হৃদমাঝারে পর্ব -০১

‘আমার বাবা-মা আমার প্রথম বিয়ের কথা লুকিয়ে আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বলতে পারেন আপনাদের ঠকানো হয়েছে। আশা করি এটা জানার পর আপনি বা আপনার পরিবার চাইবেন না এই রকম একটা মেয়েকে নিজেদের ঘরে বউ করে নিতে! আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন বলে আমি আশাবাদী।’ একশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো শুভ্রতা। কথা বলার পুরোটা সময় স্থিরভাবে টেবিলের উপর তাকিয়ে ছিলো। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনের লোকটা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। শুভ্রতার মনে মনে ভীষণ রাগ হলো। কথা বলার সময় কারো এভোয়েডনেস একদম সহ্য হয় না। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফোন স্ক্রোল শেষে টেবিলে দুহাত ঠেকিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো মেঘ। শুভ্রতার চেহারা একবার পরখ করে দেখে বলে,,’ওকে। এটার জন্যই আমাকে ডেকেছেন? আর কিছু বলবেন?’
শুভ্রতা মাথা নেড়ে বলে,,’নাহ। এইটুকুই আমি এখন আসি।’ কথাটা বলে শুভ্রতা পার্স আর ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর বাইরের দিকে অগ্রসর হতে নিলে পেছন থেকে মেঘের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,’There are less to every wine.’
মেঘের কথায় শুভ্রতার বাড়ানো পা থেমে যায়। মাথাটা হালকা পেছনে ঘুরিয়ে বলে,,’মানে?’
‘শুনেছি আপনি পড়ালেখায় খুব ব্রিলিয়েন্ট। এই কথাটার মানে নিশ্চয়ই জানেন? আর না জানলে খুঁজে নিবেন। মিনিংটা বের করতে পারলে বুঝবো আপনার আইকিউ কতটা সার্প!’ মেঘের হেয়ালি কথায় শুভ্রতার শরীর রাগে রী রী করে উঠলো। মনে মনে বলে,,’শুভ্রতা জাস্ট কুল ইয়ার। তোর এই বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে। যা পারুক বলে নিক। আর কোনোদিন তোর সামনে আসবে তো না। জাস্ট কুল!’ নিজেকে শান্ত করে শুভ্রতা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।
________________________
‘এই তুই কোথায় গিয়েছিলি হ্যাঁ? আজ তোর হলুদ আর তুই বাইরে গেছিলি? শোন শুভ্রা অনেক কষ্টে তোর বিয়েটা ঠিক করেছি। আল্লাহর দোহাই লাগে আর আমাদের সম্মান নষ্ট করিস না। আমাদের একটু মুক্তি দে। তোর জন্য কম অসম্মানিত তো হই নি। এবার অন্তত রেহাই দে!’ কথাগুলো বলে শুভ্রতার মা ছাদ থেকে নেমে গেলো। একটু আগে শুভ্রতা ফিরে দেখে বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে। শুভ্রতা কোনোমতে চেঞ্জ করে ছাদে চলে আসে। তখন পিছুপিছু এসে তার মা কথাগুলো বলে যায়। নিজের মায়ের মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে কষ্ট পাওয়া উচিৎ। কিন্ত শুভ্রতার মনে হচ্ছে সে আশারুপ কষ্ট পাচ্ছে না। তবে কি তার শরীর এইসব অপমান সয়ে গেছে? শুভ্রতা আর ভাবতে পারছে না। ছাদ থেকে নিচের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে শরীরটাকে শূণ্যে ভাসিয়ে দিতে। কিন্ত তার আগে যে অনেক কাজ আছে। নিজেকে প্রমাণ করার আছে। এটা বুঝানোর আছে যে,একটা ভূলের মাশুল এতো জঘণ্য হতে পারে না। ভূল শুধরে নেওয়ার সুযোগ তারও প্রাপ্য। সেও সুযোগ ফেলে নিজেকে প্রমাণ করে দিতে পারবে। শুভ্রতা আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে,,
‘আল্লাহ আমি জানি তুমি যা করো ভালোর জন্যই করো। আমি তোমার ইশারার বিরুদ্ধে চলতে পারবো না। কিন্ত আল্লাহ আমি কি করবো বলো? একটা নতুন জীবন মিথ্যে দিয়ে শুরু করবো? পারবো না আমি একজন মানুষকে ঠকাতে। কতোদিন লুকিয়ে রাখবো আমার অতীত? একদিন,দুদিন,একবছর? যেদিন সামনে আসবে সেদিন কি হবে? হ্যাঁ আমি একজন খারাপ সন্তান তাই তো মা এগুলো বলে গেলো! কিন্ত কি করবো বলো চাইলেও সবটা যে ঠিক করার ক্ষমতা নেই!’ রোদের জন্য শুভ্রতা বেশীক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ জ্বালা করছে। চোখের কোণে জল ভীড় করছে। কিন্ত সেটা কিসের জন্য শুধুই কি রোদের তেজ না অন্যকিছু! শুভ্রতা সেটা কাউকে জানাতে চায় না। অব্যক্ত কথাগুলো নিজের ভেতরে রাখাটাই শ্রেয়। শুভ্রতা ছাদ থেকে রুমে চলে গেলো।
________________
শুভ্রতাদের গ্রামের একতালা বাড়িটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারদিকে বাচ্চারা হইহই করছে। বড়রা কাজ করছে। শুভ্রতা নিজের রুমে চুপটি করে বসে আছে। একটু আগেই খালাতো বোন রুহি একটা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেছে। এখন শুধু সাজানো বাকি। শুভ্রতার কাণে মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে উপহাসের কয়েকটা কথা ভেসে আসছে। যেটাতে কষ্ট পেতে না চাইলেও পেতে হচ্ছে। বুকের ভেতরটা খা খা করছে। এসব শুনলে তার মা-বাবা যে আরও কষ্ট পাবে! শুভ্রতা আর মানতে পারলো না উঠে বেলকনিতে চলে গেলো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,,
‘মানুষকে ঠিক কতোটা বিশ্বাস করলে মানুষ বিশ্বাসে মর্যাদা রাখে! কে জানে! সব খামতি কি শুধু আমার ছিলো? জীবনের কতোগুলো পথ তোমার সাথে হেটেছি। আর তুমি মাঝরাস্তায় আমায় শূণ্য করে ছেড়ে চলে গেলে? ক্ষমা করবো না তোমায়। কোনোদিনও না।’

শুভ্রতা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মেঘকে কথাগুলো সেই কখন বলেছে। কিন্ত মেঘের বাসা থেকে এখনও কোনো খবর আসছে না কেনো! শুভ্রতার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। লোকটা চাইছে টা কি। আগের বারের সব সম্বন্ধে সে প্রথম দিনেই ছেলেকে সব বলে দিয়েছিলো যাতে কথা না এগোয়। কিন্ত এবারের সম্বন্ধে কেউ আসেই নি। ছেলেপক্ষ নাকি আগ থেকেই ওকে পছন্দ করে রেখেছে। শুভ্রতা আবারও একই কাজ করবে ভেবে শুভ্রতার মা আজ সকালে জানিয়েছে সবটা। শুভ্রতা অনেক কষ্টে বাবার ফোন থেকে নাম্বার চুরি করে মেঘকে কল দিয়ে ক্যাফেতে ডেকে কথাগুলো বলেছে। ভেবেছিলো মেঘ বাসায় এসব জানালে বিয়ে ভেঙ্গে দেবে। কিন্ত না এখনও কোনো খবর আসছে না! শুভ্রতা রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলো। মেঘের নাম্বারে ডায়েল করতে গিয়েও থেমে গেলো। ভাবলো আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।
‘কিরে শুভ্রা কি করছিস?’ শুভ্রতার খালাতো বোন রুহি রুমে ডুকতে ডুকতে বলে। শুভ্রতা রুহিকে দেখে বলে,,
‘ওহ রুহিপু তুই? আয় বস।’
রুহি শুভ্রতার পাশে বসে হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি আর কিছু অর্নামেন্টস বের করে বলে,,’দেখতো তোর পছন্দ হয় কিনা?’
শুভ্রতা শাড়িটার দিকে তাকালো। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি,আঁচলে বিভিন্ন লতা,পাতা,ফুল দিয়ে ডিজাইন। শুভ্রতা ঠিক এইরকম শাড়ি চেয়েছিলো। একদিন কাউকে বলেছিলো সবাই হলুদে হলুদ শাড়ি পড়ে,আমি আমার হলুদে আমার নামের সাথে মিলিয়ে শুভ্র রংয়ের শাড়ি পড়বো। শুভ্রতা আলতো হাতে শাড়িটি ছুঁইয়ে দিলো। রুহির দিকে তাকিয়ে দেখে রুহি একগাল হাসি নিয়ে বসে আছে। রুহি বলে,,’কিরে পছন্দ হয়েছে?’
শুভ্রতা মাথা নেড়ে বলে,,’খুব পড়িয়ে দাও!’
রুহিও হাসি মুখে শাড়িটি পড়িয়ে শুভ্রতাকে সাজিয়ে দিলো। অতঃপর শুভ্রতার কয়েকটা পিক তুলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যায়।
____________________
ঘোর সন্ধ্যে। কিন্ত শুভ্রতাদের বাড়ির দিকে তাকালে বুঝা দায়। ছাদে স্টেজ করে শুভ্রতাকে বসানো হয়েছে। সামনে নানা পদের কেক,মিষ্টি,খাবার। বাচ্চারা গান চালিয়ে নাচানাচি করছে। কিন্ত শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। রুহি যাওয়ার দশমিনিট পর আবার এসে শুভ্রতার শাড়ি চেঞ্জ করিয়ে হলুদ শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেলো। শুভ্রতা চেঞ্জ করতে চায় নি রুহি জোর করে চেঞ্জ করিয়েছে। রুহির ব্যবহারে শুভ্রতা পুরো অবাক। কিন্ত আপাদত মাথায় মেঘের কথা ঘুরছে। মেঘ এখনও বিয়ে ভাঙ্গলো না! তবে কি হয়ে গেলো বিয়েটা? শুভ্রতার বুক কেঁপে উঠলো।
গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রতার। সামনে তাকিয়ে দেখে শুভ্রতার মা হাসি হাসি মুখে তার গালে হলুদ লাগাচ্ছে। শুভ্রতা তা দেখে মলিন হাসলো। এই মা একটু আগে তাকে কতো কথা বললো,তার থেকে মুক্তি চাইলো এখন খুশি মনে হলুদ লাগাচ্ছে।
‘হ্যাঁ মা মুক্ত করে দেবো তোমাদের। তোমরা চাইলেও তোমাদের কাছে আসবো না। আজ কি হবে জানি না। মেঘ যদি বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় তবে আমিও তোমাদের মুক্ত করে দিয়ে যাবো।’ শুভ্রতা মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নিলো। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্ত নাহ সে কারো সামনে নিজের চোখের পানি ফেলে না। দুঃখ,কষ্টগুলো একান্তই তার ব্যক্তিগত। কাউকে দেখাতে চায় না। শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। একে একে সবার হলুদ লাগানো শেষ হলে সকলে গান,নাচ করা শুরু করে। শুভ্রতার ভালো লাগছে না বলে নিচে নেমে যায়। কিন্ত পথিমধ্যে একটা কথা কানে লাগে।

‘হুহ। আগেরবার তো নিজেই লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। কে জানে কি কি করেছে এই মেয়ে। আবার এখন ভালো লাগছে না। মন খারাপ লাগছে! হুহ ঢং।’
শুভ্রতা পেছন ফিরে চাইলো তার নিজের মামি অন্য একজনকে কথাটা বলছে। শুভ্রতার কেমন যেনো হাসি ফেলো। উপহাসের হাসি সেটা। নিজের উপর না মামির উপর কে জানে! আর দাঁড়াল না। পা চালিয়ে রুমে চলে গেলো। এখন একটু শান্তি প্রয়োজন। কিন্ত কে দেবে সে শান্তি! তার সব থেকেও কিচ্ছু নেই।

#চলবে?
#হৃদমাঝারে
জান্নাতুল নাঈমা
(১)

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন লাগলো জানাবেন। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here