#স্বপ্ন_সারথী (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)
স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু সংবাদ, আমার ভিতরে যে কি পরিমাণ তোলপাড় করেছিলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বারবার নিজেকে প্রমাদ দিয়ে গেলাম, ভুল শুনেছি বা কথাটা আদৌ সত্য নয়। স্ট্রং ডিনাইয়ালে। জোর চিৎকার করে বুক ফাটা কান্নাটায় কিন্তু সেদিন আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। এক অজানা আতংকে ভয়ার্ত দুটো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। মেয়ে দুটো যে সত্যই দূর্ভাগা। এতো ভালো একটা বাবাকে ওরা অল্প বয়সেই হারিয়ে ফেললো। আর মনের মধ্যে আশংকাটা উকি দিয়ে যাচ্ছে, পারবো কি রাশেদকে ছাড়া বাকি জীবন পাড়ি দিতে?
রাশেদের মৃত্যুটা মুহূর্তেই টক অব দ্যা কান্ট্রি। যদিও আর্মি হেড কোয়ার্টার প্রথম থেকেই খুব সতর্ক, মিডিয়ায় সংবাদটা যেনো অতিরঞ্জিত না হয়। রাত অনেক গভীর হলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই নানান লোকজনে সমাগম হতে লাগলো খিলক্ষেতের এই বাসাটায়। আমার অবশ্য মিডিয়ার সাথে কেনো, আপনজনের সাথেও কথা বলার অবস্হা নেই।
“আমি রাশেদের কাছে যাবো, আমাকে তোমরা রাশেদের কাছে নিয়ে যাও।” কেঁদে কেঁদে করা আমার এই অনুরোধটায় সবার নির্বাক দৃষ্টি, আমার কান্নার মাত্রাটাকেই বাড়িয়ে দিয়ে গেলো। সে রাতে অনেক লোকজনের উপস্থিতি থাকলেও, সবাই পিনপতন নীরবতায়। রাশেদের অস্বাভাবিক মৃত্যুটাকে কেউই মেনে নিতে পারলো না।
ছেলের অকাল মৃত্যুর সংবাদটা আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই নিতে পারলেন না। একমাত্র ছেলের শোকে শাশুড়ি বিছানা নিলেন আর শ্বশুরকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। উচ্চ রক্তচাপের রোগী রাশেদের বাবা খানিকক্ষণ পর পরই মূর্ছায় যাচ্ছেন। আর এভাবেই একটা সুন্দর সুখী গোছানো পরিবারের উপর দিয়ে হঠাৎ বয়ে যাওয়া ঝড়, একেবারে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে ফরমালিটিজ শেষ করে ভোরের মধ্যেই লাশ ঢাকায় আনা হয়। সকালের মধ্যে আর্মির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্হার লোকজনের এই বাসায় জমায়েত। আমাদের অবস্হা দেখে কেউই অবশ্য স্বান্তনা দেখানোরও সাহস পেলো না। একটা অসহায় পরিবারের কান্নায়, ভীষণ শক্ত হৃদয়ের লোকটিও আড়ালে চোখ মুছে গেলো।
রাশেদের লাশটা বাসাতে আনতেই প্রথমবারের মতো বিশ্বাস হলো ও আর নেই। আশ্চর্য হলেও সত্য লাশের খাটিয়াটা দেখার পর থেকেই আমার কান্নাটা থেমে যায়। পরম ভালোবাসা নিয়ে ওর মুখটা দেখতেই অন্য রকমের একটা সাহস পেয়ে গেলাম। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও যে আমাদের কথা মনে করছিলো, মুখ খানা দেখে নিশ্চিত হলাম। অভয় দিয়ে যাওয়া স্মিত হাসি।
রাশেদ চলে গেলেও, এভাবেই জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাহসটা দিয়ে যায়। একটা মৃত মানুষও যে কতোটা শক্তিশালী হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই রাশেদ। ওর মৃত্যু শোকটা মুহূর্তেই আমার মধ্যে শক্তিতে রূপান্তরিত, অজান্তেই। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে বাবা নিজের জীবন দিয়েছে, মেয়ে দুটোর মতো আমরাও ওর অবদানের জন্য আজীবন গর্বিত।
রাশেদের হঠাৎ এই চলে যাওয়াটাতে আমরা যতোই কষ্ট দুঃখ বা বিপদে থাকি কি না, এরপর জীবন কিন্তু চলতে লাগলো জীবনের নিয়মেই। পুরো দেশের শিরোনাম হয়ে বীরের মর্যাদায় সামরিক কবরস্হানে সমাহিত হওয়া রাশেদের কথা অল্পদিনের মধ্যেই সবাই ভুলে গেলো, শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারটি ছাড়া। সরকার বা সেনা দপ্তর থেকে নিয়ম মাফিক সাহায্য সুবিধা বা ক্ষতিপূরণ ছাড়া আমরা আর কারো কোন সহায়তা পাইনি। সত্য বলতে কি, আমাদের আর্থিক সহায়তার কোন প্রয়োজন ছিলো না। মানসিক সাপোর্টটাই তখন খুব জরুরী। কাছের কিছু আত্মীয় স্বজন প্রথম দিকে খোঁজখবর নিলেও, অল্পদিনের মধ্যেই যে যার ব্যস্ততায়। আর তাইতো বাধ্য হয়ে আমাকেই পুরো পরিবারের দ্বায়িত্ব নিতে হলো। আর মৃত রাশেদই আমার সারথী, কঠিন জীবন যুদ্ধে।
আমার শ্বশুর আব্দুল লতিফ, রাশেদ মারা যাওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় নিজেও ছেলের কাছে চলে গেলেন। সবাই আবারো শোকের সাগরে ভাসলাম। বাবা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন কিন্তু পুত্র শোকটাকে আর নিতে পারলেন না। স্বামী মৃত্যুর পর শ্বশুরের ছায়ায় সংসারটাকে টেনে নেওয়ার ভাবনায় থাকা এই আমি জীবনে আরেকটা বড় হোচট খেলাম। আর এদিকে আমার শাশুড়ির অবস্থাও অবনতিতে, ছেলে স্বামী হারিয়ে মায়ের এক প্রকার পাগল প্রায় অবস্হা। সব মিলিয়ে নিজেকে আবারো ভীষণ অসহায় বলে মনে হলো।
পরিবারের এতো কঠিন সময়েও কিন্তু ভেঙ্গে পড়িনি, রোজ রাতে রাশেদ এসে আমাকে সাহস দিয়ে যায়। আমার শিক্ষক বাবা মেয়ের এই ভয়ানক বিপদে পাশে এসে দাড়ালেন। দুঃসময়ে আমার নিজের মা আর বাবা নিজেদের সবটুকু দিয়েই আমাদেরকে সাহায্য করলেন। মেয়ে দুটোকে দেখভাল বা স্কুলে আনা নেওয়ার দ্বায়িত্ব পালন করাতে, আমিও অফিসে মনোযোগী হতে পারলাম। মেয়ে দুটোও নানা নানীর ভালোবাসায় আপ্লুত।
জীবনে হঠাৎ ঝড় আসবে, লন্ড ভন্ড করে দেওয়া বাতাসে ঘর বাড়ি ভেঙ্গে যাবে। আবার নতুন করে বাড়িঘর তুলে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার বাবার দেওয়া প্রতিনিয়ত এই দীক্ষাটা আর সাথে রাশেদ নামক সারথীর সার্বক্ষণিক উপস্হিতির অনুভূতি, আমি যেনো জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক সৈনিক।
এরপর থেকে দুটো মেয়েকে ঘিরেই আমার জীবন। চাকুরীতেও উন্নতি করতে থাকলাম নিজের যোগ্যতায়। সেনা পরিবারের সাথে সবসময়ই যোগাযোগ ছিলো, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অনেকের সাথেই দেখা হয়। সবাই ভূয়সী প্রশংসা করে, পরিবারকে সুন্দর ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বলেই। আমি নিশ্চিত মানুষের করা প্রশংসায় আড়াল থেকে রাশেদও অনুভব করে, সে যে আমার স্বপ্ন সারথী।
স্বামী মৃত্যুর দশ বছরেরও বেশি সময়টাতে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিস্হিতিরই সম্মুখীন হতে হয়েছে, তবে সব কিছুই সামাল দিয়েছি দক্ষ হাতে। দুটো চাকুরী পরিবর্তন করেছি শুধুমাত্র নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে। পুরুষ যখন ভাবে অকাল বিধবা এই আমি দুটো সন্তানকে নিয়ে অসহায়, আমার কাছ থেকে অন্য কিছু পাওয়ার আশার প্রকাশ। আমি আর রাশেদ দুজনেই তখন হাসাহাসি করি, আর সেসব লোকজনের জন্য সবসময়ই আমাদের করুনা আর ঘৃণা। ওরা যে আমার যোদ্ধা পরিচয়টা জানে না বলেই।
করোনাতে আমার নিজ বাবার মৃত্যু, অনেক বছর পর পরিবারে বড় একটা ধাক্কা হয়ে এলো। কিন্তু ততোদিনে আমি জীবন যুদ্ধের পাকা এক সৈনিক। শোককে আবারো শক্তিতে রূপান্তরিত করলাম। মেয়ে দুটোকে আমার বাবা অনেক বছর আগলে রেখেছিলেন, ওদের কষ্টটাই আমাকে বেশি ব্যথিত করে। বাচ্চা দুটোর ভালোবাসার মানুষ গুলো যে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমি একটা বিদেশী উন্নয়ন সংস্হার এইচ আর ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমার ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্সের দিকটা দেখে বলেই এদের সাথে আছি বেশ কয়েক বছর হতে চললো। পেশাগত খুব বড় ধরনের ঝামেলা নেই বলে পরিবারকেও সময় দিতে পারছি। শাশুড়ি অসুস্থ থাকলেও মা কে পরিবারের ছায়া বলেই মনে করি। শাশুড়ি যখন প্রতি নামাজে শেষে ছেলে ও স্বামীর পাশাপাশি আমার জন্যও দোয়া করে, খুব ভালো লাগার একটা অনুভূতি হয়। বিশ্বাস করি সবার দোয়া ছিলো বলেই জীবন যুদ্ধে হারিনি।
আমার নিজের খুব ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। বেঁচে থাকার সময়টাতে রাশেদ আমার এই স্বপ্নটাকে খুব উৎসাহ দিয়ে যেতো। এমনকি মৃত রাশেদ প্রায়ই এসে স্বপ্নটার কথা জানান দিয়ে যায়। গত বছর রাইসা আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে এখন পুরোদস্তুর মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। জীবনের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হলো, আর বরাবরের মতোই রাশেদ আমার সারথী। আমাদের ছোট মেয়ে জারা এ বছর শহীদ আনোয়ার থেকে ইংরেজি ভার্সনে এইচএসসি দিবে। ওর খুব শখ, মায়ের মতো আইবিএ তে পড়বে। বড় বোন ও আমার উৎসাহে, মেয়েটা খুব আশাবাদী। এখন নিজের মতো করেই প্রস্তুতিতে আছে।
স্বামী মৃত্যুর পর দুটো অবুঝ মেয়েকে নিয়ে গত দশ বছরের জার্নিটাতে কিন্তু নিজেকে কখনোই একা মনে হয়নি। যখনই হোচট খেয়েছি বা বাধা এসেছে, প্রাণপণে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করেছি। রাশেদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি অনুভব করে। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েদেরকে মানুষ করাই ছিলো আমার জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবারের জন্য থাকা ওদের মৃত বাবার ভালোবাসা আর ওদেরকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন, মেয়ে দুটোকে কখনোই লাইনচ্যূত হতে দেয়নি। এখনো প্রতিদিনই মেয়েদের কথোপকথনে থাকে বাবার প্রতি ভালোবাসা ও সন্মান। আর এভাবেই রাশেদ এখনো আমার স্বপ্ন পূরনের সঙ্গী, দক্ষ সারথী হয়েই।
(শেষ।)