হলুদ ক্ষণে স্তব্ধতা পর্ব -০৪

#হলুদ_ক্ষণে_স্তব্ধতা 💛
#পর্বঃ৪
লেখনীতে- #ইয়ানাত_রোযী

নাজরানা চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে তিন কবুল বলে দিল। কবুল বলতে গিয়ে কোটরাগত বড় বড় চোখ দুটো পানিতে ছাপিয়ে উঠলো। কার সাথে তার বিয়ে হলো নাজরানা দেখলোই না। তার দেখার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে।

হুজুর এবার বরের কাছে এসে বললেন,

-” মাসিফ বিন রশিদ, আপনি কি এ বিয়েতে রাজি আছেন? বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ”

মাসিফ এক নাগাড়ে তিন কবুল বলে পবিত্র বন্ধনে জড়িয়ে গেল। বাড়ির প্রত্যেকে প্রশান্তির হাসি হেসে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললো।

কাজিনদল ছুটে গেল নাজরানার কাছে। রোহান মুখে দুষ্টামির হাসি হেসে বলল,

-” কার সাথে তোর বিয়ে হয়েছে বল তো নাজু? ওহ সরি, আমাদের ভাবী! ”

নাজরানা অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে থেকে বলল,

-” ভাবী? মানে? আমি জানি না কার সাথে। ”

নাজরানা মাথা নিচু করে ফেললে, কাজিনরা সবাই একসাথে চিল্লিয়ে বলল,

-” আমাদের মাসিফ ভাইইইই। ”

নাজরানা বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইল বেশ খানিকটা সময়। অবাকতার রেশে দু’হাত মুখে চলে গেছে। নাজরানা গোলগোল চোখে শুধালো,

-” কখন? কিভাবে? আমাকে কেউ বলেনি কেন আগে? ”

মাইফা ভ্রু কুঁচকে বলল,

-” এভাবে বলছিস কেন? তুই কি এই বিয়েতে খুশি না? ”

নাজরানা বেশ লজ্জা পেল। গাল দু’টোয় রক্তিম আভা ধারণ করেছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ধরা দিল। এটা দেখে তার চাচাতো ভাই ফাহিম অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বলল,

-” অ্যাহ! এতো লজ্জা কোথা থেকে পাচ্ছিস তুই নাজ? মনে মনে তো ঠিকই মাসিফ ভাইয়ের সাথে ভালোবাসার ঘর বুনেছিলি! ”

নাজরানা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল,

-” মোটেই না। কি বলছো কি ভাইয়া? ”

ফিহা তা দেখে বলল,

-” হয়েছে নয়াবধূ, আর ঢং দেখাতে হবে না। আমরা সব জানি। ”

মাইফা আবার বললো,

-” এসব কথা রাখ। আগে শোন বিয়েটা কিভাবে হলো। ”
এরপর মাইফা শুরু থেকে বলতে লাগলো।

অতীত—

গায়ে হলুদের আগের দিন, নাজরানা যখন মাসিফকে তার মনের কথা জানালো সেই সময় বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে মাইফা বের হয়েছিল। মাইফা নাজরানার ফিসফিসিয়ে কথা বলা শুনে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে গেল। বুঝলো, ব্যাপারটা দূর থেকেই উপলব্ধি করতে হবে। লুকিয়ে কারোর গোপন কথা শুনতে নেই তবুও নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। যখন শুনলো নাজরানা মাসিফকে ভালোবাসে, তখন নাজরানাকে একশো একটি গালি দিল মনে মনে। এতো বোকা কিভাবে হয় মেয়েটি যে, বিয়ের দুদিন আগে ভালোবাসার কথা জানাতে এসেছে।
যেহেতু ভালোবেসেই ফেলেছে, এখন তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। বোনের কষ্ট যাতে না হয় তাই মাইফা কাজিন সবাইকে একত্র করে বিষয়টি জানালো তাদের। মাসিফকে ধরে বেঁধে তাদের দলে রাখলো। বড় হিসবে অনেক গুলো রামধমকও দিলো সবাইকে। কিন্তু সবাই বকাগুলো হজম করল। মাসিফ খুব দ্বিধায় ছিল বিয়েটা ভাঙবে কিনা!আদৌ কতটুকু ভালো হবে সবার জন্য, বুঝতে হিমশিম খাচ্ছিল। কিন্তু নাজরানার সেই অশ্রুসিক্ত চোখগুলো দেখে মাথা ঝিমঝিম করে উঠতো। তাই বিয়েটা ভাঙার জন্য সেও আমতাআমতা করে রাজি হলো।

সবাই নেমে পড়ল বর আবির হোসেনের সাথে বিয়ে ভাঙার জন্য কঠিন কোনো বিষয়ে। তারপর খুঁজে পেল, আবিরের প্রেমিকা আছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ তাদের মাঝে রাগ-অভিমাম চলছে। আবির তার বাড়িতে প্রেমিকার কথা বললে, দুই পরিবারই রাজি হয় না। আবিরের মা-বাবা মেয়েটিকে অনেক কথা শুনিয়েছিল। তাই সে আবিরের ভালোর জন্য দূরে সরে যাচ্ছিল। সব কিছুতে ব্লক করে রেখেছিল আবিরকে। এমনকি বাসায় না আসার জন্য কঠিন ব্যবস্থাও নিয়েছিল।
এই জিনিসটিকেই কাজে লাগিয়ে, রোহান গেল মেয়েটির বাসায়। মেয়েটি যখন জানলো বিয়ের খবর, ছুটে চলে আসতে চাইলো। কোনো বাধা আর মানেনি। এক প্রকার পালিয়েই চলে এসেছিল।
অন্যদিকে, মাইফা, ফিহা, ফাহিম ছিল বিয়ে বাড়িতে সব ঠিকঠাক ভাবে রাখা। কেউ যেন কিছু না বুঝে। কাজিনরা কেউই জানাতে চায়নি, বিয়েটা তারা ভাঙতে চায়। কিন্তু আবিরের ফোনে রোহানের নাম্বার সেভ থাকায় বুঝে গেল। অবশ্য কিছু যায় আসেনি তার, বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। বিয়ের আসর থেকে উঠে আসতে সাহায্য করেছিল মাইফা ও ফিহা। পরে নির্জন জায়গায় রোহানের নাম্বার থেকে আসা মেসেজের পর আবির পালাতে উদ্যত হলে ফাহিম খুব কৌশলে বিয়ে বাড়ি থেকে বের করে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেল। মাসিফ স্বাভাবিকভাবেই কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে বিয়ে বাড়ির কাজ দেখাশোনা করছে। তাকে বর পালিয়ে যাওয়ার কোনো কাজে দেওয়া হয়নি। কারণ, কারোর যাতে মাসিফের উপর সন্দেহ তৈরি না হয়।

এরপর নাজরানার বাবা যখন বলল নাজরানার বিয়ে সম্মান রক্ষার্থে আবিরের ছোট ভাইয়ের সাথে হবে, তখন সকলে চোখে অন্ধকার দেখল। এক বিয়ে আটকিয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিয়েকে পরিকল্পনা ছাড়া কিভাবে আটকাবে?

মাসিফ যখন দেখলো নাজরানা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে তার দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকালো, তখন মাফিসে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। কিছু না ভেবেই মাসিফ ছুটলো তার মা মুনিয়া খাতুনের কাছে।

মুনিয়া খাতুনকে আলাদা করে ডেকে রুমে নিয়ে গেল মাসিফ। মাসিফ দরদর করে ঘামছে। কিভাবে বলবে মাকে সে এসব কথা? যদি ভুল বুঝে তাকে আর নাজরানাকে? আচ্ছা, সে এমন কেন করছে? নাজরানাকে তো মাসিফ ভালোবাসে না। কখনো সে নজরে দেখেইনি মাসিফ। নাজরানার ‘ ভালোবাসি ‘ শুনাতে এত দ্রুত তার দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হতে লাগলো?

মুনিয়া খাতুন কিছুক্ষণ ধরে ছেলেকে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি মিষ্টি কন্ঠে বললেন,

-” কি জন্য ডেকেছিস, বাবা? ”

মাসিফের গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। ছোট টেবিলে পানির গ্লাস দেখলো। ঢকঢক করে সবটুকু পানি শেষ করে ফেলল। মাসিফ গাইগুই করে শেষে বলেই দিল,

-” আম্মু, আমাকে ভুল বুঝো না। প্লিজ। আমি নাজরানকে তোমার পুত্রবধূর সম্মান দিতে চাই। ”

মুনিয়া খাতুন বিষ্ফোরিত নয়নে মাসিফের পানে তাকিয়ে রইলেন। বললেন,

-” এসব তুই কি বলছিস? নাজরানার বিয়ে তো এখনই ঠিক হয়ে গেল ? ”

এরপর মাসিফ পুরো ঘটনা খুলে বলল মুনিয়া খাতুনকে। নাজরানার মনের কথা থেকে শুরু করে আবিরের পালিয়ে যাওয়া, সবকিছুই বললেন। ছেলের মনের ভাব তিনি বুঝতে পারলেন। মুনিয়া খাতুন কঠোর ভাব নিয়ে বললেন,

-” তোদের সব’কটার পরিশ্রম আমি বৃথা যেতে দিব না। তোর মামার সাথে আমি এখনই কথা বলছি। ”

মুনিয়া খাতুন তার ভাই ও ভাইয়ের বউকে আলাদা করে ডেকে বললেন,

-” ভাই, তোকে আমি আজ একটি আদেশ দিব। আশা করি তুই সেটা পালন করবি! ”

নাজরানার বাবা বললেন,

-” কি আপা? ”

-” আমি চাই, তোর মেয়েকে আবার বাড়ির পুত্রবধূ করে নিতে। আমি চাইনা যে পরিবারের জন্য এমন সম্মানহানি হতে হলো আমাদের, সেই পরিবারেই আমাদের ঘরের মেয়েকে দিতে। তারচেয়ে ঘরের ছেলের হাতেই মেয়েকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাক। তুই আর নাহার শুরু থেকেই দেখে আসছিস, আমি নাজরানাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখি। আশা করি তোদের কোনো আপত্তি থাকবে না! ”

নাজরানার মা, বাবা দু’জনেরই যেন বুক থেকে পাথর নামলো। বিষয়টি তাদের মাথায় পূর্বে আসেনি বলে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আবিরের বাবা,মায়ের কথায় রাজি হয়েছিলেন।

#চলবে

[ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। আশা করি ভালো, খারাপ মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here