হলুদ খাম, পর্ব:১৪+১৫

0
337

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

___________________[১৪]____________________

তনুর মনে পড়ল, মামি বলছিলো সায়ন নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে।
আচ্ছা সে কি এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে আছে!! সায়ন এবার বিরক্ত হয়ে বলল,

” ওভাবে পান্ডার মতো তাকিয়ে আছিস কেন!? চোখ দিয়ে তো এতক্ষণ আমাকে গিলে খাচ্ছিলি!!

” ক”কই! না তো।

” সব দেখেছি আমি। আমার তো ভয় হচ্ছে তোর নজর পেয়ে আমার শেষে না আবার জ্বর আসে।

” হুহ। দেখেছি বেশ করেছি। আরও দেখবো। আমার জিনিস শুধু আমিই দেখবো।

তনুর শেষের কথাটা শুনে সায়ন বাকা হাসল। তার এই হাসিটা তনুর মারাত্মক লাগে।
না পারে তাকিয়ে থাকতে, না পারে চোখ ফেরাতে। সায়ন তনুর আরও কাছে এসে বলল,

” মনে হচ্ছে খুব বড় হয়ে গেছিস! দাড়া, ফুপ্পিকে বলে তোকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।
____________________________
|
|
|
|
|
দুপুরে খাওয়ার সময় তনুর পাশে বসেছে সায়ন। তনু প্রথমে খুশি হলেও পরে বুঝতে পেরেছে সায়নের উদ্দেশ্য কি!
তনুকে জ্বালানোর জন্য সায়নের স্পর্শ করা লাগছেনা। খেতে খেতে হুটহাট তনুর দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
তনু পানি খাওয়ার জন্য জগ নিতে গেল। কিন্তু নিতে পারলো না। তার আগেই সায়ন জগ নিয়ে তনুর গ্লাসের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ পানি ঢেলে বলল,

” নে খা।

তনু বেচারি না পারছে সায়নের এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পারছে কিছু বলতে।
তার চোখেমুখে কেমন একটা চোর চোর ভাব দেখা যাচ্ছে। কেউ দেখছে কি না সেই ভয়ে সে একবার এদিক তাকাচ্ছে আবার ওদিক তাকাচ্ছে।

রুশার দিকে তাকিয়ে দেখল সে মুখ ভার করে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।
সে খাচ্ছে কম হাত নাড়ছে বেশি। তনু বুঝতে পারছেনা রুশার কি এমন হয়েছে যে এখনো মনমরা হয়ে বসে আছে।

আচ্ছা ও কি কোনো ঝামেলায় পড়েছে!? হতে পারে কোনো ছেলে ঘটিত ব্যাপার।
যা হয়তো কারো সাথে বলতেও পারছেনা। তনু ভাবল খেয়ে উঠে রুশার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে।

তনুর খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। সায়ন খেয়ে উঠে গ্লাস মুখে ধরে পানি খেতে খেতে এক কাজ করে বসল। সে পানি খাওয়া যেমন তেমন, হটাৎ করে কাশতে কাশতে পুরো পানিটুকু সে তনুর গায়ে ফেলে দিল!

তনুর চুলসহ ডান হাতের কনুই পানি পড়ে ভিজে গেছে। তনু এবার আর সহ্য করতে পারলো না। রাগে গজগজ করতে করতে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সায়ন কাশতে কাশতে উঠে বেসিনের দিকে ছুটল।
তনুর এবার ভয় হতে লাগল, সায়নের গলায় কিছু আঁটকে যায়নি তো! হয়তো সেজন্যই তাড়াহুড়ো করে পানি খাচ্ছিলো!!

এদিকে সবাই বলতে লাগল, ” একটু আস্তেধীরে খাবি তো। কি একটা অবস্থা। দেখো ওর নাকমুখ দিয়ে পানি উঠে গেছে কিনা। আরও অনেক কিছুই বলল কিন্তু সায়ন বা তনুর সেদিকে খেয়াল নেই।

সায়ন বেসিনের সামনে এসে কাশতে কাশতে হাত ধুয়ে নিল। তনু এসে দেখল এখনও সায়নের কাশি থামেনি।
কাশতে কাশতে বেচারার ফর্সা চোখমুখ একদম লাল হয়ে গেছে। তনু তাড়াতাড়ি হাত ধুতে ধুতে চিন্তিত স্বরে বলল,

” আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

সায়ন কিছু বলছে না, সে কেশেই চলেছে। কাশির চোটে সে হয়তো বলতে চেয়েও পারছেনা।
তনু হাত ধুয়ে সায়নের দিকে এগিয়ে আসার আগেই সায়ন দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো।
তনুও ছুটল তার পিছুপিছু। সিড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় এসে দেখল সায়ন নেই!
|
|
|
|
|
__________________________

কোথায় গেলো সায়ন!? মাত্রই তো ওপরে এলো। তনু বারান্দার এমাথা ওমাথা একবার ভালো করে দেখে সায়নের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
দরজাটা খোলাই আছে। তনু দ্রুত পায়ে ভেতরে এসে ঢুকতেই পেছন থেকে দরজা বন্ধের শব্দ এলো। তনু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেছন ফিরতে ফিরতে বলল,

” এসব করার কি দরকার ছিলো। আমি তো নিজেই আসতাম। জানেন আপনাকে ওভাবে কাশতে দেখে কত ভয় পেয়েছি!?

সায়ন দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দুহাত বুকে গুজে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

” দেখছিলাম। আমার কিছু হলে তুই কি করিস।

” এসব আপনার কাছে মজা মনে হয় তাই না!?

” হুম মজাই তো। যখন তুই আমার চিন্তায় পাগল হয়ে যাস, তখন নিজেকে ভাগ্যবান ভেবে মজা পাই। ভাবি যে, মায়ের পরেও আমার জন্য কেউ এভাবে দুশ্চিন্তা করে!

তনু চুপচাপ তাকিয়ে আছে সায়নের দিকে। সে আসলে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তার প্রায়ই এমন হয়, সে ভাবে তার কিছু বলা দরকার কিন্তু সে ভেবে পায়না কি বলবে।
তার মন আর মস্তিষ্ক এমন সিচুয়েশনে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। সায়ন দরজা থেকে সরে সোজা হয়ে দাড়ালো। তনুর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

” এছাড়াও তোর তো খাওয়াই শেষ হচ্ছিলো না। কত খাস রে তুই। তোকে খাওয়াতে খাওয়াতেই তো আমার সব শেষ হয়ে যাবে।

” আমি মোটেই অতো খাইনা। হুহ।

” হুম এজন্যই তো দিনদিন পান্ডা হচ্ছিস।

তনু অবাক হয়ে নিজের স্লিম ফিট বডিটাকে একবার দেখে নিল। সে ভেবে পাচ্ছেনা সায়ন তার কি দেখে পান্ডা বলছে। তনু একটা মুখ ভেংচি কেটে বলল,

” চোখে চশমা লাগান বুঝলেন! এমন স্লিম ফিট বডি দেখেও আপনার মনে হচ্ছে আমি পান্ডা!!

” চোখে পাওয়ারফুল চশমা না লাগালেও এবার থেকে সানগ্লাস লাগাতে হবে দেখছি। পান্ডাটা দিনদিন হট হয়ে যাচ্ছে!

তনু আর কথা বাড়ালো না। সে জানে সায়ন কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র নয়। যেভাবেই হোক সে তনুর হাড়মজ্জা জ্বালিয়ে দেবে। আর তনু রেগে যাবে, সেই সুযোগে সায়ন তাকে চুমুটুমু দিয়ে ফেলবে। তারপর তার রাগ নেমে যাবে।

কিন্তু সে সুযোগ তো তনু দেবে না। সে এখন থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তারপর এই সায়নকেও বুঝিয়ে দেবে সে আর সেই আগের হাবাগোবা তনু নেই। সে এখন খুব চালাক হয়ে গেছে। তনু তার চালাকি প্রমাণ করার চেষ্টায় কথা ঘুরিয়ে বলল,

” আচ্ছা, রুশার কি হয়েছে জানেন!? সকাল থেকে দেখছি কেমন মনমরা হয়ে আছে।

তনু কথা ঘোরাচ্ছে দেখে সায়ন বেশ অবাক হল। তনু সাধারণত উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। মাঝেমধ্যে না পারলেও বোকাসোকা মার্কা কিছু একটা বলে দেয়।
আর সায়ন বারবার তনুর সেই বোকাসোকা কথা গুলোরই প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু এবার সেটা হয়নি দেখে সে বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে।

তনু কিছু একটা ভেবে বলল, ” আমার কি মনে হয় জানেন!? ও নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলায় পড়েছে।

” ও নিজেই তো একটা ঝামেলা। ও আবার কোন ঝামেলায় পড়বে!?

” উফফ! আপনার সব কিছুতে মজা করা লাগে!!

” এতে মজার কি পেলি তুই!? রুশা ঝামেলায় পড়েছে নাকি ওর কারণে অন্য কেউ ঝামেলায় পড়েছে তাই খোজ নে যা।

” আশ্চর্য! আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন!? ও’তো আমাদের বোন হয়। ওর কোনো ক্ষতি হলে কি আপনার ভালো লাগবে!? বলুন!

” তনু তুই না ওকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছিস। আমি ওকে বোন ভাবলেও ও নিজেকে আমার বোন ভাবে না।

” তাহলে কি ভাবে!?

” ধুর! মুডটাই নষ্ট করে দিলি!! ভাবলাম দুজনে আজ কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করবো। তা না, উনি পড়ে আছেন রুশা না ফুসা নিয়ে।

সায়ন শেষের কথা গুলো বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তনু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। সায়ন তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে ভেবেছিলো।
আর সে!? সবটাই ভেস্তে দিল!! তনুর এখন মেঝেতে পড়ে কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে। তনু নিজের ওপর রেগে উঠল,

” তনু! তুই আবারও প্রমাণ করে দিলি তুই একটা গাধী। শুধু গাধী না পান্ডা গাধী!!
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
___________________________
সায়ন নিচে নেমে হন্যে হয়ে রুশাকে খুজে বেড়াচ্ছে। এই মেয়ে তার শান্তি হারাম করার জন্য একেবারে রেডি থাকে সবসময়। আজ এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট চাচিকে জিজ্ঞেস করলে বলল,

” রুশা পুকুরপাড়ে।

এটা শোনা মাত্রই সায়ন পুকুরপাড়ে ছুটল। যেতে যেতে বলল,

” আল্লাহ! আমাকে ধৈর্য্য দাও। এই শাকচুন্নিটাকে আমি আজ পুকুরে চুবিয়ে না মারি।

সায়ন পুকুর পাড়ে এসে দেখল, রুশা ঘাটে বসে নিচ থেকে কয়েকটা ইটের ছোট্ট টুকরো নিয়ে নিয়ে পুকুরের পানিতে ছুড়ে মারছে। সায়ন সেদিকে যেতে যেতে বলল,

” রুশা! তোর সমস্যা কি বল তো!?

আচমকা সায়নের কন্ঠঃ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠল রুশা। সায়ন ঘাটের কাছে এসে বলল,

” তোকে না সকালেই বললাম, মনের মধ্যে যেসব অবাস্তব ধারণা পুষে রেখেছিস সেগুলো মুছে ফ্যাল!

” মুছতে বললেই কি মোছা যায় সায়ন!? এতো গুলো বছর ধরে যে অনুভূতি গুলো

” শাট আপ রুশা! তোর শয়তানি আমি বুঝি না ভেবেছিস? দ্যাখ তোকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, তোকে নিয়ে আমার মনে কোনো ধরনের ফিলিংস নেই আর না হবে কোনোদিন। তোর মাথায় যদি ঘিলু বলতে কিছু থাকে, তো আমার পিছে আর সময় নষ্ট করিস না।

সায়ন চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, ” আর নেক্সট টাইম যদি কোনো ঝামেলা করিস। তো তোকে আমি এই পুকুরের সচ্ছ পানিতে না, সোজা বুড়িগঙ্গায় নিয়ে চুবাবো।

সায়ন চেলে গেলো। গতরাতে তনুকে শোবার জন্য ডাকতে নিচে এসেছিলো রুশা।
বসার ঘরে আসতেই দেখল, সায়নকে জড়িয়ে ধরে আছে তনু। সাথেসাথেই রুশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। যদিও সে এমন কিছুরই ভয় করছিলো।
কিন্তু সেটা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি। রুশা সায়নের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি বুড়িগঙ্গায় ঝাপ দিতেও রাজি।
_________________________
|
[চলবে]

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

__________________[১৫]___________________

আকাশে মেঘ জমেছে। বাতাসে বইছে শীতল হাওয়া। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। যেমন তেমন বৃষ্টি নয়, একেবারে ঝুম বৃষ্টি নামবে। ঝুমঝুম বৃষ্টি নামতে চলেছে জেনেও খোলা ছাদের ওপর দাড়িয়ে আছে সায়ন আর তনু।

তারা যে মোটেই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য দাড়িয়ে নেই, সেটা তাদের গম্ভীর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুজনেই বেশ দূরত্ব রেখে দু’দিকে ফিরে দাড়িয়ে আছে। কেউ কোনো টু শব্দ করছে না।

তবে কিছুক্ষণ পর পর ঠিকই একজন আরেকজনকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে। হটাৎ দুজনের চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো তারা। সায়ন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

” তুই এখানে কি করছিস?

” ভিজতে এসেছি। আপনি কি করতে এসেছেন?

” আচ্ছা তোর কি মনে হয় তনু? এই দোতলার ছাদ থেকে কেউ লাফ দিলে সে কি মারা যাবে? নাকি শুধু তার হাত-পা ভাংবে?

সায়নের এমন ভয়ংকর প্রশ্ন শুনে তনুর আত্না কেপে উঠল। ভ্রুকুটি করে বলল,

” আপনি ছাদ থেকে লাফ দিতে এসেছেন!? কিন্তু কেন?

” আমি লাফ দেবো কোন দুঃখে!? আমি তো তোকে আর রুশাকে এখান থেকে ফেলে দেবো ভাবছি।

সায়নের কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ গুড়ুম গুড়ুম করে উঠল। তনু কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা, সে কি শেষে সায়নের রাগ ভাংতে এসে হাত-পা ভেঙে মরতে চলেছে!? সায়ন আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, তনু বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ছাদের রেলিঙের দিকে তাকিয়ে আছে।

সায়ন এবার শয়তানি হাসি দিয়ে তনুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তনু সামনে তাকাতেই দেখল সায়ন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সায়নের চলনভঙ্গিতে কেমন যেন ভিলেন ভিলেন ভাব চলে এসেছে। সায়ন ক্রুর চোখে তাকিয়ে বলল,

” চল তোকে দিয়েই শুরু করি। বহুত জ্বালিয়েছিস আমাকে। তোকে ফেলে তারপর রুশাকেও ফেলে দেবো।

সায়ন তনুকে ধরতে গেলে তনু লাফ মেরে কয়েক ধাপ পিছিয়ে এলো। বুকে হাত রেখে তার আতংকিত মনটাকে শান্ত করতে করতে বলল,

” এই! আপনি এসব কি বলছেন!? ছাদ থেকে ফেলে দেবেন মানে!?

” আহা তনুমনি! শুধু তোমাকে একা না তো, তোমার রুশামনিকেও ফেলে দেবো। তারপর তোমরা দুই বোন মিলে সুখদুঃখ শেয়ার কইরো। কেমন!!

তনু বুঝতে পারছেনা সায়ন হটাৎ এমন করছে কেন? আচ্ছা তাকে কি জ্বীনে ধরেছে! ধরতেও পারে। এখন পড়ন্ত বিকেল, কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান দেবে। এই সময় ছাদে থাকতে নেই। তনুর এবার ভয়টা আরও জেকে ধরেছে।

এদিকে তনুর ভীতু চাহনি দেখে সায়নের ভীষণ হাসি পাচ্ছে কিন্তু বেচারা ভিলেন ভাবটা ধরে রাখতে গিয়ে হাসতেও পারছেনা। তনু এবার চিলেকোঠার দরজার দিকে তাকালো। সে মনেমনে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে নিচতলায় চলে যাবে সে।

তনুকে চিলেকোঠার দরজার দিকে তাকাতে দেখে সায়ন বুঝল, তনু পালানোর পায়তারা করছে। কিন্তু সে তো তা হতে দেবে না। সে তনুর মনোযোগ সরানোর জন্য বলল,

” আচ্ছা যাইহোক, হাতে সময় কম। এক্ষুনি মাগরিবের আজান দেবে নামাজ পড়তে যাবো। তো লাফ দেওয়ার আগে তোর শেষ ইচ্ছাটা বল।

সায়নের এমন উদ্ভট কথা শুনে তনু মনোযোগ ধরে রাখতে পারলোনা। সে ভ্রুকুটি করে বলল,

” আপনি আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবেন?

” হুম করবো তো। মুভিতে দেখিস নি? কাউকে শূলে চড়ানোর আগে তার শেষ ইচ্ছা শোনা হয়। তো আমিও তোকে ফেলার আগে তোর শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো।

তনু ভেবে পাচ্ছেনা শেষ ইচ্ছা হিসেবে সায়নকে সে কি বলবে। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কি সে সায়নের কাছ থেকে একটু সময় চেয়ে নেবে? কিন্তু সায়ন তো বলল সে নামাজে যাবে। মানে সময় নেই। তনু আমতা-আমতা করে বলল,

” এতো তাড়াহুড়ো করে ছাদ থেকে ফেলে দেবেন? একটু সময় নিয়ে ফেললে ভালো হত না! আমি তো শেষ ইচ্ছা কি এখনও তা ঠিকই কর‍তেই পারছিনা।

” সে তোর ভাবার বিষয়। আমি তো যা করার ছাদ থেকে নামার আগেই করবো। নে জলদি বল, হাতে সময় কম।

” আচ্ছা আপনি বরং আগে রুশাকে ফেলে দিন। আমি ততক্ষণে ভেবে নিই।

চিলেকোঠার দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল সায়ন। সাথেসাথেই তনু হতভম্ব হয়ে তাকালো। সে কথা ঘোরাতে ঘোরাতে সুযোগ মতো পালিয়ে যাবে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, সে একা না সায়নও তাকে উল্টাপাল্টা কথায় আঁটকে রেখে তার পালাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তনু অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

” আমার কোনো শেষ ইচ্ছা নেই। নিন ফেলে দিন আমায়। আপনাকে না অনেক জ্বালাই আমি? নিন জ্বালা থেকে মুক্ত হয়ে যান।

প্রতিত্তোরে সায়ন কিছুই বলল না। ভাবলেশহীন ভাবে তনুর দিকে এগিয়ে এলো। তনুর এবার খুব অভিমান হচ্ছে,

” সায়ন কি সত্যিই আমায় ছাদ থেকে ফেলে দেবে!? দিলে দিক, পরে ভূত হয়ে ওর ঘাড়ে চাপবো। ওর অন্য কোথাও বিয়ে হতে দেবোনা। জোর করে করতে চাইলে ওর ঘাড় মটকে দেবো। তারপর ওকেও ভূত বানিয়ে সাথে নিয়ে যাবো।

সায়ন তনুর সামনে সোজা হয়ে দাড়িয়ে বলল, ” বড়দের মতো কথা বলতে কে বলেছে তোকে? আর যার সামনে যা পারিস বল। কিন্তু আমার সামনে এরকম বড়দের মতো ভং ধরলে, থাপড়াইয়া তোর দাত সব ফেলে দেবো!

শেষের কথাটা সায়ন বেশ ধমকের সুরে বলল। সাথেসাথে কেপে উঠল তনু। সে এতক্ষণে বুঝেছে, সায়ন কেনো তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে বলছিলো। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে।

তনু ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কে জানে একটু নড়াচড়া করলেই সায়ন তাকে চড়টড় মেরে বসে কি না। সায়ন তনুর ওড়না ঘুরিয়ে মাথায় দিতে দিতে বলল,

” চল। আজান দিচ্ছে, নিচে গিয়ে নামাজ পড়বি।

বলেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল সায়ন। তনুর মাথায় কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কিছু বলতে চাইছে নাকি জানতে চাইছে ঠিক বুঝতে পারছেনা সায়ন। তনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

” কিরে পেত্নী! এখনও দাড়িয়ে আছিস কেন!? নিচে যাবি নাকি কোনো গাছের ডালে যাওয়ার প্ল্যান করছিস!!?

” আমি নাহয় বড়দের মতো কথা বলেছি বলে ছাদ থেকে ফেলে দিতে চাচ্ছিলেন। রুশাকে কেন ফেলে দিবেন বললেন!? ওর সাথে কি সমস্যা আপনার!? নাকি ওর সাথেও প্রেম করছেন!!?

তনুর কথা শুনে সায়ন কোনো রিয়াক্ট করলো না। এগিয়ে এসে তনুর হাত ধরে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,

” বাচ্চামো করা ভালো। অবুঝ হওয়া ভালো না।

তনু বুঝল সে আবারও ভুল করেছে। সায়নকে ভুল বুঝেছে সে। কিন্তু সে কি করবে? সায়নের আশেপাশে কোনো মেয়েকে দেখলেই রাগে গা জ্বলে যায় তার। সায়নকে হারিয়ে ফেলার ভয় চেপে ধরে তাকে। এটা কি তার দোষ!?

সে মনে প্রাণে সায়নকে বিশ্বাস করে। কিন্তু এই আড়াইটা বছর তনুর ওপর দিয়ে কিভাবে গেছে সেটা একমাত্র সেই জানে। সায়নের সেই কথা গুলো প্রতিনিয়ত কানে বাজতো,

” তনু আমি খুব খারাপ ছেলে। তুই ছাড়াও ভার্সিটিতে আমার আরও গার্লফ্রেন্ড আছে!

মন বিশ্বাস না করতে চাইলেও মস্তিষ্ক বলতো এটাই সত্যিই। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাতরেছে তনু। সায়ন আসেনি। এসে একবার বলেনি,

” তুই কি জানিস না? হলুদ খাম শুধুই কুরচি ফুলের! সেখানে অন্য ফুলের প্রবেশ নিষেধ!!
—————————–
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|___________________________

তনুকে বারান্দায় রেখে সায়ন দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। তনুর ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার,

” মেয়েটা এমন কেন? এতো ভালোবাসার পরও আমাকে অবিশ্বাস করছে!? আবার জিজ্ঞেস করছে, রুশার সাথে প্রেম করছি কি না! ও কি এটাও বোঝেনা যে রুশার সাথে ইচ্ছে করেই ওমন করছিলাম শুধু ওকে জ্বালানোর জন্য!? আচ্ছা ও তো আগে এমন ছিলো না। তাহলে এখন কি হয়েছে ওর?

আর ভাবতে পারছেনা সায়ন রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা মসজিদের উদ্দেশ্যে চলে গেলো সে।

_________________________

ঘড়িতে রাত নয়টা বাজে। সায়ন এখনও বাসায় ফেরেনি। তনিমা সেই কখন থেকে নিচতলার বারান্দায় পায়চারি করে চলেছে। আজ সারাদিনের ঝামেলায় সায়নের সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি সে। যতক্ষণ না সবকিছু সায়নকে জানাবে, ততক্ষণ স্বস্তি পাবে না তনিমা।

সন্ধ্যা হতেই সেলিনার বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। মনের ভুলে সে বাতের মলমটা সাথে আনেনি। ব্যাথায় কোকাচ্ছে সেলিনা। হাসু মিয়া কোত্থেকে একটা গাছড়া তেল এনে বলছে,

” এইডার উপরে কোনো ওষুধই নাই। এই তেল একবার লাগাইলে ব্যাথা কুথায় হারাই যাইবো আপনে টেরই পাবেন না।

সেলিনা সবই শুনলেন কিন্তু হাসু মিয়ার হাতে ধরা বোতলে সেই ছাই রঙের তেলের চেহারা দেখে সেটা মাখার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না তার। কিন্তু হাসু মিয়া তো নাছোড়বান্দা। এই অদ্ভুত তেলের গুনাবলী বলতে বলতে সে পিরিচে খানিকটা ঢেলেও ফেলল। সেটা থেকে অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে।

ব্যাথায় সেলিনার যায়যায় অবস্থা। হাসু মিয়া তাড়াতাড়ি পিরিচটা রাবেয়ার হাতে ধরিয়ে বলল,

” ভাবি! তাড়াতাড়ি এইডা মালিশ কইরা দেন। দ্যাখবেন ব্যাথা একদম হাওয়া।

রাবেয়া পিরিচ হাতে নিয়ে সেলিনার দিকে তাকালো। সেলিনা মুখে কিছু না বললেও তার চোখমুখ কোচকানো দেখে মনে হচ্ছে সে এই তেল কিছুতেই মাখবেনা। রাবেয়া তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল,

” ভাবি! কোন পায়ে দেবো!?

সেলিনা ফ্যাকাশে মুখ করা তাকালো। ব্যাথায় তার শিরা ছিড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে পা টা কেটে ফেললে ভালো হত। কিন্তু এই বিশ্রি তেলটাও মাখতে ইচ্ছে করছে না। সেলিনা আমতাআমতা করে বলল,

” এ ব্যাথা আমার প্রায়ই হয়। চিন্তার কিছু নেই আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে।

রাবেয়া বুঝে গেছে সেলিনা এ তেল মাখবে না। কিন্তু হাসু মিয়া বুঝতেই চাচ্ছেনা। সে এই তেল মাখিয়েই ছাড়বে। রাবেয়া না পেরে বলল,

” ভাই আমার মাথাটা খুব ধরেছে। এই তেলের গন্ধে আরও গা মাথা ঘুরছে। আপনি বরং এটা আপাকে দিন। আমি ঘরে গেলাম।

রাবেয়া সেখান থেকে কেটে পড়ল। সেলিনা ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করে বলল,

” ভাই আমার বাত ব্যাথা কমে গেছে। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। তেলটা আপনি নিয়ে যান।

হাসু মিয়া তেলের কার্যকারীতা দেখাতে না পেরে একটু মনোক্ষুণ্ণ হল। পিরিচ থেকে তেল টুকু আবার বোতলে ভরে নিল সে। বোতলের মুখ পেচাতে পেচাতে বলল,

” দেখলেন ভাবি!?

” কি ভাই?

” তেল না মাইখা শুধু গন্ধ শুইকাই আপনার বাত ব্যাথা ঠিক হইয়া গ্যাছে। তাইলে বুঝুইন একবার! এইডার গুনাগুন কত!!

সেলিনা তার কথায় একমত পোষণ করে হাসার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার হাসি দেখে কান্না নাকি হাসি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হাসু মিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সেলিনা শাড়ির আঁচল মুখে গুজে কোকাতে লাগল।

_____________________________

হাসু মিয়া তেলের বোতল নিয়ে সিড়ির মুখে আসতেই রুশার সাথে দেখা হল তার। রুশার মাথা জ্বলে যাচ্ছে, অনেক ভেবেও সায়ন আর তনুকে আলাদা করার উপায় খুজে পাচ্ছে না সে। তার এখন মাথায় তেল দিতে হবে। মাথায় তেল দিলে মাথা ঠান্ডা হবে। তারপর ঠান্ডা মাথায় সে উপায় খুজবে। হাসু মিয়ার হাতে বোতল দেখে রুশা বলল,

” এটা কি কাকু?

” এইডা তেল। ওষুধও কইতে পারো। যেকুনো ব্যাথা একদম নিমিষেই হাওয়া কইরা দ্যায়।

” আরে তাহলে আমাকে দিন আমি মাখবো।

” কুথায় মাখবা?

” কোথায় মাখবো মানে?

” আরে এইডা কিন্তু

হাসু মিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রুশা ছো মেরে বোতলটা নিয়ে যেতে যেতে বলল,

” আমাকে এখন তেল মাখতে হবে কাকু। মাখা হলে আপনাকে আবার দিয়ে দেবো।

হাসু মিয়া সেদিকে তাকিয়ে বলল, ” আহারে! এই বয়সে চেংরীডার বাতের ব্যথা ধরছে!
_______________________
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here