#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৩
#Eshika_Khanom
পূর্বাকাশে যখন সূর্যের উদয় ঘটেছে তখন যেন কিছু নতুন আমেজ কারো জীবনের সঙ্গী বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আবার কারো জন্যে নিয়ে এসেছে দুঃখের কলসি। আয়াত যখন আদ্রাফের সাথে সকালবেলা দেখা করতে যায় তখন আদ্রাফের মুখের অবস্থা দেখে কিছুটা চমকে উঠে। আদ্রাফের মুখমণ্ডলে এবং বাহুতে কিছু র্যাশ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ আদ্রাফের এই র্যাশের কারণ খুজে বের করতে অস্থির হয়ে উঠে আয়াত। আদ্রাফ তখন আয়াতকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
“এই পাগল মেয়ে, শুধু শুধু এই র্যাশের জন্যে এতো অস্থির হয়ে উঠার কি আছে আমার বলোতো?”
আয়াতের মন মানে না। আদ্রাফের মুখে ও বাহুতে এমন হালকা লাল আবার কালচে র্যাশ তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনা। আয়াত আদ্রাফকে বলে,
“আপনার মুখে হাতে তাহলে এসব র্যাশ কেন?”
আদ্রাফ ঠোঁটের হাসিটুকু আরও চওড়া করে বলল,
“এই শীতে তো অনেকের অনেক কিছুই হয়। আমারও তেমন কিছুই হয়েছে বোধহয়।”
“বোধহয়? ”
“হুম।”
“চলো নাস্তা করে ফেলি। আজ তো আবার বাসায় যেতে হবে। আর এমনিতেও শরীরটা আমার ওতো ভালো লাগছে না আয়াত। তাই আজ জলদিই বাসার জন্যে রওয়ানা দিব। আর সাজেকে থাকা যাবেনা। আচ্ছা আয়াত তুমি আবার এজন্যে রাগ করবে না তো?”
আয়াতের কেমন যেন এক অজানা ভয় কাজ করছে। সে মাথা নাড়িয়ে জানালো সে মোটেই রাগ করবে না।
.
.
.
ডক্টরের থেকে কিছুটা দূরে বসে রয়েছে আদ্রাফ। সাজেক থেকে সে ফিরেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। ইতিমধ্যে তার অসুস্থতা আরও একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেহের র্যাশগুলো বেশির ভাগই কালচে রং ধারণ করেছে। শীতও প্রায় শেষের দিকে। পাখিরা জানান দিচ্ছে, “ওরে তোরা শোন, বসন্ত আসছে, হলুদ বসন্ত।” বেশ সময় ধরে ডক্টর আদ্রাফের রিপোর্টগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আদ্রাফ তার দিকে। আদ্রাফের মন বলছে, “তোর আর থাকা হবে না রে।” এক বড় নিঃশ্বাস ফেলে তাকালেন ডক্টর আদ্রাফের দিকে। মুচকি এক হাসি উপহার দিলেন তিনি। তারপর আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ এক লম্বা শ্বাস নাও তো।”
বাধ্য ছেলের মতো ডক্টরের কথা শুনে একটি লম্বা শ্বাস নিল সে। তারপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমিই ঠিক তাইনা ডক্টর?”
আদ্রাফের জন্যে যে হাসিটা মুখে সাজিয়ে রেখেছিলেন ডক্টর, আদ্রাফের কথা শুনে সেটা নিমিষেই মিলিয়ে গেল অন্তরালে। শুকনো মুখ হয়ে গেল যেন তার। সেভাবেই সে আদ্রাফকে উত্তর দিল,
“আমায় মাফ করো আদ্রাফ। জীবনের শেষ দরজার কড়াঘাত করাটাই এখন বাকী তোমার।”
হাসতে লাগলো আদ্রাফ। মানুষ তো কষ্ট পেলে বুক ফেঁটে কাঁদে, আর আদ্রাফ? তার বুক ফাঁটা আর্তনাদ প্রকাশ করছে হাসির মাধ্যমে। জড়িয়ে ধরল সে ডক্টরকে। তারপর ছেড়ে দিয়েও হাসতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে যেন চোখের এক কোণ থেকে কিছুটা জল তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
.
.
.
নিজেকে পুরোই ঘরবন্দী করে ফেলেছে আদ্রাফ। এখন আর কারো সাথে সে কথা বলতে চায়না, দেখা করতে চায়না। গুটিয়ে ফেলেছে সে নিজেকে। আয়াতের থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলছে। মায়া বাড়াতে চাইছে না আদ্রাফ আর কারো সাথে। অঝোরে কাঁদে সে বসে বসে নিজের ঘরে। নামাজ পড়ে, খোদা তায়ালাকে ডাকে। শেষ মূহুর্তে এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। আদ্রাফের দাদী দিলারা জামান আদ্রাফের এই অবস্থা দেখে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আয়াত নিজেকে আর দাদীকে সামলায়। আদ্রাফের কাছে যেতে চাইলে তার ধারে কাছেও যেতে পারেনা। নিজের মনকে কিছুতেই মানাতে পারছে না সে। বসন্ত যেখানে প্রকৃতিকে, মানুষকে এসে নতুন রুপে রাঙায় সেখানে যেন পুরো আদ্রাফের পরিবারের মধ্যকার সকল রঙ শোষণ করে ফেলেছে।
অনেক সময় পরে আদ্রাফ বেরিয়েছে নিজের রুম থেকে। বাগানে এসে বসেছে সে। নুহাশকে ডেকে পাঠিয়েছে সে। নুহাশও ভালো নেই, হাজারো শোকে কাতরপ্রায়। তবুও বন্ধুকে সতেজ রাখার জন্যে মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে মুখোমুখি হয়েছে তার। আদ্রাফের সামনে বসে ভালো করে সে তাকায় আদ্রাফের পানে। বুকটা কেঁপে উঠে নুহাশের। কেমন শুকিয়ে গেছে আদ্রাফের চেহারা, চোখমুখ আবার ফুলে গিয়েছে। হুট করেই যেন আবার আদ্রাফ ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নুহাশ এগিয়ে আদ্রাফের কাধে হাত রেখে বলে,
“যাইহোক, এমন হয়ে গেলি কেন তুই? কি অবস্থা করেছিস নিজের? এমনিতেই তুই অসুস্থ, তারপর আবার সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিস আদ্রাফ।”
আদ্রাফ বলে, “আর হব না আমি অসুস্থ। এটাই তো জীবনের শেষ অসুখ, শেষ অসুস্থতা। তারপর মুক্তি, সবকিছু থেকে মুক্তি।”
নুহাশ বলল, “আমি জানি তোর অবস্থা। আমি জানি হাজার চাইলেও সেই সত্য থেকে লুকানো সম্ভব নয়। মরতে একদিন আমাদের সবাইকেই হবে আদ্রাফ। হাজার চাইলেও আমরা কেউ তোকে এই ভয়ানক সত্য থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবো না। জানিস আদ্রাফ, মনটা এখনো মানছে না আমার। কিন্তু সেদিন আমি তোর রিপোর্ট দেখেই সব বুঝতে পারলাম। পুরো ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিস তুই। জানি আদ্রাফ আমি, কিন্তু এই শেষ সময়টুকু আমাদের সবার সাথে হেসে খেলে পার কর। দেখবি অতো আফসোস থাকবে না। আয়াতের অবস্থা দেখেছিস কি তুই? দাদীও অসুস্থ কিছুটা সেটাও তুই জানিস। আর ঐদিকে আয়াত কেঁদেকেটে নিজের জীবনকে অর্ধেক করে ফেলেছে। আমরা নাহয় আমাদের জীবনের পূর্বের সময়টুকুতে অনেক মজা করেছি, কিন্তু আয়াতের কথা চিন্তা কর। মেয়েটা কি সারাজীবন এভাবেই কষ্ট পাবে?”
নুহাশের কথাগুলো আদ্রাফের কর্ণকুহরে পৌছতেই কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল সে। নুহাশের এক হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
“নুহাশ আমার কিছু কথা ঠাণ্ডা মাথায় শুনবি ঠিক আছে? তুই কি রাখবি আমার কিছু কথা?”
নুহাশ বলল, “হুম, কি কথা বল?”
আদ্রাফ বলল, “সবাই তো বুঝেছিসই যে আমি আর বেশিদিন নেই। তাই আমি আমার সময় শেষ হওয়ার আগেই একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমার অবর্তমানে আমার সকল সম্পত্তি আমার দাদী এবং আয়াতের নামে দিয়ে যেতে চাই। আর দাদীর অবর্তমানে সবকিছুই আয়াতের নামে থাকবে। আর আমার সকল সম্পত্তির পাওয়ার অব এটর্নি আমি তোর আর আয়াতের নামে দিয়ে যেতে চাই।”
“আমার নামে কেন?”
“কারণ আছে। এটাই আমার সিদ্ধান্ত এবং ইচ্ছে নুহাশ।”
নুহাশ কি যেন চিন্তা করল। ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে কিছু সময় মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আদ্রাফ নুহাশকে বলল,
“আমাকে কখনো ভুল বুঝিস না প্লিজ। মনে করবি না যে আমি শুধু তোকে ব্যবহার করছি। আমি সত্যিই তোকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি নুহাশ। আর তোকে ভরসা করেই সব দায়ভার দিচ্ছে।”
নুহাশ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
আদ্রাফ বলল, “হুম”।
নুহাশ প্রশ্ন করল, ” তবে কি আমি উকিলকে দিয়ে সব কাগজপত্র তৈরি করাবো?”
আদ্রাফ বলল, “হ্যাঁ খুব জলদিই করিয়ে ফেল। আমার না কেমন যেন এখন ভয় লাগা কাজ করে। আমার সাহস যেন সব মরে গিয়েছে।”
নুহাশ বলল, “তুই সাহসী ছিল, আছিস এবং যতদিন বাঁচবি তুই সাহস নিয়েই বাঁচবি।”
আদ্রাফ বলল, “হুম।” নুহাশও সম্মতি দিল।
আদ্রাফ নুহাশের হাত আরও আগলে নিয়ে বলল,
“আমার আরও একটা ইচ্ছে আছে।”
“কি?”
“রাগ করবি না বল।”
“তোর উপর কিভাবে রাগ করি আমি আদ্রাফ? বল তুই।”
“আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুই আমার পরিবারকে আগলে রাখ এবং..”
“হুম তা তো রাখবোই ইনশাআল্লাহ। তুই চিন্তা করিস না। আর এবং কি?”
“নুহাশ আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুই আয়াতকে বিয়ে করবি। করবি তো?”
#চলবে
[