হৃদমাঝারে পর্ব -০৭

#হৃদমাঝারে
নাঈমা জান্নাত
(৭)

শুক্রবার মানেই স্বস্তির দিন। সারা সপ্তাহ ধরে অফিসে খাটা মানুষদের প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া দিন। সারা সপ্তাহের সব ক্লান্তি থেকে মুক্তির জন্য বিশ্রাম নেয়। তেমনি মেঘের কাছেও শুক্রবার বিশ্রামের দিন। তাই তো বেলা নয়টা বেজে গেছে সে এখনও শুয়ে আছে। শুভ্রতা এসে দু’বার ডেকে গেছে কিন্ত সে উঠার নামই নিচ্ছে না।
‘আমি আর একবার ডাকবো এর পরও যদি না উঠা হয় তবে আজকে আর নাস্তা পাওয়া যাবে না!’ শুভ্রতা খানিক জোরে মেঘকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে। কিন্ত মেঘের কোনো ভাবান্তর নেই। সে আলসেমি করে একবার এপাশ আবার ওপাশ করছে। শুভ্রতা এবার ভীষণ চটে গেলো ওড়নাটা কোমড়ে বাধাই ছিলো এখন আবার আরেকটু শক্ত করে রান্নাঘর থেকে রুমের দিকে যায়। আজ এই লোকের আলসেমি সে ভাঙ্গাবেই। ‘আজকে ওই লোকটার একদিন কি আমার একদিন।’

রুমে গিয়ে দেখে মেঘ উপুড় হয়ে একপা বালিশের উপর দিয়ে শুয়ে আছে। শুভ্রতা তা দেখে নাক মুখ কুঁচকে বলে,,’আজ খাবেন না বললেই হতো! আরামের ঘুম হারাম করে নাস্তা বানালাম কেনো?’
এবারও মেঘের দিক থেকে উত্তর এলো না। শুভ্রতা বুঝলো মেঘ তাকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য এসব করছে। কিন্ত তাও রাগ দমন করতে পারছে না। শুভ্রতা এবার আর কোনো কথা না বলে ড্রয়িংরুম থেকে একগ্লাস পানি এনে অর্ধেকটাই মেঘের উপর ঢেলে দিলো। ফলস্বরুপ মেঘ দ্রুত উঠে বসতে নেয়। শুভ্রতা একটু ঝুঁকে পানি ঢেলেছিলো যার কারণে মেঘ হঠ্যাৎ উঠে ব্যালেন্স হারিয়ে মেঘের উপরই পড়ে যায়। আকস্মিক কান্ড দু’জনেই থ হয়ে যায়। মেঘ শুভ্রতার দিকে ভ্রু নাচিয়ে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রতা তা দেখে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,’আগামী ৫ মিনিটের মধ্যে আপনাকে টেবিলে না দেখলে খবর আছে!’ কথাটা বলে শুভ্রতা ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে নিলে পেছন থেকে মেঘের আওয়াজ ভেসে আসে,,’বউ বউ গন্ধ পাচ্ছি যেনো!’
‘ঘরে বউ থাকলে বউ বউ গন্ধ না পেয়ে কি ভাবি ভাবি ফিল পাবেন?’ শুভ্রতা চোখ গরম করে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে। মেঘ ভয় পাওয়ার ভান করে বলে,,’ও আমি তো ভুলেই গেছি। আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে আসছি!’ মেঘ ওয়াশরুমে যেতেই শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়। ও নিজেই মেঘের সাথে ফ্রি হতে চায়। তাই অনেক কথাই নিজ থেকে বলে। তাও যদি সম্পর্কটা ভালো হয়!
_____________________
‘শুভ্র তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমি চেঞ্জ করে আসছি পাশের রুমের থেকে।’
মেঘ কথাটা বলে পাশের রুমে চলে যায়। আজ যেহেতু ছুটির দিকে তাই মেঘ ঠিক করেছে আজ হালকা ঘুরাঘুরি করবে। শুভ্রতা তো সারাদিন রুমেই বসে থাকে। শুভ্রতাও নিজেদের সম্পর্কটাকে আলাদা একটু টাইম দেওয়ার জন্য রাজি হয়,তার চেয়েও বড় কথা সারাদিন এই চার দেয়ালের মাঝে বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে। খাটের উপর ব্ল্যাক আর গোল্ডেন কালারের কম্বিনেশনে শাড়ি,গোল্ডেন কালারের স্টোনের চুড়ি,আর গাজরা। এইসবটা মেঘ নামাজ পড়ে আসার সময় এনে দিয়েছে। আর শুভ্রতাকে এগুলো পড়ার জন্যই বলেছে। সবটাই শুভ্রতার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আর দেরী না করে ঝটপট শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিলো। কিন্ত নতুন শাড়ি হওয়ায় শুভ্রতার পড়তে অসুবিধে হচ্ছে। নিচের কুঁচি গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই শাড়িতে টান পড়তে নিচে তাকালো শুভ্রতা মেঘ অতি যত্নে কুঁচিগুলো ঠিক করে দিচ্ছে।

কুঁচি ঠিক করা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে,,’কিছু জিনিসের অধিকার ব্যক্তিগত ভাবে শুধুই আমার!’
মেঘের কথায় কি যেনো ছিলো। শুভ্রতা তাতে মুগ্ধ হয়। একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়। তার শাড়ির সাথে মিলিয়েই পাঞ্জাবী পড়েছে,হাত কালো ঘড়ি। মেঘকে অন্যদিনের তুলনায় আজ যেনো একটু বেশী সুন্দর ঠেকছে শুভ্রতার কাছে।
‘তুমি কাজল পড়ো না?’ মেঘের কথায় শুভ্রতার ঘোর কাটে। মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝায়। ‘আমি কাজল পড়তেই পারি না। আগে রুহিপু আইলাইনার দিয়ে কাজ সারিয়ে দিতো!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। সবকিছু ঘেটে একটা কাজল ফেলো। তারপর শুভ্রতার মুখ খানিকটা উঁচিয়ে অতি যত্ন সহকারে কাজলটা পড়িয়ে দেয় যেনো লেপ্টে না যায়। তারপর নিজে নিজেই বলে,,’পারফেক্ট!’
শুভ্রতা মেঘের কান্ডে খানিক অবাক হলেও মন জুড়ে ভালো লাগা ছুঁয়ে গেলো। লোকটা মাঝে মাঝে হুটহাট এমন কাজ করে বসে যাতে ভালো লাগা না ছুঁইয়ে থাকা যায় না।
‘আচ্ছা তোমার আর কিছু বাকি থাকলে করে শেষ করো। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’ মেঘের কথায় শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে বলে,,’আর কিছু না। শুধু গাজরাটা লাগানো বাকি!’ মেঘ ছটফট গাজরাটা হাতে নিয়ে শুভ্রতার মাথায় লাগিয়ে দেয়। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে শুভ্রতার পাছনে দাঁড়িয়ে বলে,,’একেবারে পারফেক্ট!’ কিন্ত কথাটা শুভ্রতার সাজকে নাকি ওদের দুজনকে একসাথে বলেছে সেটা ঠিক বুঝলো না শুভ্রতা। তাই নিজের মনেই বলে,,’আসলেই আপনি পারফেক্ট মেঘ!’
__________________
রিক্সার পাশাপাশি বসে আছে দুজনে। মেঘের এতোটা কাছে বসে আছে দেখে শুভ্রতার অস্বস্থি হচ্ছে না। নিজের স্বামীর পাশে বসে বাইরের খোলা আকাশ দেখছে শুভ্রতার বেশ ভালোই লাগছে। মেঘের বাইক থাকলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ রিক্সায় ছড়বে। কোথায় যাচ্ছে জানে না শুভ্রতা। কিন্ত যেখানেই যাক না কেনো তার এই সময়টা বড্ড ভালো কাটছে। ঢাকা শহর মানেই হাজারো মানুষের ভীড়। আর শুক্রবারের দিন গুলোতে ঘুরার জায়গা গুলোতে যেনো একটু বেশীই ভিড় হয়। কিন্ত এর মাঝে শুভ্রতার একহাত ধরে বেশ সাবধানেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেঘ। যেতে যেতে কোলাহল থেলে বেরিয়ে নির্জণ সরু রাস্তার সামনে থামলো দু’জন। এদিকটা কোলাহল একটু কম। যার কারণে বেশ ভালো লাগছে। দু’ধারেই গাছ লাগানো। মৃদু বাতাসে দুজনেই হেটে চলেছে। শুভ্রতার হাত এখনও মেঘের হাতের মুঠোয়। হাতটা ছাড়তে চাইছে না নাকি ছাড়তে ভূলে গেছে জানা নেই শুভ্রতার।
মনে মনে বলে,,’হাতটা শক্ত করে ধরে রাখুন মেঘ। আমার হাতটা ধরার মতো যে কেউ নেই। আমি যে বড্ড একা!’
দু’জনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই কিন্ত একে অপরকে দারুণভাবে ফিল করছে।
______________________
ঘুরতে গিয়ে বাইরের টুকিটাকি জিনিস খেয়ে শুভ্রতার পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। মেঘ অনেকবার বারণ করেছে কিন্ত কে শুনে কার কথা। এখন পুরো খাটে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেঘ দু’বার করে বকে গেছে। কিন্ত এখন বকে কি হবে। হঠ্যাৎ করে গা গুলিয়ে আসতেই ওয়াশরুমে চলে যায়। মেঘ ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে এসে শুভ্রতাকে না দেখে বিচলিত হয়। কল কেটে বিছানায় ছু্ঁড়ে মারে। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজে এগিয়ে যায়। শুভ্রতা মাথায় হাত দিয়ে বেসিনে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ দ্রুত এগিয়ে যায় সেদিকে। কোনোমতে শুভ্রতাকে ধরে এনে বিছানায় বসায়। তারপর নিজেও শুভ্রতার পায়ের দিকটার কাছে বসে দুহাতে শুভ্রতার মুখ ধরে বলে,,’শুভ্র! তুমি ঠিক আছো শরীর খারাপ লাগছে?’
‘আমি ঠিক আছি। একেতো আমি বাইরের খাওয়া খেতে পারি না,তার উপর বেশী খেয়ে ফেলেছি তাই বদহজম হয়ে গেছে! আপনি চিন্তা করবেন না। বসুন, আমি আপনার খাবার দিচ্ছি। গরম করে দিলেই হবে।’

শুভ্রতার কথায় মেঘ ধমক দিয়ে বলে,,’চুপ! বেশী কথা বলো। চুপ’চাপ শুয়ে থাকো। আমি মেডিসিন দিচ্ছি। আর আমার খাবার আমি নিয়েই খেতে পারবো।’
শুভ্রতারও ভালো লাগছিলো না যার জন্য আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো।

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here