হলুদ খাম, পর্ব:২০

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

____________________[২০]___________________

নিচতলার বারান্দায় বসে আছে রুশা আর তনিমা। রুশার চুলে তেল দিয়ে চিরুনি চালিয়ে চুলের জট ছাড়াচ্ছে সে।
প্রতিবার চিরুনিতে উঠে আসছে গাদা গাদা চুল। রুশার সেদিকে হুস নেই, আজ যদি সে টাকলাও হয়ে যায় তাতে কোনো যায় আসে না তার। সায়ন আর তনুকে আলাদা করতে পারলেই হল।

কিন্তু এখনও কোনো সাড়াশব্দ নেই দেখে রুশা বেশ অস্থির হয়ে পড়ছে।
বড় চাচা কখন চাচিকে কল দেবে সেই অপেক্ষায় কান খাড়া করে রেখেছে রুশা।
তার অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সেলিনার ফোন বেজে উঠল! সাথেসাথে আনন্দে নেচে উঠল রুশার মনটা।

সেলিনা রান্নায় ব্যস্ত, রাবেয়া গোশতের জন্য মশলা বাটতে বসেছে। সেলিনা রান্নাঘর থেকে হাক ছাড়ল,

” এই রুশা! আমার ফোনটা নিয়ে আয় তো!

সেলিনার বলতে দেরি, রুশা চুল ছাড়ানো রেখেই ঘরে ছুটে এলো। বসারঘরে ফোনটা চার্জে দেওয়া আছে, ফোনস্ক্রিনে নাম উঠে আছে ” স্নেহার আব্বু!

রুশা তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে রান্নাঘরে ছুটল। তার হন্তদন্ত অবস্থা দেখে রাবেয়া বলে উঠল,

” এতো ছোটাছুটি করছিস কেন রে! আরেকটু হলে তো বটিতে পা বেধে উলটে পড়তি।

রুশা সে কথায় পাত্তা দিলো না। সেলিনা ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করল।
রুশা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সেলিনার মুখের দিকে। ওপাশ থেকে সায়নের বাবা কি বলছে কে জানে।
সেলিনার ক্লান্ত মুখটা আরও মলিন হয়ে গেছে। সে ফোন কানে ধরে রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে রাবেয়াকে বলল,

” চুলোয় গোশতটা দেখো।

বলেই দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো সেলিনা। রুশা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সেলিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে,

” চাচি আবার ওপরে গেলো কেন? আমিও কি ওপরে যাবো!

” নাহ, চাচি জিজ্ঞেস করলে তখন কি বলবো!

” কি আর বলবো, বলবো যে আমি দরকারি কিছু নিতে এসেছি। ব্যস!

রুশা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সিড়ি বেয়ে উঠে এলো। সেলিনা ফোন কানে ধরে বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে।
রুশা পা টিপে টিপে কিছুটা এগিয়ে গেলো। সেলিনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” মাথা ঠান্ডা করো। কাল আসি, তারপর কথা হবে।

বলেই কল কেটে দিল সেলিনা। ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল। এদিকে রুশা বিরক্ত হয়ে মনেমনে ভাবছে,

” আবার বাসায় ফিরে কি বলবে! যা বলার এখানে বললে কি হচ্ছিলো।

” উফফ, চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে।

রুশা কিছুক্ষণ পর আস্তে-ধীরে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো যাতে সেলিনার সামনে না পড়তে হয়।

____________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
বিকেলের আলো কমে আসছে, বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে রাবেয়া, তনিমা আর সেলিনা।
একটু পর মাগরিবের আজান দেবে। তনু আর রুশা এখনো ঘুমোচ্ছে। সায়ন একটু আগে বাইরে গেছে, সাথে গেছে হাসু মিয়া।

চা খেয়ে রাবেয়া ট্রেটা নিচে নিয়ে গেলো। রাবেয়া নিচে নেমে যেতেই সেলিনা অস্থির হয়ে বলল,

” আপা! একটা সমস্যা হয়েছে!

” কি হয়েছে ভাবি! তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

” স্নেহার আব্বু সায়ন আর তনুর ব্যাপারটা জেনে গেছে।

” সে’তো ভালো কথা। আজ না হোক কাল তো ওরা বিয়ে করবে। তখন তো সবাই জানবেই।

” ব্যাপারটা জানাজানির নয় আপা। স্নেহার আব্বু দুপুরে কল করেছিলো।
রিসিভ করতেই বলল, ” এসব আমি কি শুনছি সেলিনা! সায়ন আর তনুর মধ্যে কি চলছে?
আমি বললাম, ” তোমায় কে কি বলল শুনি!
পরে বলছে,” কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়, সায়ন আর তনু কি রিলেশনে আছে?
আমি হ্যাঁ জানাতেই বলল,” তুমি কাল ভোরেই সায়নকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ওর প্রেম করার স্বাদ আমি ভুলিয়ে দেবো। বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে প্রেম! না জানি কি না কি করে বসবে শেষে!! তখন আমি তনিমার সামনে মুখ দেখাবো কি করে!?

সেলিনা একটু থেমে আবার বলল, ” আপা তুমি তো জানো তোমার ভাইয়ের মাথা কেমন গরম। অল্পতেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর এতোকিছু তো ফোনে বোঝানো সম্ভব না। তাই বললাম, বাড়ি ফিরে এ ব্যাপারে কথা বলবো।

তনিমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” ভালো করেছো ভাবি। আচ্ছা, ভাইয়া জানলো কিভাবে!?

” সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। মনে হচ্ছে অন্য কেউ ওকে বলেছে।

” কিন্তু কে বলবে? ওদের সম্পর্ক তো শুধু তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানেনা!

” সেটাই তো। আচ্ছা সায়ন বা তনু হয়তো কাউকে তাদের সম্পর্ক বিষয়ে বলেছে। পরে সেই হয়তো স্নেহার আব্বুকে জানিয়ে দিয়েছে।

” হুম হতে পারে। আচ্ছা বাদ দাও, কাল বাসায় ফিরে ভাইয়ার সাথে কথা বলো।

” হুম বলবো, কিন্তু সে আমার কথা শোনার আগে সায়নকে কিছু করে বসে কি না তাই ভাবছি। আর তোমার ভাইপো যে জেদি! বাপের ওপর রাগ করে শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে হয়তো।

” আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না। চলো কাল আমি আর তনুও তোমাদের সাথে যাই। তোমার সাথে সাথে আমিও ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলবো।

” তাহলে তো আরও ভালো হয়। তুমি আমাকে চিন্তামুক্ত করলে আপা।

বলে স্মিত হাসল সেলিনা। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। তনিমা আর সেলিনা মাথায় কাপড় দিয়ে আজানের উত্তর দিতে লাগল।

রুশার ঘুম ভেঙে গেছে, ভালো একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে তনুকে ডাকতে লাগল,

” এই তনু! ওঠ!! আজান দিচ্ছে।

তনু স্পষ্ট গলায় বলল, ” তুই যা ওজু করে আয়। আমি নামাজ পড়তে দাড়াচ্ছি।

বলেই বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো তনু। রুশা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ” তুই দুপুরে ঘুমাস নি!?

” না।

তনু ওড়না মাথায় দিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রুশার কেন জানি হটাৎ খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা সে কি খুব বেশি বেশি করে ফেলেছে!
কিন্তু এছাড়া আর কিই বা করতো সে। সায়ন যাকে সে ছোট থেকেই পছন্দ করে, যাকে বিয়ে করার স্বপ্নে ডুবে থাকে সারাক্ষণ তাকে কিভাবে অন্যের হতে দেবে! রুশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

__________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে তনু সবার আগে আগেই ওপরে চলে এলো।
খেতে বসে সায়ন একটা বারের জন্যও তার দিকে তাকায়নি।
অথচ সবার সাথেই কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছিলো।
কাল সকালেই যে যার বাসায় ফিরে যাবে, কোথায় সায়ন এসে তনুর সাথে একটু সময় কাটাবে তা না করে মহাশয় হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।

দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখটা ভার করে রইলো তনু।
হটাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালো। সায়ন এসেছে।
তনুর অভিমানটা যেন আরও জেকে বসল। মুখ ফিরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো সে। সায়ন এগিয়ে এসে বলল,

” আমাকে বিয়ে করবি তনু?

সাথেসাথে তনু লাফিয়ে উঠল। কি বলছে সায়ন! তনু সোজা হয়ে বসে সায়নের দিকে তাকালো। নাহ সে চোখে কোনো দুষ্টুমি খেলা করছে না। রাশভারী মুখে তাকিয়ে আছে সায়ন। তনু অবাক হয়ে বলল,

” আপনি কি এখনই আমাকে বিয়ে করবেন নাকি!

” আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।

” না দেবো না। আপনি কখনো আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছেন! আমিও দেবো না।

” তনু! আমি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি। আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করবো না। তুই কি এই বেকার ছেলেটাকে বিয়ে করবি?

এবার তনুর বেশ অস্থির লাগছে। সায়ন কি সত্যিই আর কোনোদিন জানতে চাইবে না তার মনের কথা!
জানতে চাইবেনা যে, সায়নের যেকোনো অবস্থাতেই তনু তাকে বিয়ে করতে রাজি।
সায়ন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তনুর দিকে। তনু দোলনা ছেড়ে নেমে সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম ভালোবাসা শুধুই আপনি। আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেও পারিনা।
আমি আপনার এবং শুধুই আপনার জীবনসঙ্গী হতে চাই।
বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আপনাকে সম্পুর্নভাবে নিজের করে পেতে চাই। এই কুরচি ফুল শুধু তার হলুদ খাম এর হতে চায় সায়ন।

সায়নের চোখ জোড়া খুশিতে চিকচিক করে উঠল। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে তার।
মাতাল করা মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে আসছে তনুর শরীর থেকে।
সেই মাদক মিশ্রিত ঘ্রাণ আর তনুর নেশা ধরা চাহনি সায়নকে বেসামাল করে দিচ্ছে। হুট করে সায়ন ডান হাত দিয়ে তনুর কোমর জড়িয়ে ধরল।

সাথেসাথে কেপে উঠল তনু। কিন্তু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না।
চরম আবেশে চোখ বুজে ফেলল সে। বাম হাতটা তনুর ঘনকালো চুলে ডুবিয়ে গলার পেছনে চেপে ধরল সায়ন।
নগ্ন গলায় পুরুষালী হাতের ছোয়া পেয়ে তনুর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।
সায়ন ধীরে ধীরে ঝুকে আসছে প্রেয়সীর গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটের দিকে।

তনুর হটাৎ মনে পড়ল বড় মামির কথা, সাথেসাথেই চোখ মেলে তাকালো সে।
সায়নও থেমে গেছে, মাথার মধ্যে ফুপ্পির বলা কথাটা বাজছে।
হটাৎ করে তীব্র অপরাধবোধ অনুভব হল সায়নের। তনুকে ছেড়ে সে অন্য দিকে ফিরে দাড়ালো। তনুর নিজেরও কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে।

সায়ন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” ঘুমাতে যা। অনেক রাত হয়েছে।

বলেই দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলো সায়ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুশা ওপরে এসে ডাকল তনুকে। তনুও ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শোয়ার সাথেসাথেই তনুর ঘুম চলে এলো। প্রশান্তির ঘুম!
|
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here