#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা মনি
মেঘলা এসে পৌছায় তার নতুন ঠিকানায়। মেঘলা নতুন ঠিকানা তার শ্বশুর বাড়ি। একটি বিশাল আলিশান বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে।
রিফাত গাড়ি থেকে নেমে মেঘলার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মেঘলা রিফাতের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। রিফাত বলে,
‘আজ থেকে এটাই তোমার নতুন ঠিকানা। চলো আমার সাথে।’
মেঘলা রিফাতের হাত ধরে দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায়। রিফাতের মা রোজিয়া সহ আরো কয়েকজন মহিলা দরজার সামনে দাড়িয়ে ছিল।
রোজিয়া সবাইকে দেখিয়ে বলে,
‘দেখেছ এই হলো আমার ছেলের বউ। কত সুন্দরী দেখেছ। একেবারে আমার মনের মতো হয়েছে।’
সবাই মেঘলার খুব প্রশংসা করতে থাকে। সবার মাঝে গোলগাল চেহারার এক মাঝবয়েসী মহিলা বলে,
‘বিয়েটা কিভাবে হয়েছে সেটাও সবাই জানে আপা। এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে কি হবে। এই মেয়ের বাবা তো একদম নিঃস্ব হয়ে গেছে। বাড়িটাও হারাতে বসেছিল। তোমার ছেলের পাকনামির জন্য সবকিছু,,,’
‘মেহের তুমি চুপ করো। আমার ছেলের বউ আমি বুঝে নেব। এসো রোদেলা তুমি ভেতরে এসো।’
মেঘলা রিফাতের সাথে বাড়িতে প্রবেশ করে। মেঘলার চোখ জুড়িয়ে যায় বাড়িটা দেখে। বিশাল বড় বাড়ি। বাইরে থেকে যত সুন্দর ভেতরে তার থেকেও বেশি সুন্দর। দামী সব আসবাপত্র ও সাজসজ্জার জিনিস। এত বড় বাড়ি মেঘলা দেখেছিল একটি সিনেমায়। যদিও সে এসব সিনেমা দেখতে পছন্দ করে না। রোদেলা এসব অনেক পছন্দ করে। রোদেলাই মেঘলাকে জোর করে অনেক সিনেমা দেখিয়েছে।
মেঘলাকে এভাবে তাক লেগে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলে মেহের। মেঘলাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘আমার স্বামী তৈরি করেছে এই বাড়ি। নিজের টাকায়, সুন্দর তো হবেই।’
মেঘলা অবাক হয়ে যায় মেহেরের কথা শুনে। সে তো জানতো এই বাড়ি রিফাতের বাবা আমিনুল হকের। তাহলে এই মহিলা কেন বলছে এই বাড়িটা ওনার স্বামীর তৈরি।
মেঘলাকে এভাবে ভাবনায় বুদ দেখে রিফাত তাকে ডাকে। মেঘলার হুশ ফেরে।
‘চলো আমাদের রুমে যাই।’
মেঘলা মাথা নাড়িয়ে রিফাতের সাথে যেতে লাগে। ওরা যাওয়ার পর মেহের রোজিয়াকে এসে বলে,
‘নিজের ছেলের বিয়েতে আমাকে একটু যেতেও বললা না। আমার কত ইচ্ছা ছিল যাওয়ার।’
‘আমি তো তোমাকে যেতে মানা করিনি মেহের। তুমিই তো যাওনি।’
‘যেতে তো চেয়েছিলাম। উনি তো যেতে দিলেন না।’
রোজিয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। নতুন আত্মীয়রা যদি জানতে পারত আমিনুল হকের দুই স্ত্রী তাহলে অনেক কথা হতো এসব নিয়ে। রোজিয়াকেও অনেক কথা শুনতে হতো। তাই সবসময় সে মেহেরকে এড়িয়ে চলে। মেহের কোথাও গেলে সেখানে যায়না। রোজিয়ার আর ভালো লাগে না মানুষের নানারকম কথা শুনতে।
৫.
মেঘলা রিফাতের সাথে যাচ্ছিল তখন একটি মেয়ে এসে তাদের পথ আটকে দাড়ায়। মেয়েটাকে দেখে রিফাত বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেলে। মেয়েটি মৃদু হেসে বলে,
‘বউকে নিয়ে যাওয়ার এত তাড়া কেন ভাইয়া? তোমার বউকে তো এখন কাছে পাবা না।’
‘মানে কি বলতে চাচ্ছিস তুই?’
‘তোমার বউকে আমি আপাতত নিয়ে যাচ্ছি। রাতে সাজিয়ে গুজিয়ে বাসরের জন্য পাঠিয়ে দেব।’
‘আমার বউ আমার সাথেই থাকবে।’
‘ইশ! তোমার মুখে কি কিছু আটকায় না ভাইয়া? ভাবি তুমি আমার সাথে এসো তো। আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
মেয়েটা মেঘলাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে। রিফাত অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে।
মেয়েটি মেঘলাকে বলতে থাকে,
‘আমার নাম মুন্নি। আমি তোমার একমাত্র ননদ।’
মেঘলা হালকা হেসে বলে,
‘আচ্ছা।’
‘হ্যা। তুমি আমার সম্পর্কে কি কিছুই জানো না? অবশ্য না জানাটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে সবকিছুই জানি। তোমার নাম রোদেলা ইসলাম। তুমি ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ো। তোমার একটা যমজ বোনও আছে মেঘলা। এম আই রাইট?’
মেঘলা মলিন হাসল। ছোটবেলা থেকেই মিথ্যা কথা পছন্দ করে না সে। আর আজ প্রতি মুহুর্তে তাকে এত এত মিথ্যা বলতে হচ্ছে।
‘ঠিকই বলেছ। তোমাদের পরিবারে কে কে আছে?’
‘আমি, আব্বু, বড় আম্মু, আম্মু, রিফাত ভাইয়া এবং মুবিন ভাইয়া।’
মেঘলা বেশ হতবাক হয় মুন্নির কথা শুনে। মেঘলা বুঝতে পারে রিফাতের বাবার হয়তো দুজন স্ত্রী। মুন্নি মেঘলার ভাব বুঝতে পেরে বলে,
‘আসলে রিফাত ভাইয়া বড় আম্মুর ছেলে। আমি আর মুবিন ভাইয়া,,, আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। চলো আমার সাথে তোমাকে আজ সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো।’
মুন্নি মেঘলাকে নিজের রুমে নিজে যায়। মেঘলাকে বিছানায় বসায়। মেঘলা মুন্নির রুমটা ভালো করে পরখ করে দেখে। রুম জুড়ে বিখ্যাত গায়ক আরমান খানের অনেকগুলো ছবি টাঙানো। মেঘলা হা করে ছবিগুলো দেখছিল। মুন্নি মেঘলাকে এভাবে তাকাতে দেখে বলে,
‘তুমিও কি আরমানিয়ান?’
‘মানে?’
‘আরমান খানের ফ্যানেদের আরমানিয়ান বলে। জানো আমি ওনার অনেক বড় ফ্যান। আমার ইচ্ছে ওনার বউ হবো।’
মুন্নির মুখে এরকম কথা শুনে মেঘলা স্বাভাবিকভাবেই টাশকি খায়। মনে মনে ভাবে,
‘মেয়েটার সাথে আমার তেমন পরিচয় নেই। অথচ মেয়েটা কত অবনীলায় আমাকে নিজের ব্যাপারে কথাগুলো বলছে। যেন আমি ওর অনেক দিনের চেনা। এরকম মানুষদের ঠকানো কি ঠিক হচ্ছে?’
‘কি ভাবছ ভাবি?’
‘না কিছুনা।’
‘আচ্ছা তুমি এখানে বসো। রাতে এসে আমি তোমায় খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ভাইয়ার রুমে দিয়ে আসবো। আমি কিন্তু খুব সুন্দরভাবে সাজাতে পারি। দেখবে এমন ভাবে সাজাবো যস ভাইয়া তোমায় দেখে তোমার মাঝেই বিভোর হয়ে যাবে।’
মেঘলা জোরপূর্বক হাসে।
৬.
মুন্নি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মেঘলা দরজাটা আটকে দেয়। ভারি বেনারসি পড়ে থাকতে গরম লাগছিল। তাই নিজের ব্যাগ থেকে একটা পাতলা জরজেটের শাড়ি বের করে। শাড়িটা পড়ে নেয়।
আচমকা দরজায় কেউ কড়া নারে। মেঘলার ভ্রু আপনাআপনি কুচকে যায়। সে প্রশ্ন করে,
-“কে ওখানে?”
বিপরীত দিক থেকে কোন উত্তর আসে না। মেঘলার একটু ভয় ভয় করতে থাকে। সে আলতো পায়ে হেটে দরজার কাছে যায়। দরজাটা খুলতেই রিফাতকে দেখতে পায়। রিফাত ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ছিল।
‘এতক্ষণে তোমার দরজা খোলার সময় হলো।’
‘না মানে,,,আসলে ড্রেস চেঞ্জ করছিলাম।’
রিফাত মেঘলার দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। কালো রঙের জরজেট শাড়িতে মেঘলাকে কোন পরির থেকে কম কিছু লাগছে না। রিফাত যেন মেঘলার রূপের মাঝে হারিয়ে যায়।
মেঘলা হালকা কেশে বলে,
‘আপনি কি কিছু বলবেন?’
রিফাতের ঘোর কা’টে মেঘলার কথায়।
‘হ্যা এই নিন। আপনার জন্য।’
মেঘলা তাকিয়ে দেখে রিফাতের হাতে খাবার।
‘তোমার তো মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে। এই খাবারটা খেয়ে নাও।’
বলেই মেঘলার হাতে খাবার ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। মেঘলা পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়। রিফাতের সাথে তার পরিচয় মাত্র একদিনের অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন কয়েক বছরের পরিচয় তাদের। কথাটা মাথায় আসতেই মেঘলার মনে খটকা লাগে।
‘রিফাত তো রোদকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাহলে কি উনি রোদকে চিনত? আমি তো এই ব্যাপারে কিছু জানি না। যদি এমনটা হয় তাহলে আমি যদি ভুলভাল কিছু করি ধরা পড়ে যাব।’
মেঘলা এসব ভাবনায় বুদ ছিল৷ তাই মুন্নি যে কখন চলে আসে সেটা খেয়াল করে নি।
‘ভাবি তুমি এভাবে খাবার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছ কেন? খেয়ে নাও।’
‘হুম।’
✨
রোদেলা খুলনায় পৌছে গেছে। বাস থেকে নেমে প্রেনার বোনের বাড়ির ঠিকানাটা বের করে। তারপর একটি অটোরিকশা দাড় করায়।
রোদেলাকে অটোরিকশায় উঠতে দেখে নেয় দূর থেকে দুটি চোখ। সে বাকা হেসে বলে,
‘স্বাগতম রোদেলা। শেষপর্যন্ত আমার কাছেই তুমি ফিরে এলে। আমি জানতাম তুমি মুখে যাই বলো আমাকে এত সহজে ভুলতে পারবে না। আমি তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম৷ তোমাকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। তুমি শুধুই আমার রোদেলা।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨