#হলুদ_ক্ষণে_স্তব্ধতা💛
#পর্বঃ৫
লেখনীতে- #ইয়ানাত_রোযী
গ্রামের বাড়িতে মাসিফের বরাদ্দকৃত রুমেই নাজরানা মাসিফের জন্য অপেক্ষা করছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। বাইরে চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অবশ্য হবে না’ই বা কেন?
বাসর ঘরে ঢোকার আগে মাসিফের কাছে পুরো কাজিন মহলের বিশাল অঙ্কের টাকার দাবি আছে। নগদ ২৫ হাজার টাকা এখন দিতে হবে তাদের। এই বিয়েতে মাসিফের কাছে তারা গেট ধরার টাকা, বিয়ে বাড়িতে বরকে খাওয়ানো শেষে হাত ধোয়ানোর টাকা, জুতা লুকিয়ে রেখে টাকা আদায় করা – এসব কোনো কিছুরই টাকা তারা পেলো না। এরপর বাসর ঘর সুন্দর করে ফুল, মোমবাতি, বেলুন দিয়ে সাজানোর জন্য আরেক পরিশ্রমের টাকা বাকি। সব মিলিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করেছে কাজিনদল। টাকা না দিলে তারা কিছুতেই মাসিফকে রুমে ঢুকতে দিবে না।
মাইফা মুখ বড় করে হামি দিয়ে বলল,
-” ভাইয়া, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। জলদি টাকাটা দিয়ে দাও তো আমাদের। ”
মাসিফ চোখ পাকিয়ে বললো,
-” ছিঃ ! তোর লজ্জা করে না ছোট বোনের বিয়েতে নিজে বিয়াত্তা হয়ে টাকার জন্য পড়ে থাকতে? ”
মাইফা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
-” আমার বোনের যেমন বিয়ে, তেমনি আমার ভাইয়েরও বিয়ে। আমি এখন বরপক্ষ। বড় ভাইয়ের কাছে বিয়েতে টাকা তথা উপহার চাওয়া অলিখিত এক নিয়ম। এসব যুগ যুগ ধরে চলছে। বুঝলে? ”
রোহান বলল,
-” ভাইয়া, যত দেরি করবে দেখবে তোমার বউ তত বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাসর রাত মিস করতে না চাইলে এখনই ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দাও তো। ”
মাসিফ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” তোদের সবগুলোর কানের নিচে একটা কষিয়ে থাপ্পড় না মারলে তোরা শোধরাবি না। পারবো না আমি টাকা দিতে। খুব ক্লান্ত আমি, রুমে যেতে দেয় আমায়। ”
ফিহা বিরক্তিমাখা মুখে বলল,
-” আমাদের জন্যই তোমাদের কি সুন্দর বিয়েটা হলো। আমরা তো আরও বেশি টাকার দাবিদার। ”
মাইফা ফিহাকে ফ্লাইং কিস দিয়ে বলল,
-” কি ঝাক্কাস কথাই না বললি তুই, বোনু ! হ্যাঁ, ভাইয়া আমাদের ৩০ হাজার টাকা দাও এখন। ”
ফাহিম বুকে হাত দুটো গুজে বলল,
-” ভাইয়া, তুমি যত দেরি করবে টাকার পরিমাণ তত বাড়তে থাকবে। আর ঝগড়া করে এখানেই রাত পার করতে চাইলে এই রাত দ্বিতীয়বার আর পাবে না। ভালোয় ভালোয় টাকা গুলো দিয়ে দাও। ”
মাসিফ চোখ পাকিয়ে থেকে অগত্যা টাকাগুলো দিয়ে দিল। অবশ্য সবটাকা দেয়নি। ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করেছে বিচ্ছু গুলোকে।
____
নাজরানা বাইরের সবার কথাগুলো শুনে খুব মজা পাচ্ছিল। হঠাৎ দরজার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো মাসিফ এসে দরজা বন্ধ করে দিল। নাজরানার বুকের ঢিপঢিপ বেড়ে যেতে লাগলো। মনে হলো, তার হৃদস্পন্দনের শব্দ বাইরে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ মাসিফের কথা শুনে তার সম্বিৎ ফিরে এলো,
-” এভাবে সঙের মতো বসে না থেকে, যা ভারী কাপড় ছেড়ে আয়। ”
মাসিফের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, সে হাত ঘড়িটি খুলছে। গাঢ় নীল পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেটির সাধারণ হাত ঘড়ি খোলার দৃশ্য এতো সুন্দর কেন লাগছে নাজরানার? মাসিফ ভাই কি আদৌ সুদর্শন পুরুষ নাকি তার দৃষ্টিতেই মাসিফ ভাইয়ের যে কোনো চলন ভঙ্গি সুন্দর লাগে? ইশ, নাজরানার চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। সে ভাবছে, কত নাটকীয় ভাবেই না ভালোবাসার মানুষটিকে পেল! মানুষটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হলো কেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে নাজরানার।
নাজরানা গালে হাত দিয়ে যখন এসব কথা ভাবছে, মাসিফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” আমি জানি, আমি অত্যাধিক মাত্রায় হ্যান্ডসাম। তাই বলে তুই আমাকে চোখ দিয়ে গিলে ফেলবি না! ”
নাজরানা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
-” যে না হ্যান্ডসাম! সে জন্যই তো কোনো মেয়ে আজ পর্যন্ত তোমাকে পছন্দ করেনি । ”
-” আমাকে কেউ পছন্দ করলে, তুই সে মেয়েটাকে আস্ত রাখতি?? তোর করা অবিচার গুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনো মেয়েই আমাকে পছন্দ করতে পারেনি। ”
শেষ কথাটি মাসিফ দুঃখ নিয়ে বলল। মাসিফের কথায় নাজরানার কিছু কথা মনে পড়ে গেল।
একবার মাসিফের বাসায় বেড়াতে গিয়ে দেখলো, তাদের বাসার সামনের আরেকটি বাসায় এক মেয়ে প্রতিদিন মাসিফ ভাইকে দেখলেই চুল খোলা রেখে ঘুরঘুর করে। এই মেয়েকে দেখলেই নাজরানার শরীরের আগুনের স্রোত বয়ে যায়। প্রতিদিন বিকালে ছাদে আসতো মেয়েটি মাসিফের আশায়। নাজরানাও সুযোগ বুঝে একদিন ছাদে গেল। বিকালে সচারাচর শহুরে মানুষজন অনেকটা শান্তির জন্য ছাদে উঠে। মেয়েটি ফোনে কথা বলা অবস্থায়, নাজরানা চুপিসারে তার পিছনে গিয়ে মেয়েটির অর্ধেক পিঠ সমান চুলগুলো এলোমেলোভাবে ঘাড় পর্যন্ত কেটে দিল। প্রচন্ড হাওয়া বয়ে চলায় মেয়েটি মনে করেছিলো চুল গুলো উড়ছে ও ফোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা বলায় খেয়াল করতে পারেনি। নাজরানা একটা কাগজে লিখে রেখে গিয়েছে,
-” ভুলেও এ চুল নিয়ে আর তোর বাসার সামনের ছেলেটার আশে পাশে ঘুরঘুর করবি না। নাহয়, যে চুল আছে সেটাও থাকবে না। ”
কাগজটি ইটের টুকরা দিয়ে চাপিয়ে নাজরানা মাথায় বিশাল ঘোমটা দিয়ে প্রস্থান করল।
আরেকদিন, মাইফার বিয়েতে একটি মেয়ে মাসিফকে প্রপোজ করেছিল। পুরো কাজিনদল সেখানে ছিল। মেয়েটি মাসিফের আশে পাশে ঘুরঘুর করছে, মিষ্টি করে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে। মাসিফ বিষয়টি বুঝতে পেরেও ঘাটলো না। প্রেম যদি হেঁটে হেঁটে তার কাছে আসতে চায়, ক্ষতি কি?
মেয়েটি শেষে একটি ফুল বাড়িয়ে প্রপোজই করে দিল। নাজরানা যখন দেখলো, তখন মনে হলো সে যেন আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে লাগলো। নাজরানা এখন কিছু করতে গেলে, সবাই তাকে সন্দেহ করবে এই ভেবে যে, নাজরানা মাসিফকে পছন্দ করে।
তাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুরু থেকে পুরো ব্যাপারটি নাজরানা ভিডিও করলো।
মেয়েটি ছিল মাইফাদের প্রতিবেশি। তাই নাজরানার চিনতে অসুবিধা হয়নি মেয়েটির মা, বাবা কে হতে পারে! নাজরানা সুযোগ বুঝে, ভিডিও টি মেয়েটির বাবা,মা কে দেখায়। বলে,
-” মেয়েটি এখনো ছোট আন্টি। এখন আবেগের বয়স। আশা করি বিষয়টি খেয়াল রাখবেন আংকেল, আন্টি। একজন মেয়ে হিসেবে আমি চাই না আরেকজন মেয়ের ক্ষতি হোক। আমি মুখে বললে হয়তো আপনারা বিশ্বাস করতেন না। তাই ভিডিও করে আনতে বাধ্য হলাম। এই যে আপনাদের সামনেই এটি ডিলিট করে দিচ্ছি। ”
নাজরানা বিজয়ের হাসি হেসে চলে এলো সেখান থেকে। এখন যা করার মেয়েটির বাবা, মা’ই করবেন।
_____
অতীত ভেবেই খুব হাসি পাচ্ছিল নাজরানার। মাসিফ ততক্ষণে গোসল সেরে চলে এলো। এবার নাজরানা গেল ফ্রেশ হতে।
সুতির হালকা গোলাপি রঙের একটি থ্রি-পিস পড়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। এতো ভারী শাড়ি, তার উপরে মেকাপ – সব মিলিয়ে খুব অস্বস্তি অনুভব করছিল সে। এখন তার খুব ভালো লাগছে।
মাসিফ বিছানায় আধ-শোয়া হওয়া অবস্থায় বলল,
-” এই মেয়ে, এদিকে আয়। আজ সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলাম। পা গুলো খুব ব্যথা করছে। মালিশ করে দিয়ে যা। ”
নাজরানা বিস্মিত কন্ঠে বলল,
-” বিয়ের দিন রাতে কোন স্বামী তার বউকে দিয়ে পা মালিশ করায়? আর তোমার ঐ কোদালের মতো ভারী পা আমি মালিশ করতেই পারবো না। না ঘুমিয়ে আমি নাকি এখন পা মালিশের জন্য বসবো! ”
-” স্বামীভক্তি পরীক্ষায় তুই ডাহা ফেল করলি। স্বামীভক্ত হইলে জীবনে অনেক পূণ্য অর্জন করিতে পারিবে তুমি। বউদের স্বামীরা যা বলবে তাই করতে হয় বুঝলি? ”
নাজরানা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
-” সারাদিন তুমি বসার উপরেই ছিলে। তোমার তো পা ব্যথা করার কথা না। আমাকে সারারাত জ্বালিয়ে মারতে তুমি ফাঁদ পাতছো। কি মনে করেছো, আমি বুঝি না? ”
মাসিফ ভ্রু কুঁচকে ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে আছে। বলল,
-” মাথা ব্যাথা করছে। আমার মাথাটা মালিশ করে দেয় আর আমি ঘুমাই। ”
নাজরানার এই কথাটা মিথ্যে মনে হলো না। তাই সে মাসিফের পাশে বসে ধীরে ধীরে মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মাসিফ ঘুমিয়ে গেল। নাজরানা এক দৃষ্টিতে মাসিফের দিকে তাকিয়ে রইল। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে! নাজরানা হেসে মনে মনে বলল,
-” এটাকে নাকি বাসর রাত বলে! স্বামী,স্ত্রী এই রাতে কত সুখ,দুঃখের, গল্প করে। পরস্পরকে জানার চেষ্টা করে। আর এই মহাশয় আমাকে শত কথা বলে জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। ”
নাজরানার কপালের উপর পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে, মাথা নিচু করে মাসিফের কানে কানে বলল,
-” আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। বুঝলেন, আমার জামাইটা! ”
#চলবে
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ বিশাল পর্ব দিয়েছি। তাই আপনাদের বিশাল বিশাল মন্তব্যও চাই আমার☺️। ধন্যবাদ ]