হঠাৎ এলে তুমি পর্ব -০৩

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_৩
#সুলতানা_পারভীন

-তুমি আবার শুরু করলে ধূসর? বারবার ‘প্রত্যুষা, প্রত্যুষা’ করো, কিন্তু জিজ্ঞেস করলে একদিনও বলো না এই প্রত্যুষাটা কে। আজ আবার নিজের নাম লাগাচ্ছ ওর নামের সাথে? প্রত্যুষা ধূসর আহমাদ! বলি ব্যাপারটা কি তোমার? কে এই প্রত্যুষা?

ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে দূর নীলিমার দিকে মুখ করে অভিমানী কণ্ঠে ধূসরকে প্রশ্ন করলো প্রজ্ঞা। ধূসর ততক্ষণে এগিয়ে এসে আলতো করে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো ধূসর। অন্ধকারেও মেয়েটার অভিমানী ছলছলে চোখ জোড়ার কাঁপন ঠিকই চোখে পড়লো ধূসরের। ধূসর এবারে শব্দ করেই হেসে ফেললো প্রজ্ঞার এমন অভিমানী মুখটা দেখে। প্রজ্ঞা এবারে রাগ করে সরে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার কোমড়টা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে প্রজ্ঞাকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঠোঁট নিল।

-একটা মানুষ এতো বোকা হয় কি করে বলো তো প্রজ্ঞা? প্রত্যুষার নামের সাথে নিজের নামটাও জুড়ে দিলাম তোমার বোঝার সুবিধার জন্য। তবুও যদি না বুঝতে পারো তাহলে আর কি করার আছে বলো? সরাসরি বললে তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। তাই ডিরেক্টলি আমাদের মেয়ের নামটা একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম, ম্যাডাম তো বুঝলেনই না কিছু। কি কপাল আমার! বোকা একটা বউ জুটেছে কপালে!

-এই একদম বাজে কথা বলবে না বলে দিলাম ধূসর। আর প্রত্যুষা কি ধরনের নাম? প্রত্যাশা নাম হয় জানি।

-এই যে মিসেস বকবকানি, আমার মেয়ের নাম প্রত্যুষাই হবে ওকে? তোমার নামের সাথে মিল রেখে নাম, প্রজ্ঞা, প্রত্যুষা। আমাদের ফার্স্ট বেবির নাম প্রত্যুষাই হবে, আর বাদ বাকি পরের বেবিদের নাম তোমার যা ইচ্ছে রাখতে পারো। বাই দা ওয়ে, প্রত্যাশাও কিন্তু দারুণ নাম। এক কাজ করো, প্রত্যুষার ছোটো বোন হলে ওর নাম প্রত্যাশা রাখা যাবে। প্রত্যুষা, প্রত্যাশা।

-মেয়ের খবর নেই, উনি এসেছেন মেয়েদের নাম ঠিক করতে। সরো তো, যত সব পাগল আমার কপালেই জোটে না?

-এই প্রজ্ঞা? কি বললে তুমি? আমি পাগল? তোমাকে তো আমি—–।

-পাগল নয়তো কি? মেয়ে দুনিয়াতে আসার খবর নেই, আর জনাব আছেন মেয়ের নামে বাড়ি কিনতে।

-পারলে সেটাই করতাম বুঝলে? বাট আমার লইয়ার বন্ধুটা শালার কিছুতেই মানলো না আমার কথা। শেষে স্বপ্নকুটিরের মালিকানা তোমার নামেই হস্তান্তর করতে হলো। কি আর করা? বাট আমাদের ছোট্টো প্রত্যুষা একটু বড় হলেই স্বপ্নকুটির কিন্তু ওর হয়ে যাবে, বুঝলে।

-চুপ করো তো? দুনিয়ার যত আজগুবি কথাবার্তা এই লোকটার মাথায় ঘোরে। এখানে ছাদে এতো ক্যান্ডেল জ্বালিয়েছ যে, এগুলোর কি হবে এখন?

-কি আর হবে? মোমবাতিরা আগুনের স্পর্শে গলে গিয়ে ভালোবাসার জীবন উৎসর্গ করবে। সবাই তো আর ওদের মতো ভালোবাসার জন্য এতো বড় ত্যাগ করার সুযোগটা পায় না।

-মোমবাতির জন্মই হয়েছে নিজে জ্বলে, পুড়ে, আরেকজনকে আলোর পথ দেখানো। এখানে ভালোবাসার চেয়ে দায়িত্বটাই বেশি বুঝলেন জনাব?

-ভালোবাসাটাই দায়িত্ব নিতে শেখায় প্রজ্ঞা। নইলে শুধু দায়িত্ব পালন করতে নিজের সর্বস্ব উজার করে দিতে কেউ পারে না কোনোদিন। শুধু ভালোবাসার টানেই এই আত্মত্যাগটা করা সম্ভব হয়, বুঝলেন ম্যাডাম?

-আপনার সাথে তর্ক করে জেতা আমার পক্ষে অসম্ভব জনাব। হার মানছি।

-হার তো মানতেই হবে ম্যাডাম। রাইট ইজ অলওয়েজ রাইট। তর্ক করলেই তো ঠিক কথাটা ভুল হয়ে যাবে না।

-ওফ! এই লোকটাকে একটা কথা বলে শান্তি নেই। একটা কথা বলে আরো পঞ্চাশটা কথা শুনিয়ে দেয়। কি যে করি এই লোকটাকে নিয়ে আমি!

-বেশি কিছু করতে হবে না ম্যাডাম। আমার পিচ্চি প্রত্যুষাকে এনে দাও জলদি করে। তাহলেই আর একটুও জ্বালাবো না তোমাকে।

-জ্বালাবে না ঘোড়ার ডিম। বাপ মেয়ে দুজনে মিলে আমাকে পাগল বানিয়ে পাবনা পাঠাবে, জানি না আমি?

-ইশ রে এভাবে বলতে হয় নাকি বউ? আমরা বাপ বেটিতে মিলে কি কি করবো তার বিশাল একটা লিস্ট করে রেখেছি। আসার সময়ে দেখলে না প্রত্যুষার জন্য পুরো দেয়ালটা খালি পড়ে রয়েছে এখনও? আমার সাথে প্রত্যেকটা খালি ফ্রেমও আমাদের পিচ্চিটার আসার অপেক্ষা করছে।

-ওই খালি ফ্রেমগুলো? তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছো ধূসর।

-জি ম্যাডাম। আমার প্রত্যেকটা পাগলামিই তোমাকে আর আমাদের ছোট্ট পরীটাকে ঘিরে। ওর জন্য আরো কতো প্ল্যান জমা করা আছে জানো? ও প্রথমবার যখন বাড়িতে আসবে, তখন ওর পায়ের আর হাতের ছাপগুলো দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখবো। প্রথম হামাগুড়ি দেয়ার, প্রথমবার হাঁটার মূহুর্তটা, প্রথম কথা বলার সময়টা, প্রত্যেকটা মূহুর্ত আমি ক্যামেরার বন্দি করতে চাই। আমাদের ছোট্ট স্বপ্নকুটিরের প্রত্যেকটা পরতে পরতে আমাদের ভালোবাসার গল্পগুলোর সাথে আমাদের প্রত্যুষার বেড়ে ওঠার গল্পটাও মিশে থাকবে। বাবু আসার খবরটা পাওয়ার দিন থেকে শুরু করে ওর জন্ম, হাসি কান্না, বেড়ে ওঠা, হাঁটা, সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়া, সাঁতার শিখতে গিয়ে পানিতে হাবুডুবু খাওয়া, প্রতিটা মূহুর্তে আমি ওর পাশে থাকতে চাই প্রজ্ঞা।

-জীবনে কখন কি হয় বলা মুশকিল ধূসর। কিন্তু আমিও মনে প্রাণে প্রার্থনা করি তোমার এই ছোটো ছোটো পাগলামিভরা ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক। এভাবেই পাগলের মতো ভালোবাসবে তো সবসময় ধূসর? কখনো ছেড়ে যাবে না বলো?

-উমমমমম? যেতে তো হবে তাই না?

-মানে? কোথায় যেতে হবে?

ধূসরের ভারি গলায় হঠাৎ এমন কথা শুনে প্রজ্ঞা একটু ভয়ই পেয়ে গেল। এতোক্ষণে ধূসরের শক্ত হাতের বাঁধনটা শিথিল হয়ে গেছে। প্রজ্ঞা মুখে তুলে তাকাতেই দেখলে ধূসর একটু সরে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রজ্ঞার ভীতু মুখটার দিকে চোখ পড়লেও ধূসর শান্ত, ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো আবার।

-কোথায় যাবো মানে? সারাদিন কি বাসায় বসে থাকবো নাকি? অফিসে যেতে হবে না আমাকে? অফিসে কতো কাজ জানো তুমি? মাঝে মাঝে কেমন বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করো তুমি আমি বুঝি না বাবা।

-ধূসররররররর। তোমাকে তো আমি? আমি এতো সিরিয়াসলি একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, আর এই লোকটা আমার সাথে ইয়ার্কি করছে। তোমাকে আমি আজকে মেরেই ফেলবো, একবার ধরতে পারি দাঁড়াও না? আমার সাথে ফাইজলামি করা হচ্ছে?

ধূসর কঠিন একটা মুখের ভাব করে শান্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হো হো করে হেসে ছুট লাগিয়েছিল। প্রজ্ঞা একবার ধরতে পারলে যে একটা চুলও আস্ত থাকবে না সেটা ভালো করেই জানা আছে ওর। ধূসর এতোক্ষণ ইচ্ছে করে ওর সাথে মজা নিচ্ছিল বুঝতে পেরে প্রজ্ঞাও ধূসরকে ধরার জন্য পিছনে ছুটলো। ততক্ষণে ধূসর বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছিল। প্রজ্ঞা বেশ কিছুক্ষণ ধূসরকে ধরার চেষ্টা করেও বিফল হলো। বেশ কিছুক্ষণ ছোটোছোটির পর প্রজ্ঞা হাঁপিয়ে গেছে দেখে ধূসর নিজের দৌঁড়ানোর গতি কিছুটা আনলো, আর প্রজ্ঞাও এবারে ধূসরকে ধরতে পেরে ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি বসালো ধূসরের বুকে। ধূসরের বুকে ধুপধাপ কিল বসিয়ে রাগের চোটে মেয়েটা কথাও বলতে পারছে না দেখে ধূসর একটু ঝুঁকে প্রজ্ঞার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। ধূসরের এমন কাজে প্রজ্ঞা রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। আর ধূসরও প্রজ্ঞাকে আরেকটু চমকে দেয়ার সুযোগ পেয়ে কি আর হাত ছাড়া করে? স্তব্ধ হতবাক প্রজ্ঞাকে এক টানে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকেই পা বাড়ালো ধূসর। আর প্রজ্ঞা ধূসরের গলা দু হাতে জড়িয়ে ধরে গানের কথাগুলোই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যতবার গানটা শুনছে, ততবারই বোধহয় এই একরোখা পাগল লোকটার আর তার কণ্ঠের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। নিঝুম রাতে নিরবতায় গানগুলো বারবার প্রতিধ্বনি তুলে প্রজ্ঞার কানেই গুনগুন করছে ধূসরের স্বরটা।

“পৃথিবীর যত সুখ
আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি,
মনে হয় তোমাকেই
আমি জনম জনম ধরে চেয়েছি।
শুধু যে তোমারই সাথী হতে
আমি তো এসেছি এ জগতে
এ জগতে চোখ মেলে চাইবার
তুমি ছাড়া আজ কিছু নাই আর,
তোমারই পাসে আমি রয়েছি
ও… জীবনে মরনে সাথী হয়েছি।
মনে হয় তোমাকেই
আমি জনম জনম ধরে চেয়েছি।।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here