হলুদ বসন্ত পর্ব -১২

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১২
#Eshika_Khanom

“সাজেক উপত্যকা বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে অবস্থিত এই সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে দুটি পাড়া- রুইলুই এবং কংলাক। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সাজেক ভ্যালি “রাঙামাটির ছাদ” নামেও পরিচিত।”

এতোক্ষণ ধরে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে একটা বই থেকে জোরে জোরে রিডিং পড়ছিল আয়াত। আদ্রাফ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পড়াটুকু শেষ হতেই আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দেয়। আদ্রাফ আয়াতকে ভেঙ্গিয়ো বিপরীতে আরেকটা হাসি উপহার দেয়। বিচ্ছিরি এমন মুখের ভঙ্গিমা দেখে আয়াত মুখ কুচকে আদ্রাফকে বলে,
“এতো সুন্দর করে একটা হাসি দিলাম আর আপনি এটা কি করলেন?”

আদ্রাফ নিজের গায়ে থাকা টিশার্টটি টানটান করে নিয়ে বলল,
“আমিও তোমার হাসির বিনিময়ে একটা হাসি দিলাম।”

মুখ ফুলিয়ে মাথা আদ্রাফের মুখের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিল সে। আদ্রাফও কিছু বলল না, আপনমনে ফোন চালাতে লাগলো। কোনো জায়গায় ভ্রমণকালে আদ্রাফের গান শুনতে খুব ভালো লাগে। তাই তার ভালোলাগার কাজটিই যাত্রাপথে করতে লাগলো সে। অপরদিকে আয়াত খুব বোরিং ফিল করছিল। কতক্ষণ বিরক্তি নিয়ে সে আদ্রাফের দিকে তাকাচ্ছে তো কতক্ষণ জানালের পাশে মাথা হেলিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছে। কিছু সময় পার হতেই আয়াত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে বারবার আয়াতের মাথা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছিল। আদ্রাফ হালকা হেসে আয়াতের মাথা আয়ত্ত করে নিজের কাধে সন্তোপর্ণে এলিয়ে নেয়। এভাবেই গাড়িতে করে তারা চলতে থাকলো নিজের গন্তব্যে।

সাজেক যাত্রা পথের আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিঁচু পাহাড়ি রাস্তার সাথে চারিদিকে সীমাহীন সবুজের সমারোহ মাখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইতিমধ্যে মন কেড়ে নেয় সদা সর্বদা। রিসোর্টের প্রায় কাছাকাছি চলে আসায় আদ্রাফ আয়াতকে আস্তে করে ডাক দিতেই আয়াত জেগে যায়। আর চারপাশের দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে ভাললাগার কিছু অনুভূতির জাগরণ করতে লাগে। তবে এসবের থেকেও আদ্রাফের কাছে আয়াতের হাস্যজ্বল মুখটাই সর্ব সুন্দর মনে হচ্ছে। তাইতো আদ্রাফ বাহিরের সৌন্দর্যে সময় নষ্ট না করে প্রিয়তমার হাসিতেই চোখ দুটো আবদ্ধ করতে ব্যস্ত।

আদ্রাফ এবং আয়াত পৌছে গেল সাজেকের রুন্ময় রিসোর্টে। আদ্রাফ রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। রিসোর্ট আগে থেকেই বুক করে নিয়েছে আদ্রাফ, তাই তাদের বেশি সমস্যা হলো না। আদ্রাফ দুইটি রুম নিয়েছে তাদের জন্যে। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে একটি চাবি আয়াতের হাতে ধরিয়ে দিল। আয়াত প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আদ্রাফের উপর। আদ্রাফ আয়াতের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,
“তুমি আর আমি আলাদা রুমেই থাকব, যেভাবে বাড়িতে থাকতাম আমরা।”

আয়াত আদ্রাফের কথা শুনে হতাশ হয়ে তাকালো হাতে গচ্ছিত চাবির উপর। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“বিয়ে করেছি, হানিমুনে এসেছি, তাও আমরা স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকবো। বাহ কি সুন্দর জীবন! আয়াত এতো সুন্দরভাবে জীবন পার করার জন্যে তুই এখনো নোবেল পাসনি? ছি! ছি! ছি!”

আদ্রাফ ভ্রু কুচকে আয়াতের দিকে নিজের মুখ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“কি বিড়বিড় করছেন মিসেস আদ্রাফ?”

আয়াত ভ্যাবলার মতো হেসে বলল, “নাহ কিছু না তো, কিছু না।”

আদ্রাফ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“তবে কি নিজের রুমে যাওয়া হবে? আয়াত খুব ক্লান্ত লাগছে।”

আয়াত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দুইজনেই নিজেদের রুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে আরামের এক ঘুম দিল।

সাজেক ভ্যালিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। তবে রিসোর্টগুলোতে সোলার প্যানেল রয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটর চালু থাকে। সেক্ষেত্রে রাতে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করা বিপদজনক। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা। বিদুৎ না থাকায় চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আয়াত একা একা রুমে গুটিয়ে বসে আছে। ভেবেছিল সাজেকে আসার পর কতই না মজা করবে! কিন্তু তার মজার মাথায় ঠাডা পড়েছে। আদ্রাফ এতোই ক্লান্ত যে আজ তাকে ঘুরতেই নিল না। সে এখন নিজের ফোনে বসে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ গেমস খেলছে। ১০৭ লেভেল খেলার পর সে আর আগাতেই পারেনি তাই বিরক্তিতে খেলা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ আবার সেই খেলাতেই নিমগ্ন সে। শীতের পরিবেশে সাজেক ভ্যালির রুপ থাকে অনন্য। জায়গাটি একেক ঋতুতে একেক রুপ ধারণ করে। কুয়াশা জমে রয়েছে। ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে সে। কিছু সময়ের পর দরজায় থেকে খটখট আওয়াজ শোনা গেল। ভয় পেয়ে গেল আয়াত, বিছানার এক প্রান্তে আরও গুটিয়ে নিল নিজেকে। দরজার অপর পাশ থেকে শোনা গেল এক অতি পরিচিত মোহনীয় কন্ঠস্বর। মৃদু কণ্ঠে সে ডাকছে,
“আয়াত, এই আয়াত, দরজা খোলো। তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?”

শান্তির এক নিঃশাস ফেলল আয়াত। চট করে উঠে গিয়ে চলে গেল দরজা খুলতে। যখনই দরজা খুলতে যাবে তখনই মাথায় এক অন্য ভয় চেপে বসলো। কাপা কাপা কণ্ঠস্বরে সে প্রশ্ন করল,
“কে?”

অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো,
“আমি আদ্রাফ।”

ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল আয়াত। পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

ওপাশে থাকা ব্যক্তি ভ্রু কুচকালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমি আদ্রাফ, তুমি দরজা খোলো।”

আয়াত পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

এবার আদ্রাফ বলল, “আয়াত তুমি দরজা খুলবে? ”

আয়াত অন্য পাশে থেকে বলল, “আগে বলুন কে?”

আদ্রাফ বলল, “আরে আমি আদ্রাফ, আমি আদ্রাফ।”

ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে একটা হাসি দিল আয়াত। ঝট করে খুলে দিল দরজা। দেখতে পেল, আদ্রাফ রাগী চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আয়াত হাসিটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন, ভিতরে আসুন।”

আদ্রাফ ঘরটির ভিতরে ঢুকে বলল, “এতো সময় কেন লাগলো? এতোবার জিজ্ঞেস করলে কেন আমি উত্তর দেওয়ার পরও?”

আয়াত অসহায়ত্ব নিয়ে বলল, “যদি আপনার জায়গায় কোনো জ্বীন-ভূত আসতো?”

আদ্রাফ অবাক স্বরে বলল, “কি?”

আয়াত ভাব নিয়ে বুকে দুই হাত গুজে বলল, “আমি শুধু সতর্ক ছিলাম। নিশ্চয়তার জন্যে এমন করেছি।”

“এই তোমার, তোমার এই সতর্কতা কিভাবে মাথায় এলো?”

“ওমা ছোটবেলা শুনেননি?”

“কি শুনব?”

“রাতে গুমোট পরিবেশে মাঝে মাঝে জ্বীন-ভূতও দরজায় কড়া নাড়ে। এরপর আপনি দরজা খুললে আপনার ঘাড় মটকে দিবে।”

আদ্রাফ মাথায় হাত রাখলো। হতাশ হয়ে প্রশ্ন করল,
“এটা কোথা থেকে শুনেছ?”

“আমার ফ্রেন্ডের মুখে শুনেছি। ওকে নাকি ওর দাদী বলেছে।”

আদ্রাফ কোমড়ে দুই পাশে দুই হাত দিয়ে বলল,
“আর কি শুনেছ? আমিও একটু শুনি।”

আয়াত বলল, “রাতে জ্বীন-ভূত এসে দরজায় কড়া নাড়তে পারে। তাই আমাদের উচিত কে এসেছে তা তিনবার জিজ্ঞেস করে দরজা খোলা। যদি মানুষ হয় তবে তো সে উত্তর দিবে। আর জ্বীন-ভূত হলে একবারও উত্তর দিবেনা। বরং আপনার তৃতীয়বার প্রশ্নের সময় বিরক্ত হয়ে চলে যাবে।”

আদ্রাফ হেসে দিল আয়াতের কথা শুনে। তারপর হাসতে হাসতেই বলল,
“আর সেই ভূত যদি ধৈর্যশীল হয়?”

আয়াত আদ্রাফের কথা না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “মানে?

আদ্রাফ আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” জ্বীন-ভূত যদি মিথ্যে উত্তর দেয় তিনবারই সবর সহকারে? যদি বিরক্ত না হয়ে চলে না যায়, এখানেই থাকে ঠায় দাঁড়িয়ে। তখন কি করবে?”

আদ্রাফ কথা শুনে আয়াত মহা চিন্তায় পড়ে গেল। এটা তো সে ভেবে দেখেনি। আদ্রাফের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আয়াতকে আর কোনো চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে চলে গেল রিসোর্টের বাহিরে।

“জায়গাটা বেশ সুন্দর, ধন্যবাদ আমায় এখানে নিয়ে আসার জন্যে।” আদ্রাফের কাধে মাথা রেখে বলল আয়াত। আদ্রাফ বলল, “হুম। জায়গাটা বেশ সুন্দর, যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। রাতের পরিবেশটা অনন্য এক রুপ নিয়েছে।” আয়াত নিশ্চুপ থেকে রইল। সময়টা বেশ উপভোগ করছে সে। আদ্রাফের কাধে মাথা রেখেই যদি সে এভাবেই সারাজীবন সময় পার করে নিতে পারতো তবে সে হতো সবচেয়ে সুখী।

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here