হৃদমাঝারে পর্ব -০২

#হৃদমাঝারে
জান্নাতুল নাঈমা
(২+৩)

রাতের শেষভাগ! কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা নতুন দিন শুরু হবে। সাথে শুভ্রতার জীবনের নতুন অধ্যায়। কিন্ত তার জন্য শুভ্রতার মনে কোনো উত্তেজনা, উদ্দীপনা কিছুই কাজ করছে না। অনেকরাত অবধি কাজ করে সবাই এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুম নেই শুধু শুভ্রতার চোখে। বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই গ্রিলের ফাঁকে যতটুকু দেখা যায় ততোটুকুই যেনো শান্তি। পাশেই গোলাপের চারায় কয়েকটা গোলাপ ফুটে আছে,কিছু কলি থেকে ফোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিন হলে শুভ্রতা খুব সুক্ষ্মভাবে সেটা পর্যবেক্ষণ করতো। কিন্ত আজ যেনো নিজের মাঝে কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছে না। তার জীবনের প্রতি তার কোনো অধিকারই নেই! শুভ্রতা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। দূর মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। শুভ্রতা মাথায় ওড়নাটা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য রুমের মধ্যে যায়। খাটে উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রুহি। ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট রুহির অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সকাল সকাল হালকা শীত করছে মনে হয় তার জন্য কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। শুভ্রতা মুচকি হাসে। যখন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন এই মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়েছে। রুহি শুভ্রতার বড় জেঠুর মেয়ে। তার বাবারা দু ভাই। দুজনেই একসাথেই থাকে। রুহির আরো দুটো ভাই আছে। রুহি শুভ্রতার একবছরের বড় যার জন্য তুই তুকারি সম্পর্ক ওদের মাঝে। শুভ্রতা আর বেশী না ভেবে ওয়াশরুমের দিকে যায়। ওযু শেষে নামাজে দাঁড়ায়। তারপর রুহিকে ডাক দেয়।
‘রুহিপু। নামাজ পড়বি না উঠ।’ রুহি হাই তুলে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নেয়। শুভ্রতা আবারও বেলকনিতে যায়। ফ্লোরে বসে নিজের যত্নে গড়া ফুল গাছ গুলোকে আলতো ছুঁইয়ে দেয়। আর হয়তো এদের ছুঁয়ে দেখতেও পাবে না।
‘শুভ্রা!’ রুহির কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। মাথা তুলে তাকাতে দেখে রুহি হাতে চায়ের মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা রোজকার অভ্যাস। প্রতিদিন নামাজ শেষে রুহি দুমগ চা এনে দুবোন মিলে খাবে। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে মগটা নিয়ে বলে,,’বস না।’ রুহিও শুভ্রতার পাশে ফ্লোরে বসে পড়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,,’তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না শুভ্র?’
শুভ্রতা চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে যায়। রুহির দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমার আবার কিসের কষ্ট?’
‘তুই কি ওকে ভুলতে পেরেছিস?’ শুভ্রতা এবার চায়ের কাপটা পাশে রেখে দেয়। তারপর উদাস চোখে বলে,,
‘আমি মনে করতেই চাই না।’
‘ও এটা কিভাবে করলো বল তো! মানুষ এতো বেইমা!’
শুভ্রতা এবার রুহির কোলে মাথা দিয়ে বলে,,’ছাড়ো এসব। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে!’ শুভ্রতার কথায় রুহি হাসলো। ও খুব ভালোভাবেই শুভ্রতার কষ্টটা বুঝতে পারছে। কিন্ত মেয়েটা যে বড্ড চাপা স্বভাবের বুক ফাটে তবু মুখ ফুটে না। রুহি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করে,,’আল্লাহ মেয়েটাকে ভালো রেখো।’
____________________
বধূর সাজে কাজির সামনে বসে আছে শুভ্রতা। গায়ে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা, সাথে প্রয়োজনীয় অর্নামেন্টস,দুহাত ভরা মেহেদী,ব্রাইডাল মেকাপ। সব মিলিয়ে আজ যেনো অন্য রকম শুভ্রতা। শুভ্রতার অপরপাশে মেঘ বসে আছে। মাঝখানে নেটের ওড়না। শুভ্রতা মাথা নিচু করে আছে। কেনো জানি খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরনো ক্ষতটা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে। তখনই কাঁধে কারো ছোঁয়া অনুভব করলো। রুহি দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা মনের কোথাও হয়তো নিজের মাকে আশা করেছিলো। কোণা চোখে তাকালো তার মা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার মনটা আরো একবার ভেঙ্গে গেলো। মায়ের তাকে তাড়ানোর এতো তাড়া! শুভ্রতা আর ভাবলো না। তিন কবুল বলে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হলো। জড়িয়ে গেলো অপ্রত্যাশিত সম্পর্কে।

বিদায় বেলা সবসময় কষ্টকর ঠেকে। কিন্ত শুভ্রতার মনে কোনো জানি মুক্তির আনন্দ বইছে। আসলেই কি মুক্তি নাকি আরো গভীর যন্ত্রণা! পুরো বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। শুভ্রতার বাবাও আজ বিদায় জানাতে গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। দুদিন পর শুভ্রতা নিজের বাবাকে দেখলো। লোক দেখাতে নাকি নিজের ইচ্ছেতে কে জানে উনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘ভালো ভাবে থাকিস শুভ্রা! সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।’
শুভ্রতাও নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। কিন্ত অদৃশ্য এক বাঁধা অনুভব করলো। চাপা স্বরে বলে,,
‘চিন্তা করবেন না এই শুভ্রা মরে যাবে তাও আপনাদের ধারে এসে দাঁড়াবে না। শুভ্রতা নামক কারো ছায়া আপনাদের জীবন পড়বে না। ভালো থাকবেন।’
মেয়ের কথায় শুভ্রতার বাবার হাত আলগা হয়ে এলো। তার একমাত্র মেয়েটাকে কতোটা কষ্ট দিয়েছে। কতটা যন্ত্রণায় জর্জরিত করেছে যার কারণে তার মেয়ে এই কথা বলেছে। চোখ দুটো ভিজে উঠলো উনার। শুভ্রতা সরে আসলো।

শুভ্রতার মা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে জড়িয়ে বলে,,,
‘সাবধানে থাকিস মা। সবার কথা শুনে চলিস।’
শুভ্রতা একইভাবে নিজের মাকে বলে,,’হ্যা সবার সব কথা শুনে চলি বলেই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আশা করি আজকের পর আমি নামক বোঝা আপনাদের জীবন থেকে দূর হয়েছে। মুক্তি দিলাম আপনাদের। একটা কথা বলি,সন্তানের কাছে মায়ের মৃত্যুর থেকে কষ্টদায়ক আর কিছুই নেই। আশাকরি আর কোনোদিন সন্তানের সামনে নিজের মৃত্যুর কথা বলবেন না। যাই। ভালো থাকবেন।’

শুভ্রতা মাকে ছেড়ে তার ছোট ভাই স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরে। রুহি আর স্নিগ্ধ শুভ্রতার সাথে যাবে। এতোক্ষণ মেঘ নিরব ভাবে সবটা দেখছিলো। এবার এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার বাবাকে বলে,,’চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমার কাছে ভালো থাকবে।’ তারপর তাদের যাত্রা শুরু হয় নতুন গন্তব্যে।
____________________
ফুলে সজ্জিত রুমে বসে আছে শুভ্রতা। মাথায় মেঘ নামক চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাইছে কি মেঘ! কেনো বিয়ে করলো শুভ্রতাকে। শুভ্রতার মাথাটা কেমন ধরে যাচ্ছে। বার কয়েক মাথা ঝাঁকাল। নাহ মাথাটা কিছুতেই হালকা হচ্ছে না। খট করে দরজা খোলার আওয়াজে শুভ্রতা সেদিকে তাকালো। লালা শেরওয়ানী গায়ে মেঘ এগিয়ে আসছে। খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকেই তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা তা দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। তাও নিজেকে সামলে বলে,,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
মেঘ আলমারির কাছে যেতে যেতে বলে,,’বলুন। শুনছি আমি।’
শুভ্রতা খাট থেকে নেমে বলে,,’আমাকে কেনো বিয়ে করলেন আপনি?’
মেঘ আলমারি থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিতে নিতে বলে,,’আপনাকে আমার পরিবারের খুব পছন্দ হয়েছে বলে।’
শুভ্রতা তা শুনে খানিকটা রেগে বলে,,’কিসের পছন্দ হ্যাঁ? আপনি সত্যিটা বললে এই পছন্দ কোথায় হাওয়া হয়ে যেতো! আপনি কি চাইছেন আমাকে বলুন তো।’

‘আপাদত ফ্রেশ হতে। অনেক ধকল গিয়েছে। এসে বাকি কথা শুনবো।’ মেঘ কথাটা বলে শুভ্রতাকে তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমে চলে যায়। শুভ্রতা রাগে দুঃখে মাথার ওড়নাটা খাটে ফেলে দেয়,গায়ে থাকা গয়না গুলো খুলে খুলে একপ্রকার ছুড়ে মারে ড্রেসিংটেবিলের উপরে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। আপাদত রাগ কমানো খুব প্রয়োজন। কিছুক্ষণপর,মুখের সামনে পানির গ্লাস দেখে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে শুভ্র রংয়ের জামা,গোসলের কারণে মাথার চুল থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। শুভ্রতা তাকাতেই ইশারায় পানি নিতে বলে। শুভ্রতা পানিটা নিয়ে এক শ্বাসে খেয়ে নেয়।
শুভ্রতা কিছু বলার আগেই মেঘ থামিয়ে বলে,,’আগে ফ্রেশ হয়ে এসো,বাকিটা পরে শুনবো।’

শুভ্রতার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে তাই আর কিছু বলে নি। নিজের জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয় শুভ্রতা। বাইরে এসে দেখে তার ছড়ানো ছিটানো জিনিস গুছিয়ে রাখা।
তা দেখে শুভ্রতা মনে মনে বলে,,’লোকটা গোছানো মনে হয়।’ শুভ্রতার ভাবনা ভাঙ্গে ভারী আওয়াজে,,’আমি এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা পছন্দ করি না। এর পর থেকে গুছিয়ে রাখবার চেষ্টা করো।’শুভ্রতা কিছু বললো না। মাথায় পেছিয়ে রাখা টাওয়াল খুলতে থাকে। মেঘ খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর মাথার নিচে হাত দিয়ে বলে,,’কাজ কম্পলি হলে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ো।’
মেঘের কথায় শুভ্রতা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মেঘ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ‘আরে আমার কথাই তো শুনলেন না।’ শুভ্রতার কথার বিপরীতে কোনো উত্তর আসলো না। শুভ্রতা তা দেখে বলে,,’এতো ডোরেমনের নবিতার থেকেও ফাস্ট!’

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ।)

#হৃদমাঝারে
জান্নাতুল নাঈমা
(৩)

নতুন একটা দিন এক নতুন সূচনা। কারো জীবনে নিয়ে আসে সুখের বার্তা,আবার কারো জীবনে দুঃখের কালো ছায়া। আকাশের বুকে উদীয়মান সূ্র্যের দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্রতা। একটু আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নতুন জায়গায় তার ঘুমাতে খুব অসুবিধে হয়। একদমই ঘুম আসতে চায় না। কাল সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে সকালে হালকা চোখ লেগে এসেছিলো কিন্ত আবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘুম থেকে উঠে মেঘকে পাশে না পেয়ে খানিক অবাক হয়। এতো সকালে কোথায় গিয়েছে। সারারুম খুঁজে ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পেয়ে বুঝলো মেঘ ওয়াশরুমে। মেঘের কান্ড কারখানা শুভ্রতার কাছে কেমন যেনো ঠেকছে। লোকটা খাপছাড়া মনে হচ্ছে। লোকটা সব জেনে শুনে বিয়ে করলো,এখন আবার কেমন যেনো এভোয়েড করছে। লোকটা কি শুভ্রতাকে দয়া করছে? কিন্ত সে তো দয়া চায় নি। সে চেয়েছিলো একটু ভালোবাসার আশ্রয়। কিন্ত সেটা মেঘের কাছ থেকে চায় নি। কারো কাছ থেকে আশাও করে নি। তাও কি হচ্ছে,কেনো হচ্ছে! শুভ্রতা আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।

‘উঠে পড়েছো? যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। একটু পরেই নিচ থেকে ডাক পড়বে।’ হঠ্যাৎ করে মেঘের কন্ঠ পেয়ে শুভ্রতা খানিক চমকালো। হয়তো গভীর ভাবনায় মত্ত ছিলো বলে। শুভ্রতার মনে মনে ইচ্ছে করছিলো মেঘকে অনেক কথা বলতে। কিন্ত কেনো জানি বলতে পারছে না। তবে কি সে তার ভাগ্য মেনে নিয়েছে? হয়তো তাই।
‘কি হলো কি ভাবছো?’ আবারও মেঘের কন্ঠ শুনে শুভ্রতার ভাবনার অবসান হলো। কিন্ত এবার চমকালো না। মাথা নেড়ে আলমারির দিকে চলে গেলো। কাল রাতেই কিছু জামা কাপড় আলমারিতে রেখে দিয়েছিলো। সেখান থেকে একটা শাড়ি নিতে গেলে পেছন থেকে একটা মোলায়েম কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

‘শাড়ি পড়ার প্রয়োজন নেই। জামা পরো।’ শুভ্রতা কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে,,’কিন্ত আমি তো নতুন বউ। আমি যতটুক জানি নতুন বউদের শাড়ি পড়া লাগে। নইলে সবাই কি বলবে!’
মেঘ এগিয়ে এসে আলমারি থেকে একটা গোলাপি থ্রি-পিছ বের করে শুভ্রতার হাতে দিয়ে বলে,,’কে কি বললো এতো শুনে কাজ নেই তোমার। মানুষের কাজই হচ্ছে অন্যকে কথা শুনানো। আর কেউ কিছু বললে বলবা আমার স্বামী বলেছে পড়তে। ওকে? নাউ গো!’
মেঘ কিছুটা আদেশের সুরে কথাটা বলে। কিন্ত শুভ্রতার মনে ওই দুটো শব্দ ‘আমার স্বামী’ তে আটকে গেছে। ঠোঁট কামড়ে মনে মনে বলে,,’হ্যাঁ আমার স্বামী! তবে কিছু মাস আগেও এখানে অন্য একজনের থাকার কথা ছিলো।’ শুভ্রতা আর কিছু বললো না। ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো।
_____________________
মেঘদের বাসা ভর্তি মেহমানে গিজগিজ করছে। এর মাঝেই কাজিনদের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে শুভ্রতা। পাশে অবশ্য রুহি আছে। তাও অস্বস্থি জেনো কাটছে। অবশ্য মাঝখান দিয়ে অনেকে জামা পড়া নিয়ে কথা বলে গেছে। গ্রামের বাড়ি তার উপর নতুন বউ কথা তো হবেই। কথা শুনতে শুনতে শুভ্রতা যেনো হাপিয়ে উঠেছে।
‘কি দিনকাল এলো রে বাবা। বিয়ের পরেরদিন এতো মেহমানের সামনে নতুন বউ থ্রি-পিছ পড়ে ড্যাং ঢ্যাং করে ঘুরছে। বলি ও মোহনা (মেঘের মা) নতুন বউকে কিছু বলো।’
একজন মাঝবয়সী মহিলা কথাটা বলে উঠে। শুভ্রতা মাথা নিচু করে ফেলে। ইচ্ছে করছে জবাব দিতে কিন্ত নতুন হিসেবে নিজের ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে আছে। মেঘের মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই পেছন থেকে মেঘের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,
‘আরেহ ফুফি যে! তা আমার বউকে নিয়ে তোমার এতো সমস্যা কেনো? আমার বউ শাড়ি পড়ুক,জামা পড়ুক আমার বউয়ের ইচ্ছে। তাছাড়া তোমার ছেলের বউয়ের মতো শাড়ি পড়ে শরীর দেখানোর চেয়েও জামা পড়াই উত্তম।’
মেঘের কথায় মহিলাটি চুপসে গেলো। কথায় আছে না,,’আকাশের দিকে থু থু ফেললে,সেটা নিজের গায়েই এসে পড়ে।’
মেঘের কথায় শুভ্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। মেঘ যতবার ‘আমার বউ’ বলেছে সারা শরীরে আলাদা এক কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। মেঘ এবার শুভ্রতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,,’তোমাকে না বলেছিলাম কেউ কিছু বললে বলবে ‘আমার বর আমাকে পড়তে বলেছে!’ কথা কি কানে যায় না নাকি?’

‘আহ মেঘ। মেয়েটাকে বকছিস কেনো। নতুন মানুষ বুঝে নি সবটা। আর আপা শাড়ি নিয়ে এতো মাতামাতি করার কিছু নেই। যে যেটা কম্পোর্টেবল ফিল করে। বাচ্চা মেয়ে শাড়ি সামলাতে পারবে নাকি। আর একটু পরে এমনিতেই পরা লাগবে। শুভ্রা আসো নাস্তা খেয়ে নেবে। এই তোরাও আয় (কাজিনদের উদ্দেশ্য করে)’

শুভ্রতা মেঘের দিকে আড়চোখে তাকালো। লোকটা কেমন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার মাথায় নতুন চিন্তা এলো,,’আচ্ছা লোকটা কি খেয়েছে? নাকি না খেয়েই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে।’ শুভ্রতার নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো। দুদিনের চেনা একজন লোকের জন্য এতো চিন্তা? তবে কি এটাও পবিত্র সম্পর্কের জোর!
____________________
মেঘ আর শুভ্রতা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা ছবি তোলা হচ্ছে। মেঘ শুভ্র রংয়ের একটা পাঞ্জাবী পড়ে আছে যার মাঝে রঙিন সুতোর কাজ। শুভ্রতা একটা গোলাপি রাঙা শাড়ি পড়ে আছে। দুজনকেই বেশ মানাচ্ছে। ছবি তোলার মাঝেই শুভ্রতার কানে ভেসে আসে একটি কথা,,’এই মেয়ে পক্ষ চলে এসেছে।’ অন্য মেয়ে হলে হয়তো এখন দৌড়ে চলে যেতো। কিন্ত শুভ্রতা তা করবে না। মেঘ এগিয়ে সেদিকে গেলো। একে একে শুভ্রতার মা,বাবা,জেঠু,জেম্মা,বাকি সবাই এলো। শুভ্রতাকে দেখে তার মা,জেম্মা জড়িয়ে হাল জিজ্ঞাস করলো। শুভ্রতা ছোট্ট করে শুধু ‘ভালো।’ বললো। এতে শুভ্রতার পরিবার আশাহত হলো। বিশেষ করে শুভ্রতার মা-বাবা। মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। মেয়ের জীবনে একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গিয়েছে যার কয়েকমাস না যেতেই মেয়েটা সামলে উঠার আগেই আরেকটা সম্পর্কে জুড়ে দিয়েছে। কিন্ত এখন যে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।

‘বেয়ান আমরা শুভ্রতা আর জামাই কে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই। আপনারা অনুমতি দিন।’ বিদায়ের সময় শুভ্রতার বাবা কথাটা বলে। শুভ্রতার যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। কিন্ত মুখ ফুটে বলতে পারছে না। চুপ করে রুহির পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আসলে আমাদের এখানে লোক কম। মা-বাবা একা সামলাতে পারবে না। আজকে এদিকটা সামলে আমরা কাল যাবো।’ মেঘের কথায় শুভ্রতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। কিন্ত শুভ্রতার বাবা,জেঠু আবারও বললেন। কিন্ত কাজ হলো না। অবশেষে ঠিক হলো কাল যাওয়া হবে। সবাই চলে গেলো।
____________________
সারাদিনের ক্লান্তিতে শুভ্রতার শরীর খানিকটা কাহিল হয়ে পড়েছে। মেঘের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্ত মেঘ না আসাতে খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে সুন্দরভাবে খাটে শুয়ে থাকতে দেখে খানিক অবাক হয়। খাটের একপাশে তার ব্যাগ গুছানো। মেঘ এখন নিজের দুটো জামা নিচ্ছে। শুভ্রতা কিছুই বুঝতে পারছে না ব্যাগ ফ্যাক করছে কেনো। বোকার মতো জিজ্ঞাস করে ফেলে,,’ব্যাগ ফ্যাক করছেন যা?’
শুভ্রতার কথায় মেঘ হাত থামিয়ে বলে,,’আজ না তোমার বাসায় যাওয়ার কথা!’
শুভ্রতার মনে পড়লো। তারপর মিনমিন কন্ঠে বলে,,’আমি গুছিয়ে নিতাম। আপনার কষ্ট করা লাগতো না।’ মেঘ কিছু বললো না। নিজের কাজে মন দিলো।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। সকালবেলায় বাসা এসেছে। এখন বিকেল। সবাই খেয়ে ভাত ঘুম দিচ্ছে হয়তো। মেঘও রুমে ঘুমাচ্ছে। শুভ্রতা তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আপু!’ পেছন থেকে ভাইয়ের কন্ঠ শুনে শুভ্রতা তাকালো। হাতে একটা বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাইয়ের বয়স নয়। বেশ ছোট। শুভ্রতা হাটু গেড়ে বসে বলে,,’কিছু বলবি?’
স্নিগ্ধ হাতের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলে,,’এটা তোর। আমার সব ম্যাজিক বল এখানে। তুই তো চলে যাবি। তাই এটা তোকে দিলাম।’
ভাইয়ের কথায় শুভ্রতা খানিক হাসলো। ছোট ভাইটাও বুঝলো সে চলে যাবে। শুভ্রতা ভাইকে আদর করে বোতলটা নিয়ে বলে,,’থ্যাংস ভাই। শুন আমার রুমের ড্রয়ারে একটা চকলেটের বক্স আছে। পুরোটা তোর। নিয়ে নে।’
‘ইয়ে থ্যাংকিউ আপু। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।’ কথাটা বলে স্নিগ্ধ চলে যায়।

‘তুমি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারো।’ শুভ্রতার পাশে এসে দাঁড়ায় মেঘ। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’আপনাকে কে বললো?’
‘আসলে স্নিগ্ধ রুমে গিয়ে ড্রয়ার থেকে চকলেট নিচ্ছিলো। তখন একটা পেপারে দেখলাম। জিজ্ঞাস করার পর বললো তুমি এঁকেছো।’
মেঘের কথায় শুভ্রতা আলতো হেসে বলে,,’ওহ আচ্ছা। আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। ‘
‘সব শুনবো। আপাদত আমার কিছু বলার আছে। আমি পরশু ঢাকার টিকেট কেটেছি। একটু পরে আমরা বাসায় ফিরে যাবো। যা গোছগাছ আছে করে নাও।’ কথাটা বলে মেঘ হাটা দিলো। পেছন থেকে শুভ্রতা ডাকলো মেঘের কানে গেলো না,নাকি পাত্তা দিলো না কে যানে।

#চলবে?

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here