হৃদপূর্ণিমা পর্ব -১৯

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৯ |

নাফিসাদের বাড়ি এসেছে দুইদিন হয়েছে। রথির এই বাড়িতে দম বন্ধের মতো লাগছে। আরেকজনের ঘাড়ের ওপর বসে খাওয়াটা একদমই তার বিবেকে সাঁয় দিচ্ছে না। তার উপর নাশিদেরও দুইদিন ধরে দেখা নেই। কথা বলা তো দূর মহারাজা একদম গুম হয়ে গেছে। ঘুমানোর আগে মায়ের দেয়া কষ্টে কাঁদে আর নাশিদের দেয়া ব্যথার তীব্রতা তো আছেই। পরেরদিন নাশিদ ওর বাসা থেকে জামা-কাপড়সহ খুঁটিনাটি এনে দিয়েছে তাও দেখা করেনি। তবে রথি কোচিং ছাড়েনি। নাশিদদের বাসা থেকে দূর হলেও রোজ বাস ধরে তাকে কোচিং যেতে হয় আবার আসতেও হয়। ভেতরটা তার দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে মাকে আর নাশিদকে ছাড়া। এমন কী করেছে যার জন্য নাশিদ তার সঙ্গে দেখাই করছে না?
নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলে বলে নাশিদ অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে। আর ও যখন বাসা থেকে বের হয় তার আগেই রথি কোচিং এর জন্য চলে যায়। রথি মাথা নিচু করে শুধু শুনতো। নাফিসা রথির মন খারাপ দেখে রথিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে বলে,

-‘রাগারাগি হয়েছে বুঝি? আরেহ টেনশন নিস না। আমার ভাই মাঝেমধ্যে ক্ষ্যাপা হলেও ঠান্ডা হলে দেখবি তোকে চোখে হারাবে।’

-‘কেন রেগে আছে আমি তাইতো বুঝছি না নাফু। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না!’ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো রথি।

-‘ঠিক আছে আজ জেগে থাকিস, কাল তো তোর কোচিং অফ?’

রথি মাথা নাড়ায়! নাফিসা রথির চোখ মুছে দিয়ে বলে,

-‘তাহলে তো হয়েই গেলো। কাঁদিস না রথি, তোর মতো স্ট্রং মেয়ে কেঁদে বুক ভাসালে চলে? এখন যা তো ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর। আমি নিচে যাই, মা ডাকছে!’

রথি মাথা নাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নাফিসা এদিকে নিচে নামতেই দেখলো তার মা কেমন দৌড়াদৌড়ি করছে৷ নাফিসা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘কী ব্যাপার মা? এভাবে এতো দৌড়াদৌড়ি হচ্ছে কেন?’

মনিকা থেমে যায়। তার চোখে-মুখে খুশির আভাস। নাফিসা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো। মনিকা নাফিসার সামনে এসে হাসিখুশি স্বরে বলে উঠলো,

-‘আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে অর্পিতার কথা মনে আছে? অর্পি আজ আমাদের বাড়ি আসছে। থাকবেও কিছুদিন!’

নাফিসার হাসি মুখটা নিমিষেই ফুঁস। নাফিসা নরমালি বললো,
-‘হুট করে আসছে যে?’

-‘আমি বলেছি আসতে। এছাড়াও ভাইও একদিন বলেছিলো অর্পিতা আসার জন্য জেদ ধরেছে। আমি ভাবলাম আসুক কিছুদিন থেকে যাক!’

নাফিসা ছোট করে “ওহ” বললো। মনিকা থাকলো না দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। নাফিসা কিছু বিস্কুট আর সরবত নিয়ে উপরে চলে এলো। এতক্ষণে রথিও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেছে। নাফিসাকে দেখে বললো,

-‘এসেছিস? আন্টি কী বললো?’

নাফিসা কথা ঘুরিয়ে বললো, ‘ও কিছু না। জিজ্ঞেস করলো রথির খেয়াল রাখছি কি না। দেখ আমায় দিয়ে তোর জন্যে সরবতও পাঠালো।’ মিথ্যা বলার কারণ সে চায় না অর্পির কথা উঠিয়ে নিজের মেজাজ খারাপ করুক।

রথি মুচকি হেসে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
-‘তোরা আমায় ঋনি করে দিচ্ছিস রে নাফু। আমি সত্যি আর এখানে থাকতে পারছি না। প্লিজ আমায় ছেড়ে দে!’

-‘ঠাটিয়ে এক চড় মারবো তোকে। তোর এসব ফর্মালিটি অন্যদের সাথে দেখা কিন্তু আমার বেলায় চলবে না। আমার কথা কী বলছি, ভাইয়ের সামনে একবার এ কথা উচ্চারণ করেই দেখা না। রামধোলাই খাবি!’
রথি মুখটা ছোট করে ফেললো। নাফিসা একপ্রকার জোর করেই সরবত খাইয়ে দিলো সাথে বিস্কুটও। এদিকে রথি প্রতিনিয়ত অস্বস্তিতে মরছে।
সন্ধ্যায় রথি নাফিসার সাথে নিচে আসে। সোফায় বসে টিভি দেখছিলো তখনই নাশিদ সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো। রথির সেদিকে চোখ যেতেই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। দুইদিন পর দেখলো এই মানুষটাকে। দেখার তৃপ্তি যেন মিটে না। নাশিদকে সামনাসামনি দেখার জন্য কতো কিছুই না করেছিলো সে। দুইদিন তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিলো একপলক দেখার জন্য অথচ সেই মানুষটাই তার সামনে৷ আর কী লাগে? নাশিদ রথির দিকে একপলক তাকিয়ে উপরে চলে যায়। রথি কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে টিভি দেখায় মনোযোগী হয়।
রথিকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই নাশিদ চলে আসলো একটা এ্যাশ কালারের টিশার্ট আর সাদা টাউজার পরে। নাশিদকে দেখে রথির যেন হুঁশ উড়ে গেলো। এই ছেলে যাই পরে সেটাই তাকে স্যুট করে। এতো সুদর্শন ছেলে, রথির তো ইচ্ছে করছে কাজল এনে কানের পিছে টিপ লাগিয়ে দিতে যেভাবে তার মা ছোটবেলায় পরিয়ে দিতো। প্রতিবার টিপের সাথে বলে উঠলো,

-‘আমার রথিপরীর যাতে কারো নজর না লাগে। মাহশাল্লাহ, আমার মেয়েটা!’

রথির ইচ্ছে করছে নাশিদকে কালো টিপ দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলতে,

-‘আপনার উপর যেন কারো নজর না লাগে পুলিশম্যান! আপনি শুধু আপনার রথের মনপুরুষ।’

লিভিংরুমে এসে নাশিদ ঠিক রথির পাশে বসলো। রথির বাহুর সঙ্গে নাশিদের বাহু লাগতেই রথি খানিক কেঁপে উঠলো। কিন্তু নাশিদের কোনো পতিক্রিয়াই দেখা গেলো না। নাফিসা তো গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গাইছে আর এদিকে রথি অস্বস্তিতে ভুগছে। নাফিসা ডানপাশের সারির সোফাতে। খানিকটা দূরে ওদের থেকে। রথির অস্বস্তি লাগলেও একটা সৎ সুযোগ পেলো আর তা হলো নাশিদের সঙ্গে কথা বলার। রথি আধো আধো স্বরে বললো,

-‘দুইদিন কোথায় ছিলেন আপনি? বাসা অবধি পৌঁছে দিয়েই আপনার কাজ শেষ? আমি কেমন আছি কী করছি সেটা জানার ইচ্ছা হলো না? কী দোষ ছিলো আমার যার জন্য আমার সাথে এমন অবিচার করেছেন?’

-‘ওই থার্ডক্লাস ছেলেটার কথা আগে বলো নি, এটাই তোমার দোষ!’
নাশিদ মৃদু সুরে বললো। রথি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার আগেই নাশিদ উঠে অন্য সোফায় গিয়ে বসলো। ঠিক তখনই মনিকা আসলো। রথি গোল গোল চোখে একবার নাশিদের দিকে তো আরেকবার মনিকার দিকে তাকালো। মনিকা হাসিমুখে নাশিদকে বললো,

-‘নাশিদ বাবা এসেছিস তুই? আজ কে আসছে বল তো?’

নাশিদ মনিকার কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মনিকার পানে। রথি নিজেও একইভাবে অবাক। কার কথা বলছেন উনি? এদিকে মনিকার কথা শুনে নাফিসারও গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এতে যেন রথির খটকা বেড়ে গেলো।

-‘বুঝিসনি তাইতো? অর্পি আসছে। এতক্ষণে চলে এসেছে মনে হচ্ছে!’

নাশিদ চট করে উঠে দাঁড়ালো। রথি নাশিদের দিকে চেয়েও তাকাতে পারলো না কারণ এই বজ্জাত মহিলা রথির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে। মনিকা এবার মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে রথিকে উদ্দেশ্য করেই বললো,

-‘আশা করছি রথি নিজের ঘরে যাবে। মেহমান আসছে তো, তোমার ভালো নাও লাগতে পারে!’

রথি প্রথমে উত্তর দিবে কিনা বুঝলো না। তবে রথি প্রথম থেকেই এই মহিলাকে সহ্য করতে পারে না। রথির কাছে কথাগুলো অপমানজনক লাগলেও সেটা উড়িয়ে দিয়ে ভাবলো কিছু মানুষের রোগই ব্যাঁকা করে কথা বলা। তাই বিষয়টিকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে হাসি দিয়ে বললো,

-‘সমস্যা নেই আন্টি। আপনার সমস্যা হলে আমি চলে যাচ্ছি!’

বলেই রথি উঠে দাঁড়ায় এবং কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে যায়। নাশিদ রথির যাওয়ার পানেই তাকিয়ে আছে কিন্তু তার মায়ের জন্য কিছুই বলতে পারছে না। মনিকাও নাশিদের দিকেই তাকিয়ে। সে নাশিদের দৃষ্টি বোঝার চেষ্টা করছে। মনিকা এবার রথিকে আরও কিছুটা শুনিয়ে বললো,

-‘বাবা নাশিদ! অর্পি তো চলেই আসছে। যাও গেটে গিয়ে দাঁড়াও, অর্পি খুশি হবে!’

-‘আমি টায়ার্ড মা!’

বলেই নাশিদ ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নেয়। রথি ততক্ষণে উপরে গিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগে। এই অর্পি কে সেটা সে দেখেই ক্ষান্ত হবে। নাশিদ পানি খাওয়া শেষ করে লিভিং এ যাওয়ার আগেই সদর দরজা থেকে একটি মেয়ে ছুটে নাশিদের কাছে গেলো এবং কোনো কথা ছাড়াই তাকে জড়িয়ে ধরে! নাশিদ আর মেয়েটিকে একসাথে এভাবে দেখে রথির পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো। মুহূর্তের জন্যে সে ভাবতে ভুলে গেলো। বুকের বা পাশটাও কেমন চিনচিন করছে তার। চোখের কোণও ভিঁজে গেছে মুহূর্তেই। এই দৃশ্য যেন তাকে প্রাণহীন করে তুলেছে। রথির ভাবনার মাঝেই মেয়েটি বলে উঠলো,

-‘ফাইনালি! ফাইনালি নাশিদ তোমায় আমি পেলাম। তোমার এই অর্পি কতদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলো জানো? এবার আর কোথাও যেতে দিবো না তোমায়। দরকার হলে আমার সঙ্গে সারাজীবনের জন্য বেঁধে রাখবো বুঝলে?’

মেয়েটির কথাবার্তায় রথির বুঝতে বাকি রইলো না এটাই অর্পিতা। অর্পির কথায় রথির চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পরলো। প্রিয় মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মেয়েকে দেখা বুঝি এতটাই কষ্টের? কেউ যেন বারংবার তীর মেরে তার ভেতরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে। নাশিদ তৎক্ষনাৎ নিজের থেকে অর্পিকে ছাড়িয়ে নিলো। নাশিদ রুদ্ধ কন্ঠে বললো,

-‘মাথা কী তোমার গেছে? এগুলা কোন ধরণের ফাইজলামি? কোথায় কী করতে হয় জানো না? তুমি কী নার্সারির বাচ্চা?’

-‘আহা! এতটুকুর জন্য এমন বিহেভ করছো কেন বলো তো? এই ফুপি! তোমার ছেলেকে কিছু বলবে?’

নাফিসার দৃ্ষ্টি তখনই উপরের দিকে গেলো। রথি নাশিদদের দিকে তাকিয়েই চোখের জল ফেলছে। নাফিসা একবার ওদের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। উপরে যেতে যেতে ততক্ষণে রথি রুমে চলে গেছে! নাফিসা সেখানেই রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে বসে পরলো। আপনমনে বলে উঠলো,

-‘তোকে যেটা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম তুই সেটারই মুখোমুখি হলি! আল্লাহ জানে এই অর্পি স্নেক কোন ঝামেলা পাকায়। তোদের এই মান-অভিমান আমারই যে ভালো লাগছে না!’

রাত ৯ টার মধ্যেই ওদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হলো। খাবার খেয়ে রথি নাফিসার ঘর থেকে বের হতেই অর্পির মুখোমুখি হলো সে। এক সুন্দরী মেয়েকে নাফিসার ঘর থেকে বের হতে দেখে অর্পিও খানিকটা অবাক হলো। রথির পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো। রথি পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই অর্পি রথিকে থামিয়ে বললো,

-‘তুমি কে? নাফিসার ঘরে কী করছো?’

রথি কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। তখনই নাফিসা এসে বললো,

-‘ও আমার বান্ধুবি আপু, রথি!’

-‘ও আচ্ছা।’

-‘তুমি এখানে যে?’

-‘হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়ে তোমার ভাইয়ের রুমে যাচ্ছি, দেখি কী করছে মশাই! অফিসার তো সবসময়ই বিজি থাকেন!’ হেসেই বললো অর্পি! রথি একপলক অর্পির দিকে তাকিয়ে বুঝলো অর্পিও কম সুন্দরী না। পরমুহূর্তে নাশিদের ঘরের কথা শুনে রথির মাথা নিচু করে ফেললো।
অর্পি নাশিদের ঘরের সামনে গিয়ে দরজা কয়েকবার ধাক্কালেও নাশিদ দরজা না খুলে বললো,

-‘ডিস্টার্ব করো না অর্পি, কাজ করছি!’

নাশিদের রুদ্ধ কন্ঠস্বর শুনে অর্পি আর নাশিদকে বিরক্ত করার সাহস পেলো না। যতোই হোক, নাশিদ তার কাজ নিয়ে অনেকটা সেন্সেটিভ! সে তার কাজে কাউকেই চিনে না। অর্পি তাই কিছু না ভেবে আবার ক্যারিডোর পার হয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। নাফিসা রথিকে কাঁধ দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,

-‘সুযোগ তোর সামনে। যা গিয়ে কথা বল আমি এখানে দাঁড়িয়েছি।’

রথি প্রথমে যেতে না চাইলেও নাফিসা রথিকে ধাক্কিয়ে ধুক্কিয়ে পাঠালো। রথি কাঁপা কাঁপা পায়ে নাশিদের রুমের দিকে যেতে লাগলো। মনের ভেতরে হাজারো ভয়, অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here