হলুদ খাম, পর্ব:১৩

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

___________________[১৩]__________________

সায়ন আর নিজেকে সামলাতে পারছেনা, ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে তার। নিজের সব রাগ নিয়ে তনুকে হ্যাচকা টান মেরে নিজের কাছে এনে বলল,

” আমাকে ভুলে যা তনু! নাহলে তোকে খুন করে ফেলবো আমি।

তনুর চোখে বাধ ভেঙেছে, নোনাজলে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে তার আকুতিভরা মুখটা। সায়ন এক ঝটকায় তনুকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

____________________________

সেই ঘটনার পরদিন সকালেই রাইসা’দের বাসা থেকে তনু বোচাগঞ্জে নিজেদের বাসায় ফিরে গেছিলো।
সায়নের প্রতি প্রচন্ড রাগ আর অভিমান নিয়ে ফোন নম্বর থেকে শুরু করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম সব জায়গা থেকে সে সায়নকে ব্লক করে দিয়েছিলো।

ভেবেছিলো সায়ন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু সায়ন ফেরেনি! এমনকি তনুর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু তনুর শত রাগের মাঝেও একটা আশা ছিলো, সায়ন আসবে!

এভাবে দিনের পর দিন চলে গেলো। একে একে সপ্তাহ পেরিয়ে এক মাস কেটে গেল।
তার পর মাসের পর মাস পেরিয়ে বছর কেটে গেলো। ধীরে ধীরে তনুর রাগ আর অভিমান একত্রে মিশে পরিণত হল জেদ এ।

একসময়কার দুষ্টু স্বভাবের চঞ্চল মেয়েটা ঘরকুনো জেদি মেয়েতে পরিণত হল।
কথায় কথায় তনু খুব রেগে উঠতো। রিলেটিভদের প্রোগ্রামেও যাওয়া বন্ধ করে দিল।
হটাৎ হটাৎ যেকোনো ব্যাপারে জেদ ধরে বসতো সে। আর সেই জেদ ধরে রাখতে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলতো।

________________________
|
|
|
|
|
ছোট মামির ডাক পেয়ে তনুর ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ মেলে দেখল, রাবেয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াতে আঁচড়াতে কি যেন বলছে।
তনুর ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি , তাই কথা গুলো সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না।
রাবেয়া চুল গুলো উঁচু করে খোপা বাধতে বাধতে তনুকে বলল,

” তনু তাড়াতাড়ি ওঠ। ওদিকে ছাগল জবাই দেওয়া হয়ে গেলো। তুই কি দেখবি না!?

তনু আড়মোড়া ভেঙে বলল,” না মামি। আমার ভয় লাগে! আমি দেখবো না।

” আচ্ছা দেখতে হবে না। উঠে নাস্তা করে নে চল। সবাই নিচে নাস্তা করছে।

তনু মাথা নাড়িয়ে সায় দিল, মানে সে যাচ্ছে। রাবেয়া চিরুনিটা রেখে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,

” আর এই সায়নটা কোথায় গেছে কে জানে। এতো করে বললাম খেয়ে যা। মাংস কাটতে বসলে তখন কে আবার নাস্তা রেডি করে দেবে!

সায়নের নাম শুনতেই তনুর ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।
গতরাতে সায়নকে জড়িয়ে ধরেছিলো সে! পরে আবার সায়নের গালে চুমুও খেয়েছে!! ভাবা যায়!!!

রিলেশনের দেড় বছরেও সে কোনোদিন নিজে থেকে সায়নকে স্পর্শ অব্দি করেনি।
সায়নই হুটহাট তার কপালে, গালে, হাতে ভালোবাসার পরশ ছুইয়ে দিতো।
তনু বেড থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে ভাবছে,

” এখন আমি সায়ন ভাইয়ার সামনে কিভাবে যাবো!? ইসস, ভাইয়া তো আমাকে লজ্জা দেওয়ার কোনো পথই অবশিষ্ট রাখবে না।

” না রাখে না রাখুক। আমি তো আর পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরিনি বা চুমু খাইনি। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে একটু আদর করেছি, হুহ।

_____________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
তনু চুল বেধে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসেছে। নিচতলায় বসারঘরে কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা শুধু রুশা ছাড়া।
সে পরোটা চিবাতে চিবাতে আরেক হাত দিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছে।
বারান্দা থেকে মামা-মামীদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। তারা ছাগল জবাই দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। তনু রুশার পাশে বসতে বসতে বলল,

” ছাগল জবাই দেওয়া হয়ে গেছে নাকি রে!?

” হুম। এখন কাটাকুটি চলছে।

তনু খেয়াল করল রুশার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। তনু ওর জন্য ঢেকে রাখা নাস্তার প্লেটটা নিয়ে খেতে খেতে বলল,

” তোর কি মন খারাপ!?

” না।

তনুর বুঝতে বাকি নেই রুশার সত্যিই মন খারাপ। কিন্তু কেন!? গতরাতেও তো বেশ হাসিখুশি ছিলো সে। তনু আবার বলল,

” তাহলে এমন চুপচাপ হয়ে আছিস কেন!?

” তো কি করবো নাচবো”?

রুশা রেগে যাচ্ছে দেখে তনু আরও অবাক হয়ে গেছে। কি হয়েছে মেয়েটার!?
এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন!? রুশা বেশ বকবকানি স্বভাবের মেয়ে।
যদিও মাঝেমধ্যে অকাজ করে বসে, আবার ঝাড়িও খায় সেজন্য। কিন্তু কখনো তো এমন রেগে যায় না।

তনুর সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই রুশা ঝটপট খেয়ে প্লেট রেখে হাত ধুতে চলে গেছে। তনুর কেন জানি ব্যাপারটা ঠিক সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। রুশার মনে কি চলছে কে জানে।

_____________________________
|
|
|
|
|
তনিমা, সেলিনা আর হাসু মিয়া মিলে আকিকার গোশত ভাগ করছে।
পাশেই একটা কাঠের চেয়ারে চোখমুখ অন্ধকার করে বসে আছে স্নেহার বাবা।
নাতনির আকিকায় স্নেহার বাবার ইচ্ছে ছিলো, সে বড় করে অনুষ্ঠান করবে। আত্নীয়স্বজন সহ গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করবে।

কিন্তু শেষ সময়ে এসে ইমরান আর স্নেহা বেকে বসল, সেইসাথে সায়নও সায় দিল। তাদের কথা হচ্ছে,

” সায়ন অনেক খুজেও গ্রামে ভালো একটা বাবুর্চি পায়নি। আর যে গরম পড়ছে, এতো লোকের রান্নাবান্নার ঝামেলা কে নেবে!?
সেলিনার বাতের ব্যথা আছে, সে বেশিক্ষণ না দাড়াতে পারে না বসতে পারে।
রাবেয়ার আবার বেশিক্ষণ চুলার আচ গায়ে লাগলে গা জ্বালা করে।
বাকি রইলো তনিমা, সে তো আর একাই এতো লোকের রান্না করতে পারবে না।
তাই সিদ্ধান্ত হল, আকিকার গোশত ভাগ করে আত্নীয়স্বজন, গরীব মিসকিনদের মাঝে বন্টন করে দেওয়া হবে।

ইমরান আর স্নেহার মেয়ের নাম রাখা হয়েছে, “ইসমাত আরা”।
নামটা রেখেছে ইমরান। স্নেহা ভাবছে ইমরান কখন মেয়ের নাম ঠিক করল! তাকে তো আগে বলেনি।
তার সন্দেহ ছিলো ইমরান আদৌ কোনো নাম ভেবে রেখেছে কিনা। আকিকার সময় বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে ভেবে, নিজেই মনেমনে মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিলো। আর ভেবেছিলো ইমরান যদি মেয়ের নাম বলতে না পারে, তবে স্নেহা তাকে কয়েক মাসের রিমান্ডে নেবে। কিন্তু ইমরান এতো সুন্দর নাম রেখেছে দেখে সে অবাক হলেও বেশ খুশি হয়েছে।

___________________________
|
|
|
|
|
তনুর একা একা বসে খেতে ভাল্লাগছেনা। নাস্তার প্লেটটা হাতে নিয়ে বারান্দার দোলনায় এসে বসল। দোলনা জিনিসটা তাকে চুম্বকের মতো টানে। সেখানে বসে সে সারাটাদিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে।

দোলনায় দোল খাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে সায়নকে খুজে বেড়াচ্ছে তনু।
মহাশয় কোথায় আছে কে জানে। নাকি প্রেমিকার চুমু খেয়ে বদহজম হয়েছে তার!
ঠিক তখনই উঠোন পেরিয়ে হাস মুরগির খামারের দিকে তনুর দৃষ্টি আঁটকে গেল।

বাবার পাশে দাড়িয়ে সায়ন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিরাট এক লিস্ট নিয়ে দেখছে।
কাকে কাকে গোশত দেবে তার লিস্ট! তনু পরোটা চিবাতে চিবাতে কখন যে আঙুল মুখে পুরে ফেলেছে সেই খেয়াল নেই তার। সে লোভাতুর দৃষ্টিতে তার সায়নকে দেখতে ব্যস্ত।

রোদে ঘেমে সায়নের নভোনীল রঙের পাঞ্জাবিটার বেশ কয়েক জায়গায় ভিজে গেছে।
তাতে তার মেদহীন সুঠাম দেহ যেনো আরও ফুটে উঠেছে। কপালের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম গুলো সে মাঝেমধ্যে হাতের তালু দিয়ে মুছে নিচ্ছে।

আঙুলে দাতের কামড় লেগে তনুর হুস ফিরল। ক্ষণিকের জন্য ভ্রুকুটি করে আবার স্মিত হেসে সায়নের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আপনি একেবারে আঁশফলের মতো। আঁশফল খাওয়ার সময়ও আমার হুস থাকে না। যতই খাই আশ মেটে না। আপনি এতো অগোছালো কেন বলুন তো! এই যে আপনার কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম পড়ছে। সেটা মোছার জন্য তো সাথে টিস্যু প্যাকেট রাখতে পারেন।

” থাক রাখতে হবে না। আমি বরং আপনাকে একটা রুমাল বানিয়ে দেবো। তাতে সুন্দর করে আমার নাম লিখে দিবো।

এমন আজগুবি চিন্তাভাবনা মনে আসতেই তনু হেসে ফেলল। কিসব ভাবছে সে! সায়নকে যদি সে রুমালটা দেয়ও, সে হয়তো মুখ না মুছে তনুর সামনে নাক মুছবে। অসম্ভব কিছু নয়। সে তনুকে জ্বালানোর জন্য সবকিছু করতে পারে। তনুকে সূদুর হিমালয়ে নিয়ে গিয়ে পর্বতে না উঠিয়েই ফেরত নিয়ে চলে আসবে।

____________________________
|
|
|
|
|
সায়ন সব লিস্ট চেক করে হাসু মিয়াকে বুঝিয়ে দিল। সে এখন গোসল যাবে, তার ভীষণ গরম লাগছে। সিড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় আনতেই দেখল তনু আধখাওয়া নাস্তা নিয়ে দোলনায় বসে আছে। সায়ন পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,

” তনু আমাকে খাইইয়ে দে তো। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।

তনু এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলো। সায়নের কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে বলল,

” কেন আপনার কি হাতে ব্যাথা!?

সায়ন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ” তুই কি খাইয়ে দিবি!?নাকি আমি সারাদিন না খেয়ে থাকবো!? আমি কিন্তু সকাল থেকে খাইনি।

তনুর মনে পড়ল, মামি বলছিলো সায়ন নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে। আচ্ছা সে কি এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে আছে!! সায়ন এবার বিরক্ত হয়ে বলল,

” ওভাবে পান্ডার মতো তাকিয়ে আছিস কেন!? চোখ দিয়ে তো এতক্ষণ আমাকে গিলে খাচ্ছিলি!!

” ক”কই! না তো।

” সব দেখেছি আমি। আমার তো ভয় হচ্ছে তোর নজর পেয়ে আমার শেষে না আবার জ্বর আসে।

” হুহ। দেখেছি বেশ করেছি। আরও দেখবো। আমার জিনিস শুধু আমিই দেখবো।

তনুর শেষের কথাটা শুনে সায়ন বাকা হাসল। তার এই হাসিটা তনুর মারাত্মক লাগে। না পারে তাকিয়ে থাকতে, না পারে চোখ ফেরাতে। সায়ন তনুর আরও কাছে এসে বলল,

” মনে হচ্ছে খুব বড় হয়ে গেছিস! দাড়া, ফুপ্পিকে বলে তোকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here