হৃদমাঝারে তুমি পর্ব -০১

রোহান নামের ছেলে টার কু-দৃষ্টি নজর এড়ালো না নিরার। এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়তে হয় নি তাকে। একদিকে নিজের শাড়ি টা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অপরদিকে রোহানের বাজে দৃষ্টি, নিজের মধ্যে একটা বিশ্রী অনুভূতির সৃষ্টি করছে। গা রিরি করে উঠছে ঘৃণায়। আশা কে ও খুঁজে পাচ্ছে না নিরা। সে থাকলে হয়তো একটু ভালো লাগতো! কোথায় সে? আড়চোখে দেখলো রোহান এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে! ইচ্ছে করছে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিতে! আর জিঙ্গেস করতে,

‘মেয়ে দেখলে হুঁস থাকে না? নাকি ইচ্ছা করে চোখ দিয়ে গিলে হজম করে ফেলতে?’

কিন্তু তা ও করা যাচ্ছে না। চারদিকে লোকজন গিজগিজ করছে। সিনক্রিয়েট করা ঠিক হবে না। নিরা রিতিমত উশখুশ করছে। প্রিয়া সেটি খেয়াল করলো,

‘কি হলো নিরা কোনো সমস্যা?’

‘আ-স-লে…

প্রিয়া খেয়াল করলো নিরা বেশ আনইজি ফিল করছে। তার মুখে জড়তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। নিরা মূলত আশার সঙ্গেই এখানে মানে তার বিয়েতেই এসেছে। আশা আর আদ্রাজ তার ফুফাতো ভাই বোন। মামাতো বোনদের মধ্যে প্রিয়া বড়। অনেক কিছুর পর তার আর পিয়াসের বিয়ে টা হচ্ছে। চুটিয়ে প্রেম করেছে দুজন। দুই পরিবারে জানাজানি হওয়ার পর প্রিয়ার পরিবার মানতে চায় নি। শেষে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আজ তাদের সম্পর্ক টা বিয়ের রূপ নিলো। আশার সঙ্গে প্রায়ই এখানে আসতো নিরা। সেই হিসেবে তার বিয়ে তে নিরা কে আসার জন্য ইনভাইট করা হয়েছে! প্রথমে নাকোচ করেছিলো নিরা। পরে আশার জোড়াজুড়ি তে বাধ্য হয়ে আসতে হলো তাকে। চঞ্চল আর ভালো মনের হওয়ায় নিরা ও হয়ে উঠে প্রিয়ার পছন্দের তালিকায় একজন। মেয়েটা কে তার কাছে দারুণ লাগে। কথা বার্তা চালচলন একদম সাধারন একটা মেয়ের মতো। বলা বাহুল্য বেশ মিশুক ও বটে! মেরুন রঙা শাড়ি টায় আজ তাকে কি না লাগছে? একদম খাপে খাপ মানিয়েছে ভালো। কারো নজর না লাগুক! প্রিয়া বললো,

‘বলো আমাকে কি হয়েছে!’

‘না আপু কিছু হয় নি!’

‘আমি দেখছি তুমি কেমন কেমন করছো! বলে ফেলো কি হয়েছে!’

নিরা বাধ্য হয়ে বললো,

‘আমার আসলে শাড়ি টা পড়ে খুব আনইজি লাগছে! এই মনে হচ্ছে খুলে যাবে। আর দেখো না আপু আশা ও নেই! আমি এটা চেঞ্জ করে নিই?’

‘এখনো তো মূল ফাংশন স্টার্ট ই হলো না তার আগেই শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলবে?’

‘প্লিজ আপি!’

‘আচ্ছা ঠিক আছে যাও তাহলে!’

‘হিহিহি থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ্ আপি!’

প্রিয়া হালকা হাসে। অনুমতি পেয়ে নিরা হলুদের স্টেজ থেকে উঠে চলে আসার জন্য উদ্যত হয়। ছ্যাঁসড়ার মতো রোহান এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখেই যাচ্ছে যা নিরা ভালোই খেয়াল করেছে। চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রাগ টা। সংযত করা যেনো দায়। নাক মুখ খিঁচে মনে মনে বললো,

‘ছ্যাঁসড়ামির ও একটা লিমিট থাকে কিন্তু এই ছেলে সেই লিমিট টাও অলরেডি ক্রস করে ফেলেছে!’

নিরা নিজেকে কন্ট্রোল করে স্টেজ থেকে নেমে এক হাতে শাড়ির নিচের দিক টা ধরে আর এক হাত কোমড়ে দিয়ে বসা থেকে উঠে নিচে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। এমন মনে হচ্ছে যেনো আর এক কদম দিলেই শাড়ি টা খুলে যাবে। শাড়ি পড়ার বিন্দুমাত্র অভ্যাস নেই তার তাও শুধুমাত্র আশার জোড়াজুড়ি তে পড়তে হলো। তাকে একা ছেড়ে এখন সে-ই সবার আগে লাপাত্তা হয়ে গেছে। ভীষণ রাগ হলো নিরার, মনে মনে শখানেক গালি দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে। ঠিক করলো রুমে গিয়ে এক্ষুনি শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলবে! এইসব ত্যানা প্যাঁচিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না! এখনো পর্যন্ত যে হোঁচট খেয়ে পড়ে সবার সামনে মান সম্মান হারাতে হয় নি এটাই অনেক।

একটা রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো কয়েক টা পিচ্চি ছেলে মেয়ে বসা। নিরা মুচকি হেসে বললো,

‘বাবু রা তোমরা একটু বাহিরে যাবে প্লিজ!’

তারা বললো যাবে না। এখানে খেলবে সবাই। নিরা ভাবলো জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়ে ও চেঞ্জ করে নেওয়া যাবে। তাদের সাথে জোড়াজুড়ি না করাই ভালো! যেই ভাবা সেই কাজ সে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

_____________________

আদ্রাজ এতো টা সময় ধরে খেয়াল করছিলো প্রিয়ার ফ্রেন্ড রোহান বারবার লুকিয়ে আড়চোখে নিরা কে দেখছে। তার এই চাহনি মোটেও ভালো লাগলো না আদ্রাজের কাছে। নিরা ও বসা থেকে নড়ছে না দেখে রাগ টা আরো গাঢ় হয় তার। নিরা কে দেখলেই তার রাগ উঠে। একটা ছেলে এমন ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে অথচ সে তা লক্ষ্য করা সত্ত্বেও কিছু বলছে না কেন তাকে? রোহানের জায়গায় সে হলে তো এতোক্ষণে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দিতো! আর এইদিকে কোনো রেসপন্স ই নেই! এই জন্যই মেয়েটা কে খুব অদ্ভুত আর ঝগড়াটে মনে হয় আদ্রাজের কাছে। হঠাৎ করে পেছন থেকে ডাক পড়ে।

‘ভাইয়া?’

‘হ-হা। ও আশা তুই?’

‘কি দেখছিলে এতো গভীর ভাবে?’

আদ্রাজ ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

‘ক-কই না-তো!’

‘বুঝি বুঝি!'(মুচকি হেসে)

‘শাট আপ আশা!’

আদ্রাজ রেগে যাচ্ছে দেখে আশা জোড় পূর্বক হাসি থামিয়ে বললো,

‘আচ্ছা সরি তুমি কি নিরা কে দেখেছো? কতক্ষন নাগাদ খুঁজছি কিন্তু দেখো পাচ্ছি ই না! আমি এতোক্ষণ ঐ দিকে কাজে আটকে গিয়েছিলাম!’

‘আশ্চর্য তোর বান্ধবীর খোঁজ আমি রাখি নাকি?'(খানিকটা রেগে)

‘আরে বাবা রাগ করছো কেন? দেখলে বলো না দেখলে আমাকে আরো খুঁজতে হবে!’

আদ্রাজ শর্টকাটে বলে দেয়,

‘না দেখি নি!’

তার কথা শুনে আশা চলে যায় মুখে আরো কি সব যেনো বলছিলো আদ্রাজ তা শুনবার প্রয়োজন মনে করে নি। কেননা আশার কথা কানে নেওয়া মানেই নিজের রাগ কে ডেকে আনা।

আশা যেতেই আদ্রাজ সেদিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো এবার সত্যি সত্যি ই নিরা নেই। আশা যেনো তাকে উস্কে না দেয় তাই তাকে মিথ্যা বলেছিলো যে সে দেখেনি। কিন্তু এখন আসলেই নেই?

‘আরে একটু আগে এখানেই তো ছিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো? রোহান কেও দেখছি না। গেলো টা কোথায় দুজন?’

রোহান কেও দেখা যাচ্ছে না। আদ্রাজ স্টেজের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুজন কেই খুঁজতে থাকলো।

‘কিরে আদ্রাজ কাকে খুঁজছিস?’

প্রিয়ার কথায় ধরা পড়ে যায় আদ্রাজ। আমতা আমতা করে বললো,

‘না তো আমি আবার কাকে খুঁজবো?’

প্রিয়া ও হাসে। এই হাসির কারণ আদ্রাজের মতিগতি সে বুঝতে পেরেছে। আদ্রাজের আনচান করা চোখ জোড়া তবুও খুঁজে চলেছে নিরা কে! কেন খুঁজছে এই প্রশ্নের উত্তর নিজের ই অজানা! যেই মানুষ টা কে আদ্রাজের সহ্য হয় না তাকেই মন খুঁজছে দেখে ভারী অবাক সে নিজেও! দৃষ্টি এদিক সেদিক থেকে প্রিয়ার উপর পড়লো। মুচকি মুচকি হাসছে দেখে আদ্রাজের ভাবনায় ছেদ পড়ল।

‘হাসছো কেন তুমি?’

‘না তো আমি কেন হাসবো?’

আদ্রাজ বুঝতে পারলো তার কথা তাকেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে। তাই আর কিছুই বলার মতো পেলো না। প্রিয়া নিজ থেকেই বললো,

‘নিরা নিচে গেছে শাড়ি চেঞ্জ করতে!’

‘তো আমি কি করবো?’

‘শোন ভাই তোর আগে পৃথিবীতে আমি এসেছি। তাই বুঝ শক্তি একটু হলেও তোর থেকে বেশি আমার আছে। তুই না বললেও আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি তোর চোখ নিরা কেই খুঁজছে।’

‘ধুর!’

‘ধুর না এটাই সত্যি!’

‘একদমি না!’

‘যাকে দু চোখের বিষ বলা চলে তাকেই তোর চোখ হন্ন হয়ে খুঁজছে, কি ব্যাপার বলতো?’

আদ্রাজ কিছু বলার আগেই তাকে কেউ একজন টেনে নিয়ে যায়। পেছন থেকে তাও সে বলে উঠে,

‘তোমার চোখে সমস্যা আছে আরলি একটা চোখের ডক্টর দেখাও। নাহলে কিন্তু পিয়াস ভাই তোমাকে বিয়ে করার আগেই বিয়ের আসর ছেড়ে দৌড়ে পালাবে!’
.
.
নিরা ওয়াশরুমে যাওয়ার পর মনে পড়লো সে তো তার জামা ই নিয়ে আসে নি। চোখে মুখে ভালো করে পানি দিয়ে কৃত্রিম আস্তরণ দূর করতে চেষ্টা করে। নিজের ফেইস টাই কেমন ভার ভার লাগছে। যে এই কাজ টা করেছে সে ই নেই! আশা তাকে জোড় করে মুখ ভর্তি মেকআপ ও করিয়ে দিয়েছে আর তারপর নিজেই নাই হয়ে গেছে। এতো টা রাগ হচ্ছে না তার উপর যা আর বলার নয়। নিরা মনে মনে ঠিক করলো,

‘একবার শুধু তোকে আমি হাতের কাছে পাই! তারপর দেখাবো মজা!’

নিরা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। বড় আয়না টায় নিজের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেকআপ ধুয়ে মুছে ফেলে দেওয়ার পর এখন নিজের কাছেই বেশ হালকা লাগছে। পানি দেওয়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। ঝট করে মন টাই ভালো হয়ে গেলো। তাই নিরা ভাবলো শাড়ি টা থাকুক। আশা এসে তাকে জামা পড়া দেখলে মন খারাপ করবে। তাই চেঞ্জ না করে বরং গুছিয়ে একটু পড়ার চেষ্টা করা যাক। ফোন টা বের করে ইউটিউব এ ঢু মারলো সে। বেডে বাচ্চা গুলো গাড়ি নিয়ে মুখে ‘বু বু পিপ পিপ’ শব্দ করে খেলছে। সেটা দেখে নিরার ঠোঁটে হাসির রেশ ফুটে উঠলো। ফোন টা একহাতে নিয়ে আরেক হাতে শাড়ি টা ধরে বেলকনিতে চলে যায় সে।

‘স্টেপ বাই স্টেপ শাড়ি পড়ার নিয়ম’ লিখে সার্চ করলো নিরা। ঝটপট পেয়ে ও গেলো। ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়ায় সে মনের খুশিতে কয়েক টা ভিডিও ডাউনলোড করে নেয়। আর টেনে টেনে ভিডিও গুলা একবার দেখে। তারপর পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। খেয়াল করে পিচ্চিদের চেঁচামেচি আর কানে আসছে না। বেডের দিকে তাকিয়ে দেখে তারা সেখানে নেই। তার মানে চলে গেছে! যাক ভালোই হলো। নিরা উঁকি দিয়ে দেখলো দরজা টাও বাঁধা আছে। তাই সে শাড়ি টা খুলে কোমড়ের একপাশে গুঁজে নেয়। ফোন টা আয়নার একপাশে লাগিয়ে রেখে দেয়। ভিডিও টা প্লে করে তা দেখে দেখে শাড়ি টা পড়ার চেষ্টা করে। প্রায় ২০ মিনিট নাগাদ চেষ্টা করে কুচি গুলো সুন্দর করে দিতে সক্ষম হয়। আঁচল টা কাঁধের দিকে দিতেই পেছন থেকে খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকায় নিরা। বিষ্ময়ে বিমূঢ় তার চোখ জোড়া! কারণ দরজায় যেই মানুষ টি দাঁড়িয়ে আছে সে……..

চলবে———————

#হৃদ_মাঝারে_তুমি
#পর্ব_০১
#Written_by_Mehebin_Nira

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here