#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ১৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩২,
“একটু বাইরে আয়, কথা আছে।”
হিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় রায়া। এরপর হাটা ধরে ছাদের দিকে। হিয়া নাতাশাকে বলে পিছু পিছু যায় বোনের। রায়া ছাদে এসে রেলিং এ হাত রেখে একটু হেলান দিয়ে দাড়ালো। হিয়া রায়ার পাশেই রায়ার মতো করে দাড়ায়। রায়া চুপচাপ সন্ধ্যার আকাশে নেমে আসা অন্ধকার দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। হিয়া মনে ভয় আর সংশয় নিয়ে দাড়িয়ে আছে বোনের পাশে। রায়া কিছু বলছেনা দেখে হিয়া বলে উঠে,
” কি রে আপু? ডেকে এনে চুপ করে দাড়িয়ে আছিস যে?”
” লুইস সু”ইসা’ইড করার চেষ্টা করেছে। জানিস তুই? আমার ধারণা তুই জানিস। সত্য টা বলবি হিয়া।”
রায়া হিয়ার কথার প্রতিত্তোরে হিয়ার দিক হয়ে দাড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। রায়া বোনের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। সবাই চলে যাওয়ার পর রায়া ফোন হাতে নিয়ে মেসেন্জারে ঢুকতেই এলভিনার মেসেজ দেখেছে সে। এরপরই হঠাৎই বাবা মায়ের চলে যাওয়ার কারণটাও ধরতে পারে৷ হিয়া বিষয় গুলো জানে কিনা এটা যাচাই করতেই সে হিয়াকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
হিয়া বোনকে কখনও মি’থ্যা বলেনি এ যাবত। সেখানে বোনের চোখে চোখ রেখে মি’থ্যা বলতে চাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সে একটু হলেও ধারণা করেছে এলভিনা হিয়ার কাছে মেসেজ দেওয়ার আগে রায়াকেই মেসেজ করেছিলো। আজ হয়তো রায়া তার ফোন চেক করেছে। নয়তো রায়া এ ব্যাপারে জানার কথা না। হিয়া আনমনে এসব ভেবেই রায়াকে কাঁপা স্বরে উত্তর দেয়,
” হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু তুই আরেকটা কথা তো জিগ্যেস করলি না আপু? ”
” অন্তরের কথা?”
” হ্যাঁ।”
” মিঃ শাহীন চৌধুরী আর মিসেস অন্তরা চৌধুরী গেলেন তো। উনাদের ছেলে ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবে। মাঝ খান দিয়ে সে।”
আর কিছু বলতে পারলোনা রায়া। চোখ বন্ধ করে নিলো। ছাদের রেলিং ঘেষে বসে পরলো। গায়ের ওরনা টা একপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। হিয়া বোনের এভাবে ভেঙে পরা দেখে নিজেও বোনের কাছে বসে জড়িয়ে ধরে৷ নিজেও কেঁদে ফেলে রায়াকে ধরে৷ রায়া এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেঁদে কেঁদে বললো,
” হিয়া, বোন রে! ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচতেই পারবোনা অ’প”রাধ বোধে। আমিও ম”রে যাবো। মানুষ বলে শেতাঙ্গরা একজন চলে গেলে অন্য জনকে আকড়ে ধরে। ও কেনো পারলোনা বোন? ওর এতো ভালোবাসা তো আমার কা’ল হয়ে দাড়ালো। আমি চাইলেও আর নিজেরে নিয়ে ভাবতে পারবো না। ঐ শাহীন চৌধুরী আর অন্তরা চৌধুরী তিনটা জীবন ন’ষ্ট করলো। রাদ মানুষ টা কিছু না করেও সারাজীবন ক’ষ্ট পাবে। আমি মানতে পারবো না রে হিয়া।”
“ওনারা আমাদের বাবা মা আপু। এভাবে নাম নিও না।”
হিয়া বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটা বললো৷ রায়া ঝট করে হিয়াকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। সে বললো,
” আজ থেকে আমার কোনো বাবা মা নাই। বাবা মা সন্তানের ভালো চায়, কেমন ভালো চায় বুঝলাম না আমি। ক’ষ্ট পেয়েই ভেতরে ভেতরে দ’ম আটকে রোজ ম”রে যাচ্ছি৷”
হিয়া বোনকে কি বলে শান্তনা দিবে! ভাষা পেলোনা। রায়া চোখের জল মুছে ওরনা কাঁধের একপাশে ফেলে এলো পায়ে ছাদ ছাড়লো। হিয়াও উঠে দাড়ালো। পাথরের মতো দাড়িয়ে বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু বোনের পিছনে আর গেলো না। রায়াকে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য একা ছেড়ে দিলো। সে জানে তার বোন একটু পর নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যাবে। তার বোনের ধৈর্যশক্তি অনেক। ছোটোবেলা বাবা মাকে কাছে না পেলেও বোনকে দেখেছে সে, নিজেকে সামলে হিয়াকেও সামলে নিতে। হিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস তার বোন এসবের ট্রমা ঠিক কাটিয়ে উঠবে। হিয়াও ছাদ থেকে নাতাশার রুমে চলে আসলো।
৩৩,
ডাইনিং টেবিলে ডিনার করতে বসেছে সবাই। এহসান মঞ্জিলের প্রতিটা সদস্য বসেছে খেতে। প্রথমে মিসেস কল্পনা আর আনিকা সার্ভ করে দিয়েছে। এরপর যে যার মনে যেটা দরকার পরছে নিয়ে খাচ্ছে। খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বলছেনা৷ মিঃ জাহিদুল এহসান এটা পছন্দ করেন না খাওয়ার সময় কেউ কথা বলুক৷ সাথে তিনি এটাও পছন্দ করেন না, বাড়ির সবাই খাবে, আর বাড়ির বউ-রা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কার কি লাগবে এগিয়ে দিবে। উনার কথা এক পরিবার, সবাই একসাথে বসে খাবে। সকালবেলা আর দুপুরবেলা কাজের সূত্রে কে কোথায় থাকে, ঠিক থাকে না। কিন্তু রাত্রীবেলা সবাইকেই একসঙ্গে হতেই হবে৷ খাওয়ার পর সবাই টুকটাক গল্প করে উঠে চলে যায় ঘুমাতে। আর শুক্রবারে বাড়ির ছেলেরা রান্না করে। পরের শুক্রবারে মেয়েরা রান্না করে। মিঃ জাহিদুল মনে করেন সংসারে পুরুষ মানুষদের যেমন কাজ সামলে একটা অবদান আছে, মেয়েরা সারা সপ্তাহ ছুটোছুটি করে রান্না করে, সংসার সামলায় তাদেরও একটু রেস্ট দরকার৷ সেজন্য মাসে চার শুক্রবারের দুই শুক্রবার বাড়ির সকল কাজ করার দায়িত্ব ছেলেদের, আর বাকি দুই শুক্রবার ছেলেদের রেস্ট করার জন্য ছাড় দেওয়া হয়। হিয়া খেতে বসার আগে নাতাশার মুখে কথাগুলো শুনেছে। শুনে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে তার। অথচ তাদের ছোট্ট পরিবার, কখনও এভাবে বসে খাওয়া হয়নি, হিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে খাওয়ার পাশাপাশি খাওয়ায় ব্যস্ত প্রতিটা মানুষকে দেখছে একটু পরপর৷ কি সুন্দর তাদের পরিবারের বাধন। হিয়া এভাবেই একবার দেখার ফাঁকে ইহসাসের দিকে চোখ পরতেই ইহসাস হিয়াকে চোখ মে”রে দেয়। হিয়া ভাতের লোকমা মুখে দিচ্ছিলো তখন। ইসাসের এহেন কাজে সে খাবে আর কি! তার হেচকি উঠে যায়। রায়া টেবিল ছেড়ে উঠে এসে বোনের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দেয়। সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে হিয়াকে নিয়ে। ইহসাস হিয়ার এই অবস্থা দেখে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আনমনে বিরবির করে, ‘এই মেয়ে সামান্য চোখ মা”রায় হেঁচকি তুলে যা তা অবস্থা করে ফেললো, একে বিয়ে করে বাসর করতে গেলে তো বাসর করেই হার্ট অ্যা”টাক করে আমায় জে”লে পাঠাবে৷ পুলিশ এসে বিয়ের রাতেই নববধু হ”ত্যার দায়ে ১৪গুস্টি সহ জে’লের ১৪শিকেয় তুলে ফেলবে৷ বাপরে কি ভয়ংকর ঘটনা৷’ ইহসাস ব্যাপারটা কল্পনা করেই ঝা’কি দিয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ পর হিয়ার হেঁচকি কিছুটা থামলে সবাই সবার চেয়ার বসে পরে। মিসেস সেলিনা হিয়াকে বলে উঠেন,
” সাবধানে খাবে তো আম্মু। দেখলে হেচকি উঠে কি অবস্থা হলো৷”
হিয়া মিসেস সেলিনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। উত্তরে কিছু বলে না। উনার কথার সাথে তাল মিলিয়ে মিসেস কল্পনাও বলেন,
” বড় ভাবী ঠিকই তো বললো আম্মু, খেতে বসে কোন চিন্তায় চলে গিয়েছিলে?”
হিয়া এবার চুপ করে থাকতে পারলোনা। দুজনের কথার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায়! সে হাসিমুখেই বললো,
” এতো উত্তেজিত হবেন না, আমি ঠিক আছি৷”
” খাওয়ার সময় শুধু খাবারের দিকেই মনোযোগ দিতে হয় মামনি, খাবার আল্লাহ তায়ালার এক অশেষ নেয়ামত, আমাদের রিযিকে যতটুকু খাবার আছে, ততটুকুই মনোযোগ সহকারে খেয়ে নিতে হয়। খাবার তো আমাদের বেচে থাকার মাধ্যম৷ খাবার সময় মনোযোগ দিয়ে খেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয় বুঝলে মামনি! এই সময় কথা বলা বা চিন্তা করা একদমই উচিত না৷”
মিঃ জাহিদুল এবার সুন্দর করে হিয়াকে বুঝালেন। হিয়া উনার কথার উত্তরে বললো,
” বুঝলাম আংকেল৷ মাথায় রাখবো।”
” শুধু মাথায় রাখলে চলবেনা, মানতেও হবে আম্মু।”
মিঃ রুবেল হিয়ার কথা শুনে কথাটা বললেন। হিয়া উনার কথাতেও বললো,
“জ্বি আংকেল অবশ্যই মানবো।”
হিয়া হাসিমুখে উনাকে উত্তর দিয়ে একবার ইহসাসের দিকে তাকালো। ইহসাসও হিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনের মাঝে চোখাচোখি হতেই, ইহসাস চোখ নামিয়ে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো ভাতের প্লেটে আঙুল দিয়ে আঁকাআকি করতে লাগলো আর লোকমা বানিয়ে ভাত মুখে দিচ্ছিলো। হিয়া তা দেখে নিজেও খেতে খেতে বিরবির করে বললো, ‘ ঢং দেখো, যেনো কিছুই করেনি। ব’দ একটা, যার জন্য এতোকিছু, সে এমন ভাব করছে যেনো কিছুই হয়নি। ব'”জ্জাত একটা।’ এরপর সে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রায়ার একটুও খেতে ইচ্ছে করছেনা, তবুও সবার সাথে বসায় ছোটো ছোটো গ্রাসে খাবার খেতে থাকে। সবার এতো অমায়িক ব্যবহার দেখে মনে মনে ভাবে, ‘কত সুন্দর একটা পরিবার, সবাই কতটা আদর ভালোবাসা দিচ্ছে। অথচ তার বাবা মা প্রতিটা মানুষকে ঠ*কিয়ে তার মনের অবস্থা লুকিয়ে,তাদের ছেলেকে মানতে পারবে কি না পারবে! সবকিছু লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলো।’ রায়া হতাশার শ্বাস ফে’লে। রাদ, রায়া,আনিকা,নাতাশা,ইহসাস চুপচাপ নিজেদের খাবার শেষ করে। শেষ করে উঠে হাত ধুতে যেতে ধরলেই মিঃ জাহিদুল বলেন,
” তোমরা সবাই হাত ধুয়ে এসে এখানে আবার বসো একটু। আমার কিছু কথা বলার আছে।”
ওরা সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করলো। কি কথা বলবেন উনি! আনিকা কৌতূহল দ”মন করতে না পেরে বললো,
” কি কথা বলবেন বাবা?”
” আগে হাত ধুয়ে এসো তোমরা। ”
সবাই বুঝলো হাত ধুয়ে না আসা অব্দি উনি বলবেন না। সবাই হাত ধুতে চলে গেলো।
চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ওয়েদার দিনদিন খারাপ হচ্ছে, আর অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। গল্প টা শুরু করার আগে বুঝিনি এমন অবস্থা হবে, দুয়া করবেন আমার জন্য। হ্যাপি রিডিং। আসসালামু আলাইকুম।