হিমাংশুর জলপদ্ম পর্ব -০৩

#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৩]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

– কি ব্যাপার বসে পড়লে যে? হাঁপিয়ে গিয়েছো?

কুমুদকে একটি বড গাছের মোটা শেকড়ে বসতে দেখে প্রশ্নটি করলো হিমাংশু।কুমুদ সেখানে বসে বুকের বা পাশে ডান হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে ব্যস্ত।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

– পানি!পানি খাবো।

– এখানে পানি কোথায় পাবো?হেঁটে একটু সামনে চলো ঐ দেখ একটা কাঁচা রাস্তা চোখে বাঁধছে।

– আমি আর যেতে পারবো না।খুব পানি পিপাসা পেয়েছে।

– এখন আশেপাশে কোনো পানির উৎস দেখতে পাচ্ছি না।তোমায় পানি খাওয়ায় কিভাবে?একটু কষ্ট করে সামনে চলো দেখি বাড়ি যাওয়ার জন্য কিছু পাই কিনা।

উঠে দাঁড়ালো কুমুদ।সামনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই সামনে একটি কাঁচা রাস্তা দেখা যাচ্ছে।কুমুদ এতটাই ক্লান্ত যে সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আর পথটার দূরত্ব সামান্য হলেও তার কাছে দূরত্বটা মনে হচ্ছে বিশাল।সে সেদিকে তাকিয়ে একটি শুঁকনো ঢোক গিললো।অতঃপর আশেপাশে তাকিয়ে পানির কোনো উৎস দেখতে না পেয়ে হাঁটা শুরু করলো।আবারও সেই একই ভঙ্গিতে হাঁটছে দু’জন সামনে হিমাংশু তার পিছনে কুমুদ।পথের ধারে এসে কুমুদ আবারও মাটিতে বসে পড়লো।হিমাংশু সেদিকে একবার তাকিয়ে পথের দু’পাশে চোখ দিলো।দূর দূরন্ত পর্যন্ত কোনো জনমানবের দেখা নেই।হিমাংশু একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।সূর্য এখন মাথার উপর।কড়া রোদে হিমাংশুর সাদা পাঞ্জাবিটি ঘামে ভিজে একাকার।মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোর গোঁড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিক চিক করছে।ঘন কালো ভ্রুর নিচে গোল গোল চোখে যেন হাজার রাতের ঘুম এসে জমা হয়েছে।অনবরত অধর কামড়ে জানান দিচ্ছে যে সে ভিষণ চিন্তিত।ক্লান্ত হিমাংশু কুমুদের দিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়ে।দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও পথের অদূরে তাকাতেই দেখতে পায় একঝাঁক গরুর গাড়ির সমাহার।পরিশ্রান্ত হিমাংশুর মুখে ফোঁটে প্রশান্তির হাসি।সে উচ্ছ্বসিত হয়ে কুমুদের দিকে তাকিয়ে বলে,

– এই চলো আমাদের যেতে হবে।

কুমুদ চোখ যুগল বন্ধ করে বিশ্রাম নেওয়ার প্রচেষ্টায় ছিল।হিমাংশুর কথায় চোখ খুললো।পথে চোখ যেতেই দেখতে পেল একঝাঁক গরুর গাড়ি।সবগুলো একটি সারি করে চলছে।গাড়িগুলো তাদের সামনে আসতেই বুঝতে পারলো এতে করে দুধ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে।গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য অবশ্য নেই। তবে শহরে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।হিমাংশু তাদের থামতে বলে একটি গাড়িতে উঠলো।গাড়ির মালিকগুলো কুমুদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আসলে তারা এই প্রথম সাদা শাড়িতে সিঁদুর পরিহিতা কোনো নারীকে দেখছে।গাড়ির একজন মালিক হিমাংশুকে প্রশ্ন করে ফেললো,
– উনি কে হন আপনার?

চমকে উঠলো কুমুদ সাথে হিমাংশুও কি বলবে সে? কুমুদ কি হয় তার?কুমুদ শীতল চাহনিতে তাকিয়ে রইলো হিমাংশুর দিকে।হিমাংশু আঁড়চোখে কুমুদকে একবার দেখে সেই লোকটার দিকে তাকালো।লোকটার মাথার পুরো জায়গাটা একদম ফাঁকা। অর্থাৎ তেলতেলে টাক।ভুঁড়ির জোরে পুরো শরীরটাই নিখোঁজ। যে কোনো ব্যক্তি আগে তার ভুঁড়ির দিকে তাকাবে।হিমাংশু মুখ কালো করে ফেললো।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,

– স্ত্রী।

– তা তারে এমন সাদা শাড়ি পরায় রাইখাছেন ক্যান?

– তা জেনে আপনি কি করবেন?আমাদেরকে একটু শহরের পথে নামিয়ে দেন।

– কোন গ্রাম থেকে আইলেন?

হিমাংশু মুখ খুলে কিছু বলার আগেই পাশ থেকে কুমুদ বললো,

– শীবপুর!

– কিহ্?ঐ বদ্ধ গ্রামে ক্যান গেছিলেন?পাগল নাকি আপনেরা?

হিমাংশু মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড় করলো,
– লোকটা একটু বেশিই কথা বলে।

– উঠেন আপনাগো ছাইড়া দিই।

বলতে দেরি হিমাংশুর উঠতে দেরি নেই।কুমুদও ধীর পায়ে গিয়ে উঠলো গাড়িতে।ছাওনি দেওয়া গাড়িটা হেলেদুলে গাঁয়ের কাঁচা পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে শহরের পথে।কুমুদ মাথায় ঘোমটা দিয়ে আড় চোখে হিমাংশুর দিকে তাকালো হিমাংশু এক কোণায় বসে দুই পা দোলাচ্ছে। ডান পা আগে তারপর বাম পা।বেশ লাগছে দেখতে।

বাড়ি ফিরে যাওয়ার খুশিতে হিমাংশু ভুলেই গিয়েছিল সে সাথে কত বড় বিপদ নিয়ে যাচ্ছে। নিত্যরঞ্জন রায় গৃহের সামনে দাঁড়িয়ে শুঁকনো ঢোক গিললো সে।কুমুদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়িটির দিকে।এতো বড় বাড়ি সে কখনো দেখিনি।বাড়িটির চারপাশে চোখ বুলিয়ে চলেছে সে।হিমাংশু বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভীত চাহনি দিলো।তারপর কুমুদের দিকে একবার তাকিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।কুমুদও শাড়ির আঁচল খাঁমচে হিমাংশুর সাথে গেল।
বিশাল ছাদ বিহীন খোলা বারান্দার একপাশে বসে কুলোয় চাল ঝাড়ছেন মিতালী বায়। কুলোয় বারি দিতে দিতে পায়ের শব্দে চোখ তুলে সরদ দরজার দিকে তাকাতেই চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে মিতালীর।কুলো ফেলে দৌড়ে চলে যায় নিজের ছেলের কাছে।চোখের কোণে জমা হওয়া ক্ষুদ্র পানি কণা ডান হাতের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে মুছে হিমাংশুর উদ্দেশ্যে বলে,

– বাবাটা আমার এসেছিস?মায়ের উপর রাগ হয়েছে তাই বলে ঘর ছাড়তে হবে বাপ?

হিমাংশু ঠোঁট উল্টায় মায়ের মুখটা দুই হাতে আবদ্ধ করে বলে,

– মা আমি দিদির শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলাম।সেখান থেকে তার ননদের সাথে তার শ্বশুর বাড়ি।

– মা অনেক খুশি হয়েছে তুই ঘরে ফিরে এসেছিস দেখে।দাঁড়া তোর ঠাম্মাকে ডাকি।

বলে পিছন ফিরতে যাবে সেই মুহুর্তে তার চোখে পড়ে হিমাংশুর পিছনে ডান দিকে কাচুমাচু করে দাড়িয়ে আছে এক কিশোরী মেয়ে।ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে মিতালীর।হবে হিমাংশুও তার মায়ের দৃষ্টি অনুসর করে পিছনে তাকায়।অতঃপর অপরাধী মুখ করে তার মাকে বললো,
– মা ও কুমুদ।

মিতালী কুমুদের দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।ফর্সা শরীরে সাদা শাড়ি, সিঁথি জুড়ে লাল সিঁদুর।আলতা রাঙা পায়ে কোনো জুতো নেই।টানা টানা ভীত চোখ জোড়ায় যেন হাজারো রহস্য লুকিয়ে আছে।মিতালী কুমুদের থেকে চোখ সরিয়ে হিমাংশুকের উদ্দেশ্যে বললেন,

– সে যেই হোক কিন্তু তোর সাথে কি করে?

হিমাংশু মাথা নত করে নিচু স্বরে বললো,
– আমি ওকে বিয়ে করেছি।

ঠাস করে একটি চড় পড়লো হিমাংশুর ডান গালে।মিতালী রাগে গরগর করে বললো,

– বিয়ে করেছিস?আর আমরা কিছু জানি না?আমাদের কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করসিনি?এতে বড় হয়ে গিয়েছিস?বয়স কত তোর?আর ও সাদা শাড়ি পরে আছে কেন?

কুমুদের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন মিতালী।কুমুদ চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।হিমাংশু নত স্বরেই বললো,

– মা মেয়েটি অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে ছিল।মানুষ হিসেবে অনেক বাঁচানো আমার কর্তব্য ছিল।

– আচ্ছা? তাহলে কেউ খারাপ পরিস্থিতিতে থাকলে তাকে বাঁচাতে যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলবি তুই?

– এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না মা।

– চুপ একদম আমায় মা বলে ডাকবি না। ছিঃ!ছিঃ! এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?এতো শিক্ষিত হয়ে গিয়েছিস তুই যে তোর জীবনে বাবা মার কোনো প্রয়োজন নেই?

– মা মেয়েটির জায়গায় তুমি থাকলে বুঝতে পারতে মেয়েটি কত কষ্টে আছে।

– চুপ মুখে মুখে তর্ক করবি তো আরও একটা চড় খাবি।

কথাটা বলে মিতালী ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।অতঃপর তার শাশুড়ি এবং তার স্বামী উত্তম রায়কে নিয়ে এলেন বাড়ির প্রধান ফটকে।একে একে ঘর থেকে হিমাংশুর জেঠা,জেঠি,পিশি সকলে বেরিয়ে এলেনে।সবাই হিমাংশুকে কথা শুনিয়ে ক্ষ্যান্ত হলো।তবে এসবের মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু সকলের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছেন উত্তম।সকলের বকাবকি রাগারাগির পর উনি শুধু একটি কথায় উচ্চারণ করলেন,

– হিমাংশু এ বাড়িতে থাকবে না।

সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো উত্তমের দিকে।সে এমন কিছু বলবে তা সবার ধারণার বাইরে ছিল।কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিতালী। ভেজা কন্ঠে বললেন,
– কি বলছো গো এসব?আমার ছেলেটা কোথায় যাবে বাড়ি ছেড়ে?

– যেখানে খুশি যাক কিন্তু এ বাড়িতে থাকবে না।

হিমাংশু মুর্তির মতো জমে শক্ত হয়ে গিয়েছে।সে জানতো বাড়িতে কেউ কুমুদকে মেনে নেবে না। কিন্তু তাকে বাড়ি থেকে এভাবে বের করে দেবে তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।তার কথাটা শোনার বা বোঝার কেউ কোনো চেষ্টায় করছে না।সে কেন করলো বিয়ে করলো?কোন পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিয়ে করলো তা কপউ জানতে চায়ছে না।সকলে তার উপর নিজেদের রাগ মেটাতে ব্যস্ত!আত্মসম্মানে লাগলো হিমাংশুর।সে সটান পিছন ঘুরে একপাশে নত হয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জল বিসর্জন দেওয়া কুমুদের হাতটা ধরে সোজা হাঁটা শুরু করলো।সাথে সাথে মিতালী চিৎকার করে কেঁদে বলতে লাগলেন,

– বাবা যাস না।দাঁড়া আমার কথাটা শোন।

পিছন থেকে কথাটা কর্ণগহ্বরে পৌঁছালেও সে কথার ধার ধারলো না হিমাংশু সে কুমুদের ডান হাতের কব্জি ধরে বেরিয়ে এলো নিত্যরঞ্জন রায় গৃহ থেকে। জানা নেই আর কখনো ফিরে আসা হবে কিনা এ গৃহে! তবে তার জীবনের সকল ছোট ছোট সুন্দর মুহুর্তগুলোর সৃষ্টি হয়েছে এই গৃহেই।এই গৃহে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত হিমাংশুর চোখের পাতায় ভেসে বেড়াবে আজীবন!

অন্ধকার পথে খালি পায়ে হিমাংশুর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে কুমুদ।হিমাংশু গম্ভীরভাবে হেঁটে চলেছে শহরের ইট পাথরের তৈরি পাকা রাস্তা দিয়ে।কুমুদ অপরাধী কন্ঠে বললো,
– আমার জন্য আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হলো।

হিমাংশু কোনো উত্তর দিলো না।শুধু আঁড় চোখে একবার দেখলো কুমুদের অবস্থান।হিমাংশুর উত্তর না পেয়ে কুমুদ বললো,

– কোথায় যাচ্ছি আমরা?

হিমাংশু গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,

– যেদিকে দু চোখ যায়।

চলবে..

(গল্পটি রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুগের সময়কালের প্রেক্ষাপটে লেখা নয়।এটি তারও পরে ইংরেজদের শেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা।সতীদাহ শুধুমাত্র কাহিনি সাজাতে ব্যবহার করা হয়েছে।গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।রিচেক করিনি বানান ভুল হতে পারে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here