#স্বপ্ন_সারথী (দ্বিতীয় পর্ব)।
মাতৃত্বের আস্বাদ পেতে যাচ্ছি, সংবাদটা মুহূর্তেই নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। নিজ শরীরে অনাগাত সন্তানকে ধারন করে আছি, ভাবতেই প্রতি মুহূর্ত শিহরিত হই। হঠাৎ করেই নিজেকে অনেক পরিনত বলে আবিষ্কার করলাম। আর সবচাইতে খুশি হলাম, রাশেদকে আনন্দে ভাসতে দেখে। পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ সম্ভবত এখন রাশেদই। সারাক্ষণ হাসি খুশি মুখে একটা চিন্তার ভাজ, পিতৃত্বের প্রস্তুতি ও দ্বায়িত্বে থাকা ব্যস্ত একজন। চাকুরীর শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু পর পর আমার খোঁজ নেওয়া, অনাগত সন্তানকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন গল্প। অনুভূতি গুলো আজীবনের সুখ স্মৃতি হয়ে আছে।
আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডটা কিন্তু মোটেও মসৃণ ছিলো না। শুরু থেকেই নানান শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো, যার সরাসরি প্রভাব পড়লো অনার্সের পরীক্ষাগুলোতে। এমনিতে প্রতি পরীক্ষার আগে আগে আমি হলে উঠে যেতাম, শামসুন্নাহার হলে সহপাঠীদের সাথে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অন্য রকম একটা আনন্দও ছিলো। কিন্তু শারীরিক অবস্হার বিবেচনায় সেবার খিলক্ষেতের বাসা থেকেই পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কোন এক পরীক্ষার আগের রাতের কথা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারিনি, চিন্তিত রাশেদ সারারাত আমার পাশে। সকালে পরীক্ষা দিবো কি দিবো না, দোলাচলে। রাশেদের দেওয়া অভয় আর সাহসেই শেষ পযর্ন্ত পরীক্ষা হলে চলে এলাম। দৌড় ঝাপ করে শিক্ষকদের সহায়তায় সিক বেডে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্হাও করলো রাশেদ। একটু পর পর বমি, একটু রেস্ট আবার পরীক্ষার খাতায় লেখা। ঐ দিনের কথা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি। এভাবেই সেবারের বাকি পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম নিজের সাথে একরকম যুদ্ধ করেই।
ও আপনাদের আরেকটা কথা জানিয়ে রাখছি, মানসিক শক্তি যোগাতে পরীক্ষা চলাকালীন পুরো সময়টাতেই কিন্তু রাশেদ ছুটিতে ছিলো। সত্য বলতে কি, ওর সার্বক্ষণিক উপস্হিতি ও সাপোর্টের কারণেই পরীক্ষাগুলো শেষ করতে পেরেছিলাম। আর অনার্সের রেজাল্টও কিন্তু শেষ পযর্ন্ত খুব খারাপ হয়নি। আমার জীবনের আরেকটা স্বপ্ন পূরণ হলো। আর এভাবেই রাশেদ সারথী হয়ে পাশে থেকে গেলো মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত।
অনার্স পরীক্ষা শেষে পড়াশোনার চাপ ছিলো না বলে অনাগত সন্তানের যত্নে নিজেকে সময় দিতে পারছিলাম। নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সিএমএইচে রুটিন চেকআপে নিয়মিত যেতাম, রাশেদের হাত ধরে। প্রেগন্যান্সির ঝুঁকিপূর্ণ প্রথম তিন মাস কাটিয়ে উঠার পরের চেকআপেই দুঃসংবাদ পেলাম, গর্ভকালীন ডায়াবেটিকস। খবরটা শুনে আমার চাইতে মনে হয় বেশি দুঃখ পেয়েছিলো রাশেদ। বেচারা হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার আর ডাইটেশিয়ানের সাথে দফায় দফায় কনসালটেশনে। আমার জন্য ডায়েট চার্ট তৈরী, ইনসুলিনের ডোজ আর এগুলোর সময়মতো প্রয়োগ সবকিছু মনিটরিং করে গেলো ডেলিভারির আগ পযর্ন্ত।
সৈনিকদের চাকুরীর এই একটা সমস্যা, যখন তখন বদলির আদেশ। ডেলিভারির মাস দুয়েক আগে হঠাৎই ওর যশোর সেনানিবাসে বদলি, আমার জন্য দুঃসংবাদ হয়ে এলো। যদিও সাথে আরেকটা সুসংবাদ ছিলো, রাশেদের মেজর পদে প্রমোশন। স্ত্রীকে এ ভাবে রেখে সে কিছুতেই নতুন কর্মস্হলে যাবে না, আড়ালে মা কে বলেছে আর্মির চাকুরী থেকে না কি ইস্তফা দিবে! বাসায় যখন এসব ইত্যাদি ইত্যাদি নাটক চলছে, আমি শান্ত মাথায় দুশ্চিন্তা না করে চাকুরীটা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। আর তার বাদেই ভীষণ মন খারাপ করে ওর যশোর যাওয়া। সে রাতের কথা আজো আমার মনে আছে, জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো অনেকক্ষণ।
এখনকার মতো সে সময়টাতে ফোনে ফ্রি অডিও ভিডিও কল করার কোন অপশন ছিলো না। রাশেদ তারপরও বলতে গেলে কাজের সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণই আমার সাথে ফোনে যুক্ত। আর প্রতি সপ্তাহে ঢাকা যশোর দৌড়াদৌড়িতেও ওর একটুও ক্লান্তি নেই।এবার সে সময়টাতে আমার অন্য আরেকটা স্বপ্ন পূরনের গল্পের কথা আপনাদেরকে জানাবো, যেটাও কিন্তু রাশেদের হাত ধরেই পাওয়া।
ছাত্র জীবনে আমি বরাবরই মেধাবীদের একজন। উদয়ন স্কুলের প্রথম দিককার ছাত্রী, বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে স্কুল বা পরবর্তীতে কলেজে শিক্ষকদের বাড়তি মনোযোগ পেয়েছি। গনিতে পারদর্শী ছিলাম বলে, বাবার মতো শিক্ষকদেরও আশা ছিলো বুয়েটে ভর্তি হতে পারবো। কিন্তু বুয়েট ভর্তি স্বপ্ন ভঙ্গের পর আর সাইন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথে হাটি নি। আইআরে ভর্তি হয়ে করা এই পড়াশোনাটাতে আমার চাঁপা কষ্ট আছে, ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় থাকা মেধাবী রাশেদ কিন্তু সেটা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলো।
রাশেদের অনুপ্রেরনাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ য়ের এমবিএতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখলাম। নিজের সম্পর্কে আমার ভাবনা যখন তলানিতে, ঠিক সেই সময় রাশেদ আমার প্রজ্ঞা, মেধা বা লিডারশিপ স্কিলসের প্রশংসায়। ওরই বন্ধু শামস ভাই তখন আইবিএয়ের ফাইনাল সেমিস্টারের ছাত্র। ভাইয়া আমার প্রেগন্যান্সি কালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিন বাসায় এসে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করতেন। শামস ভাই আগে থেকেই ভর্তি কোচিংয়ের সাথে জড়িত, পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখেন। আর সর্বোপরি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আগে থেকেই থাকা আমার দক্ষতায়, প্রথম বারেই আইবিএতে ভর্তির সুযোগ মিলে গেলো।
আমার প্রথম সন্তান জন্মের সপ্তাহ দুয়েক আগে পাওয়া এই অর্জনটা অন্যরকমভাবে আত্মবিশ্বাস দিয়ে গেলো। আমার পক্ষেও অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব, রাশেদের বহুদিন ধরে দিয়ে যাওয়া উৎসাহের এই বাস্তব ফলাফল অনুপ্রেরণার। পরিবার পরিজন বা স্বজনদের সবাই এক বাক্যে বলতে লাগলো ” সাদিয়াতো আইবিএতে চান্স পাবেই, ও তো ছোটবেলা থেকেই তুখোড়”। জীবনের কঠিন সময়ে, নিজের ভিতরের সেরাটা বের করে আনতে পারার পুরো কৃতিত্বটা অবশ্য আমি সবসময় রাশেদকেই দেই। সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর স্ত্রীদের যে কোন সাফল্যে স্বামীর অবদান সিংহ ভাগ। আর আমার ক্ষেত্রে রাশেদের কনট্রিবিউশন একটু বেশিই।
এবার মূল গল্পে ফিরি, আমার বড় কন্যা “রাইসা” জন্মের মুহূর্তের সময়টা থেকে। প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টাতে সতর্কভাবে বাসাতেই কাটিয়েছিলাম। নিয়মিত চেকআপ আর সঠিক চিকিৎসায় বড় কোন সমস্যা না হলেও শেষ মুহূর্তে এসে জটিলতার শুরু। বাচ্চার তেত্রিশ সপ্তাহ বয়সের কমপ্লিকেশনটায় অস্ত্রোপচারে যেতে হলো, জরুরী নোটিশে।
হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে যাওয়া এই আমাকে গভীর রাতে এম্বুলেন্সে করে খিলক্ষেত থেকে সিএমএইচে নিয়ে আনা হলো। রাশেদও তখুনি যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। উদ্বিগ্ন রাশেদ পুরোটা পথ কলিগ, হাসপাতাল স্টাফ আর স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে যায়। ভোরে পরিমরি করে হাসপাতালে এসে আমার পাশে সদ্যজাত কন্যাকে দেখে রাজ্যের বিস্ময়ে। আমার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। এরপর রাইসাকে অনভ্যস্ত হাতে ভয়ে ভয়ে ভীষণ যত্ন নিয়ে যখন কোলে তুলে নেয়। “বাবার হাতে সদ্যজাত সন্তান” পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যটা উপভোগ করলাম প্রাণভরে।
কাহিনীটাকে এখন একটু দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। রাইসা জন্মের পর আমার আর রাশেদ, দুজনের জীবনেই অনেক পরিবর্তন। রাইসাকে কেন্দ্র করেই যেনো আমাদের জীবনের চাকা। তবে আইবিএতে এমবিএ শুরু করা, সাথে নবজাতক। আমার জীবনটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠলো। স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় শেষ পযর্ন্ত দুটোই সামাল দিতে পারলাম, বেশ ভালোভাবেই। যদিও এমবিএ একটু সময় নিয়েই শেষ করলাম, সংসার আর পড়াশোনাকে ব্যালেন্সড রাখতে। এমবিএয়ের ফাইনাল সেমিস্টারে এসে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেগন্যান্ট হওয়ার সংবাদ, সবাইকে আবারো খুশির জোয়ারে ভাসালো।
সত্য বলতে কি, আমার দ্বিতীয় সন্তান জারার জন্মের সময়টাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। রাশেদ মিরপুরে স্টাফ কলেজের কোর্সে ছিলো বলে পুরো সময়টাতে ওকে পাশে পেয়েছিলাম। জারার জন্মে এবার সবচাইতে বেশি খুশি হলো সম্ভবত ওর বড় বোন রাইসা। তিন বছরের অতটুকুন বাচ্চা সারাক্ষণ বোনকে আদরে রাখে, সেই থেকে আগলে রেখেছে আজো পযর্ন্ত।
আমাদের পরিবারের এরপরের গল্পটা আর আট দশটা সাধারণ পরিবারের মতোই। দুই বাচ্চা দেখভালের পাশাপাশি আমাদের দুজনের ক্যারিয়ার চালিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। রাশেদ চৌকস মেধাবী অফিসার, বরাবরই বসদের সুনজরে। আর আমিও এমবিএ শেষ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ব্যস্ত পেশাগত জীবনে।
রাশেদের মৃত্যুর পর আমার একটা বড় আফসোস এখনো তাড়া করে, ঢাকার বাইরে কোন সেনানিবাসে ওর সাথে গিয়ে সংসার করতে না পারা। নিজের পড়াশোনা, বাচ্চা বা ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আমি আগাগোড়া ঢাকাতেই থেকে গেছি। যার ফলে আমাদের বিয়ের বয়স বারো বছর হলেও, বহুদিন আমাদের আলাদা থাকতে হয়েছে।
রাইসার বয়স তখন নয় আর জারার ছয়, দুজনেই ঢাকা সেনানিবাসের নামী একটা স্কুলে। আমি চাকুরীতে ব্যস্ত এক্সিকিউটিভ পদে। রাশেদ লেঃ কর্নেল হিসেবে বান্দরবানের আলীকদমে একটা ব্যাটেলিয়ানের দ্বায়িত্বে। আমাদের পরিবারে চারদিক থেকে তখন শুধুই সুখের সংবাদ, রাশেদের নামে ডিওএইচএসের একটা প্লটও বরাদ্দ হয়েছে। সুন্দর একটা বাড়ি তৈরী করার স্বপ্নে আমরা বিভোর। ঠিক ঐ সময়টাতেই একটি দূর্ঘটনা পুরো পরিবারকে তছনছ করে দিয়ে গেলো।
দু হাজার বারো সালের তেইশে অক্টোবর, এক দূর্যোগময় রাতে কিছু পাহাড়ি দূষ্কৃতিদের তাড়া করে ক্যাম্পে ফেরার পথে রাশেদকে বহন করা জীপটা পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। রাশেদ সহ অন্য একজন সৈনিক ঘটনাস্হলে নিহত, জিপের ড্রাইভার সহ বাকি তিনজন আরোহী গুরুতর আহত। সবাইকে দ্রুত হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলেও, ইতোমধ্যে রাশেদের মৃত্যুটায় নিশ্চিত ছিলো উদ্ধারকারীরা।
রাত দুটোর দিকে যখন মৃত্যু সংবাদটা পাই, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। খানিকক্ষণ বাদে ধাতস্হ হতেই জোর একটা চিৎকার দিলাম। রাইসা আর জারা দুজনেই হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে ভয়ার্ত চাহনীতে। আমি নিশ্চিত মেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরে আমার করা কান্নাটায় সেদিন আরশ কেঁপে উঠেছিলো।
()