#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_১১
_________________
সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর মুসকানকে পড়তে বসিয়েছে সায়রী৷ মুসকান বিছানায় বসে পড়ছে। সায়রী তাঁর পাশে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন ঘাটাঘাটি করছে৷ পড়ার ফাঁকে মুসকান একটু পর পর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মনটা তাঁর ভীষণ খচখচ করছে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে এখন অবদি ইমনকে সে দেখতে পায়নি৷ খাওয়ার সময়ও ইমন ছিলো না। ইরাবতী কথার ফাঁকে বলেছে, ইমন কি একটা কাজে বাইরে গেছে ব্যাস এটুকুই। মুসকানের ছটফট করাটা সায়রীর চোখ এড়ায়নি। সে বেশ বুঝতে পারছে মুসকানের মনে এখন কি চলছে। সায়রী ভাবলো “মুসকানের সাথে কথা বলতে হবে। ওকে বোঝাতে হবে এসব আবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে। ভালো, মন্দ বোঝার বয়স মুসকানের হয়নি তাই তাঁকে ভালো মন্দ বোঝানোটা আমার কর্তব্য”।
.
দিহান রুমে এসে মুসকানকে এক ব্যাগ চকোলেট দিলো৷ তারপর সায়রীর সাথে পায়ে পা বাজিয়ে ঝগরা করতে লাগলো। মুসকান মুখটা গোমড়া করে বসে আছে। মনে মনে অসংখ্য অভিযোগ করতে থাকলো তাঁর নানাভাইকে নিয়ে৷ সে কেনো একটিবারও তাঁর সাথে দেখা করছেনা? এ বাড়িতে সে আছে অথচ তাঁর নানাভাইয়ের সাথে তাঁর একটুও দেখা হচ্ছেনা তা কি মানা যায়?
দুপুর অবদি বাইরে ছিলো ইমন৷ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে৷ নিজের সব অনুভূতিগুলো কে গলা টিপে হত্যা করেছে । এবং নিজের মা কে জানিয়েছে তাঁর জন্য মেয়ে দেখতে। যতো তারাতাড়ি সম্ভব বিয়ে করবে সে। মুসকান নামক যে ভয়ংকর অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে আছে তাঁকে সেই অনুভূতি ছাড়াতে নিজের লাইফে কাউকে আনা খুব প্রয়োজন। কিছুদিনের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে এতো বছরের বন্ধুত্ব সে ধ্বংস করতে পারবেনা ৷ বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে বন্ধুত্বকে বেছে নিয়েছে সে। মুরাদের বলা কথাগুলো তাঁকে খুব কড়াভাবেই আঘাত করেছে।
বেলকনিতে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর নানারকম চিন্তা করে যাচ্ছে ইমন৷ সচরাচর সে সিগারেট খায় না। মাঝে, সাঝে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খাওয়া হতো। অথচ আজ মুরাদের বলা কথা গুলো শোনার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে সিগারেটের উপরেই আছে ৷ বাড়ি ফিরেও একি অবস্থা তাঁর মা এতো বার খাওয়ার জন্য আকুতি, মিনতি করলো অথচ সে বাইরে খেয়েছে বলে মিথ্যা স্বান্তনা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো মা কে।
ইমন বাড়ি ফিরেছে প্রায় এিশ মিনিট হয়ে এলো। এতোক্ষণ মুসকান অপেক্ষা করছিলো তাঁর জন্য। ভেবেছিলো একবার হলেও দেখা করতে আসবে। কিন্তু না ইমন একবারের জন্যও আসেনি। বুকের ভিতর খুব অস্থির করছে তাঁর। ফাঁপর লাগছে খুব৷ কেনো আসছে না? একবার দেখা করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? সেদিন তো খুব বললো ‘মুসু তোকে একটা দিন না দেখে থাকাও যেন দায়, মুসু তোর এই মুখটা তে কি আছে বল তো? উপরওয়ালা কি পৃথিবীর সব মায়া তোর এই মুখটায় ঢেলে দিয়েছে? আমি খুব বেহায়া হয়ে গেছিরে। আমি খুব বেহায়াপনা করছি তোর সাথে৷ তুই কি আমার এই বেহায়া মনের চাওয়াতে সাড়া দিবিনা’? উত্তরে মুসকান কিছু বলতে পারেনি। লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিলো সে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল ঝড়ের বেগে৷ কাঁপা গলায় শুধু বলেছিলো ‘রাখছি’।
অথচ আজ এক দুপুর না দেখেই দিব্বি কাটিয়ে দিলো। রাগে,দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো তাঁর। তাঁর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড যখন তাঁর বান্ধবীর সাথে মিট না করে,কথা না বলে তখন বান্ধবী হাত কাটে। ঘুমের টেবলেট খায়। ইমনকেও তো সে ভালোবাসে খুব ভালোবাসে। ইমনও তো তাঁর বয়ফ্রেন্ড তাহলে ইমন যে সকাল থেকে দুপুর অবদি তাঁর সাথে কথা বলেনি,দেখা করেনি তাহলে তাঁরও তো উচিত হাত কাটা,বা ঘুমের টেবলেট খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকা। তাহলে কি সেটাই করবে? কিন্তু হাত কাটার জন্য ব্লেট কোথায় পাবে? এ বাড়ির কোথায় ব্লেট থাকে সে তো জানেনা। পরোক্ষণেই ভাবলো হাত কাটলে কাল পরীক্ষা দেবে কি করে? তাছাড়া সে যদি খুব ব্যাথা পায়? তাহলে কি ঘুমের টেবলেট খাবে? হ্যাঁ এটা করা যায়। এখন খাবে কাল সকাল অবদি ঠিক ঘুম ছেড়ে যাবে। পরীক্ষা তো দুপুর দুটায় শুরু। কিন্তু ঘুমের টেবলেট কোথায় পাবে? বাথরুমে দরজার দিকে চেয়ে রইলো কতোক্ষন। সায়রী বাথরুমে তাই পুরো রুম খোঁজে দেখলো কোন ওষুধ আছে কিনা? কিন্তু ঘুমের ওষুধ সে চিনবেই বা কি করে? কে হেল্প করবে এখন তাঁকে? রুম ছেড়ে বেরিয়ে নিচে ওকি দিলো। কাজের মেয়ে পারুল দুপুরের খাবার রেডি করছে। ইরাবতীর রুমে গিয়ে দেখলো সে ঘুমাচ্ছে। তাই ভাবলো ইমনের রুমে যাবে। ইমনের ড্রয়ারে একদিন বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেখেছিলো। ঘুমের ওষুধ না পেলে সামনে যা পাবে সব খাবে৷ ইমন তো বাড়ি নেই রুম নিশ্চয়ই ফাঁকা?
ইমনের রুমে গিয়ে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি করে বেশ কিছু ওষুধ পেলো৷ কয়েকটা পরিচিত কয়েকটা অপরিচিত। গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ খেলে ক্ষুধা লাগবে বেশী বেশী তাই সেটা বাদ রেখে ঠান্ডার ওষুধ মোনাস আর নাপা এক্সট্রা হাতে নিলো। খুব মনোযোগ সহকারে প্রতিটি টেবলেট গুলো এক এক করে হাতের মুঠোয় নিতে লাগলো। এগারোটা হয়ে গেছে তাই আর নিলো না। টেবিলে চেয়ে দেখলো গ্লাসে পানি ভরাই আছে তাই পানির গ্লাস নিতে যাবে তখনি ইমন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—- এসব দিয়ে কি করবি?
—- এগুলো খাবো৷ ঘোরের মধ্যে থেকে কথাটা বলেই চমকে পিছনে তাকালো। ইমনকে দেখে আরো দ্বিগুণ চমকে গেলো। পা থেকে শুরু করে মাথা অবদি কেমন করে যেনো কেঁপে ওঠলো।
—- খাবি মানে? এসব কি পাগলামি মুসু তুই এতোগুলো ওষুধ খাবি? কি ওষুধ নিয়েছিস দেখি মাথা ঠিক আছে তোর?
কাঁধে চেপে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো ইমন। মুসকান কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
—- তুমি কোথায় ছিলে নানাভাই?
—- চুপপ। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে? এসব কি করছিলি তুই?
ধমক খেয়ে কেঁদে দিলো মুসকান। ভয়ে ভয়ে বললো,
—- তুমি আমার সাথে সকাল থেকে দেখা করোনি। কথা বলোনি তাই হাত কাটতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখানে ব্লেট পাবো কোথায়? তাই ঘুমের টেবলেট খুঁজছিলাম কোনটা কি জানিনা তাই এগুলোই নিলাম।
বিস্ময় চোখে চেয়ে ধমকে ওঠলো ইমন।
—- কিহ! এসব কি কথা ? এগুলো কার থেকে শিখেছিস? আমি দেখা করছিনা, কথা বলছিনা তাঁর সাথে এটার কি সম্পর্ক?
—- বয়ফ্রেন্ড যদি গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা না করে কথা না বলে তাহলে গার্লফ্রেন্ড রা তো হাত কাটেই। ঘুমের টেবলেটও খায় এটাই তো ভালোবাসা।
—- কে বলেছে এগুলো?
—- আমার বান্ধবী দের থেকে শুনেছি৷
মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেলো ইমনের। ইচ্ছে করলো থাপড়িয়ে সবকয়টা দাঁত ফেলে দিতে। কিন্তু পারলোনা শুধু হাত থেকে সবগুলো টেবলেট নিয়ে মুসকান কে শাসিয়ে বললো,
—- চুপ করে এখানে বসে থাক আমি আসছি।
ওষুধ গুলো ফেলে দিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো ইমন৷ হাসবে না কাঁদবে না রাগবে বুঝে ওঠতে পারছেনা৷ তবে এটুকু বুঝেছে সায়রী ঠিক বলেছে। আর যাইহোক তাঁর মতো অনুভূতি মুসকানের হয়নি। হবে কি করে? এটুকু বয়সে এরা সত্যি প্রেম কি?ভালোবাসা কি? বোঝে? এসব বোঝার জন্য হলেও তো নির্দিষ্ট একটা বয়সের প্রয়োজন। সে বয়সে আসতেও তো অনেক দেরী। এ বয়সে এদের যা অনুভূতি এগুলো না প্রেমের পর্যায়ে পড়ে না ভালোবাসার পর্যায়ে পড়ে৷ বয়ফ্রেন্ড কথা না বললে দেখা না করলেই হাত কাটতে হবে এক গাদা ওষুধ খেয়ে মরতে হবে বাহরে বাহ। কি যুগ এলো রে। হাঁটুর বয়সি পোলাপান প্রেমের নতুন নিয়ম, ভালোবাসার আজগুবি নিয়ম তৈরী করছে। এরা তাহলে স্কুলে গিয়ে এসব অপকর্ম শেখে? ইচ্ছে করলো আজ থেকেই মুসকানের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে৷ স্কুল যেতে হবেনা তাঁর বাসায় রেখে নিজে পড়াবে। কিন্তু তাঁর তো সে অধিকার নেই। তাহলে কি হবে? সায়রীকে বলে স্কুলের মেয়েদের কি শাসন করা উচিত? নাকি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? কিন্তু মুসকানকে তো শাসন করা উচিত। কি করে করবে? ধমক দিলেই তো কান্না করে দেয়। মেয়েটা এই বিশ্রি জিনিসটা না শিখলেই কি হতো না? ধমক দিলে কাঁদতে হয় এটা ওকে কে শেখালো? কে বোঝালো? তাঁকে এ মূহুর্তে সামনে পেলে গর্দান নেওয়া হতো বোধহয়।
.
মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো ইমন। মুসকান জড়োসড়ো হয়ে নিজের ওড়না চেপে ধরে বসে রইলো। ইমনের দম বন্ধ লাগছে। নিজের অনুভূতি কে তো গলা টিপে হত্যা করেছে তাহলে সেই অনুভূতি আবারো তাঁকে নাড়াচাড়া কেনো করছে? এই মেয়েটা কেনো তাঁর পৃথিবী উলটপালট করে দিচ্ছে? সকাল থেকে দেখা করেনি কথা বলেনি তাই বলে বোকার মতো কি কান্ড টাই না করতে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস সে ছিলো নয়তো কি হতো? বড় বড় করে মুসকানের দিকে তাকালো ইমন। বললো,
—- আর কখনো এমন পাগলামি করবি না মুসু।
—- তাহলে তুমিও আর কখনো আমাকে ছেড়ে দূরে থাকবেনা বলো?
বড়সড় ধাক্কা খেলো ইমন। আচমকাই খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মুসকান কে। মুসকান চমকে গেলো ভীষণ। জড়োসড়ো হয়ে রইলো সে।
—- দূরে গেলে তোর কষ্ট হয়?
—- হুম আমার বুকের ভিতরটা শুকিয়ে যায়, ফাঁপর লাগে। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। বুকের ভিতর গরম বাতাস বইতে থাকে। মন চায় বুকের মাঝখানে ব্লেট দিয়ে কেটে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঠান্ডা করি।
কথাটা শুনতেই ইমন চমকে গেলো। কারণ তাঁরও তো একি অনুভূতি হয়। তাহলে কি মুসকানের ভিতর সত্যি তাঁর জন্য স্ট্রং একটা অনুভূতি রয়েছে?
সবকিছু ভুলে গিয়ে ইমন কথা দিলো কখনো দূরে যাবেনা সে৷ খুশিতে মুসকানও ইমনকে জরিয়ে ধরলো। ঘোরের মধ্যে রয়েছে ইমন সেই ঘোর থেকেই সে একটা ভুল করে ফেললো। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মুসকানের৷ মনের সব অনুভূতি বিলীন হয়ে একরাশ ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরলো তাঁকে। কোনভাবেই ইমনের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা৷ ইমনের দুটো রূপের সাথে সে পরিচিত ছিলো আজ যেনো আরেকটা রূপ যোগ হলো৷
মুসকান যখন শব্দ করে কেঁদে ওঠে চমকে ছেড়ে দেয় ইমন৷ পুরো শরীর,মাথা ঝিম ধরে গেছে তাঁর। মূহুর্তেই মুরাদের বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকে ঢোলের মতো। তাঁর মানে কি সত্যি ইমন চৌধুরী বেঈমান হয়ে গেলো? ইমন চৌধুরীর ব্যাক্তিত্বে বেঈমান,বিশ্বাসঘাতক উপাধি কি যোগ হয়ে যাবে? চরিএেও কি দাগ পড়ে গেলো তাঁর?
.
চোখ বুজে ইমনের দু পিঠ খামচে ধরে বুকে মাথা রেখে কাঁপছে মুসকান। ইমন মুসকানের মাথাটা একহাতে চেপে ধরে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে৷ মাথা কাজ করছে না তাঁর। ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় গুলি করে মরে যেতে। ইচ্ছে করছে বুকের ভিতর শত ছুড়ির আঘাত করতে৷ কি থেকে কি হয়ে গেলো৷ এই বাচ্চা মেয়েটার থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে কেনো রাখতে পারেনা সে? ছিঃ।
_________________________
সেদিনের পর দুমাস কেটে যায়। ইমন আর মুসকানের কাছাকাছি যায়নি৷ মুসকানও ভয়ে একা তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। তবে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে তাঁদের। ইমনের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল আবেগের বশে মুসকান যদি নিজের ক্ষতি করে ফেলে?
.
কোর্ট থেকে ফিরেছে সবেমাএ। তখনি ইরাবতী কয়েকটা মেয়ের ছবি সামনে ধরলো। ইমন শার্ট খুলে তয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বাথরুম যাচ্ছিলো। তখনি তাঁর মা সামনে এসে পড়ে।
—- বাবা এবার কিন্তু চোখ, মুখ খিচবা না৷ এবারের সবগুলা মেয়ে যথেষ্ট সুন্দরী এবং শিক্ষিত। এর মধ্যে দুজন এডভোকেটও।
ইমন মাকে দেখানোর জন্য খপ করে ছবিগুলো নিয়ে এক পলক দেখে বললো,
—- ইশ মা সবগুলো দেখেই ময়দা সুন্দরী লাগছে। ঠোঁটের লিপস্টিক দেখেছো মনে হচ্ছে মানুষের রক্ত খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে। এসব চলবে না।
ইরাবতী আহত গলায় বলে,
—- বাবা তোমার ঠিক কেমন মেয়ে চাই একবার মুখ ফুটে বলে আমাকে ধন্য করবা?
ইমন করুণ চোখে তাকায় মায়ের দিকে। ‘তোমাদের চোখের সামনেই তো আছে মা। যার শরীরের দুটো তিল তীরের মতো আমার হৃদপিন্ডে আঘাত করেছে, যাকে দেখার জন্য আমার মনটা সর্বক্ষণ ব্যাকুলতায় ভোগে, যার চোখে,মুখে উপরওয়ালা দুনিয়ার সব মায়া ঢেলে দিয়েছেন, আমার বন্ধু নামক চরম শত্রু, গোপন শত্রুর একমাএ আদরের বোন আমার মুসুরানী’। মনের কথা মনে রেখেই বললো,
—- ক্ষুধা লাগছে খাবার বাড়ো গিয়ে এসব নিয়ে পরে কথা বলবো।
.
মুরাদের চাচার শরীরটা বেশী ভালো না। সবাই আতঙ্কে থাকে মুরাদের বাবার মতো হুট করে যদি ওনিও দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেন? বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে যতো চিন্তা ছোট মেয়েকে নিয়েই। এবার ছোট মেয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এ কথা বড় মেয়ে রুমার হাজব্যান্ড রাতুল শুনতেই বলে,
—- আব্বা আপনার এক মেয়েকে দূরে বিয়ে দিয়েছেন। এবার রিমি চলে গেলে আপনি আর আম্মা একদমই একা হয়ে পড়বেন। আমি বলছিলাম ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক৷ আপনি মরিয়ম চাচির সাথে কথা বলেন। মুরাদের জন্যও তো মেয়ে খোঁজা হচ্ছে শুনলাম।
মেয়ে জামাই তাঁর খুবই জ্ঞানী, বুদ্ধিমান তাঁর এই সিদ্ধান্তে খুশি না হয়ে পারলো না। নিজের ভাইয়ের ছেলেকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন তিনি।
বাড়ির সকলের মধ্যে আলোচনা চললো পুরো এক দুপুর। এবং সিদ্ধান্ত হলো সামনে সপ্তাহে মুরাদ আর রিমির বিয়ে৷ মায়ের মুখের ওপর কথা কোনদিনই বলেনি মুরাদ। চাচাকেও সে যথেষ্ট সম্মান করে। বিয়ে নিয়ে কথা ওঠার পরই মুরাদের মনে যে প্রশ্নটা জাগে তা হলো ‘রিমি কারো সাথে রিলেশনশীপে নেই তো’?
রিমির সাথে একা কথা বলে মুরাদ। নিজের বাড়ির মেয়েদের যথেষ্ট ভালো করেই চিনে সে। তবুও মনের ভিতর তো আর ঢুকতে পারেনা তাই সিওর হয়ে নেয়।
এবং বিয়ের ডেট ফিক্সড করে ফেলে।
.
ইমনকেও ফোন করে জানিয়ে দেয়। বিয়ের তিনদিন আগে থেকে যেনো তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত থাকে সে। প্রিয় বন্ধুর বিয়ে নিয়ে কতশত প্ল্যান ইমনের। সব থেকে বেশি আশ্চর্য হয়েছে রিমির সাথে বিয়ে শুনে তাঁর মানে এক হিসেবে মুসকান মুরাদের শালিকাও তো হবে। যাক হাসি তামাসার ছলে মুরাদের কাছে তাঁর শালিকাকে চাওয়া যাবে। মুরাদের রিয়্যাকশনও বোঝা যাবে।তৎক্ষনাৎ অনেক প্ল্যান করে ফেললো ইমন। প্রতিটা সেকেন্ড কল্পনা করতে লাগলো সে কি করবে না করবে। কিভাবে পটাবে মুরাদকে। সেই সাথে মুসকান কেও দেখে নেবে। সেদিনের পর মুসকান ইমনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। যা একদম ভালো ঠেকছে না তাঁর কাছে। একবার একা পেলে সেদিনেরটা রিটার্ন হবে ভেবেই মুচকি হাসলো।
এতো খুশি এতো আনন্দ আগাম পরিকল্পনা সব ঠিক থাকবে তো? কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত খুশি হলে সেই খুশি নাকি কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? মুরাদের নতুন জীবনে পা দেওয়াতে ইমনের জীবনও কি নতুন মোড় নেবে? যদি তাই হয় সে জীবনে মুসকান থাকবে তো?
#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_১২
.
সময় খুব দ্রুতই চলে গেলো। চলে এলো বিয়ের দিন। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধবে ভরপুর। ভোর রাতেই গরু জবাই করা হয়৷ মাংস কাটতে গিয়ে বা হাতের আঙুলে আঘাত লাগে ইমনের৷ মুরাদ তাঁকে রুমে নিয়ে এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে চলে যায়। ইমন কিছুক্ষণ রেষ্ট নিবে তাই রিমির বড় বোন রুমাকে বলে এক কাপ কফি দিতে। সকলেই কাজে ব্যাস্ত রুমা কফি বানিয়ে মুসকানকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। মুসকান কফি নিয়ে রুমে যেতেই দেখে ইমন চোখ বুজে একহাত কপালে ঠেকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। হাতের ব্যান্ডেজ দেখে কান্না পেলো তাঁর। মুখটা কাঁদো কাঁদো করেই কাছে গিয়ে পাশে বসলো৷ ধীর আওয়াজে বললো,
—- তোমার কফি।
ইমন চোখ মেলে তাকালো। এই মিষ্টি কন্ঠস্বর,এই মিষ্টি মুখটারই অপেক্ষা করছিলো সে। মুচকি হেসে ওঠে বসলো। পলকহীন ভাবে চেয়ে জিগ্যেস করলো,
—- তুই বানিয়েছিস?
মুসকান মাথা বামে-ডানে ঘুরিয়ে না করলো। ইমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে কফির মগ নিয়ে বললো,
—- চা,কফিটা অন্তত শিখতে পারিস? আর কিছু না হলেও এই দুটো তো আমি তোর হাতেই খাবো।
মুসকান মাথা নিচু করে বললো,
—- আচ্ছা।
—- কি আচ্ছা শিখবি নাকি?
—- হুম।
—- একদম না। এই বয়সে এটা না শিখলেও দোষের কিছু নেই৷ আরো দু,এক বছর পর এসব শিখে নিবি। এখন শিখতে গেলে হাত,পা পুড়াবি আর দোষ হবে আমার৷
মুসকান গোমড়ামুখে বললো,
—- এখনিতো বললে শিখতে আবার এ কথা বলছো কেনো?
ইমন কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললো,
—- কই এটা বলেছি নাকি? না তুই ভুল শুনেছিস। আমি বলেছি দু এক বছর পর শিখতে পারিস।
মুসকান বোকা চোখে চেয়ে রইলো। ইমন মিটিমিটি হাসছে আর কফি খাচ্ছে। কফি শেষ করতেই মুসকান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইমন বললো,
—- তুই কি আমার আঘাতের স্থান টা দেখিসনি মুসু?
মুসকান টলমল চোখে তাকালো বললো,
—- দেখেছি৷ কিন্তু সময় নিয়ে তাকাইনি আমার ভয় লাগে।
—- তাহলে আমার আঘাতে তোর খারাপ লাগেনি তাইতো?
মুসকান চুপ হয়ে চেয়েই রইলো। ইমন হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
—- একটা চুমুতো খেতেই পারিস। প্রেমিকার চুম্বনে প্রেমিকের মরণ ব্যাধিও সেড়ে যায় তা কি তুই জানিস না?
হাত থেকে কফির মগ টা ফস করে পড়ে গেলো। যার ফলে আরো বেশীই কাঁপছে মুসকান। ইমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ধমকে বললো,
—- চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। যা বলছি এখনি যা। এতো ছোট আত্মার মানুষ যেনো আমার সামনে আর এক সেকেন্ডও না থাকে৷
মুসকান হতভম্ব হয়ে পিছন ঘুরতেই ইমন আবারো ধমকে ওঠলো,
—- ঐ এটা কে নেবে? তোর কলিজা এতো ছোট জানলে তোর চুমু চাওয়া তো দূরের কথা নিজেও চুমু খেতাম না।
মুসকান নিচু হয়ে মগটা কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ছুঁড়ে ফেললো মগটা। রাগে গটগট করতে করতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। সামনে রাগ খাটাতে পারেনি বলে রাগটা ইমনের আড়ালেই খাটালো৷ একেতো তাঁকে লজ্জা দিয়েছে তারওপর ধমক দিয়ে অপমান করে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাঁর। রান্নাঘরে মরিয়ম আক্তার মেয়েকে বকা দিচ্ছেন। সারাদিনে একটা কাজও করেনা মেহমানকে কফি দিতে বলেছে বলে এতো রাগ দেখানোর কি আছে বুঝলেন না তিনি৷ তাই কয়েকটা বকা দিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন ৷
.
দুপুর গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। মুসকান, মুসকানের বান্ধবী আর মামাতো, খালাতো ভাই বোনরা মিলে বাসর সাজাচ্ছে। বিয়ে পড়ানো হয়েছে আধাঘন্টা আগেই। মুরাদের বন্ধু,বান্ধব রা মিলে বসার রুমে আড্ডা দিচ্ছে। রিমিও তাঁদের সাথেই রয়েছে। ইমন অনেক সময় ধরে মুসকানকে দেখেনি। তাই সবার থেকে সরে গিয়ে যে ঘরে বাসর সাজানো হচ্ছে সে ঘরে গেলো। গিয়ে দেখলো সবাই মিলে খুব হৈচৈ করছে। মুসকানও প্রচুর মজায় আছে ওদের সাথে। কি সুন্দর, মিষ্টি হাসি মেয়েটার, কি সুন্দর করে সবার সাথে কথা বলছে অথচ তাঁর সামনে এলেই চুপসে যায় কেমন। মাথা চুলকে মিটিমিটি হাসতে লাগলো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। মুসকান কথার ফাঁকে দরজায় তাকাতেই ইমনকে দেখতে পায়। ইমন ইশারা করে বাইরে আসতে। মুসকান এক ঢোক গিলে ধীরস্থিরভাবে বিছানা থেকে নেমে বাইরে যেতেই ইমন মুসকানের হাতটা চেপে ধরে ছাদে নিয়ে যায়।
.
মুসকান যখন রুম থেকে বের হয় পিছন পিছন তাঁর খালাতো ভাই শাওনও বের হয়। শাওন এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। মুরাদ সহ মুরাদের সকল ভাই, বোনরাই প্রচন্ড রাগি সেই সাথে কাজিনদের ব্যাপারেও ব্যাপক সিরিয়াস। ইমনের সাথে ওভাবে মুসকানকে দেখে অবাক হয় সে। সেই সাথে সন্দেহও হয়। কারন তাঁর নানি মারা যাওয়ার পরেরদিনই মারুফের বন্ধুর সাথে মারিয়ার সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়েছে। অনেক ঝামেলাও হয়েছে এ নিয়ে। একি কাহিনী কি মুরাদ ভাইয়ের বন্ধুও করছে? আর মুসকান? ও তো অনেকটাই ছোট মারিয়ার থেকেও ছোট ও ওর সাথে ইমন ভাইয়ের মতো একজন মানুষ সম্পর্কে জরাবে? নিজের সন্দেহ সঠিক না ভুল? তা বুঝার জন্যই সে চুপিচুপি চলে যায় ছাদে।
ছাদের দরজার পাশেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসকান৷ ইমন তাঁকে ওটা সেটা প্রশ্ন করছে সে শুধু হুম,না করে উত্তর দিচ্ছে। ইমন এক ধ্যানে চেয়ে আছে মুসকানের লজ্জামিশ্রিত মুখটার দিকে। বুড়ো আঙুল দিয়ে মুসকানের ঠোঁটের কোনার তিলটায় হাত বুলাচ্ছে আলতো ভাবে। দরজার চিপা দিয়ে শাওন দেখার চেষ্টা করছে ঘটনাটা আসলে কি? ইমনের কন্ঠস্বর কানে এলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা। রাতের বেলা ছাদে লাইট অন থাকে বলে এটুকু দেখতে পাচ্ছে যে ওরা কি করে? যতোটা বুঝার বুঝে গেছে সে। তারপরও শেষটা দেখার অপেক্ষায় তারপর এদের শায়েস্তা করবে। ভালো মানুষীর আড়ালে আসল ইমনটাকে টেনো হিঁচড়ে বের করবে আজ শাওন।
মুসকানের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে কপালে আলতো স্পর্শ করলো ইমন। তারপর পকেট থেকে দুটো গোলাপ বের করে একটা মুসকানের হাতে দিলো। আরেকটা মুসকানের বেনুনীর ভিতর গুঁজে দিলো। মুসকান গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে সে৷ ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে। কিন্তু সামনের মানুষ টার অবাধ্য হয়ে এক পা নড়ার শক্তিও তাঁর নেই।
ইমন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—- সেদিনেরটা রিটার্ন হয়ে যাক? কাঁদবি না প্লিজ।
মুসকানের বুকটা ধক করে ওঠলো। পুরো শরীর তাঁর মৃদু কেঁপে ওঠলো। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকলো সে। ইমন তাঁর দুগালে, কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। মুসকানের হাত আপনাআপনিই চলে গেলো ইমনের বুকে, পিঠে। মৃদু হাসলো ইমন। ইচ্ছে করছিলো আরো কাছে নিতে ভেসে যেতে অন্য এক দুনিয়ায় কিন্তু সে আর এগোলো না। দুহাতে শক্ত করে বুকে জরিয়ে নিয়ে বললো,
—- এতো নরম কেনো তুই? প্লিজ শান্ত হো কিছু করবোনা এমনি বলেছি। সেদিনতো ভুল করে হয়ে গেছে বার বার কি আমি ভুল করবো নাকি? এই শুধু জরিয়ে ধরবো একটু বলেই বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চুলে নাক ঘষতে লাগলো।
দুজনই যখন একে অপরের সাথে মিশে রয়েছে। দুজনেরই যখন শ্বাস-প্রশ্বাস মিলে, মিশে একাকার ঠিক সে সময়ই মুরাদ ইমনের শার্টে চেপে ধরে একটানে সড়িয়ে বিশ্রি একটা গালি দিলো। আচমকাই এমন কিছু হওয়াতে ইমন কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু মুরাদ যখন মুসকানের গায়ে হাত তুললো মাথায় রক্ত চড়ে গেলো তাঁর। ইমন মুরাদের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে অগ্নি চক্ষুতে চেয়ে রাগান্বিত গলায় বললো,
—- তোর সাহস কি করে হয় ওর গায়ে হাত তোলার?
—- তোর সাহস কি করে হয় আমার বোনকে নোংরা ভাবে স্পর্শ করার?
—- মুখ সামলে কথা বল মুরাদ। তুই না জেনে না বুঝে রিয়্যাক্ট করতে পারিস না।
—- কি বুঝাবি তুই কি বুঝাবি? বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক।
দু বন্ধুর মধ্যে মারামারি লেগে গেলো। একজন অপরজনকে সমান তালে ঘুষি দিয়েই যাচ্ছে। মুসকান ভয়ে গুটিশুটি হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। শাওন ওদের ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ওদের দুজনের শক্তির কাছে সে যেনো সামান্য পিঁপড়া মাএ।
একপর্যায়ে ইমনকে নিচে ফেলে মুরাদ তাঁর উপরে ওঠে কলার চেপে ধরে বললো,
—- তুই আমার কলিজার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি?
ইমনও তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে মুরাদকে নিচে ফেলে কলার চেপে ধরে বললো,
—- তুই আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারবিনা। না জেনে, না বুঝে তুই আমার হৃদপিন্ডে আঘাত করেছিস।
একিভাবে মুরাদ আবার ইমনকে নিচে ফেলে চিৎকার করে বললো,
—- আমার কলিজার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস কে দিলো তোকে?
—- ইমন চৌধুরীকে সাহস দিতে হয়না।
—- মুসু আমার কলিজা। কি করে পারলি তুই?
—-মুসু আমার হৃদপিন্ড। একিভাবে মুরাদকে নিচে ফেলে চিৎকার করে কথাটা বললো ইমন।
—- খুন করে ফেলবো আমার বোনের দিকে হাত বাড়ালে।
—- তোর বোনকে আমি ভালোবাসি বিয়ে করতে চাই।
—– মরে গেলেও ওকে পাবিনা তুই। বললো মুরাদ৷
সাথে সাথে ইমন একের পর এক ঘুষি দিতে লাগলো। মুসকান কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে বললো,
—- আমার দাদাভাইকে মেরোনা। বলেই নিচে বসে পড়লো।
ইমন ছেড়ে দিলো মুরাদকে মুরাদ সাথে সাথে ওঠে গিয়ে মুসকান কে কোলে তুলে নিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে ইমনের দিকে চেয়ে হিংস্র গলায় বললো,
—- তোকে আমি ছাড়বোনা।
ইমন শার্টের কলার ঠিক করতে করতে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—- আর আমি তোর বোনকে।
_________________________
পুরো বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। গতকাল রাতেই মুরাদের বাড়ি থেকে শুরু করে চৌধুরী বাড়িতেও খবর পৌঁছে গেছে। ইমন মুরাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সকলের সামনে জোর গলায় বলে এসেছে মুসকান যদি তাঁকে চায় তাহলে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই ইমন চৌধুরী কে আটকানোর।
সকাল থেকে মুসকান কিছু মুখে দেয়নি। মুরাদ বাদে সকলেই এসেছে তাঁর কাছে। কেউ তাঁকে খাওয়াতে পারেনি৷ সব রাগ, অভিমান দূরে ঠেলে অবশেষে মুরাদই আসে খাবার নিয়ে। ভাত মেখে মুখের সামনে খাবার দিতেই মুসকান ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মুরাদের চোখও ঝাপসা হয়ে আসে। বোনের দুগালে দশআঙুলের ছাপ দেখে তাঁর বুকটা হুহু করে ওঠে। একদিকে প্রিয় বন্ধুর করা বিশ্বাসঘাতকতা, বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ অন্যদিকে বোনকে করা আঘাত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাঁকে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পরম স্নেহে বোনকে খাওয়িয়ে দিলো সে। তারপর অনেকটা সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝালো যাতে এসবে মনোযোগ না দেয়। ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে বলে এও বললো, রাজপুত্রের মতো ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেব। ইমনের থেকেও হাজারগুন ভালো হবে সেই ছেলে৷ ইমন তো কদিন পর বুড়ো হয়ে যাবে। আমার বোনের বুড়ো বর কেনো হবে?
মুরাদ যতোই তাঁকে ভুলানোর চেষ্টা করছে মুসকান ততোই কান্নায় ভেঙে পড়ছে। একসময় ব্যার্থ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মুরাদ। মরিয়ম আক্তার মুরাদকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলে,
—- দেখ মুরাদ তুই বাড়াবাড়ি করছিস। কাল ছেলে টাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলি। ওরা যদি একজন আরেকজনকে পছন্দ করেই থাকে এতে দোষের কি আছে? হ্যাঁ ইমনের বয়সটা মুসুর থেকে বেশী তাই বলে এতোটাও না যে এদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে না। ভুলে যাসনা তোর বাবা যখন আমাকে বিয়ে করে আনে তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম আর তোর বাবা স্কুল মাস্টার ছিলো। একটা ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পঁচিশ, ছাব্বিশ বছর লেগে যায়। উচ্চশিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে চাকুরি নিতে গেলেও আটাশ,ঊনএিশ বছর বয়স হয়ে যায়। প্রত্যেক মেয়ের বাবা-মাই চায় উচ্চশিক্ষিত কর্মঠ ছেলেকে মেয়ের জামাই করতে। সেভাবে বিবেচনা করে দেখলে আমি কোন সমস্যা দেখছিনা। তাছাড়া এরকম অহরহ আছে যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে বিয়ে করে। তাঁরা কিন্তু অনার্স,মাস্টার্স পাশ করা মেয়ে বিয়ে করেনা। কিন্তু তাঁদের এটাই করা উচিত অথচ তাঁরা কমবয়সীদের দিকে নজর দেয়। বিয়ে করে তাঁরাও সংসার করে।
সেখানে ইমন, মুসু যদি দুজন দুজনকে চায়। আমরা কেনো চাপ প্রয়োগ করবো?
মুরাদ রেগে চলে যেতে নিতেই মরিয়ম আক্তার হাত টেনে ধরে কঠিন গলায় বলে,
—- ইমন যথেষ্ট ভালো একটা ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদে চাকরি করে। চারিএিক দিক দিয়েও কোন সমস্যা নেই। ওর পরিবারে,ওর কাছে আমার মেয়ে সুখীই হবে। আমাদের তো ভাগ্য ভালো এমন একটা ছেলে আমাদের মেয়েকে পছন্দ করে। তাছাড়া এখনি তো বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে না। ওরা যদি একে অপরের পছন্দ করেই থাকে করুক না সমস্যা কোথায় । তুই কেনো বন্ধুত্ব নষ্ট করবি? কেনোই বা বোনের মন থেকে ইমনকে সড়ানোর চেষ্টা করবি? আর সত্যি বলতে ইমনের থেকে মুসুই হয়তো বেশী চায়। আমিতো মা ছোট থেকেই মেয়েটা ওর জন্য পাগল। দেখিস নাই কোন মেয়ে ইমনের ধারে,কাছে আসতে দেখলেই কেমন ক্ষেপে যেতো। তুই বিষয়টা কঠিন না করে সহজ ভাবে মেনে নে বাবা। আর যাই হোক বন্ধুত্ব নষ্ট করিস না।
.
মরিয়ম আক্তারের বোঝানোতে লাভ হয়নি। মুরাদ সেই এক কথায় রয়েছে ইমন তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর যাইহোক কোন বিশ্বাসঘাতকের কাছে সে বোন দেবেনা। মুসকানকে পুরো ঘর বন্দী করে রেখেছে মুরাদ। না স্কুলে, না প্রাইভেটে কোথাও যেতে দিচ্ছে না। এর মধ্যে একদিন রিমির ফোন দিয়ে ইমনের সাথে কথা বলতে শুনেছিলো মুসকানকে। ফলশ্রুতিতে রিমির ফোন ইউজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের ফোনের সিম খুলে নিয়েছে। মোট কথা ইমন, মুসকানের যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ।
চলবে…