হাওয়ায় ভাসা উড়ো চিঠি পর্ব -১৩

#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১৩)

এক সপ্তাহ গেলে ও যখন উষার শশুড় বাড়ি থেকে কোনো খোঁজ এল না। তখন সত্যিই অবাক হলো আবৃত্তি। পুরো পরিবারটা ধকল সামলাতে ব্যস্ত। উন্মেষ আবার ঠিক ঠাক বিজনেসে মন দিয়েছে। এভাবে থাকলে ব্যবসায় লস হবে। উষা বসে থাকে নিরালায়। ঘর থেকে বের হয় না। সন্ধ্যায় যখন উন্মেষ বাড়ি ফিরল তখন খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। নুন চিনির সরবত দিয়ে আব‍ৃত্তি বলল, “ইয়াসদের বাড়ি থেকে কেউ আসল না একবার! মানছি যে এটা খুব ই মর্মন্তুদ। তবে একটি বার ফোন তো করাই যেত। অন্তত ইয়াস তো করতেই পারত।”

“আমরা ও তো খোঁজ নেই নি। তাছাড়া ইয়াস ও তো নিজ সন্তান হারিয়েছে। সবটা মেনে নিতে সময় তো লাগবে।”

“তবু আমার কেমন যেন লাগছে।”

“কেন বলো তো?”

“জানি না। প্লিজ একবার খোঁজ নিয়ে দেখবে। কিছুতেই আমি শান্তি পাই না।”

“দেখব, এখন বসো পাশে।”

চিন্তিত মুখেই বসল আবৃত্তি। উন্মেষ ওর হাতটা নিয়ে খেলছে। বাচ্চাদের মতো করে এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছে।
“কি করছ?”

“এমনিই ভালো লাগছে।”

“অভ্যেস এখনো যায় নি।”

“যাবে কেন। অভ্যেস গড়েছিলাম যাওয়ার জন্য?”

“তুমি বড়ো অদ্ভুত।”

“আর এই অদ্ভুত মানুষটা কেই তুমি থাক বাদ দাও সেসব। সবাই খেয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি খেয়েছ?”

“না। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ফ্রেস হও এক সাথে খাই।”

“থ্যাংকস আবৃত্তি।”

“হঠাৎ থ্যাংকস বললে যে।”

“আমার ভা ঙা পরিবারটা কে আবার জুড়ে দেওয়ার জন্য। লেখার মৃ ত্যুর পর আমি ভাবি নি সবাই কে আগলে নিতে পারবে তুমি।”

“আপুর মতো আমি কখনোই হতে পারব না উন্মেষ।”

“কেউ কারো মতো হয় না আবৃত্তি। না তোমার মতে হতে পেরেছিল লেখা আর না তুমি লেখার মতো। তবু চারটে বছর একসাথে ছিলাম আমরা। কোনো অভিযোগ উঠে নি।”

উঠে এল আবৃত্তি। পর্দা মেলে দিয়ে বলল,
“কাল একটু বাড়ি যাব। দিয়ে এসো তো। মামুনির শরীর ভালো নেই।”

“ঠিক আছে। কয়দিন থেকে এসো না হয়।”

“না। থাকা যাবে না এখন। আন্টি কতটা সামলাতে পারবে আমি জানি না। উষা তো খেতেই চায় না।”

উজ্জ্বল হয়ে এল উন্মেষের অক্ষি। কিছুটা এগিয়ে টেনে নিল আবৃত্তি কে। ঘাড়ে নাক ঘষতে শুরু করেছে। “তুমি বড়ো বেশি ভালো আবৃত্তি। তোমার মতো কেউ নেই।”

“আমি তো স্বার্থপর ও।”

“উহু।”

“তুমিই তো বলেছিলে।”

“পরিস্থিতি বলিয়েছে। তবে এটাই সত্য তুমি সব থেকে সেরা। সবার থেকে আলাদা। বড়ো লক্ষি তুমি।”

“খাবে না?”

“উহু।”

“কেন?”

“তোমায় খাব।”

“ছিইই। সরো বলছি।”

“আই নিড ইউ আবৃত্তি। আই নিড ইউ।”

“এখন!”

“একটু স্বস্তি চাই আমার। গত কয়েক মাস ধরে আমি অশান্ত হয়ে গেছি। প্লিজ বউ।”

আর বাঁধা দিল না আবৃত্তি। উন্মেষের স্পর্শ গুলো গাঢ় হতে শুরু করেছে। এক একটা ভালোবাসার ছোঁয়া যেন ভাসিয়ে নিচ্ছে কোনো গভীরে।

বরাবর ই পাতলা ঘুম উন্মেষের। তবে আজ ছেলেটার খুব গভীর। এই যে এত সময় ধরে আবৃত্তি ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে। চুমু খাচ্ছে অহরহ। কোনোটাই ধ্যান নেই। আবৃত্তি হাসল। মৃদু কোমল এক হাসি। ছেলেটার ভালোবাসায় সিক্ত হতে হতে ভুলেই গিয়েছিল মানুষটা রক্ত মাংসে গড়া। স্থির করল আবৃত্তি। নখ গুলো আজ ই কেঁটে ফেলবে। উন্মেষের পিঠময় কত গুলো দাগ। গলায় ও আছে একটা। উঠার চেষ্টা করল আবৃত্তি। তবে বলিষ্ঠ দেহের উন্মেষের শক্তপোক্ত এই আলিঙ্গনের সাথে পেরো উঠল না। ছেলেটার ঘন ঘন গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ল আবৃত্তির গলায়। আবৃত্তি ডাকে।
“উঠ, অনেকটা বেলা হয়েছে।”

“বিরক্ত কেন করো বউ। একটু ঘুমাতে দাও প্লিজ। এই তো ঘুমিয়েছি।”

“অনেক সময় ঘুমিয়ছো।”

“উহু।”

“তাহলে আমাকে যেতে দাও।”

“কোথায় যাবে? শুয়ে থাকো, এভাবেই ভালো লাগছে।”

“বাথরুমে যাব, গোসল করব। ছাড়ো এখন।”

“একা কেন যাবে?”

চট করেই উঠে বসল উন্মেষ। আবৃত্তি নিজেকে ঠিক করতেই আবারো এলোমেলো করে দিল উন্মেষ। চোখ রাঙাল মেয়েটি। সেসব পরোয়া না করে মেয়েটি কে কোলে তুলে নিল উন্মেষ।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আলমাস বললেন,”তোমরা দুজনেই কিছু দিন ঘুরে আসতে পারো।”

“না বাবা। এখন ঘুরাঘুরির কোনো প্রয়োজন নেই।”

“তোর বাবা তো ঠিক ই বলেছে। ঘুরে আয় ভালো লাগবে।”

“ভালো লাগার প্রয়োজন তো এখন নেই মা। উষা সবে একটু একটু ঠিক হতে শুরু করেছে। সব দিক আগে ঠিক হোক।”

“হ্যাঁ আন্টি। আমার ও তাই মনে হয়।”

“আমরা তোমার পর আবৃত্তি?”

“ছি, ছি তা কেন হবে।”

“তাহলে আন্টি বলে ডাকো যে। লেখা যদি আমার মেয়ে হয়ে থাকে তবে তুমি কেন নয়।”

শীতল হয়ে এল আবৃত্তির দু চোখ। দিতিয়া কাছে টেনে নিল মেয়েটিকে। চোখের জল মুছে তিনি বললেন,”দু বোন ই বড়ো লক্ষি। আমরা নিশ্চয়ই খুব ভাগ্য করে এসেছি। না হলে দুই চাঁদ ই কেন আমার ঘরে আসবে।”

ইয়াস এসেছে। রুগ্ন তার চেহারা। উষার পাশে এসে বসল। উষা ভালো করে দেখে নিল প্রিয় স্বামীর মুখটা। তারপর বলল, “কি হয়ে গেল।”

“হুম।”

“আমি খুব খারাপ মা তাই না?”

“এমন নয়।”

“আমাদের বাচ্চাটা পৃথিবীর স্বাদ নিতে পারল না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইয়াস। খুব কষ্ট।”

“বাদ দাও সেসব, বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি। ব্যাগ গুছিয়ে নাও।”

“দুদিন পর যাই?”

“তাহলে গাড়ি পাঠিয়ে দিব?”

“কেন তুমি থেকে যাও।”

“আমার ভালো লাগে না।”

ইয়াসের মনের অবস্থা ভালো না। উষার ও না। দুজনের কেউ ই শান্তি তে নেই। ইয়াস ফোন তুলল। “দুদিন পর গাড়ি পাঠিয়ে দিব তাহলে।”

“দরকার নেই। আমি আজ ই যাব।”

“ঠিক আছে।”

কষ্ট পেল উষা। বড্ড অভিমান করে আজ যাওয়ার কথা বলেছে। তবে সেটা বুঝল না ইয়াস। এটা যেন মানতেই পারছে না মেয়েটি। ওয়াসরুমে গিয়ে এক চোট কাঁদল। আর তারপর ই ভাবল ইয়াস ও ওর মতো অশান্তিতে ভুগছে। সেহেতু ছেলেটার আচরণ অস্বাভাবিক হতেই পারে।

আবৃত্তিকে জড়িয়ে উষা বলল, “আমার জন্য অনেক করেছ ছোট ভাবি। সমস্ত পাগলামু সহ্য করেও ঠিক ই এসেছ খাওয়াতে। সব কিছুর জন্য থ্যাংক ইউ।”

“বড়োদের মতো কথা বলে আমাদের উষা পাখি। দেখি তো তোমায়।”

মলিন মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তবে সে হাসি প্রাণহীন। স্নেহে ভরা নয়নে মেয়েটিকে দেখে নিল বার কয়েক। উন্মেষ বোনের মাথায় হাত বুলাল। বিয়ের দিন এতটা কষ্ট লাগে নি যত টা কষ্ট আজ হচ্ছে।

লেখার মৃ ত্যু কে নিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন ললিতা বেগম ও আসাদ সাহেব। সময়টা এত খারাপ ছিল যে আবৃত্তি ও সময় দিতে পারে নি। এবার ঠিক হলো ওনারা কিছু দিন এ বাড়ি এসে থাকবেন। উন্মেষ নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে। আবৃত্তি জানে না এটা। মামুনি বাবা কে দেখে আবেগপ্লুত হয়ে এল। উষার চলে যাওয়াতে যতটা মন খারাপ হয়েছিল বাবা মামুনি আসাতে সেটা পূরণ হয়ে এসেছে। ললিতা মেয়েকে কিছু উপহার দিলেন। “কি মামুনি?”

“খুলে দেখ।”

কিছু গহনা রয়েছে বাক্সটি তে। আবৃত্তির অবাক হওয়া দেখে বললেন, “বিয়েটা খুব ই অস্বস্তির মধ্যে হলো। মন খারাপ ছিল খুব। তাই আর দেওয়া হয় নি।”

“প্রয়োজন ছিল না মামুনি।”

“আগেই তো বানিয়েছিলাম। দুই বোনের জন্য দু সেট গহনা।”

একটু মন খারাপ হলো সবার। প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসে লেখার স্মৃতি। ভালোবাসার মানুষ গুলো চলে গেলেও সারা জীবনের জন্যেই ক্ষ তটা রয়েই যায়।

সন্ধ্যা থেকে টুকটাক আড্ডা চলছে। পরিবার কে হাসি খুশি দেখে উন্মেষের মন পুলকের আবেশে ভরে উঠে। আবৃত্তি নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। সাথে আছে কলি। উন্মেষ দাঁড়িয়ে রইল সুযোগের অপেক্ষায়। তবে সুযোগ হলোই না। কলি নড়ছে না এক চুল।
“কলি শোন, আমার ঘরে গিয়ে দেখ…।”

“কি দেখবে?”

“কি দেখবে দাঁড়াও মনে করতে দাও।”

মনে করল উন্মেষ। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না। আবৃত্তি চা নামিয়ে নিল।
“বললেন না তো।”

“ভুলে গেছি।”

“আশ্চর্য! মাথা গেছে আপনার?”

“হয়ত।”

“কলি আসো তো আমার সাথে।”

“না।”

“কেন? ও কেন যাবে না?”

“তুই নাস্তা নিয়ে যা তো কলি।”

“ঠিক আছে ভাই জান।”

নাস্তা নিয়ে গেল কলি। উন্মেষ ভালো ভাবে দেখে নিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরে আবৃত্তি কে।
“কি হলো?”

“তুমি আমার সাথে ঘুমাবে।”

“কেন?”

“এটা কেমন কথা। বউ হয়ে অন্য ঘরে ঘুমাবে?”

“আর কিছু দিন…”

মাঝ পথে আটকে দিল মেয়েটি কে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে স্লাইট করে বলে,
“আজ তো মা বাবা এসেছেন। গেস্ট রুম পরিষ্কার করা নেই। প্লিজ আমার সাথে ঘুমাবে তুমি।”

“সরো তো, খালি ধান্দা।”

“হ্যাঁ। ধান্দাই তো।”

“আবার মন খারাপ করো কেন।”

“তুমি বুঝলে না।”

“বুঝি না তো।”

রান্না ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মুখ টিপে হাসে আবৃত্তি। “চুপি চুপি চলে এসো।”

“চুপি চুপি কেন?”

“আমার লজ্জা করবে না?”

দুষ্টু হাসল উন্মেষ। খপ করে মেয়েটির হাত ধরে বলল,
“করুক লজ্জা। সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যাব।”

“ছাড়ো এখন।”

“না যদি পালিয়ে যাও।”

“কোথায় যাব আর?”

“অনেক দূরে। আমার ভয় হয় আবৃত্তি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তোমার বোনকে হারিয়ে বুঝেছি একটা সম্পর্ক দলিল হওয়ার পর কতটা আপন হয়ে যায়। হুট করেই না চাইতেও চলে আসা দায়িত্ব গুলো ভালোবাসায় পরিনত হয়ে যায়। ভাগ্য তোমায় আমায় এক করেছে। ফের তোমায় ছাড়া সত্যিই আমি ম রে যাব। আর হারাতে পারব না আমি।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**বর্তমানে আবৃত্তি আর উন্মেষ স্বামী স্ত্রী। লেখা নেই তাদের মাঝে। তাই স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে আসাটাই তো উচিৎ। নাকি আবৃত্তি আর উন্মেষের বিচ্ছেদ হওয়াটা পাঠকদের পছন্দ হবে?**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here