#হবে-কি-আমার(২)
#writer_Ruhi-mondal
#পর্ব_17
ঝলমলিয়ে সোনালী রোদ্দুরে আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতির চারিপাশে, চকচক করছে গাছের প্রতিটি পাতা,পিচঢালা রাস্তায় দুই সারিবদ্ধ নারকেল গাছের পাতা গুলো ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে,ঝনঝন শব্দ হচ্ছে, গাড়ি চলছে ফুলস্পিডে ফাঁকা রাস্তায়, মৃন্ময় খুব সাবধানে গাড়ি ড্রাইভ করছে পাশে তনুশ্রী ঘুমিয়ে কাঁদা,সে একটু লং জার্নি করলেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু ফ্রন্ট সিটে মাথা এলিয়ে দিতে সে বারংবার ঢলে পড়ছে মৃন্ময় তা দেখে তনুশ্রী কে একহাতে টেনে নিজের সাথে যত্নে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। অনু ব্যাক সিটে বসে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে যেখানে জলাশয়ের এক সারিতে কাশ ফুলের মেলা বসেছে, অসংখ্য কাশবন হাওয়ার তালে এদিক ওদিক দুলে বেড়াচ্ছে,অরিন্দম বারংবার অনুকে টেনে ভিতর বসাচ্ছে কিন্তু সে আবার পূর্বের ন্যায় মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছে বাহিরে, মৃন্ময় তাদের দুজনের অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। অরিন্দম অনু, মৃন্ময় দের গাড়িতেই এসেছে,অনু জেদ ধরেছে সে তার দিদি’র সাথেই আসবে, অগত্যা অরিন্দম ও রাজি হয়ে যায়। কিন্তু অনুর এহেন কার্যকলাপে অরিন্দম চরম বিরক্তিতে পড়ে যাচ্ছে সে এবার বিরক্ত হয়ে অনুর ডান হাত টেনে নিজের একদম কাছে অনলো,অনু সরে যেতে নিলে অরিন্দম রাগী গলায় বলল, __’কতবার বলবো তোমায়, এমন মুখ বার করবে না! পিছন থেকে গাড়ি এসে গেলে তখন কি হবে একটু কথা শোনা যায় না?’
অনু বিরক্ত হয়ে বলল,
__’ছাড়ুর তো আমার কিছু হবে না। আর পিছন থেকে গাড়ি এসে আমার মাথা উড়িয়ে সেটা সাথে করে নিয়ে চলে যাবে না। তবুও এমন করছেন কেন?’
__’তোমাকে বসে থাকতে বলেছি বসে থাকবে! একটাও কথা বলবে না!’
অনু মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে নালিশের সুরে বলল,
__’জামাই বাবু দেখছেন আমাকে কেমন বকছেন উনি!’
মৃন্ময় ফিক করে হেসে দিল সে বেশ মজা পাচ্ছে এদের দেখে ক্ষনিক সময় নিয়ে সে পিছনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
_’অরি তুই আমার শালিকাকে এত ধমক দিচ্ছিস কেন?’
অরিন্দম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
_’তোর শালিকা’কে বল আমার কথা শুনে চলছে। এমন বাচ্চামী করলে চলে না সবসময়!’
অনু কপাল কুঁচকে বলল,
__’আমি মোটেও বাচ্চামী করছি না!’
__’সে আমি টের পাচ্ছি!’
__’আমি কি আপনাকে জ্বালাতন করি বরবাবু?শেষের কথাটা অনু মুখ ছোট করে বলল,তা দেখে অরিন্দমের মায়া হলো, মেয়েটাকে সে একটুও কষ্ট পেতে দিতে চায় না,আর সে কষ্ট দেবে ও না, একটু মানে একটু ও না, সামান্যতম ও না, তাকে মন খারাপ সে করতে দেখলে তার বুক কাপে, যতটা নিজের সাধ্যে থাকবে হাসিখুশি তে রাখবে, তার জন্য সব করতে পারে, যদিও জানে অনু এখন পুরোটাই অভিনয় করে নালিশ করছে তবুও তার অভিনয়েই তার কথা রাখবে, অরিন্দম অনুকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
__’একদমই না!’
মৃন্ময় শব্দ করে হেসে বলল,
_’পেয়েছিস একটা বাচ্চা বউ!’
অরিন্দম হেসে দিল,অনু ঠোঁট ফুলিয়ে অরিন্দমের বুকে মাথা রাখে, অরিন্দম তার মুখে বাতাসের তালে উড়ে আসা চুলগুলো একবার এলোমেলো করে দিল,অনু ভ্রু কুঁচকে তাকালো বলল,
_’এমন করছেন কেন? হুঁশ কোথায়, জামাইবাবু আছে না। লজ্জা করে না?
অরিন্দম আবার মুচকি হেসে চুল গুলো কানের পাশে সরিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল,
_’তোমার জামাইবাবু মত আমিও নির্লজ্জ হতে চাই বউ!’
অনু চমকালো, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর সে যেনো লজ্জায় লাল হলো, অরিন্দম তা দেখে আবার হেসে দিল।
____
অরিন্দম লাগেজ নিয়ে হেঁটে চলেছে হেঁটে বললে ভুল সে অনুর সাথে দৌঁড়ে চলেছে,আর অনু সে-তো অরিন্দমের থেকে 10 হাত দূরে একপ্রকার দৌড়ে রাস্তা শেষ করছে অরিন্দম দ্রুত হেঁটে ও নাগাল পাচ্ছে না। মৃন্ময় তনুশ্রী পাশাপাশি হেঁটে আসছে বেশ কিছুটা দূরে। মৃন্ময়ের এক কাকার ছেলে পুষ্কর তার গাড়িটা নিয়ে গিয়েছে,রাস্তায় তার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়,সে এক ঘন্টার জন্য ধার নিয়েছে গাড়িটা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়। মৃন্ময় আর না করেননি কারন সেখান থেকে অলকা দেবীর বাড়ি পনেরো মিনিটের দুরত্বে তাই তাঁরা কেউ আপত্তি না করে গাড়ির চাবিটা হাতে দিয়ে চলে এসেছে, কিন্তু সোজা রাস্তায় বৃষ্টির জল জমেছে তাই তারা অন্য রাস্তা ধরেছে, পনেরো মিনিটের যায়গায় এখন কুড়ি বাইশ মিনিট লাগবে তাদের গন্তব্য পৌঁছাতে। মৃন্ময় তনুশ্রী একসাথে কথা বলতে বলতে হাটলেও অরিন্দম কিছুতেই অনুকে পাশে পাচ্ছে না। মেয়েটা এখন থেকেই তাকে ভুলতে বসেছে, গ্রামে পা রাখতেই সে ভুলে গিয়েছে যে সে বিবাহিতা সে একা না তার সাথে তার পাশে আরও একটি মানবের স্থান হয়েছে, তাকে নিজের সাথে করে নিয়ে আশপাশের মানুষের সাথে পরিচয় করাতে হয়, তাদের রাস্তায় অনেকেই কৌতুহল দৃষ্টিতে দেখছে, কেউ কেউ অনুকে জিজ্ঞাসা করছে,বিয়ের পর জোরে এসেছে তার স্বামী কোথায়? সে একা কেন যাচ্ছে? অনু তাদের পিছনে হাত দেখিয়ে আবার দৌড়ানো শুরু করেছে। অরিন্দমের মেজাদ বিগড়ে যাচ্ছে সে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অতঃপর আর এগিয়ে যেতে পারলো না দাঁড়িয়ে গেল সে কিন্তু অনু তবুও পাত্তা দিল না। অরিন্দম এবার ধমক দিয়ে বলল,
__’তুমি দাঁড়াবে হ্যাঁ কি না? আমি কিন্তু এখান থেকে এক্ষুনি ফিরে যাব?’
অনু কথাটা শ্রবন করতেই দাঁড়িয়ে যায় অতঃপর সে পিছন ফিরে অরিন্দমের দিকে তাকাল, অরিন্দম কে বেশ দূরে দেখে অনু অরিন্দম কাছে এগিয়ে এলো। অনু কে আসতে দেখে অরিন্দম লাগেজটা নিচে রাখলো,অনু কৌতুহল ভরা কন্ঠে বলল,
__’ফিরে যাবেন বলছেন কেন? আপনি না বললেন এখানে তিনদিন থাকবেন তাহলে এখনি চলে যাবার কথা বলছেন কেন?’
_’যাব না তো কি করবো তুমি একবার ও আমার কথা মনে করছ, এক্ষুনি তো ভুলে যাচ্ছ, একটু পর আরও ভুলে যাবে। তুমি পিছন দিকে তাকিয়ে একবারও দেখছো আমি তোমার থেকে কত দূরে আছি তাও আবার বারবার তোমাকে ডাকছি তাও একবারও দাঁড়াবার নাম নিচ্ছ না। একবার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখো তোমার দিদিকে দেখে কিছু শেখো সে তার স্বামীর সাথে আসছে,আর তুমি?
অনু কথাটা শুনে ঠোঁট ফোলালো,সে যে গ্রামে পা রাখতেই পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠছে,তাই সে সব ভুলতে বসেছে। এই তো মাএ ন’দিন হলো সে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শত শত বছর আসেনি সে এই গ্রামে,এই মাটির গন্ধ সে যুগযুগ ধরে পাইনি,তার মামা মামীকে কতদিন কতকাল দেখেনি তাই তো সে দৌড়ে যাচ্ছে তাদের দেখার জন্য, প্রিয় দুই বন্ধু কে সে কত ঘন্টা দেখেনি কত কথা জমিয়ে রেখেছে সে, তাদের সাথে হাসাহাসি করা হয়নি। কিন্তু তার যে এখন স্বামী আছে সে প্রথম বার শ্বশুরবাড়ি আসছে, স্ত্রী হিসেবে তাকে সহধর্মিণী হতে হবে, তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা বুঝতে হবে, যেহেতু তার বড়ো দিদি নিজের স্বামীর সঙ্গিনী হয়ে পাশে আছে তাকে ও থাকতে হবে,দিদি তাকে বারংবার বলছে অরিন্দম কে একটু বুঝতে হবে, একটু বড় করতে হবে নিজেকে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার খেয়াল রাখতে হবে, মুখে ভালোবাসি ভালোবাসি বললে চলবে না, মুখে না বলেও প্রকাশ করতে হবে, সে সব চিন্তা করে অনু ছোট করে বলল,
_’সরি। চলুন, একসাথে যাই!’
অরিন্দম লাগেজ হাতে তুললো, একপলক অনুর মুখপানে তাকাল। অতঃপর সে হাটা শুরু করল,অনু গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চললো তার সঙ্গী হয়ে।
কিছুটা রাস্তা যেতে অরিন্দম আড়চোখে অনুর মুখপানে তাকাল,অনুর মুখ মলিন তা দেখে অরিন্দমের নিজের ওপর খারাপ রাখল, কি দরকার ছিল মেয়েটাকে ধমক দেওয়ার,তারা সরু গলিতে পা রাখল,পিছনে তাকিয়ে অরিন্দম দেখলো মৃন্ময় দের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, অতঃপর অরিন্দম দাঁড়িয়ে গেল তাকে দাড়াতে দেখে অনু ও দাঁড়িয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, অরিন্দম চারিপাশে তাকাল, কেউ নেই আশেপাশে তা দেখে বা হাতে অনুকে নিজের নিকট টেনে আনলো অনু ভড়কানো দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল অরিন্দমের মুখপানে অরিন্দম সে দৃষ্টি দেখে গোপনে হাসলো অতঃপর সে সময় নিয়ে অনু’র কপালে অধর ছোঁয়াল।
#চলবে