির আসার দিকে তাকাই।একটা মুহূর্তে বাস চলে আসে।বাসে উঠি।সিট খুঁজে নিয়ে জায়গায় বসি।কিছুক্ষণ বাদে বাস ছেড়ে দেয়।তরতর বাস চলতে থাকে তার আপন গতিতে।আর আমি ক্লান্ত,ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাথা এলিয়ে দিই সিটে।চোখ বুঁজে আনতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাল রাতের বিষন্ন মাখা সেই স্মৃতিপট।
ভাবলাম আকাশ দেখা করতে আসবে।আসে নি।কল করেও খোঁজ নেয়নি।
টোয়াও আমার উপর খুব অভিমান করে আছে কাল রাতের সেই বিমর্ষ কাহিনীর কথা না খুলে বলাতে!
আচ্ছা,সবার অভিমানের বিলাপে আমার কষ্টের ছাপ গুলো শুধুই ছাপা পড়ে যাবে?নাকি নিবৃত্তে নিজের কাছে চেপে রাখলে এমনটা কষ্ট পেতে হবে!.
চলবে…
(ইদানীং কেনজানি লিখতে পারছি না।লিখার জন্যে মানসিকতা হচ্ছে না!বুঝি না কেন এমনটা হচ্ছে!তারপরও চেষ্টা করছি!)