হলুদ ক্ষণে স্তব্ধতা পর্ব -০৭ ও শেষ

#হলুদ_ক্ষণে_স্তব্ধতা💛
#পর্বঃ৭ (অন্তিম পর্ব)
লেখনীতে- #ইয়ানাত_রোযী

(দূর্বল মনের ব্যক্তিদের জন্য সতর্কতা)

মাঝরাতে বিকট শব্দে মাসিফের ঘুম ভেঙে গেল। ধরফর করে সে উঠে বসলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো নাজরানা পাশে নেই। ভ্রু কুঁচকে শব্দটা কোথা থেকে আসছে বুঝার চেষ্টা করছে মাসিফ। বুঝতে পারলো খাটের নিচ থেকে। যা আন্দাজ করলো, তাই হলো।

নাজরানা মেঝেতে বসে কোমড়ে হাত দিয়ে গোঙাচ্ছে। মাসিফ এই দৃশ্য দেখে হো হো করে হেসে দিল। নাজরানা ব্যথা ভুলে মাসিফের পানে গোলগোল চোখে চেয়ে রইল। সে কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,

-” তুমি আমার ব্যথা দেখে হাসছো? ”

-” কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাবি আর মাঝে একগাদা বালিশ দিয়ে রাখলে তো এই অবস্থাই হবে! ”

-” এই, তুমি আমাকে উঠতে সাহায্য না করে বসে বসে মজা নিচ্ছ? ”

মাসিফ হেসে হেসে উঠে গিয়ে নাজরানাকে অবাক করে দিয়ে কোলে তুলে নিল। এরপর বিছানায় শুয়ে দিল। নাজরানা ভেবেছিল শুধু হাত দিয়ে টেনে তুলবে। মাসিফের দিকে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। মাসিফ ছোট টেবিলের ড্রয়ার থেকে ব্যথা উপশমের ক্রিম নিয়ে নাজরানার হাতের কুনুইতে লাগিয়ে দিল। এরপর বলল,

-” তোর পায়জামাটা হাঁটু পর্যন্ত তোল। ”

নাজরানা আঁতকে উঠে বলল,

-” কেন? ”

বিরক্তি নিয়ে মাসিফ বলল,

-” হাঁটুতেও তো ব্যথা পেয়েছিস, সেখানে ক্রিম লাগাতে হবে না? ”

নাজরানা ধীরে ধীরে হাঁটু পর্যন্ত পায়জামা তুললে মাসিফ সযত্নে ক্রিমটি লাগিয়ে দিল। এরপর বলল,

-” আমি বাইরে যাচ্ছি, ক্রিমটা কোমড়ে লাগিয়ে নেয়। ”

-” তুমি ক্রিম লাগিয়ে দিলে সমস্যা কি? ”

-” এই মাঝরাতে তোর ঘোরে পড়ে নিজের মাথা নষ্ট হোক, তা চাই না। ”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে পড়লো মাসিফ। এদিকে নাজরানা কিছুক্ষণ বসে মাসিফের বলা কথাটি বুঝার চেষ্টা করল। বুঝতে পেরেই ভীষণ লজ্জা পেল সে।

_____

পরের দিন রিসিপশন শেষে নাজরানা ফ্রেশ হয়ে আকাশী রঙের একটি থ্রি-পিস পড়েছে। কাল সকালেই তারা ঢাকায় চলে যাবে। মাসিফের অফিসের ছুটি শেষ। ঢাকায় মাসিফ ও তার মা, বাবা একসাথে থাকে। কিন্তু মাসিফের মা, বাবা এবার বেশ কিছু দিন গ্রামে বাড়িতে থেকে ছেলে ও ছেলের বউকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে যান।

নাজরানা ড্রেসিং টেবিলে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে মাসিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” এই যে, শুনো। আমি তোমার কে হই? ”

মাসিফ মোবাইলের দিকে চেয়েই বলল,

-” সেটা তো তুই’ই ভালো জানিস। ”

-” আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি। বলো। ”

-” আমার বিয়ে করা বউ। ”

নাজরানা শব্দগুচ্ছ গুলো শুনে ভারী লজ্জা পেল। তবুও নিজেকে সামলে বলল,

-” তাহলে নিজের ভাষা ঠিক করে কথা বলবে আমার সাথে । ”

কপালে ভাঁজ পড়লো মাসিফের। বলল,

-” কি বুঝাতে চাইছিস তুই? ”

নাজরানা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,

-” আবার! আমাকে ‘তুই’ করে আর বলবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে ‘তুই’ করে বললে, বিষয়টা খারাপ দেখায়। আমাকে ‘তুমি’ করে বলবে। বুঝেছো? ”

-” বাবা রে! মহাগিন্নি একদম। আচ্ছা, ‘তুমি’ করেই বলবো। তবে আমার বেশ সময় লাগবে। ”

নাজরানা ‘আচ্ছা’ বলে লম্বা বেণী করে ফেলল। একটু পর নাজরানা আবার বলল,

-” চলো না, এই রাতের গ্রামটা একটু ঘুরে আসি, প্লিজ। কালকে তো ঢাকায় চলেই যাব। ”

নাজরানার আবদার মাখা কথা শুনে মাসিফ তা ফেলতে পারলো না। বাড়িতে থাকা সকলের অলক্ষ্যে মাসিফ ও নাজরানা চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লো। হোক না, তাদের কিছু একান্ত সুন্দর মুহূর্ত! তা জমা পড়ুক স্মৃতির খাতায়।

_________

২ বছর পর,

মাসিফ হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছে। সেখানে উপস্থিত আছেন, মাসিফের মা,বাবা ও নাজরানার মা, বাবা। সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। মাসিফ একবার হাঁটছে, একবার বসছে। কিছুতেই তার মন শান্ত হচ্ছে না। ভেতরে তার প্রেয়সী বধূ নাজ, তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উপহার দিতে লড়াই করে যাচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ড।

মাসিফ নাজরানার পাশে থেকে তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ডা. রেহেনা আক্তার আসতে নিষেধ করেছেন। নাজরানার অবস্থা শোচনীয়।

মাসিফ নামাজ কক্ষে গিয়ে নামাজ পড়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত করছে তার নাজ যেন সুস্থ থাকে ও তার বাচ্চা যেন সুন্দরভাবে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়।

নাজরানার প্রতিটি চিৎকার তার বক্ষপিঞ্জর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে হলো মাসিফের। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।

মাসিফ আবার করিডোরে এলো। ওপাশ থেকে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া বাচ্চার কান্নার শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো। উপস্থিত সকলের মুখে হাসি আসলেও মাসিফের মন ছটফট করছে, তার নাজ ঠিক আছে কিনা এই ভেবে।

নার্স দ্রুত বাইরে এসে মাসিফকে ডেকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল। নার্স হলুদ তোয়ালে মোড়ানো এক শুভ্ররাঙা ফুটফুটে শিশু মাসিফের কোলে তুলে দিল। মাসিফ “আলহামদুলিল্লাহ ” বলে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে চুমু খেল। নার্স বলল,

-” অভিনন্দন, আপনার পুত্রসন্তান হয়েছে। ”

মাসিফ এরপর তার হলুদ রাজপুত্রেরর কানে আযান পড়িয়ে দিল।

ডা. রেহেনা আক্তার বললেন,

-” আপনার সাথে আপনার স্ত্রী কথা বলতে চায়। হয়তো হাতে বেশি সময় নেই। আমরা রক্তের ব্যবস্থা করছি। ”

মাসিফের এ কথা শুনে মনটি ধক করে উঠলো। সে নাজরানার পাশে এসে বসলো। নাজরানা দু’চোখ ভরে তার ভালোবাসার মানুষটিকে এবং তাদের একমাত্র চিহ্নকে দেখছে। চোখ ভর্তি পানি নাজরানার। সে হাত বাড়িয়ে তাদের হলুদ রাজপুত্রকে কোলে তুলে নিল। নাজরানার শরীর প্রচন্ড দূর্বল। সে বাচ্চাটির মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিল। বুকের সাথে একদম শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে বাচ্চাটিকে। নাজরানা ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

-” তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। ভালো করে শুনো। আমি চলে গেলে, তুমি আরেকটি বিয়ে করে নিও। আমাদের ছেলের জন্য খুঁজে খুঁজে একদম ভালো মা নিয়ে আসবে। আমাদের ছেলের ভালোবাসায় কখনো যেন কমতি না পড়ে। তুমি নিজে সাবধানে থাকবে। মেজাজ আগের মতোই গরম থাকুক। তবে সেটি শুধু আমার জন্যই। একটি জিনিস খুঁজতে গিয়ে পুরো বাড়ি এলোমেলো করো না। টেবিলের উপর আমার একটি ডায়রি আছে। সেখানে সবকিছু লেখা কোথায় কি রেখেছি। আমি আর তুমি যে দোলনায় বসে আমাদের একান্ত সময় কাটাতাম, সে দোলনাটি তুমি খুলে স্টোর রুমে রেখে দিও বা ফেলে দিও। আমি চাই না, আমাদের স্মৃতি তোমার মনকে বিষিয়ে ফেলুক। মাকে বলবে, মাছের কাঁটা বেছে দিতে। এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেলে, এখনো মাছের কাঁটা বাছতে শিখলে না। আমাদের সেই পুরোনো কোলবালিশটিকে তুমি আমাদের ছেলের পাশে রাখবে। যাতে সে মা মা গন্ধ পায়। আমার তো এ কোলবালিশ আর তুমি ছাড়া ঘুমই আসে না! ”

মাসিফের চোখ ভর্তি পানি। সে ধমক দিয়ে বলল,

-” এসব কথা আর কখনো বলবে না, নাজ। আমি, তুমি আর আমাদের ছেলে একসাথে থাকবো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

নাজরানা মাসিফের দিকে কাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

-” আমাকে একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাবে? ”

মাসিফ উঠে গিয়ে নাজরানাকে একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। শুধু কপালে নয় পুরো মুখে পাগলের মতো চুমে খেয়ে বলল,

-” কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখনই ডাক্তারকে ডাকছি। ”

নাজরানা বাচ্চাটিকে তার পাশে রেখে, মাসিফের হাত ধরে তাকে আটকে দিল। এরপর দূর্বল হাতে তার সামনে নিয়ে আসলো মাসিফকে। তার গালে একটা চুমু খেয়ে বুকে মাথা গুজে দিল। মাসিফ লক্ষ্য করল, নাজরানার শরীর কেমন ভারী হয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নাজরানা বলল,

-” ভালোবাসি তোমাকে। তুমি ভালো থেকো। আমাদের ছেলের খেয়াল রেখো। কখনো মন খারাপ করবে না তুমি। ”

এটি বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীরের সমস্ত ভার মাসিফের গায়ের উপর ছেড়ে দিল। মাসিফ ডাক্তারকে চিল্লিয়ে ডাকলো। ডাক্তার এসে নাজরানার পালস রেট চেক করলে বলে,

-” দুঃখিত। তিনি আর বেঁচে নেই। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে আপনার স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ ছিল না আজ। আপনার পরিবার এখনো ব্লাড জোগাড় করতে পারেনি। ”

এ কথা শুনে মাসিফ হেলে পড়লো। নাজরানাকে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।

______

দেখতে দেখতে মাহতিমের বয়স চার পাড় হলো। নাজরানার প্র‍্যাগনেন্সির সময়ই তারা তাদের ছেলে বাবুর জন্য এই নামটি ঠিক করেছিল।

-” আব্বু! আব্বু! উঠো না। আর কত শুয়ে থাকবে! সকাল ৬টা বাজে। আজকে কি মনে নেই তোমার? ”

মাহতিম ছোট ছোট বুলি আওড়িয়ে মাসিফকে ডাকছে। মাসিফ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,

-” ওরে বাবা। আমার ছেলেটা কত বড় হয়ে গেল! আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ”

মাহতিম ছোট ছোট হাতে মাসিফের হাত ধরে টানতে লাগলো। কিন্তু শক্তিতে পারছে না। মাসিফ নিজেই উঠে গেল।

নাজরানা মা°রা যাওয়ার পর মাসিফ নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছিল। পরে অবশ্য ছেলের মায়াভরা মুখ দেখে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করেছে সে। নাজরানার সেই দোলনা সে এখনো সরিয়ে দেয়নি। প্রতিটি রাতে সেই দোলনায় না থাকলে তার দমবন্ধ লাগে। মাসিফের এখনো মনে হয়, নাজরানা তাকে ও মাহতিমকে দূর থেকে দেখে থাকে। যদিও এসব সম্ভব নয়, তাও মাসিফের মনের শান্তি এটি।
মাসিফের আলমারি, ড্রয়ার প্রতিটি জায়গায় এখনো নাজরানার জিনিসপত্র আগের মতোই আছে। কত সহস্র বার যে তার নাজের ডায়েরিটি পড়েছে সে!

আজ নাজরানার মৃ’ত্যুবার্ষিকী। মাহতিমকে তার দাদা, দাদিই বলেছে এই দিনে তার আম্মু সেই অন্ধকার ঘরে চলে গিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে ডেকে নিয়ে গেছে। তাই আর আসবে না।
এদিনে মাহতিম তার বাবাকে নিয়ে আম্মুর কাছে আসে। প্রতি বছর একটি ফুল বা তার ব্যবহৃত কোনো জিনিস তার আম্মুকে দিয়ে আসে।

নাজরানার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মাহতিম বলল,

-” আম্মু, তুমি অন্ধকারে একদম ভয় পেও না। আমি আর আব্বু সবসময় এখানে আসবো। জানো, আজকে কি এনেছি তোমার জন্য? গতকালকে আব্বুর সাথে বসে আমি অনেক লিখা শিখেছি। সেই পেন্সিলটা তোমার জন্য এনেছি। রাতের বেলা তো আসতে পারি না। তাই তুমি পেন্সিলটা রাখো। ”

মাসিফের ছেলের জন্য মন কেঁদে উঠলো। কি মায়াভরা অবুঝ কথা তাদের ছেলের! নাজরানা তাদের এভাবে ছেড়ে চলে না গেলেও পারতো!

মাসিফ বলল,

-” মাহা, দাদার সাথে গাড়িতে বসো। আমি একটু পর আসছি। ”

মাহতিম চলে গেলে মাসিফের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাসিফ মনে মনে বলতে লাগলো,

-” দেখেছো, তুমি! আমি আর মাহতিম কত একা তোমাকে ছাড়া। তুমি থাকলে জীবনটা কত সুন্দরই না হতো! তোমার #হলুদ_ক্ষণে_স্তব্ধতা আমি প্রথম এনেছিলাম। এরপর তুমিই হলুদ রাঙা ফুটফুটে ফুল আমার হাতে তুলে দিয়ে, আমার পৃথিবীকে স্তব্ধ করে চলে গেলে। তুমি আমায় এতো ভালোবাসলে কেন নাজ? তুমি ভালো না বাসলে আমার মন কখনোই বাধ্য হতো না তোমায় অসীম ভালোবাসা দিতে। যদি কোনোভাবে মৃ’ত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে বোধ হয় সকলেই সুখে থাকতো। তবে তা যে নিতান্তই অবাস্তব। ”

মাসিফ কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নাজরানার কবরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখন মাহতিমই তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। তাকে ঘিরেই বেঁচে থাকতে হবে মাসিফের। নাজরানাকে কথা দিয়েছে, মাহতিমকে কখনোই ভালোবাসার কমতি অনুভব হতে দিবে না। মাসিফই তার বাবা, মাসিফই তার মা।

#সমাপ্ত

[ ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। এ গল্পের পুরোটা সময় ধরে যারা ছিলেন, তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অবিরাম ভালোবাসা❤️। সকলে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here